সারাদিন এতো কাজ করে ক্রান্ত অসুস্থ শরীরে বিছানায় শুয়ে নিহি চোখ বন্ধ করতেই কেউ একজন চুলের মুঠি ধরে টেনে গাল বরাবর পরপর দুইটা তাপ্পর মারলে নিহির হুশ ফিরে।
-‘নবাবজাদি, আজ এতগুলো বছর পর আমার ছেলে আসবে আর তুই একটু কাজ না করতেই রুমে ঢুকে শুয়ে গেলি?’ রাগী রাগী স্বরে বলে উঠলো পারভীন বেগম।
মুহূর্তের মধ্যেই নিহির অসুস্থ ভাবটা কেটে গেল।
-‘চাচি আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। সব কাজ-ই তো শেষ। আর কিছু ধোয়া-ফালা আছে ঐগুলো রেহেনা খালা করছে তাই চলে আসছি। ‘ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলো নিহি।
-‘একটু কাজ করতেই তোর শরীর খারাপ হয়ে যায়? আর রেহেনা খালা বলার কে? এতো এতো খাবার খাস, ফ্রি-তে এসব কোথ থেকে আসে, খেয়াল আছে? মা-বাবা মরে গিয়ে মেয়েটাকে আমাদের ঘাড়ে দিয়ে তো বেঁচে গেছে। আজ কতগুলো বছর পর আমার ছেলেটা আসবে। এখন যা, আমার ছেলে সাদাফটার রুমটা আরেকটু ভালো করে ঝাড়ু দিয়ে আয়। ভালো মতো দিবি কিন্তু। আমি গিয়ে যেন সব পরিষ্কার পাই।’
নিহি মাথা নিচু করে ‘হ্যাঁ’ বোধক সম্মতি জানিয়ে রুম ছেড়ে বের হতে নিল। সারাদিন পেটে কোনো খাবার পড়েনি। ক্ষুদায় পেট চো চো করছে। তার উপর কয়েকদিন ধরে জ্বর জ্বর ভাব। দুপুরে বাশী খাবার দেওয়ার কারণে এই অসুস্থতার মধ্যে এসব খেতে ইচ্ছে হয়নি।
-‘আর হ্যাঁ শোন, আমার ছেলে রাহান আসলে ভুলেও ওর রুমে যাবি না। খবরদার বলে দিলাম। কেন বলছি, আশা করি বুঝতে পেরেছিস? তুই তো যাকে-তাকে এক মুহূর্তের মধ্যে বশ করে ফেলিস।’ চোখ লাল করে পারভীন বেগম নিহির উদ্দেশ্যে কথাগুলো ছুড়ে দিল।
নিহির চোখ গড়িয়ে অবাধ্য পানিগুলো বেরিয়ে এলো। এখন এসব আর গায়ে মাখে না তবুও আজ এভাবে রাহান ভাইয়াকেও নিয়ে এমন কথা শুনে চোখের পানি-গুলো আর আটকাতে পারলো না। নিহি অশ্রু-মাখা চোখে চাচির দিকে একবার তাকিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
রুম থেকে বের হতেই রেহেনা খালাকে সিঁড়ি ঝাড়ু দিতে দেখা গেলো। রেহেনা খালা নিহিকে দেখেই বলে উঠলো,
-‘একি নিহি ! তুই এই জ্বর শরীর নিয়ে বের হতে গেলি ক্যান? কিছু লাগলে আমারে বলতি , আমি এনে দিতাম।’
নিহি এক নজরে রেহেনা খালার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই বাসায় দুইটা মানুষের ভালোবাসা পেয়েই নিহি বেঁচে আছে। চাচা আর এই মানুষটা। চাচি সবসময় নিহিকে কাজের উপরেই রাখতে চায় আর এই মানুষটা রাতে বাসায় যাওয়ার আগে চুরি করে নিহিকে অর্ধেক কাজ করে দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ধরা খেয়ে রেহেনা খালা চাচির কাছ থেকে অনেক বকাও খায় তাও উনি করে দেয় কাজ। একদম মেয়ের মতো করেই আগলে রাখেন। আর বাসায় চাচা থাকলে চাচি কিছুই বলতে পারে না নিহিকে।এইসব কিছু চাচা জানে। রেহেনা খালা চাচাকে সুযোগ পেলে-ই সব বলে দেয়। তাই চাচা যতক্ষণ বাসায় থাকে চাচিকে চোখে চোখে রাখে।
-‘তুই তোর কাজ কর রেহেনা। আদেশ দেওয়ার মালিক আমি, তুই নয়।’
নিহি শুকনো মুখে মলিন হেসে রেহেনার খালার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে নিলেই পেছন থেকে পারভীন বেগম উক্ত কথাগুলো বলে উঠলো কাজের ভোয়া রেহেনার উদ্দেশ্যে।
রেহেনা খালা পারভীন বেগমের কথা শুনে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে আবারো সিঁড়ি ঝাড়ু দেওয়ার কাজে মনোযোগ দিলো। আর নিহি পরিষ্কার করার জন্য রাহানের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
-‘রেহেনা, তুই নিচে গিয়ে রান্নাঘরের কাজ কর। উপরের এসব-কিছু পরিষ্কার আরিফা করবে, তুই নিচে যা।’
চাচির কথা-য় নিহির পা থেমে গেল।
-‘মেডাম, নিচে সব কাজ তো শেষই। নিচে আর কোনো কাজ নেই। আমি না-হয় এটা ঝাড়ু দিয়ে ফেলি?’ ভয়ে ভয়ে রেহেনা নিহির দিকে আস্বস্তভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে চাচির কথার প্রতিত্তুরে বলে উঠলো।
-‘না, আমি যা বলছি তাই কর। ঝাড়ুটা ওখানে রেখে নিচে যা তুই। উপরে যেন আর না দেখি তোকে।’ পারভীন বেগম রাগীস্বরে পাল্টা জবাব দিল।
শেষ পর্যন্ত রেহেনা অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিচে নেমে গেলো। মেয়েটার জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে রেহেনার। অসুস্থ শরীর নিয়ে সারাদিন এতো এতো কাজ করার পরে রেহেনা নিজেই জোর করে মেয়েটাকে একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য পাঠিয়েছে। দুপুরে’র খাবারটাও খায়নি, খাবেও বা কী করে! এই অসুস্থতার মধ্যে ডায়নিটার দেওয়া বাশী খাবার কার-ই বা খেতে ইচ্ছে হবে! আজ স্যার আসুক, সবকিছু বলে দিতে হইবো।
এসব ভাবতে ভাবতেই রেহেনা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একবার উপরের দিকে তাকালো, দেখলো পারভীন বেগম এখনো দাঁড়িয়ে আছে। পারভীন বেগম জানে, রেহেনা চুরি করে নিহিকে কাজে সাহায্য করতে আসবে তাই রেহেনা যতক্ষণ না নিচে রান্নাঘরে ঢুকছে ততক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবে। রেহেনা মুখ ভেংচি কেটে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। সে এই ডায়নিটার অপেক্ষায়। ডায়নিটা রুমে যাওয়ার সাথে সাথে সে আবারো নিহির জন্য উপরে উঠে যাবে।
নিহি রেহেনা খালার যাওয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহানের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। এখন এই সবকিছুই নিত্য কারবার। এখন চাচির কথায় আর খারাপ লাগা কাজ করে না। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে এইসবকিছুই স্বাভাবিক মনে হয় নিহির কাছে। সবার রূপ বাবা-মা যাওয়ার পরই বেরিয়ে আসলো। এর আগে সবাই কতই না ভালোবাসতো মা-বাবার সামনে। অথচ এখন! শুধু চাচা আর রেহেনা খালা ছাড়া আর কেউ খোঁজই নেয় না। এইসব কিছু এখন দীর্ঘশ্বাস।
নিহি রাহানের রুমটাতে ঢুকতেই এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করলো। সেই-ই সাত -বছর আগে মানুষটাকে দেখেছিল। তখন কতই না দুষ্টমি করতো মানুষটার সাথে। রাহানের সাথে নিহির এমন ভাব চাচি অন্য দৃষ্টিতে দেখতো কিন্তু বাবা-মা’র সামনে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতো না। আর তাই তো উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার সাথে সাথে ডাক্তারি পড়ার উদ্দেশ্যে রাহান ভাইয়াকে বাইরের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। রাহান ভাইয়ার ইচ্ছে ছিল দেশে থেকেই ডাক্তারি পড়বে কিন্তু চাচির জন্য শেষ-পর্যন্ত চলে যেতেই হলো। তখন নিহি সবে মাত্র বারো’তে পড়লো। এরপর আর কোনো দেখা বা কথা হয়নি। এরপর তো নিহির জীবনটাই পাল্টে গেল। হঠাৎ ঝড় এসে নিহির জীবনটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল। এক এক্সিডেন্টে বাবা-মা দু’জনই নিহিকে এই দুনিয়ায় একা করে দিয়ে বিদায় নিল।
মাঝে মাঝে চাচীদের সাথে কথা বলার সময় রাহান ভাইয়ার কণ্ঠ শুনেছে। এখন এই সবকিছু অতীত। তখন বাবা-মা ছিল। নিহি অনেক ছটফটে ছিল। সম্পূর্ণ বাড়ি মাথায় তুলে রাখতো অথচ এখন! কী নিশ্চুপ! তখনের জীবন আর এখনের জীবন বিস্তর তফাৎ। এখন হয়ত রাহান ভাইয়া তার জীবনের একটা অংশ নিহিকে ভুলেই গেল কিন্তু নিহি..! সে তো তার রাহান ভাইয়াতেই আটকে আছে। মনের এক অংশ জুড়ে এখনো আগলে রেখেছে মানুষটাকে।
রাহান ভাইয়া যাওয়ার পর আর কোনোদিন রুমটাতে ঢোকা হয়নি নিহির । ঢোকা হয়নি বললে ভুল হবে, চাচি ঢুকতে দেয়নি রাহান ভাইয়ার রুমটাতে নিহিকে। ড্রেসিং টেবিলের উপর রাহান ভাইয়ার হাসিমুখে ছবিটার উপর ধুলো’র আস্তরণ পড়েছে। নিহি হাঁটুমুড়ে বসে পরমযত্নে ছবিটা’র উপর হাত বুলিয়ে মুছে রাখলো। এখন পারফেক্ট। কতগুলো বছর পর মানুষটার মুখচ্ছবিটা একটু দেখতে পেরেছে! নিহি ছবিটার উপর হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলো। সে উঠে গিয়ে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলো। পুরো রুমে সূর্যের কিরণের ছড়াছড়ি।
রুম ঝাড়ু দেওয়ার পর মুছার মাঝ-পথে দরজা খোলার আওয়াজে নিহি চমকে পিছনে তাকাতেই ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সে জানতো রেহেনা খালা চুরি করে নিহির কাজে সাহায্য করার জন্য আসবেই।
রেহেনা খালা নিহির চোখে চোখ পড়তেই পান খাওয়া লাল ঠোঁটে হেসে দিলো।
-‘শোন নিহি,আমি সিঁড়িটা ঝাড়ু দিয়ে ফেলছি আর মুছেও ফেলছি। এখন এখানে তুই বসে থাক। আমি করি বাকি কাজগুলো।’
-‘চাচি কই? দেখলে বকা দিবে তোমায় খালা। তুমি অনেক কাজ করেছো। এখন গিয়ে রেস্ট নাও।’
-‘ দূর পাগলী, ডায়নিটা ঘুমাচ্ছে, আমি রুমে উঁকি দিয়ে দেখে তারপর কাজ সাড়ছি। আর তুই তো আমার মেয়ের মতোই।’
-‘আহঃ খালা, ডায়নি বলো না। কোন সময় আবার ধরা খাও।’
-‘দুরু, ডায়নি বলছি আরো কম বলছি। ও তো একটা শাকচুন্নি।’
নিহি হেসে বাকি রুমটুকু মুছতে নিলেই রেহেনা খালা নিহিকে বিছানার উপর বসিয়ে নিজে কাজে লেগে পড়লো।
নিহি শ্রদ্ধাভরা দৃষ্টিতে রেহেনার দিকে তাকালো। এই মানুষটা এতো ভালো কেন, সেটা নিহি বুঝে পায় না। মায়ের মতো করেই ভালোবাসে নিহিকে । নিজের সন্তানের মতোই নিহিকে মায়া করে। উনার নিজের কোনো সন্তান নেই, বিধবা। রেহেনা খালা মানুষটাও বড্ড ভালো। স্বামী মারা যাওয়ার পর আর কোনো বিয়ে করেনি, শহরে এসে এই বাসায় কাজ নিয়েছে।
#চলবে কী?
#প্রেমসরণী
#পর্ব ১
#নাজমুন_বৃষ্টি
(