তুই আমার প্রেমময় নেশা পর্ব -১৫ ও শেষ পর্ব

#তুই_আমার_প্রেমময়_নেশা
#মিফতা_তিমু
১৫ এবং সমাপ্তি পর্ব( প্রথমাংশ )

ব্রাইডাল সাজে বাড়ির বসার ঘরে বসে আছি।বাবার কথা শোনাটা যে আজ আমার কাল হয়ে দাঁড়াবে সেটা ভাবতে পারিনি।আমায় যে নিভ্র ভাই কে কষ্ট দেওয়ার ফল এভাবে দিতে হবে সেটা ভাবতেই পারিনি।লোকে বলে কাউকে কষ্ট দিয়ে কখনো সুখে থাকা যায়না তাই হয়তো আজ শাস্তি পাচ্ছি।বাবার একটা কথা যে আমার পুরো জীবন বদলে দিয়েছে।

আর কিছুক্ষণ পরই অন্যের স্ত্রী হয়ে যাবো।নিজেকে আমায় আমার ভালোবাসার মানুষের পরিবর্তে পরপুরুষের কাছে সপে দিতে হবে।এখন মনে হচ্ছে পুরো জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে।ভালোবাসলাম একজন কে আর বিয়ে করতে হচ্ছে আরেক জন কে।এসব কি আমার সাথেই হওয়া লাগছিল। এত বড় অন্যায় আমার সঙ্গে কেন হলো আল্লাহ? তুমি কি আমায় আমার করা পাপের শাস্তি দিচ্ছ? এই শাস্তির থেকেও তোমার দেওয়া মৃত্যু আমার জন্য হিতকর।

আমার মুখের প্রায় পুরোটাই লেহেঙ্গার ওড়না দিয়ে ঢাকা বিধায় আমি যে এই ওড়নার আড়ালে কাদছি সেটা কারোর চোখে পড়ছে না। কাদতে কাদতে কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবছি।

নিদ্রা: বাবা তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।তুমি শুধু আমাকে বলো কি করতে হবে।আমি তোমার জন্য সব করতে পারি।
আজিজ: তোকে কিছুই করতে হবে না।তুই শুধু নীরব কে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যা মা।আমি শুভম কে কথা দিয়েছি যে তোর সঙ্গে নীরবের বিয়ে দিবো।এখন সেই কথার খেলাপ আমি করতে পারব না।এই কথার খেলাপ করলে আমাদের বন্ধুত্বে চির ধরবে আর আমার পরিবার ভেঙে যাবে নিদ্রা।আমি আমার কাছের মানুষজনদের হারাতে চাই না নিদ্রা।

বাবার কথা শুনে আমি যেন খেই হারিয়ে ফেলেছি।মনে হচ্ছে কেউ পৃথিবী ফাঁক করে পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা গলিত লাভার মাঝে আমায় ছুড়ে ফেলেছে।শুধু মনে হচ্ছে এরকম একটা কথা শোনার আগে মৃত্যু কেন হলো না।

বাবা আমায় খুব ভালোবাসে।সন্তানদের মধ্যে ছোটো হওয়ায় বাবা আর মা দুজনেই আমায় বেশ সমীহ করে।সেই বাবার মুখ কি করে ছোটো হতে দেই সন্তান হয়ে? বাবার মুখ আমার জন্য ছোটো হলে আমি জান্নাত পাবো তো? বাবার মুখ আমার জন্য ছোটো হলে নিভ্র ভাই কে বিয়ে করে আমি সুখী হবো তো?

নিভ্র ভাই তুমি কোথায়? তোমায় যে আজ আমার খুব প্রয়োজন।তুমি কেন আমায় আগলে রাখলে না? আজ যে তোমার রাত কে অন্য কেউ নিয়ে যাচ্ছে।তুমি যে আমায় সবসময়ের জন্য হারাতে চলেছ নিভ্র ভাই।নিরব কে ভালো না বাসা সত্বেও আমায় ওকে যে বিয়ে করতেই হবে।তুমি আজও আসবে না আমায় বাঁচাতে?

আমার মৌনতা কে সম্মতি ধরে নিয়ে বাবা হাসিমুখে মা আর বড় মাকে বলে আমায় রেডি করিয়ে দিতে। বড় মা যখন আমায় ভরি ভরি স্বর্ণালংকার পড়াতে ব্যস্ত তখন আমি মলিন মুখে হেসে বললাম,
নিদ্রা: বড় মা তুমি তো বলতে আমায় তোমার ছেলের বউ করবে নিভ্র ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে? যার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্যে এত সপ্ন দেখেছিলে সে জানে তো আজ আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? সে জানে তো আর কেউ তার দানবীয় হাতের চর সহ্য করবে না?

আমার কথায় বড় মা মুচকি হেসে বলল,
নাদিরা: সমস্যা কি নিরব তো আর তোকে চর মারবে না।তোকে আর আমার ছেলের চর খেতে হবে।আজ থেকে নীরবের সঙ্গে ভালোবেসে সংসার করবি।
আমি বিনিময়ে শুধু মলিন হাসি দিলাম আর মনে মনে বললাম,
নিদ্রা: কত সহজে তোমরা সবটা মেনে নিলে তাইনা? অথচ যাকে নিয়ে এতদিন জল্পনা কল্পনা করলে তার কথাটা একবারও ভাবলে না।তোমরা তো মেনে নিলে কিন্তু আমি পারব তো সবটা মানতে? প্রশ্নটা তোলা রইলো।কোনোদিন পারলে উত্তর খুঁজে নিবো।

কাজী সাহেব বিয়ে না পরিয়ে শুধু পান চিবোচ্ছেন বলে বাবা এবার কাজী কে বেশ জোরেসরেই ধমক লাগালো।বাবা বললো,
আজিজ: কি ব্যাপার কি কাজী সাহেব? আপনি বিয়ে না পরিয়ে পান খাচ্ছেন কেন?
কাজী সাহেব পান খাইয়া বন্ধ করে বললেন,
কাজী: আপনিই তো বললেন…

কিন্তু কাজী সাহেব কে মাঝপথে থামিয়ে বাবা বললো,
বাবা: আমি কি বলেছি না বলেছি সেটা পরে ভাববেন।আগে বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।সবকিছুর একটা টাইম টেবিল আছে।সময় মত নাহলে জীবনের অনেক কিছুই থেমে যায়।

কি আর করবে কাজী সাহেব? বাবার ধমক খেয়ে দোয়া পড়তে শুরু করলো।এদিকে আমি ওড়নার ফাঁক দিয়ে দেখছি নিরব আমায় বিয়ে করতে পেরে বেশ খুশি মনে বসে আছে।একেবারে জামাই সাজ দিয়ে বসা যাকে বলে।

আজিজ তালুকদার কাজী সাহেব কে ইসারা করে আড়ালে কাউকে ইসারা করেন তারপর ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলে। ইসারায় কথাবার্তা শেষে আজিজ সাহেব নিজের দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসেন।জবাবে তারাও বাকা হাসেন।

কাজি সাহেব অনেক দোয়া দরুদ পরে এবার নিরব কে বললেন,
কাজী সাহেব: জনাব নিরব চৌধুরী আপনি কি আজিজ তালুকদারের কনিষ্ঠ কন্যা জান্নাতুল তিরানা নিদ্রা কে শরীয়ত মোতাবেক নিজ স্ত্রী হিসেবে মানতে রাজি আছেন? তাহলে তিনবার বলুন কবুল কবুল কবুল…
কাজীর কথা শুনে নীরব কিছুক্ষণ সময় লাগিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা করতে থাকে।আমি তার এরকম বিড়ম্বনায় অবাক হচ্ছি।আমাকে বিয়ে করতে কবুল বলার জন্য নীরবের তো এত সময় লাগার কথা না।

অবশেষে নিরব বলেই ফেললো,
নিরব: কবুল কবুল কবুল…
নীরবের কবুল বলা শুনে ঘরে উপস্থিত কয়েকজন আলহামদুলিল্লাহ বললেও পরিষ্কার আতঙ্ক ফুটে উঠে তিন বন্ধু তথা মেহেরান,আজিজ আর শুভম এর চেহারায়।তারা তিনজন একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছেন ভয়ার্ত চোখে।

এবার কাজী আবারও বললেন,
কাজী: জান্নাতুল তিরানা নিদ্রা আপনি কি শুভম চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র নিরব চৌধূরী কে শরীয়ত মোতাবেক নিজ স্বামী মানতে রাজি আছেন? তাহলে তিনবার বলুন কবুল কবুল কবুল…

কাজীর কথা শুনে আমি চুপ করে আছি।আমার চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝরছে তবুও আমি চুপ করে আছি।এবার বাবা খানিকটা কর্কশ কণ্ঠেই বললো,
আজিজ: তাড়াতাড়ি কবুল বলো নিদ্রা।সময় বয়ে যাচ্ছে…
নিদ্রা:( কোথায় তুমি নিভ্র ভাইয়া? আমায় এভাবে সবার মাঝখানে একা করে চলে গেলে? কেন এলেনা আমায় বাঁচাতে? হয়তো তোমার আমার পথ আলাদা হওয়াই কপালে লিখা ছিল ) ক…

Le jayenge le jayenge
Dilwale dulhaniya le jayenge
Le jayenge le jayenge
Dilwale dulhaniya le jayenge

Aji rahey jayenge rahey jayenge
Paisewaley dektey rahey jayenge
Le jayenge le jayenge
Dilwale dulhaniya le jayenge

আমি কবুল বলবো তার আগেই বাইরে থেকে গান বাজনার আওয়াজ পাওয়া গেলো।আমি গানটা শুনে সাথে সাথে আমার মুখের উপর থেকে ঘোমটা উঠিয়ে ফেললাম আর দৌড় দিলাম বাড়ির বাইরের দিকে। সাউন্ড বক্সে অনেক জোরে জোরে আমারই কণ্ঠে গাওয়া দিল ওয়ালে দিল ওয়ালে দিল দিল ওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে বাজছে…

আমার দেখাদেখি বাকিরাও আমার পিছু পিছু এলো।বাবা তো আমায় ডাকতে ডাকতে পিছনে এলো।বাইরে এসেই আমি দেখলাম একটা ট্রাকের উপর দুটো সাউন্ড বক্সে গান বাজছে আর তার সামনে নিভ্র ভাই তার গার্ডের দলবল নিয়ে বিয়েতে আসা বর পক্ষের বরের মত নাচছে।অবশ্য গার্ডদের পোশাক আজ কালোর বদলে রঙিন হয়েছে।তারা একেকজন মনের মাধুরী মিশিয়ে ইচ্ছে মত নাচছে।কয়েকজন তো নিভ্র ভাইয়া কে ঘাড়ে তুলে নাচছে।

সেখানে উপস্থিত সকলে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে।বাবা অদ্ভুত চোখে ভাইয়া কে দেখছে।সকলের চোখে বিস্ময় থাকলেও শুধু শুভ্র ভাইয়ের চোখে খুশির ঝলক।আমি বুঝলাম তারমানে ভাইয়াই নিভ্র ভাই কে সবটা জানিয়েছে।

বাবা এত হট্টগোল দেখে এগিয়ে এসে নিভ্র ভাইয়ের সামনে দাড়িয়ে বললো,
আজিজ: এসব কি নিভ্র? এটা ভদ্র বাড়ি। এখানে এরকম নাচগানা কেন করছো? আর এরকম পাঞ্জাবি পড়েছ কেন? তুমি তো পাঞ্জাবি সহজে পড়ার মানুষ না আর নিদ্রার বিয়েতে তুমি থাকার তো কথা নয়। তুমিই তো চলে গিয়েছিলে সব ছেরে তাহলে আবার কেন ফিরে এসেছ?

এবার নিভ্র ভাই তার গার্ডের ঘাড় থেকে নেমে বাকা হেসে বললো,
নিভ্র: কী করবো বলতো শশুর আব্বা।নিজের বউয়ের থেকে দূরেই থাকতে পারলাম না তাইতো চলে এলাম বউয়ের বিয়েতে ।আমার বউ নিদ্রার বিয়ে তো হবে কিন্তু সেটা আমার সাথে কারণ একবার বিয়ে হলে তালাক না হওয়া ব্যতীত মেয়েদের আরেকটা বিয়ে দেওয়া জায়েজ নয়।যদি দেওয়া হয় তাহলে যে দিবে সে জাহান্নামে যাবে।তাইতো শশুর আব্বা কে জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে চলে এসেছি।

আজিজ: তুমি কি করে ভাবলে আমি তোমায় নিদ্রা কে বিয়ে করতে দিবো? তোমার বিয়ে আমি নিদ্রার সঙ্গে হতে দিবনা।নিদ্রার বিয়ে তো নিরবের সঙ্গেই হবে।

নিভ্র ভাই এবার বাকা হেসে বললেন,
নিভ্র: একজন বিবাহিতা কে আবার বিয়ে দিবেন তাও তারই স্বামীর সামনে এটা তো অনেক বড় না ইনসাফি।এরকম অন্যায় তো মানবে না মেহেরহান হোসেন নিভ্র। নিদ্রার বিয়ে তো আমার সাথেই হবে।
গায়েজ ওদের বন্দী করো।

নিভ্র ভাইয়ের বলতে দেরি হলেও গার্ডদের করতে দেরি নেই।সাথে সাথে সবগুলো গার্ড এসে সবাই কে বেধে নেয়।মেয়ে গার্ডগুলো আমার বোন থেকে শুরু করে মেয়েদের সবাই কে বন্দী করে।আমি বড় বড় চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।ভাইয়া আমার কাছে এসে বাকা হেসে আমাকে কোলে তুলে নেয় আর বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
নিভ্র: চিন্তা করিস না রাত।সবাই কে বিয়ের পরই মুক্ত করে দিবো।

আমি আর কথা বাড়ালাম না কারণ ভাইয়া এখন ভয়ংকর মুডে আছে। অতঃপর ভাইয়া কাজী কে বললেন বিয়ে পড়াতে আর কাজিও ভাইয়ার এত গার্ডের ভয়ে বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন।কবুল বলে আমরা দুজনেই রেজিষ্ট্রি করলাম।অতঃপর কাজিকেও ছেড়ে দেওয়া হলো আর বাকি সবাই কেও।ভাইয়ার কাছ থেকে দশ হাজার টাকা পেয়ে কাজী নাচতে নাচতে চলে গেছে।

সবাই কে ছেরে দেওয়ার পর বাবা আচমকা নিভ্র ভাইয়ের পিঠে চাপর মারলো আর বাকা হেসে বললো,
আজিজ: যাক তাহলে আমাদের প্লানটা সাকসেসফুল হয়েছে।
বাবার কথায় নিভ্র ভাই ভ্রু কুচকে বাবার দিকে তাকালো আর বললো,
নিভ্র: প্ল্যান মানে? কোন প্ল্যান?
আজিজ: তাহলে তো ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে।
নিভ্র ভাই বাবার কথা শুনে বাবার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়।

ফ্ল্যাশব্যাক কাল বিকেলে,

ছাদে শুভ্র দাড়িয়ে আছে মন খারাপ করে। বন্ধু তো গেছেই এখন বোন কেও হারাতে বসেছে এইদিকে নীলাও প্রেগনেন্ট।এই অবস্থায় খুশি হবে নাকি মন খারাপ করবে সেটা বুঝতে পারছে না।

আজিজ, মেহেরান আর শুভম ছাদে এসেছিল।অনেকদিন পর দুই বন্ধু একসঙ্গে হয়েছে আড্ডা দিবে বলে। ছাদে চিলেকোঠার ঘরের কাছে ডিভানে শুভ্র কে বসে থাকতে দেখে ওর দিকে এগিয়ে যায়।তিনজন শুভ্রর পাশে বসে। শুভ্র প্রকৃতি দেখায় এতই ব্যস্ত যে ওর পাশে কেউ এসে বসেছে সেটা বুঝতেই পারেনি।

হঠাৎ ঘাড়ে কারোর হাত বুঝতে পেরে পাশ ফিরলো শুভ্র।আজিজ ও তার বন্ধুদের দেখে অবাক হলো। শুভ্র কে বিস্মিত হতে দেখে আজিজ তালুকদার বললো,
আজিজ: তুই যখন একমনে ধ্যান করছিলি তখন এসেছি? এখানে একা কেন বসে আছিস?
আজিজের কথায় শুভ্র মন খারাপ করে বললো,
শুভ্র:কি করবো বলো? আমার বন্ধু হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোনকেও হারিয়ে ফেলেছি।নিদ্রা এখন আর কারোর সঙ্গেই মিশে না। হাসতে ভুলে গেছে ও।ছোটো বোনটাকে এভাবে দেখতে খারাপ লাগে।
শুভ্রর কথায় মেহেরান হোসেন বললো,
মেহেরান: কিন্তু ওদের এক করার উপায়ও তো পাচ্ছি না।
শুভম: এমন যদি কিছু করা যেত যাতে নিভ্র ফিরে আসতে বাধ্য হতো।
শুভম এর কথায় আজিজ কিছু বলবে তার আগেই ও ফোন বেজে উঠলো।ফোনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেললো।তারপর ফোন রিসিভ করলো।ফোনের ওপারে লোকটা কি বললো শুনা না গেলেও লোকটার কথা শুনে আজিজ এঁর শ্রী উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ও আচ্ছা…তোমার টাকা তুমি পেয়ে যাবে বলেই ফোনটা রেখে দিল।

ওর দিকে শুভ্র, মেহেরান,শুভম তিনজনই উৎসাহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর হাসির কারণ জানার জন্য।আজিজ ওদের দেখে বাঁকা হেসে বললো,
আজিজ: নিভ্র ফিরে এসেছে।নিদ্রা কে ওর পিছন পিছন হোটেলে ঢুকতে দেখা গেছে।আমি জানি আমায় কি করতে হবে।শুভম নিরব কে ডাক।আমার প্ল্যানে আমার ওকে দরকার।

আজিজ তালুকদারের কথা কেউ না বুঝলেও আর কথা বাড়ায় না।শুভম চৌধুরী আজিজ তালুকদারের কথামত শুভম কে নিচ থেকে ডেকে পাঠালো।

স্টাডি রুমে বসে আছে পাঁচজন আজিজ, মেহেরান,শুভম,নিরব আর শুভ্র।সকলেই অনেক উত্তেজিত আজিজ তালুকদারের প্ল্যান জানার জন্য।অবশেষে আজিজ মুখ খুললো,
আজিজ: আমি জানি নিরব তুই নিদ্রা কে ভালবাসিস কিন্তু ও তোকে ভালোবাসে না। ও নিভ্র কে ভালোবাসে আর নিভ্রও ওকে ভালোবাসে। যে সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ সে কখনো তার ভালোবাসার মানুষের মনের খুশি কেড়ে নিয়ে তাকে নিজের সঙ্গে থাকার জন্য বাধ্য করে না আর করলে সে প্রকৃত প্রেমিক নয় সে হলো মোহের পূজারী।আমি জানি তুই নিদ্রা কে ভালবাসিস আর মন থেকেই ভালবাসিস তাই ওর খুশিতে তোর খুশি।এখন আমি চাইছি নিভ্র আর নিদ্রা কে এক করতে তুই আমায় হেল্প কর।

আজিজ তালুকদারের কথা শুনে নীরব কি বলবে বুঝতে পারছে না।এতবছর ধরে যাকে ভালোবাসলো সে অন্য কাউকে ভালবাসে? তাহলে এতদিন কি মানুষটা কে নিয়ে মিথ্যা সংসার সাজানোর সপ্ন দেখলো? এখন তাহলে তার কি করা উচিত? ভালোবাসার মানুষটার জন্য নিজেকে স্যাক্রিফাইস করা উচিত নাকি ভালোবাসার মানুষ কে জোর করে আকড়ে রাখা উচিত? জোর করে ধরে রাখলে কি ভালোবাসার পবিত্রতা থাকবে?

অনেকক্ষন সময় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে নিজের বুকে পাথর রেখে নিরব আজিজের কথায় সায় দিল।আজিজ এবার বলতে শুরু করলো,
আজিজ: আমার মনে হয়না আজ নিদ্রা আসবে কারণ ওদের মধ্যে কথা কাটাকাটিও হতে পারে আবার সবটা মিটে যেতেও পারে তাই আমাদের যা করতে হবে সব আজকের মধ্যে করতে হবে।আমি কাল সকালে নিদ্রা কে ফোন দিয়ে জরুরি তলব করে ওকে ডেকে পাঠাবো।তারপর ও এলে আমার বন্ধুত্ত্ব আর পরিবার ভেঙে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে ওকে তোর সঙ্গে বিয়েতে রাজি করবো।

আজিজের কথা শুনে শুভ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আজিজ ওকে ইসারায় থামিয়ে দিয়ে বলে,
আজিজ: কথার মাঝে কথা বলা আমার পছন্দ মা শুভ্র।নিদ্রা আমাকে খুব ভালোবাসে আর মানেও তাই আমার সম্মান নষ্ট হবার ভয়ে আমার কথায় রাজি হয়ে যাবে।তারপর ওকে আর তোকে বিয়েতে বসিয়ে দিবো।এইদিক দিয়ে আমার চোখের আড়াল হয়ে শুভ্র নিভ্র কে ফোন দিবি আর ওকে বলবি আমি জোর করে নিদ্রার ফোন দিচ্ছি। নিভ্র তখন নিদ্রার বিয়ের কথা শুনে পাগল হয়ে যাবে আর দিক বেদিক হারা হয়ে নিদ্রার বিয়ে আটকাতে আসবে।তারপর আমি ওকে বলবো যে নিদ্রার সঙ্গে ওর বিয়ে আমি হতে দিবো না তারপর ও আমাদের বেধে রেখে নিদ্রা কে বিয়ে করে ফেলবে।

এবার নিরব আজিজের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
নিরব: তুমি কি করে শিওর হলে নিভ্র ভাই তোমাদের বেধে রেখে নিদ্রা কে বিয়ে করবে? ও তো নিদ্রা কে নিয়েও চলে যেতে পারে।
আজিজ: নিভ্র এত বছর নিজেকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে সামলে রেখেছে কারণ আমি ওকে বাধ্য করেছি।ওকে শর্ত দিয়েছি ওকে ওর পায়ে দাড়াতে হবে আর নিদ্রার চাকরি হতে হবে তাহলেই ও নিদ্রা কে পাবে নয়তো আমি ওর থেকে নিদ্রা কে সবসময়ের জন্য নিয়ে যাবো।এর জন্যই ওকে লিনার ( নিভ্রর খালা ) বাড়ি পাঠিয়েছিলাম।এখন ওর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে তাই ও এখন আর আমার কথা শুনবে না। ও এবার নিদ্রা কে বিয়ে করে নিজের কাছে রাখবে আর এটা আমি শিওর।এখন সবাই রাজি তো? সবার এখন দায়িত্ত্ব হলো আমার এই প্ল্যান সবাই সবার বউ কে নিজের মতো করে বুঝাবে যাতে তারা কোনো প্রতিবাদ বা বাধা সৃষ্টি না করে।সবাই রাজি?

আজিজের কথায় সকলে সমস্বরে সায় দিল।

বর্তমান,

আমি আর নিভ্র ভাই আহাম্মকের মত বসে আছি।আমাদের পিছন দিয়ে এতকিছু হয়ে গেলো আর আমরা জানিই না।বাবা এত এত প্ল্যান করে আমাদের বিয়ে দিলো।সরাসরি বললেই হতো।

আজিজ: কি জামাই কেমন শক দিলাম?
নিভ্র: এত প্ল্যান না করে সরাসরি বললেই হতো।রাত কে এমনই বিয়ে করে ফেলতাম 😒
আজিজ:😒😒

শুভ্র: হয়েছে হয়েছে এদের এবার ছাড় দাও।অনেক প্ল্যানিং প্লটিং হয়েছে।আমার বোনটা তার সোয়ামি কে পাওয়ার জন্য অনেক তড়পাচ্ছে।ওদের এবার ছাড় দাও।

ভাইয়ার কথায় আমি লজ্জা পেলাম।তারপর নীরবের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বললাম,
নিদ্রা: তোর কারণে যে আমি আর নিভ্র ভাই আবার মিলবো সেটা জানা ছিলনা।তোর কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ নীরব।তুই আমায় ভালবাসিস আমি জানতাম তবুও কখনো সেটার প্রকাশ করিনি কারণ আমি যে তোকে ভালোবাসিনি।তবে আজ আমি সত্যি তোর কাছে কৃতজ্ঞ।আমি তোকে ভালবাসি..আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে… বলেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম।নিরব আমায় জড়িয়ে ধরে হালকা অশ্রু চোখে বললো,
নিরব: আমিও তোকে অনেক ভালোবাসি বুচি।

আমি নীরবের মুখে বুচি শুনে হেসে দিলাম।ছোটোবেলায় নাক বুচি ছিল বলে আমায় বুচি বলে ডাকে।এবার নতুন ভাবী আমার কাছে এসে বলল,
নীলা: হয়েছে অনেক কান্নাকাটি।এবার চলো ননদিনি নাহলে দেরি হয়ে যাবে।রাত হয়ে গেছে।তোমার বর যে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

বাসর ঘরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে আছি।এত গয়নাগাটি পরে প্রচন্ড অসস্তি করছে।অনেকক্ষন ধরে বসে আছি কিন্তু নিভ্র ভাই আসার সুযোগই পাচ্ছে না।বাইরে ওর কাছে সকলে রীতিমত পঞ্চাশ হাজার টাকা চেয়ে বসেছে।তার মধ্যে আমার ভাইয়া আর নিরবও আছে।আমি বুঝতে পারছিনা মেয়েদের এই খেলায় ওদের কি কাজ।

অবশেষে বিরক্ত হয়ে গয়নাগাটি খুলে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম।আজ আকাশে মস্ত বড় এক পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।হালকা হাওয়া বইছে।এতক্ষণ গয়নাগাটি পরে থাকার কারণে যে গরম লাগছিল তা এই হালকা বয়ে যাওয়া বাতাসে চলে গেছে।আমি হাত ছড়িয়ে ঠান্ডা স্নিগ্ধ প্রকৃতির রূপ উপভোগ করতে থাকি। হঠাৎ কোমরে কারোর ঠান্ডা ছোঁয়া অনুভব হতেই কেপে উঠি। মানুষটা আমার চেনা।বহু প্রতীক্ষিত মায়াময় স্পর্শ যাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই।

নিভ্র ভাই আমার কোমরে তার দুই হাত রেখে কানের কাছে ফিসফিস করে আগ্রাসী কণ্ঠে বলল,
নিভ্র:তুই আমার প্রেমময় নেশা রাত যে নেশা আমার আজিবনেও ছুটবে না। বাঁচতে হলেও তোকে চাই আর মরতে হলেও তোকে…

ভাইয়া কে পুরো কথা শেষ করতে দিলাম না।পিছন ফিরে ভাইয়ার মুখে হাত চেপে বললাম,
নিদ্রা: মরার কথা আগেই শুনতে চাই না।আল্লাহ যতদিন হায়াত রেখেছেন অতদিন একসঙ্গে বাঁচবো।তোমার সঙ্গে বাঁচতে চাই প্রাণভরে।

ভাইয়া স্নিগ্ধ হেসে আমায় জড়িয়ে ধরলেন।তার বুকে মুখ গুঁজে আমিও তার গায়ের উষ্ণ ওম অনুভব করতে লাগলাম।
#তুই_আমার_প্রেমময়_নেশা
#মিফতা_তিমু
১৫ এবং সমাপ্তি পর্ব( শেষাংশ )

চার মাস পরে,

বাড়িতে হইচই লেগে গেছে।সকলে শুধু দিনরাত এটাই ভাবছে নীলা আর শুভ্রর বাচ্চার নাম কি রাখা যায়।সেই সকাল থেকে নীলা আর শুভ্র ঝগড়া করেছে নীলা বলছে একটা তো শুভ্রর সেটা ভালো লাগছে না আবার শুভ্র কিছু বললে নীলারও ভালো লাগছে না।আজ আবার শুভ্র তার কাজ নিভ্রর গলায় দিয়ে ছুটিতে বাড়িতে বসে আছে তাই এই ঝগড়ার উৎপত্তি।এবার ওদের থামাতে না পেরে নিদ্রা বললো,
নিদ্রা: ছেলে হলে নীলাদ্রি রাখবো নাম আর এটাই ফাইনাল।

এবার আমার চিৎকারে সকলে আমার দিকে মনযোগ দিলো।নতুন ভাবী ভ্রু কুচকে বললো,
নীলা: আর যদি মেয়ে হয় তাহলে?
ভাইয়াও ভাবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললো তাহলে তাহলে…
নিদ্রা: মারিয়াম নীলা হইসে…
শুভ্র: হ্যাঁ এবার ঠিকাছে।নিদ্রা তুই আরও আগে বললি না কেন? হুদাই এতক্ষণ আমার বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করছিলাম।
নিদ্রা; ও এখন আমার দোষ তাইনা?নিজে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করবে আর সলিউশন আমি দিলে আমাকেই দোষ দিবে।মেরি বিল্লি মুঝে মিয়াও।

আমার কথায় ভাইয়া হেসে উঠলো।সকলে আবারও প্ল্যানিং করতে বসে গেলো যে কে কি করবে।কে বেবী কে স্কুল থেকে আনবে,কে ওকে খাওয়াবে।ঠিক হলো আমি যেহেতু ফুপি তাই আমি বেবী কে খাওয়াবো।

অফিসে বসে নিভ্র কাজ করছে।ওর কপাল খারাপ ওর শালাবাবু তার নিজের ভাগের কাজও ওর গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বউয়ের সঙ্গে আরামসে রোম্যান্স করছে আর ও এদিকে বউকে ছাড়া নিরামিষ মুডে কাজ করছে। বউটা কে দেখতে অনেক ইচ্ছে করছে কিন্তু যেতে পারছে না।

হঠাৎ নিভ্রর ফোন বেজে উঠলো।নিদ্রার ফোন দেখেই নিভ্র খুশি মনে ফোন ধরলো।কিন্তু ওই পাশ থেকে শুভ্রর আতঙ্কিত গলা শুনে নিভ্রর বুকটা ধ্বক করে উঠলো,
শুভ্র: নিভ্র ভাই তাড়াতাড়ি আয়।নিদ্রা সেন্সলেস হয়ে গেছে।ওর জ্ঞান ফিরছে না।আমরা ডক্টর কে কনসালট… টুট টুট টুট…

বাকি কথা আর শুনলো না নিভ্র । ফোন কেটে দিয়ে সাথে সাথে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।বাড়ি ঢুকতেই ডক্টর সিনহা বেরিয়ে যেতে দেখলো।লোকটা ওদের পারিবারিক ডাক্তার। নিভ্র ঝড়ের বেগে সিড়ি দিয়ে উঠলো।নিজের ঘরে এসে দেখলো নিদ্রা বিছানায় শুয়ে আছে আর ওকে ঘিরে সকলে বসে আছে।নিদ্রা লজ্জায় লাল নীল বেগুনী হচ্ছে আর নীলা ওকে ক্রমশ টিটকারী মেরে মেরে গুতোচ্ছে।

নিভ্র ভাই কে দেখতেই আমি চুপ করে গেলাম কিন্তু আমার মুখের হাসি এখনো যাচ্ছে না।ভাইয়া সবাই কে উদ্দেশ্য করে বলল,
শুভ্র: এই সবাই চলো চলো। দুই মিয়া বিবিকে একা ছেরে দাও।আমি আর বাবা চললাম মামা আর নানু হওয়ার খুশিতে মিষ্টি বিলাতে।এর আগের বার ২০ কেজি বিলিয়েছিলাম।এবার চল্লিশ কেজি বিলাবো।

ভাইয়ার কথা শুনে বড় বাবাও বললো,
মেহেরান: আমিও দাদা হওয়ার খুশিতে মিষ্টি বিলাব।এবার যদি এলাকাবাশিকে মিষ্টি খাওয়াতে খাওয়াতে পাগল না বানিয়েছি তাহলে আমার নামও মেহেরান হোসেন নয়।
এবার বাবা বললো,
বাবা: আমি তো তোদের সবার থেকে ডাবল মিষ্টি বিলাব।
আর মায়েরা বললো আমরা তো পিঠা বানাবো।
তন্দ্রা বললো,
তন্দ্রা: আমি কট কিনবো…
নিশী: আমি ড্রেস
এবার সবশেষে নতুন ভাবী বললো,
নীলা: আর আমি জুতো….

নিভ্র তো বড় বড় চোখে সবার দিকে তাকিয়ে আছে।সবার কি হয়েছে বুঝতে পারছে না।সবাই এরকম অদ্ভুত ব্যবহার করছে কেন?
শুভ্র: হয়েছে এবার বাইরে চল নাহলে জামাই বাবু ফুলতে ফুলতে ফেটে যাবে।
শুভ্রর কথায় সকলে ওদের একা করে বেরিয়ে গেলো আর শুভ্র নিভ্র কে বাকা হেসে চিমটি কেটে বেরিয়ে গেলো।

বাইরে এসেই বাড়ির ছেলেরা অর্থাৎ অভ্র, শুভ্র, মেহেরান,আজিজ সবাই মিষ্টি কিনতে বেরিয়ে পড়লো আর মায়েরা পিঠা বানাতে বসে পড়লো।আর ইয়াং লেডিরা প্ল্যান করতে বসে পড়লো।ঘর ফাঁকা হতেই নিভ্র ভাই আমার কাছে এসে বসল আর অবাক হয়ে বলল,
নিভ্র: এসব কি হচ্ছে রাত? সবাই পাগল হয়ে গেছে। এরা এত মিষ্টি বিলাতে চাচ্ছে কেন? মায়েরাই বা পিঠা কেন বানানোর কথা বলছে? নিশী, নীলা তন্দ্রা ওরা শপিং করার কথা কেন বলছে?

আমি ভাইয়ার দিকে কিছুক্ষন আহাম্মকের মত তাকিয়ে থেকে অতঃপর কটমট দৃষ্টিতে তাকালাম।ভাইয়া আমার দৃষ্টি দেখে ভরকে গেল।অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
নিভ্র: এভাবে তাকাচ্ছিস কেন জান?
নিদ্রা: তুমি এত গাধা? সবাই এত কথা বললো তবুও বুঝলে না যে তুমি বাবা আর আমি মা হতে চলেছি।

নিদ্রার কথা শুনে নিভ্র চমকে উঠলো।নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না নিভ্র। ও যা শুনলো তা কি সত্যি? সত্যি ও বাবা হতে চলেছে? আরেকবার পরখ করে নিতে নিদ্রার কাছে গিয়ে বলল,
নিভ্র: রাত আরেকবার বল।আমি যা শুনেছি তুই কি তাই বলেছিস? আমি কি সত্যিই ঠিক শুনেছি মানে আমি কি সত্যি বাবা হতে চলেছি?( ছলছল চোখে )

আমি মুচকি হেসে ভাইয়ার বুকে মুখ গুঁজে বললাম,
নিদ্রা: তুমি যা শুনেছ আমি তাই বলেছি।আমরা মা বাবা হতে চলেছি ভাইয়া…
ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো।প্রত্যেকটা ছেলের কাছেই তার বাবা হওয়ার মুহূর্ত তার জীবনের সেরা মুহূর্ত।এই সময়টা তারা অনেকটা হাসিমজা করে কাটাতে চায়।মন ভরে অনুভব করতে চায়।

সাত বছর পরে,

ওটির সামনে দাড়িয়ে আছে অভ্র। ক্রমাগত পায়চারি করে চলেছে।ভিতরে তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে অনবরত তন্দ্রা।এইদিকে নিজের চাচু কে এত পায়চারি করতে দেখে সাত বছর বয়সী ফারহান নিভ্র কে বললো,
ফারহান: বাবা চাচ্চু এভাবে হাটাহাটি করছে কেন?
ছেলের প্রশ্নে নিভ্র চেহারা থেকে চিন্তিত ভাব সরিয়ে মুচকি হেসে বলে,
ফারহান: ঐযে তোমার মাম্মার টামি তে যেমন বেবী আছে তেমনি তোমার চাচীমনির টামীতেও বেবী আছে। বেবিটা এখন বেরিয়ে আসতে চাইছে তাইতো চাচিমনি কে ডাক্তার নিয়ে গেছে বেবী বের করতে।একটু পরে ওরা বেবী কে নিয়ে আসবে তাই তোমার চাচু বেবী কে দেখার জন্য এভাবে হাটাহাটি করছে বুঝলে?

নিভ্রর কথায় ছোটো ফারহান কি বুঝলো কে জানে কিন্তু অদূরে বসে থাকা সাত বছর বয়সী নীলাদ্রি ( শুভ্র নীলার বড় ছেলে ) , পাঁচ বছর বয়সী অতসী ( নিশি আর নীরবের মেয়ে ) আর তিন বছর বছর বয়সি ফাহাদের ( শুভ্র নীলার ছোট ছেলে ) কাছে গিয়ে ওদের তিনজন কে বললো,
ফারহান: জানিস নীল আমার না ছোটো পুতুল বউ আসছে। ও এখন চাচিমনির টামীতে।আরেকটু পরে চাচু আর ডক্টর নিয়ে আসবে ওকে।
ফারহানের কথা শুনে নীল ওরফে নীলাদ্রি বললো,
নীল: তারমানে আমার বনু…
অতসী: তারমানে আমারও ছোটো বোন আসবে নীল ভাইয়া?
নীল: ওই অতসী আমাকে ভাইয়া ডাকবি না?
অতসী: কেন?
নীল: এমনই
অতসী: আমি তো ডাকবো…
নীল:😠😠

এবার ফাহাদ বললো,
ফাহাদ: আমাকে ফাহাদ ভাইয়া বলবে ফারহান ভাইয়া?
ফারহান: আরে হ্যাঁ হ্যা তোকে ভাইয়া ডাকবে।আর আমাকে ফারহান ভাই ডাকবে যেভাবে মাম্মা বাবা কে ভাইয়া ডাকে।

কিছুক্ষণ পর অটি থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ শোনা গেলো।ডক্টর টাওয়েল এ একটা ছোটো নবজাতক বাচ্চা মেয়ে কে নিয়ে এসে হাসিমুখে বললেন,
ডক্টর: congratulations মিষ্টার হোসেন।আপনার মেয়ে হয়েছে।
অভ্র মেয়ের দিকে চোখ না দিয়ে ডক্টর কে বললো,
অভ্র: বাচ্চা পরে দেখবো আগে আপনি বলুন তন্দ্রা ঠিক আছে তো? আমি ওকে দেখতে পারব?
ডক্টর: ইয়েস শি ইজ কমপ্লিটলি ফাইন।উনি এখন তো সেন্স লেস কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই উনার….

অভ্র ডক্টরের পুরো কথা না শুনেই ভিতরে চলে গেলো তন্দ্রা কে দেখতে।এইদিকে সকলে বাচ্চা কে একটু ধরে ধরে আদর করলেও কেউ কোলে নিচ্ছে না।নিদ্রা কে নিভ্র বাবুর কাছেই ঘেঁষতে দিচ্ছে না কারণ এমনিতেই নিদ্রা প্রেগনেন্ট যদিও সবেমাত্র দুই মাসের তবে বেশি প্রটেকটিভ হলে যা হয়।

নিশী আর নিরব ভয় পাচ্ছে যে হাত থেকে যদি পরে যায়।নীলা বাবু কে কোলে নেওয়ার জন্য এগিয়ে গেলে শুভ্র ওর সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয় যে আগে ও নিবে।দুজনে ঝগড়া করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।এইদিকে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা সবাই বাড়িতে কেউ আর হসপিটালে আসেনি। যা করার সব ছেলে মেয়েরা মিলে করেছে।

যখন বাবু কে কেউ কোলে নিচ্ছে না তখন ডক্টর কাচুমাচু মুখে বেবী কে নিয়ে দাড়িয়ে থাকে।এইদিকে ফারহানের শখ জাগে বাবু কে আগে ওই কোলে নিবে তাই ও ডক্টরের কাছে গিয়ে ডক্টরের এপ্রন ধরে টানে।নিজের এপ্রণে টান অনুভব করতেই ডক্টর ফারহানের দিকে তাকায়।ফারহান ডক্টরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
ফারহান: ডক্টর আমাকে একটু দিবেন পুতুল বউ কে?

ফারহানের কথায় ডক্টর ভ্রু কুচকে তাকায় ওর দিকে।নিদ্রা আর নিভ্র এক দৃষ্টিতে তাদের ছেলে কে দেখছে। নিদ্রার মুখে তৃপ্তির হাসি।হয়তো আবার কোনো ভালোবাসার কাহিনী শুরু হতে যাচ্ছে বলেই সেই হাসি।ফারহান ডক্টর কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,
ফারহান: আরে দিন না…
ডক্টর: তুমি পারবে না।তুমি তো এখনও ছোটো।
ফারহান: ফারহান ইমতিয়াজ সব পারে।আপনি দিন ওকে আমার কাছে।

ফারহানের জেদ দেখে ডক্টর অসহায় চোখে নিভ্র আর নিদ্রার দিকে তাকায়। নিভ্র মুচকি হেসে ডক্টর কে ইসারা করে ফারহানের কাছে বাবু কে দিতে।ডক্টর ফারহান কে চেয়ারে বসতে বলে সাবধানে ফারহানের কাছে বাবু কে দেয়।সাথে নিলাদ্রী, অতসী আর ফাহাদ বাবু কে দেখতে চলে আসে।অনেকক্ষন আদর করার পর ফারহান বলে,
ফারহান: বাবু ঘুমোচ্ছে তোরা আর ডিস্টার্ব করিস না।নিল ওদের নিয়ে এক জায়গায় বসা।
নীল ফারহানের কথা শুনে ফাহাদ আর অতসী কে নিয়ে যায়।

ফারহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত বাবুর দিকে তারপর ধীর কণ্ঠে বাবুর দিকে তাকিয়ে বললো,
ফারহান: সাইয়ারা কায়নাত সানাহ্….আমার সানাহ্।আমার পুতুল বউ ❤️

নিভ্র একদৃষ্টিতে তার ছেলে ফারহান কে দেখছে।ফারহান নতুন বাবু ওরফে তার পুতুল বউ কে নিয়ে বসে আছে।বাবুর প্রতি ফারহানের কেয়ার নিভ্র কে তার ছোটবেলা মনে করিয়ে দিচ্ছে। নিভ্র কোথাও না কোথাও ফারহানের মাঝে নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছে।

নিভ্র নিদ্রা কে উদ্দেশ্য করে বললো,
নিভ্র: এরকমই একদিনে তুই হয়েছিলি নিদ্রা।তখন আমিও তোকে কোলে নিয়ে বলেছিলাম নিদ্রা।তন্দ্রা কিন্তু ছোটোবেলায় খানিকটা তোর মত দেখতেছিলো তবুও আমি তোকেই কোলে নিয়েছিলাম।
নিদ্রা: নিভ্র ভাই মনে হয় দ্বিতীয় নিভ্র আর নিদ্রা আসতে চলেছে।
নিভ্র: সেটাই মনে হচ্ছে।ছোটো নিদ্রা আর নিভ্র❤️

৭ বছর পর,

নিভ্র ওর স্টাডি রুমে বসে টেবিলে ল্যাপটপে কাজ করছিলো।তখনই ওর ঘরের দরজায় কড়া পড়লো। নিভ্র না দেখেই বললো,
নিভ্র: কাম ইন..
নিভ্রর কথা শুনে ফারহান ভিতরে এলো। নিভ্র এক পলক ফারহান কে দেখে বললো,
নিভ্র: যা বলার চেয়ারে বসে বলো।

ফারহান নিভ্রর কথামত নিভ্রর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলো।এবার নিভ্র বললো,
নিভ্র: কি বলবে বলো?
অনেকক্ষন চুপ থেকে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফারহান বললো,
ফারহান: আমি পুতুল কে ভালোবাসি বাবা।

ফারহানের কথা শুনে নিভ্র ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
নিভ্র: তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো ফারহান? সানাহ্ অনেক ছোটো বাচ্চা।সবেমাত্র ওর সাত বছর আর তুমি ওই টুকু পিচ্চি কে ভালোবাসো?
ফারহান: কেন বাবা মাম্মাও তো তোমার থেকে সাত বছরের ছোট।তুমি যখন মাম্মাকে ভালোবাসতে পারো তখন আমি কেন পুতুল কে ভালোবাসতে পারবো না।
নিভ্র ফারহানের কথায় বাকা হেসে বলে,
নিভ্র: তোমার মা আমাকে কি ডাকে মনে আছে তো? নিভ্র ভাই ডাকে। সানাহ্ কে ভালোবাসলে ঔ কিন্তু ভাইয়া ডাকবে।
ফারহান: তুমি যদি মাম্মার ভাইয়া ডাক সহ্য করতে পারো তাহলে আমিও পারব।

নিভ্র: ওকে ফাইন তুমি সানাহ্ কে ভালোবাসতেই পারো তবে সেটা আড়ালে।
নিভ্রর কথায় ফারহান অবাক হয়ে বললো,
ফারহান: মানে?
নিভ্র: মানে হলো যতদিন অব্দি সানাহ্ আঠারো বছরের না হচ্ছে অতদিন অব্দি তুমি না সানাহ্ র আশপাশেও যাবে আর না ওকে তোমার ভালবাসার কথা বলতে পারবে।তুমি যদি ওর কাছাকাছি যাও কিংবা ওকে তোমার ভালবাসার কথা বলো তাহলে আমি ওকে তোমার নিরা আন্টির বাড়ি পাঠিয়ে দিবো।তুমি কি এরপরও ওকে তোমার ভালোবাসার কথা বলতে চাও?
ফারহান: কিন্তু বাবা ওর তো আঠারো বছর হতে এখনো এগারো বছর বাকি।এতদিন আমি কি করে অপেক্ষা করবো?
নিভ্র: সবুরে মেওয়া ফলে ফারহান।কিছু পেতে হলে ধৈর্য্য ধরতে হয়।তোমার আপত্তি আছে?
ফারহান: না বাবা আমার পুতুল বউয়ের জন্য আমি সব করতে পারি।
ফারহান: ওকে পুতুল বউ ডাকা বন্ধ করও। সানাহ্ ডাকতে শিখো কারণ আমি চাইনা ও কোনো ভাবে সন্দেহ করুক যে তুমি ওকে ভালোবাসো।এসব ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে ওর পড়ালেখার ক্ষতি হবে আর ওর পড়ালেখার ক্ষতি যাতে নাহয় সেটা তুমি দেখবে।

ফারহান: আচ্ছা…
ফারহান পুরো কথা শেষ করবে তার আগেই সানাহ্ ওকে ডাকতে ডাকতে আসে। দরজা সামান্য ফাঁক করে সানাহ্ নিভ্র কে বলে,
সানাহ্: মেঝ বাবা ফারহান ভাইয়া কে নিয়ে যাই? নীল ভাইয়া, অতসী আপু,ফাহাদ ভাইয়া, ফারাহ্ ফারহান ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।সবাই ক্রিকেট খেলবে।
নিভ্র মুচকি হেসে বলল,
নিভ্র: যা নিয়ে যা…
সানাহ্ মুচকি হেসে ভিতরে ঢুকে টানতে টানতে ফারহান কে নিয়ে গেলো।ফারহান বিষণ্ণ মুখে সানাহ্ কে অনুসরণ করলো।

ফারহান চলে যেতেই নিভ্র বললো,
নিভ্র: সরি বেটা কিন্তু আমাকে এরকম করতেই হবে।তোমার নানাভাই এমনটা করেছিল বলেই আজ তোমার মাম্মা আত্মনির্ভরশীল।আমি চাই সানাহ্ও আত্মনির্ভরশীল হোক।তার জন্য যদি একটু অপেক্ষা তোমায় করতে হয় তাহলে তাই ভালো।

~~~

হাতের উপর স্কেলের বারি পড়তেই সানাহ্ র চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। স্কেল টেবিলে ছুড়ে ফারহান বললো,
ফারহান: একটা অঙ্ক তোকে কতবার করাতে হবে সানাহ্।আমি টায়ার্ড তোকে এই ত্রিকোণমিতির অঙ্ক করাতে করাতে।আর কয়বার করাবো? এভাবে হলে তো তুই অঙ্কে এ প্লাস ধরে রাখতে পারবি না।

সানাহ্: ভাইয়া আমি তো পরীক্ষায় এ প্লাস পাই।
ফারহান: ওই এ প্লাসের কোনো মূল্য আছে? না স্কুলের পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাস আর না আমি করতে দিলে পারিস।পরীক্ষার সময় তুই যে কি করে নাম্বার পাস আল্লাহ জানে।আজ থেকে তোর রাদের সঙ্গে খেলা মানা।আর যদি দেখেছি তোকে ওর সঙ্গে খেলতে তাহলে দেখবি।
সানাহ্ কাদতে কাদতে বললো,
সানাহ্: তুমি যখন অতসী আপুর সঙ্গে ঘুরাঘুরি করো তখন আমি কিছু বলি? তাহলে তুমি কেন আমি রাদ ভাইয়ার সঙ্গে ঘুরলে রাগ করো? তুমি আমাদের কথাই বলতে দাও না।

ফারহান: আমি একশোবার ঘুরবো অতসীর সাথে তোর কি? তুই ঘুরবি না রাদের সাথে ব্যাস।এখন চুপচাপ অঙ্ক কর নাহলে আরেকটা বারি দিবো হাতে।
সানাহ্ করছি করছি বলে আবার অঙ্ক করায় মন দিল আর মনে মনে ফারহানের গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো,
সানাহ্: আমার একটা কথাও শোনে না।সবসময় আমায় বকে।কখনো ভালোবেসে কিছু বলে না আর অতসী আপুর সঙ্গে ঘুরে।নিজে ঘুরলে দোষ নেই আর আমি ঘুরলে দোষ।আর কথাই বলবো না।

ফারহান সানাহ্ র দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বলে,
ফারহান: আমি জানি তোর রাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই তবুও তোকে কারোর সঙ্গে দেখলে আমার যে বড্ড খারাপ লাগে। অতসী আমার বান্ধবী,আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আর সর্বোপরি ও আমার ফুপাতো বোন।।ওর সঙ্গে আমার যেরকম সম্পর্ক তোর সঙ্গে আমার সেরকম সম্পর্ক না।তোর সঙ্গে আমার মনের সম্পর্ক।তুই যদি জানতি আমি কেন তোকে রাদের সঙ্গে ঘুরতে মানা করি তাহলে এরকম কথা বলতিনা। #তুই_আমার_প্রেমময়_নেশা সানাহ্ যেই নেশা আজীবনেও ছুটবে না।

সমাপ্ত….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here