#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২০।
অর্ণবের চেঁচানোর শব্দে পৃথা দৌড়ে রুম থেকে এসে দেখে বাসায় অনেক মানুষ ঢুকেছে। তাদের কেউই পরিচিত না। তাই পৃথা অর্ণবকে জিজ্ঞেস করল,
‘উনারা কারা, অর্ণব?’
অর্ণব তার দিকে ফিরে বলল,
‘জানি না আমি। হুট করেই বাসার ভেতর ঢুকে পড়েছে।’
‘ওদের না চেনারই কথা। তবে, আমাকে চেনো কিনা দেখতো?’
কথাটা বলেই বাসার ভেতর একজন প্রবেশ করে। আর তাকে দেখেই অর্ণব আর পৃথা চমকে যায়। পৃথা ঢোক গিলে। অর্ণবের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। লোকটা মুচকি হেসে পৃথার দিকে চেয়ে বলে,
‘আমাকে কি চিনতে পেরেছ, পৃথা?’
পৃথা নাক মুখ শক্ত করে বলে,
‘আপনি এখানে কেন এসেছেন?’
‘ওমা, আসব না? তুমি কার সাথে আছো, সেটা আমার জানতে হবে না? তাই খুঁজে খুঁজে চলে এলাম। তা, আমাদের বসতে বলবে না?’
অর্ণব শক্ত গলায় জবাব দেয়,
‘না, বলবে না। আপনাদের আমাদের বাসায় বসার কোনো প্রয়োজন নেই। যেই রাস্তা দিয়ে এসেছেন সেই রাস্তা দিয়েই আবার ফিরে যান।’
ফরহাদ দাঁত কেলিয়ে হাসল। বলল,
‘কী যে বলো না? এত কষ্ট করে এলাম, আর তোমরা একটু চা নাস্তা না খাইয়েই বিদায় করে দিচ্ছ? এটা কেমন দেখায়, বলো? আচ্ছা যাও, তোমাদের বলতে হবে না, আমরাই ভেতরে গিয়ে বসছি।’
এই বলে ফরহাদ তাদের বসার রুমে চলে যায়। তার পেছন পেছন তার লোকগুলোও ভেতরে যায়। অর্ণবের রাগ তরতর করে বাড়ছে কেবল। পৃথা থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। অর্ণব চাচার দিকে চেয়ে বলে,
‘চাচা, আপনি বাসায় যান। উনারা আমার পরিচিত।’
চাচা চলে যাবার পর অর্ণবও বসার ঘরে যায়। ফরহাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
‘দেখুন, আমি আর কোনো ঝামেলা চাইছি না। পৃথা এখন আমার বিবাহিতা স্ত্রী। ও আমার সাথে এখানেই থাকবে। তাই অযথা কোনো ঝামেলা না বাড়িয়ে আপনি ফিরে যান।’
ফরহাদ বাঁকা ঠোঁটে হেসে বলল,
‘পৃথা তোমার কী হয় না হয় সেটা কি আমি একবারও জিজ্ঞেস করেছি? সে তোমার বউ হোক বা না হোক সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। ওর বাবা আমাকে ওয়াদা দিয়েছেন, ওকে আমার সাথে বিয়ে দিবেন। এখন যদি উনি উনার ওয়াদা না রাখেন, তবে আমিও আমার ওয়াদা রাখব না।’
অর্ণব ভ্রুকুটি করে বলল,
‘আপনার কিসের ওয়াদা?’
‘পৃথা হয়তো জানে না, ওর বাবার সমস্ত কোম্পানির মালিক এখন আমি। ওর বাবা এই বিয়ের শর্ত দিয়েই আমার থেকে কম্পানিগুলো নিতে চেয়েছিলেন। যেহেতু এখন আর আমাদের বিয়ে হচ্ছে না, সেহেতু এখন এই কম্পানিগুলোও আমার। কাল থেকে পৃথার বাবা পথে বসবে। ব্যবসা নেই তো, খাবেন কী উনি? উনার ঐ বিশাল বাড়িও যে তখন আর বেশিদিন থাকবে না।’
পৃথা সব শুনে ভীষণ রেগে গেল। সে তেড়ে এসে বলল,
‘আপনি একটা জঘন্য মানুষ। আমাকে বিয়ে করার জন্য আপনি আমার বাবাকে ব্যবহার করছেন। আপনার মতো একটা লোককে শুধু আমি কেন, কোনো মেয়েই বিয়ে করতে চাইবে না।’
ফরহাদ বরাবরের মতোই মুখের হাসি বজায় রেখে বলল,
‘থাক, বিয়ে করার আর প্রয়োজন নেই। বিয়ের বদলে এত সম্পত্তি পেয়েছি, আমার তাতেই হবে। তুমি তোমার মতো সুখে সংসার করো, দোয়া রইল।’
অর্ণব তখন বলল,
‘আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন, দেশে আইন বলেও একটা জিনিস আছে। আপনি একজনের সম্পদ জোরপূর্বক দখল করতে পারেন না। আপনার বিরদ্ধে আমরা আইনি পদক্ষেপ নিব।’
‘হা হা, হাসালে। শোনো, তোমাদের এসব ফালতু আইনের ভয় আমাকে দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। এমন দু চারটা আইন আমি নিজেই পকেটে নিয়ে ঘুরি। নিজের আইন নিজের কাছেই রাখো। ফরহাদ কোনো আইনের পরোয়া করে না। আমি যা বলেছি তাই করব, এখন পারলে আমাকে আটকে দেখাও।’
এই বলে ফরহাদ উঠে দাঁড়াল। তারপর তার লোকদের নিয়ে সে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। পৃথা রাগে গদগদ করছে। ওরা চলে যাওয়ার পর সে চেঁচিয়ে বলে,
‘দেখেছেন অর্ণব, ঐ লোকটা কতটা খারাপ! আর ওর জন্য আমি আমার বাবাকে ভুল বুঝছিলাম। ঐ লোকটা আমার বাবাকে ভয় দেখিয়ে এসব করিয়েছে। তাই তো বলি, বাবা তো কখনো এমন করেন না, উনি আমার কষ্ট বুঝেন। তবে কেন হঠাৎ, আমি কষ্ট পাচ্ছি জেনেও এই বিয়েটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করছেন? এখন বুঝেছি তার কারণ। আমাদের একবার বাবার সাথে কথা বলতে হবে, অর্ণব। চলুন না, আমরা কাল বাবার সাথে দেখা করি। আমার মনে হচ্ছে, আমরা বোঝালে বাবা ঠিক বুঝবেন। দেখবেন, উনি তখন মেনে নিবেন সবকিছু।’
অর্ণবের কেন যেন এত সহজেই সবকিছু বিশ্বাস হলো না। ফরহাদ যা বলেছে সত্যিই কি তেমন কিছু আদৌ ঘটেছে? নাকি, আবার তার সাথে কোনো গেইম খেলা হচ্ছে? পৃথার বাবা সত্যিই ফরহাদের ফাঁদে পড়েছে, নাকি দু’জন মিলে তাকে ফাঁদে ফালানোর চেষ্টা করছে? অর্ণব কোনোভাবেই ফরহাদকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। ঐদিকে পৃথার এত অস্থিরতা দেখেও তার ভালো লাগছে না। তাই সে বলল,
‘ঠিক আছে, কাল না হয় আমরা তোমার বাবার সাথে দেখা করব। তবে, শুধু দেখা করব। উনি যদি তোমাকে সাথে নিতে চান, তাহলে কিন্তু সেটা আমি কখনোই মেনে নিব না। ‘
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। শুধু দেখাই করব।’
পরদিন সকালে পৃথা ঘুম থেকে উঠেই দেখল, অর্ণব বাসায় নেই। দরজা বাইরে দিয়ে লক করে সে কোথাও গিয়েছে। পৃথা ফ্রেশ হয়ে এসে অর্ণবের নাম্বারে কল দেয়। অর্ণব কল রিসিভ করে। জিজ্ঞেস করে, নাস্তায় সে কী খাবে? বললে সে খাবার বাইরে থেকে নিয়ে আসবে। পৃথা তাকে বারণ করে দেয়। বলে, সে বাসায় বানাবে। অর্ণব তখন বলে,
‘তবে, এখন না। আমি বাসায় আসার পর গ্যাস জ্বালাবে। এর আগে ভুলেও রান্নাঘরে যাবে না।’
পৃথা তার কথা মতো রান্নাঘরে না গিয়ে রুমেই বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর অর্ণব আসে। তারপর দু’জন মিলে সকালের নাস্তা বানায়। নাস্তা খাওয়া শেষ করে পৃথা বলে,
‘আমি বাবাকে এখন কল দিয়ে বলে দিব, আমরা যে দেখা করতে চাইছি?’
‘এখনই বলবে?’
‘হ্যাঁ, বলে দিই। আমার বাবার জন্য খুব টেনশন হচ্ছে।’
‘আচ্ছা, বলো। উনাকে আমাদের বাসার কাছে রেস্টুরেন্ট আসতে বলো। আমরা সেখানে গিয়েই উনার সাথে কথা বলব।’
‘আচ্ছা।’
পৃথা বাবার নাম্বারে কল দেয়। প্রথম দু’বার কল রিসিভ হয়না। তৃতীয় বারের মাথায় রিসিভ হয়। পৃথা কাঁপাকাঁপা স্বরে বলে,
‘ব-বাবা, কেমন আছো?’
পৃথার বাবা ফুঁপিয়ে উঠেন। বলেন,
‘মনে পড়েছে বাবার কথা? আমি তো ভেবেছিলাম, বাবা বলে যে কেউ আছেন সেটাই হয়তো তুমি ভুলে গিয়েছ।’
‘এভাবে বলো না, বাবা। আমার এমনিতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ, তুমি আমার সাথে রাগ করো না।’
‘আচ্ছা, রাগ করব না। তুমি ভালো আছো, মা?’
‘হ্যাঁ বাবা, আমি খুব ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
‘তোমাকে ছাড়া কীভাবে ভালো থাকি, বলো? শুনলাম, তুমি নাকি বিয়েও করে ফেলেছো?’
পৃথা ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ।’
‘বাবাকে একবার বললেও না? তোমার পছন্দের কথা আমাকে বললে কি আমি সেটাকে প্রাধান্য দিতাম না? একবারও সেটা না বলে, তুমি এভাবে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে, আমার বুঝি এতে কষ্ট হয়নি? এমন কেন করলে, মা? বাবাকে তো একবার বলতে পারতে।’
‘চেয়েছিলাম বাবা। কিন্তু, তোমার রাগের ভয়ে কিছু আর বলতে পারিনি।’
‘আচ্ছা যাকগে যা হবার তো হয়েই গিয়েছে? তা, আমার জামাই কোথায়? তার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিবে না?’
পৃথা খুশি হয়ে বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, অবশ্যই। নাও কথা বলো তুমি।’
পৃথা অর্ণবের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দেয়। অর্ণব তো থমকে যায়। সে তো বুঝতে পারছে পরিস্থিতিটা মোটেও স্বাভাবিক না। পৃথার বাবা সব জেনে বুঝে ইচ্ছে করে এসব করছেন। উনি তো অর্ণবকে আগ থেকেই চেনেন। তার প্রতি রাগটাও হয়তো আগের মতোই রয়ে গেছে। এখন মেয়েকে হাতে নেওয়ার জন্য হয়তো আবার অভিনয় করছেন।
অর্ণব ইতস্তত হয়ে পড়ে। নির্মল হেসে ফোনটা হাতে নেয়। কানে নিয়ে সালাম দেয়। পৃথা বাবা তার জবাব দিয়ে বলে উঠে,
‘আবার আমার মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়েছো? তুমি আসলেই একটা নির্লজ্জ। এতকিছু বলার পরেও আমার মেয়ের পিছ ছাড়লে না।’
পৃথা সামনে বলে, অর্ণব নিজেকে সংযত করে। শান্ত গলায় বলে,
‘জি, আপনার মেয়েকে ভালোবাসি তো। তাই আমার মধ্যে কোনো দ্বিধা, ভয় বা লজ্জা নেই। আর ভবিষ্যতেও থাকবে না। বুঝতে পেরেছেন, শ্বশুর আব্বা?’
পৃথা ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘আরে, শ্বশুর আব্বা কী? বাবা বলো বাবা।’
চলবে…
(ঈদ মোবারক, পাঠকমহল। সকলের ঈদ কাটুক একরাশ আনন্দের ভীড়ে। ভালোবাসা)#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২১।
‘বিয়ে যখন করেই ফেলেছ, তখন তো আর কিছু করার নেই। তবে আমারও তো একটা ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার থাকতে পারে। আমার একটা মাত্র মেয়ে, ভেবেছিলাম ধুমধাম করে তার বিয়ে দিব। কিন্তু, কিছুই তো আর হলো না। আপাতত এখন না হয়, ছোট খাটো একটা অনুষ্ঠান হোক। আমার পরিবারের কিছু মানুষ আর অর্ণবের পরিবারের কিছু মানুষ থাকবেন। তাছাড়া অর্ণবের মা বাবার সাথেও তো আমার কোনো কথা হয়নি। তা, তুমি এখন কী বলো, অর্ণব?’
অর্ণব জবাব দেওয়ার আগে পৃথার মুখের দিকে চাইল। বেশ উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে তার মাঝে। বাবা যে তাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছে, এই নিয়ে মেয়েটা প্রচন্ড খুশী। কিন্তু, অর্ণব তো জানে, পৃথা ব্যাপারটাকে যতটা সহজ চোখে দেখছে, ব্যাপারটা আদৌ এতটা সহজ না। তার সামনে বসে থাকা মানুষটা এতটাও সরল সোজা না যে, এই বিষয়টাকে তিনি এত সহজেই মেনে নিবেন।
তাও সে নিশ্বাস নিয়ে বলল,
‘অনুষ্ঠান করা যেতেই পারে। আর আমার পরিবারের পক্ষ থেকেও কোনো দ্বিমত পোষণ করার কোনো সম্ভাবনা নেই। আপনি আপনার মতো ব্যবস্থা করতে পারেন,(একটু থেমে) বাবা।’
পৃথার বাবা স্মিত হেসে বললেন,
‘যাক তাহলে, তোমারও সম্মতি পেয়ে খুশি হলাম। ঠিক আছে তাহলে, আগামী শুক্রবার তোমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। তার আগে তোমার মা বাবার সাথে আমি কথা বলব। উনাদের নাম্বারটা আমাকে দাও।’
অর্ণব তার মা বাবার নাম্বার পৃথার বাবাকে দেয়। আর বলে,
‘চিন্তা করবেন না, উনারা সবকিছু জানেন।’
পৃথা বাবা তার দিকে এক পলক চেয়ে বললেন,
‘তাহলে তো ব্যাপারটা আমার জন্য আরো সহজ হবে।’
সব কথাবার্তা শেস করে পৃথার বাবা বললেন,
‘যেহেতু শুক্রবারে আবার বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছেই, তাহলে আপাতত এই কয়দিন পৃথা আমার কাছেই থাক। শুক্রবারেই না হয় তুমি একেবারে জামাই সেজে গিয়ে পৃথাকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে গেলে?’
অর্ণব মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘না বাবা, আমি দুঃখিত। ওকে আমি এক মুহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল করব না। শুক্রবারে সকালে ওকে আমি আপনাদের বাড়িতে নিয়ে যাব। দুপুরের মধ্যে ও তৈরি হবে। তারপর বিকেলের দিকে আমি আমার পুরো পরিবারসহিত আপনার বাড়িতে এসে ওকে নিয়ে যাব। এত আগে ওকে আমি আপনার কাছে পাঠাতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করবেন।’
পৃথার বাবা বেশ বিরক্ত হলেন। পৃথা নড়ে বসল। বলল,
‘কেন? বাবা যেটা বলেছেন সেটাই তো আমার কাছে ভালো লেগেছে। আমি এই কয়দিন বাবার কাছে থাকি। তারপর শুক্রবার এসে আমাদের পরিপূর্ণ একটা বিয়ে হবে। অন্য সবার মতো আমি বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি যাব। এটা না করে, আপনার কাছে থেকে কি আর সেই অনুভূতিটা পাব নাকি? মনেই তো হবে না, আমার যে বিয়ে হচ্ছে। তার চেয়ে বরং বাবা যেটা বলেছেন সেটাই করি।’
অর্ণব তার কথায় ক্ষুব্ধ হলো। মেয়েটা মিনিটেই উল্টে গেল। সে জানতো, এখানে আসলে এমন কিছুই হবে। মেয়েটাকে তার বাবা বুঝিয়ে ফেলবেন। আর হয়েছেও তাই। অর্ণব তাই শক্ত গলায় বলল,
‘আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, পৃথা। এখানে আর নতুন করে কোনো অনুভূতি নেওয়ার কিছু নেই। আমি যা বলেছি তাই হবে। শুক্রবারেই তুমি তোমার বাবার বাড়িতে যাবে, এর আগে না।’
পৃথা কিছুটা ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘অর্ণব, আপনি এমন কেন করছেন? আপনি তো জানেন সবকিছু। বাবার পাশেও তো এখন আমাকে থাকতে হবে, তাই না? প্লিজ, রাজি হয়ে যান।’
অর্ণব চোখ মুখ কুঁচকে চেয়ে রইল। পৃথার বাবা গম্ভীর গলায় বললেন,
‘আমার মেয়ে আমার কাছে যেতে চাইছে, আর তুমি ওকে আটকাচ্ছো? এটা কেমন ব্যবহার, অর্ণব? তুমি কি তাহলে বিয়ের পর আমার সাথে ওর কোনো যোগাযোগ রাখতে দিবে না? এটা কি কোনো ভালো মানুষের ব্যবহার? ও কি এখন ওর বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দিবে? এটাই চাও তুমি?’
অর্ণব লোকটার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে। পৃথার কাছে অর্ণবকে খারাপ প্রমাণ করার কোনো চেষ্টাই উনি ছাড়ছেন না। আর ঐদিকে পৃথাও হয়েছে, একইরকম। বাবা যা বলছেন, তাই বসে বসে গিলছে।
পৃথা অর্ণবের দিকে উত্তরের আশায় চেয়ে আছে। অর্ণব পারছে না। অনেক চেষ্টা করে, নিজের মনকে দমিয়ে অবশেষে সে বলল,
‘ঠিক আছে। আমি আটকাবোনা পৃথাকে। তবে, ঐ বাড়িতে থাকা অবস্থায়, ফরহাদ যেন ঐ বাড়ির আশে পাশেও না ঘেঁষে। আমি কিন্তু, সারাক্ষণ এই ব্যাপারটা নজরে রাখব। আর হ্যাঁ, পৃথা কিন্তু অলরেডি’ই আমার বিবাহিতা স্ত্রী, এটা যেন কেউ না ভুলে। বুঝতে পেরেছ, পৃথা?’
পৃথা হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি। আপনি এত টেনশন করবেন না। বাবা আছেন তো আমার খেয়াল রাখার জন্য।’
অর্ণব তখন মনে মনে বলল,
‘বাবা আছেন বলেই তো এত টেনশন।’
,
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অর্ণব পৃথার চলে যাওয়া দেখল। যেমনটা দেখেছিল হসপিটাল থেকেও সেদিন চলে যাওয়ার সময়। আর ঐদিন চলে যাওয়ার সময় বুকটা তার তীব্র ব্যথায় মিইয়ে যাচ্ছিল। আজও তাই হচ্ছে। এত কষ্টের পর আবার পৃথাকে সে পেয়েছে। এবার আর কোনো কিছুর বিনিময়েই সে পৃথাকে হারাতে দিবে না।
পৃথার গাড়িটা যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, অর্ণব ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকেই সেটা দেখল। তারপর রাতে সেও আবার তার বাড়িতে ফিরে গেল।
পরদিন সকালেই অর্ণব পৃথার বাসার সামনে যায়। সেখানে গিয়ে সে পৃথাকে কল দিয়ে বলে, বারান্দায় আসতে। পৃথা এসে অর্ণবকে দেখে অবাক হয়। তাকে ডেকে বাসায় আসতে বললেও, সে বারণ করে বলে, “আসবে না”। দূর থেকে দু’জন কিছুক্ষণ দৃষ্টি বিনিময় করার পর, অর্ণব চলে যায়।
সেদিন দুপুরের পর থেকে পৃথার শরীরটা আবার খারাপ লাগতে শুরু করে। সে দুপুরে অল্প কিছু ভাত খেয়েছিল। সেগুলোও ব মি করে সব বের করে। কিন্তু তাও বমি তার শেষ হয় না। পরপর তিনবার বমি করে, শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে তার। ওয়াশরুম থেকে বেড পর্যন্ত আসতে পারছিল না। পা ফেললেই যেন পড়ে যাবে। মাথা তার প্রচন্ড ঘুরাচ্ছে। সে পা ফেলতে গিয়ে ধপ করে ওয়াশরুমের দরজার সামনেই বসে পড়ে। তারপর আর উঠতে না পেরে “খালা” বলে চেঁচিয়ে উঠে। তার চিৎকারে খালা বাইরের রুম থেকে দৌড়ে এলেন। পৃথাকে পড়ে থাকতে থেকে তিনি দ্রুত তাকে টেনে তুললেন। ধরে নিয়ে বিছানায় বসালেন। পৃথা বসার সঙ্গে সঙ্গেই বিছানায় শুয়ে পড়ে। খালা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হইছে, খালা? এমন করতাছেন কেন? শরীর খারাপ লাগতাছে আপনার?’
‘হ্যাঁ, খালা। বমি হয়েছে, মাথা ঘুরাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে আর উঠতে পারছি না। খুব দুর্বল লাগছে।’
খালা প্রথমে ভ্রু কুঁচকান। পরক্ষণেই শাড়ির আঁচলটা মুখের কাছে নিয়ে লজ্জামাখা স্বরে বলেন,
‘আমার তো অন্যকিছু মনে হইতাছে, খালা। আবার কোনো সুখবর আইতাছে না তো?’
হুট করে “সুখবর” বলে শব্দটাকে তার মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করতে পারল না। এই সুখবরটা কী নিয়ে হতে পারে, কিছুক্ষণের জন্য সে সেটা ভুলে গেল। পরে তার মনে পড়ল, সে তো এখন বিবাহিতা। এখন তো একটু বমি আর মাথা ঘুরালেই খালার মতো মানুষরা “সুখবর” বলে চেঁচাবেন। ব্যাপারটা স্বাভাবিক। তবে এই মুহুর্তে এই ব্যাপারটা পৃথার কাছে বড্ড বিরক্ত লাগল। সে তাই চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
‘কী যে বলেন, খালা। সুখবর আসবে কোথ থেকে? আমাদের বিয়ের বোধ হয় ভালো করে এক সপ্তাহও হয়নি। আর আপনি এখনই সুখবর নিয়ে পড়ে গেলেন।’
খালার মুখে সেই লজ্জামাখা হাসি কিন্তু গেল না। বরং সেটা আরো চওড়া হলো। তিনি বললেন,
‘আরে তাতে কী? এক সপ্তাহেও সুখবর অয়, আপনি টেস্ট করান, খালা।’
পৃথা মাথার উপর হাত রেখে বলল,
‘উফফ খালা, আপনাকে আর আমি বুঝিয়ে পারব না। আচ্ছা, বাদ দেন। আপনি গিয়ে বরং আমার জন্য একটা ডিম সিদ্ধ করে নিয়ে আসুন। আমার প্রেশার মনে হয় লো, তাই শরীরটা এত দুর্বল লাগছে।’
খালা তার কথা মতো কাজে চলে গেলেন। আর পৃথা ভাবুক মনে চিন্তা করল, এই শরীরের হঠাৎ এত খারাপ হওয়ার আসল রহস্যটা কী? এত ঔষধ খেয়েও তো কোনো লাভ হচ্ছে না। শরীরের তো কোনো উন্নতি সে দেখছে না। এখন কি আবার একবার ডাক্তারের কাছে যাবে সে? আগের রিপোর্টটাও তো তার ভালো করে দেখা হয়নি। যদি অর্ণব তার কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে থাকে? পৃথা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। টানা এতগুলো দিন তার শরীরটা এমন। এটা তো আর এমনি এমনি হচ্ছে না, নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো কারণ আছে। পৃথা তাই ঠিক করে, সে কালই আবার সেই ডাক্তারের কাছে যাবে। তারপর আগের রিপোর্ট টা সে নিজের চোখে দেখে, তবেই ক্ষান্ত হবে।
চলবে…