প্রেমাঙ্গনা পর্ব -৩০ ও শেষ

#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩০।(অন্তিম পর্ব)

আর কিছুক্ষণ পর পৃথার ডেলিভারি হবে। ডাক্তার তাকে চেকাপ করে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরই নার্স এসে তাকে ও . টি তে নিয়ে যাবে। পৃথা ইতিমধ্যেই দুশ্চিন্তা আর ভয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে। সে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসছে না, কেবল এদিক ওদিক ছুটছে। পৃথার বাবা তাকে বুঝিয়ে চলছেন, সাথে অর্ণবের মাও। তাকে একটু স্বস্তি দেওয়ার জন্য সবাই তাকে অনেক পজিটিভ কথা বলছেন। কিন্তু, পৃথার এসব ব্যাপারে কোনো হুঁশই নেই। সে তো ভয়ে আড়ষ্ট। সবাই যতই পজিটিভ কথা বলুক না কেন, তার মনে বারবার কেবল খারাপ চিন্তায় আসছে। অন্যদিকে অর্ণবও দু’দিন যাবত একটু স্থির হয়ে বসেনি। পৃথার জন্য সে আগে থেকেই সবকিছু জোগাড় করে রাখছে। অপারেশনের সময় যেন এইটুকু সমস্যায় পড়তে না হয়, তাই সবকিছুর ব্যবস্থা আগেই সে করে রেখেছে।

________

মাত্রই অর্ণব পৃথার কেবিনে ঢুকে। অর্ণবকে দেখতে পেয়ে পৃথার যেন আত্মা ফিরে আসে। সে অর্ণবের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘এতক্ষণ কোথায় ছিলেন, অর্ণব? আপনি জানেন আমি কত দুশ্চিন্তা করছিলাম।’

‘কেন, দুশ্চিন্তা করছিলে কেন? আমি তো এখানেই আছি।’

পৃথা ঢোক গিলে অসহায় সুরে বলে,

‘আমার ভয় করছে, অর্ণব।’

অর্ণব তাকে আর কী আশ্বাস দিবে। সে তো নিজেও ভয়ে কুপোকাত। তাও সে পৃথাকে ভরসা দিয়ে বলল,

‘ভয় পেও না, আমরা সবাই আছি তো।’

পৃথা বলল,

‘আমার সাথে আপনি ও . টি তে যাবেন। আমি একা যেতে পারব না।’

‘কিন্তু, ডাক্তার দিবে না, পৃথা।’

‘না না, প্লিজ। আপনি ডাক্তারকে বলুন। আপনি না গেলে আমিও ও . টি তে যাব না।’

অর্ণব বলল,

‘আচ্ছা, শান্ত হও। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলব।’

তারপর সে পৃথাকে নিয়ে গিয়ে বেডে বসাল। পৃথার অস্থিরতা তখনও কমেনি। সময় যত আগাচ্ছে, তার ভয়ও তত বাড়ছে। বাড়ির সবাই তাকে ভরসা দিচ্ছে, বোঝাচ্ছে। কিন্তু, এই সময়টাই তো ভয়ানক। হাজার বোঝালেও এই সময়ে ভয়কে কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠা যায় না। তাই পৃথাও পারছে না। সে উদাস চোখে অর্ণবের দিকে চেয়ে বলল,

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব, অর্ণব?’

‘হ্যাঁ, বলো।’

পৃথা মাথা নিচু করে আমতা আমতা করে বলল,

‘যদি আজকে আমি মা রা যায়, তাহলে কি আপনি আমায় ভুলে গিয়ে আবার বিয়ে করবেন?’

অর্ণব ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কীসব বলছো? একদম এসব ভাববে না। কিচ্ছু হবে না তোমার।’

‘আর আমার যদি কিছু হয়ও, আপনি কিন্তু আর বিয়ে করতে পারবেন না। প্রমিস করুন।’

‘পৃথা, তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ? এসব কথা কেন বলছো? কিচ্ছু হবে না তোমার, আমরা আছি তো।’

‘উফফ, আপনি আগে আমায় প্রমিস করে বলুন, আপনি দ্বিতীয় বিয়ে করবেন না। আমি আমার জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারব না, অর্ণব।’

অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

‘যেখানে তোমার অবর্তমানে আমি আমার নিজের অস্তিত্বই কল্পনা করতে পারি না, সেখানে দ্বিতীয় কোনো বিয়ে প্রশ্নই আসেনা। একদম এসব বোকা বোকা কথা বলবে না। যা হবে ভালো হবে। বি পজেটিভ।’

এর মাঝেই কেবিনে একজন নার্স এলেন। তিনি এসে পৃথাকে বসে থাকতে দেখে বললেন,

‘আপনার কি এখনও পেইন উঠেনি।’

পৃথা মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘না তো।’

‘আশ্চর্য, সময় হয়ে গিয়েছে অথচ এখনও পেইন উঠছে না কেন?’

পৃথা অস্থির হয়ে বলল,

‘আমার বাবুর কি কোনো সমস্যা হয়েছে? আমার তো কোনো পেইন হচ্ছে না। আপনি ডাক্তারকে ডাকুন। পেইন হতে হবে না। আমাকে এক্ষুণি ও . টি তে নিয়ে যান। তাড়াতাড়ি অপারেশন করে আমার বাবুকে পৃথিবীতে আনুন। এই শেষ মুহূর্তে এসে ওর কিছু হলে আমি মরে যাব।’

অর্ণব পৃথাকে একহাতে আগলে নিয়ে বলল,

‘শান্ত হও, পৃথা। কিচ্ছু হয়নি। সবকিছু ঠিক আছে। আমাদের বাবুও সুস্থ আছে। এত হাইপার হয়ও না।’

নার্স বললেন,

‘হ্যাঁ, আপনি শান্ত হোন। আপনাকে এখনই ও . টি তে নেওয়া হবে। আমি স্ট্রেচার নিয়ে আসছি।’

পৃথার বুকের ধুকধুকানি অনেক বেড়ে গেল। সে এবার ভয়ে কেঁদে ফেলল। সবার উদ্দেশ্য বলল,

‘আমাকে সবাই ক্ষমা করে দিও। যদি আমি ফিরে না আসি, তাহলে আমার সন্তানকে তোমরা সবাই অনেক অনেক আদর আর যত্ন করে বড়ো করো। ও যাতে কোনোদিন আমার কমতি অনুভব না করে।’

পৃথার বাবা তখন তাকে ধমক দিয়ে বললেন,

‘এসব কী বলছো, পৃথা? একদম এসব বলবে না। তোমার কিচ্ছু হবে না। আমাদের সবার দোয়া আর ভালোবাসা আছে তোমার সাথে। কিচ্ছু হবে না তোমার।’

অর্ণবের মা এগিয়ে গিয়ে পৃথার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,

‘আমার নাতি বা নাতনি কে নিয়ে সুস্থ শরীরে ও . টি থেকে বের হও, দোয়া করি।’

________

পৃথাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে ও . টির সামনে নিতেই সে চেঁচিয়ে বলল,

‘অর্ণব, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন।’

নার্স জিজ্ঞেস করলেন,

‘উনি কোথায় যাবেন?’

‘আমরা সাথে ভেতরে যাবে।’

‘দুঃখিত, বাইরের কাউকে আমরা ভেতরে এলাউ করিনা।’

‘প্লিজ, এমন করবেন না। উনাকে ছাড়া আমার ভয় করবে।।প্লিজ, উনাকে আসতে দিন।’

‘না, এটা সম্ভব না। আমাদের এখানে এই নিয়ম নেই। ডাক্তার শুনলে রেগে যাবেন।’

‘অর্ণব, আপনি ডাক্তারের সাথে কথা বলুন না।’

অর্ণব পৃথার মাথার উপর হাত রেখে বলে,

‘তোমার জন্য উনারা হসপিটালের নিয়ম অমান্য করতে পারবেন না, পৃথা। আর এটা খারাপ দেখায়। আমি, এই যে দরজার বাইরে আছি। কোনো অসুবিধা হলে আমাকে ডাকলেই আমি ভেতরে চলে যাব। তুমি দুশ্চিন্তা করো না, এই যে আমরা সবাই আছি এখানে।’

পৃথা ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। প্রচন্ড ভয় লাগছে তার। ভয়ে হাত পা যেন জমে যাচ্ছে। তার চোখের কোণ বেয়ে পানি পড়ে। অর্ণব কিছু করতে পারে না। পৃথার চোখের পানি দেখে তারও চোখ ভিজে উঠে। নার্স পৃথাকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত পৃথা অর্ণবের দিকে ভেজা চোখে চেয়ে থাকে। তার সেই চোখের দৃষ্টি অর্ণবের ভেতরের ভয় আর অস্বস্তিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। বাইরে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পায়না সে। পুরোটা সময় ভয়ে সে জড়োসড়ো হয়ে থাকে।

________

দীর্ঘ এক ঘন্টা বিশ মিনিট অপারেশন শেষে ভেতর থেকে বেশ জোরে চিৎকারের শব্দ শোনা যায়। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই অর্ণবের বুকের ভেতরে প্রশান্তির হাওয়া বয়। সে তার মায়ের দিকে চেয়ে কাঁপাকাঁপা স্বরে বলে,

‘ম-মা, শুনতে পাচ্ছো?’

অর্ণবের মা খুশিতে কথা বলতে পারছেন না যেন। তিনি বলেন,

‘হ্যাঁ, বাবা। আমাদের খুশী চলে এসেছে।’

কিছুক্ষণ পরই নার্স একটা ফুটফুটে ফুলকে কোলে নিয়ে বাইরে এলেন। হেসে বললেন,

‘আলহামদুলিল্লাহ, মেয়ে হয়েছে।’

সবাই খুশিতে সবস্বরে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠল। নার্স বাবুকে অর্ণবের কোলে দেয়। অর্ণবের যেন হাত কাঁপছে। সে তার বাবুকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। কী চমৎকার চোখে বাচ্চাটা তার দিকে চেয়ে আছে, যেন সে বুঝতে পারছে এটাই তার বাবা, তার সবথেকে নিরাপদ আশ্রয়। তারপর একে একে সবাই বাবুকে কোলে নিয়ে আদর করে। অর্ণব নার্স কে জিজ্ঞেস করে,

‘পৃথা কেমন আছে?’

‘ভালো আছেন। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা উনাকে কেবিনে দিব।’

________

বাবুকে কোলে নিয়ে পৃথা খুশিতে কেঁদে ফেলে। খুব করে আদর করে তাকে। তারপর অর্ণবের দিকে চেয়ে বলে,

‘দেখেছেন অর্ণব, আমি বলেছিলাম না, আমার মন বলছে আমার মেয়ে হবে। দেখুন, আমার ফুল হয়েছে।’

অর্ণব হেসে বলে,

‘হ্যাঁ, আমাদের ফুল।’

তারা তাদের মেয়ের নাম ভালোবেসে “ফুল” রাখল। আর তাদের মেয়েও যেন তাদের দেওয়া এই নামের পরিপূর্ণ স্বার্থকতা রেখেছে। নাম যেমন ফুল, তেমনি দেখতেও হয়েছে ফুলের মতো। আর ফুলের মতোই তার সুভাসে এখন পুরো পরিবার রমরমা থাকে। তাকে নিয়েই যত হৈ চৈ, আনন্দ। তাকেই নিয়েই যেন তাদের জীবন পরিপূর্ণ।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here