আকাশেও অল্প নীল পর্ব -০১

“বিয়ে দিলে মেয়ে হবে দুদিন পর। আর আপনি রাস্তায় অস’ভ্যের মতো লাফালাফি করছেন? কেমন মেয়ে আপনি?”

ভরাট পুরুষালি কণ্ঠে উক্ত কথাটি শুনে লাফালাফি থামিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাড়ালো রাইমা। কানে ধরে থাকা মুঠোফোনটি নামিয়ে কল কে’টে দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তার থেকে দুহাত দূরত্বে দাড়িয়ে থাকা পুরুষটির আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো। জিন্স, হুডি জ্যাকেট পরিহিত পুরুষটির মুখে মাস্ক। হতে পারে ফেব্রুয়ারী মাস, কিন্তু এতোটাও শীত নেই, যতোটা শীত হলে গায়ে মোটা শীতের কাপড় পরতে হবে। আর জায়গাটা যদি হয় ঢাকা শহর তবে তো শীতের বালাই কমই বলা চলে। রাইমাও লোকটির কথার জবাবে থমথমে স্বরে বললো,

“রাস্তাটা নিশ্চয় আপনার তৈরিকৃত না! তো সেই রাস্তায় কে লাফাচ্ছে, কে দৌড়াচ্ছে! আপনার এতো মাথা ব্যথা কেনো?”

লোকটি নিরুত্তর রইলো রাইমার কথায়। রাইমা যেভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করলো। লোকটিও তেমন ভাবেই রাইমার আপাদমস্তক দেখে নিলো। তা দেখে রাইমাও নিজের দিকে একবার নজর বুলালো। ফোনের স্কিনে নিজের চেহারাও দেখে নিলো। না তাকে তো জোকারের মতোও লাগছেনা! বা পরণের কাপড়টাও ততোটা অসভ্য মাত্রার নয়। স্কার্ট টপসের উপর গলায় ওরনাও পেচানোই আছে। তাহলে এই লোক তাকে এভাবে পর্যবেক্ষণ কেনো করছে? বুঝতে পারলো না রাইমা। সে এবার গলা উচিয়ে জিগাসা করলো,

“আমাকে কি এলিয়েনের মতো দেখতে? এভাবে স্ক্যানিং করছেন কেনো আমায়?”

“আমি আপনাকে স্ক্যানিং করছিনা অস’ভ্য মেয়ে। আপনি আমায় দেখলেন, আমিও দেখে নিলাম, শোধবোধ। এখন রাস্তা থেকে সরে দাড়ালে আমি গাড়ি বের করে চলে যেতে পারতাম। আপনি রাস্তা আটকে লাফালাফি করছেন, আমি গাড়ির হর্ণ চাপার পরও আপনার সরার নাম নেই। সেজন্য আপনার সাথে কথা বলতে বাধ্য হয়েছি। নয়তো আমার প্রয়োজন ছিলো না আপনার সাথে এরকম অযাচিত সময় নষ্ট করার। আমার সময়ের মূল্য আছে।”

লোকটি উত্তর দিলো রাইমার কথার। রাইমা কথাগুলো শুনে ভালো করে চারপাশ আর লোকটির পিছনে উকি দিয়ে দেখে নিলো। সত্যই সে একটি বাড়ির মূল ফটকের সামনে দাড়িয়ে আছে। আর ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় সে শুনতে পায়নি গাড়ির শব্দ। সে নিজেকে নিয়ে এতোটাই বুদ হয়ে ছিলো দিন দুনিয়ার খবর তার মস্তিষ্কে নেই। নিজের ভুল জেনেও রাইমাকে লোকটির কথা শুনানো নিয়ে প্রচুর রাগ হলো রাইমার। সে লোকটির সামনে তেড়ে গিয়ে আঙুল উচিয়ে বললো,

“রাইমা খন্দকারকে কেউ এভাবে কথা শোনায়নি মি:। সো কিপ ইউর মাউথ শাট। আমি এতোটাও অপরাধ করিনি, যতোটা করলে আপনি আমায় ইনসাল্ট করার রাইট পাবেন!”

লোকটি রাইমাকে চমকে দিয়ে অবাক করার মতো একটি কাজ করলো। সে রাইমার আঙুল উচানো হাতটা ধরে পিছন দিকে বেঁকে ধরলো। এরপর পূর্বের ন্যায় গম্ভীর স্বরে বললো,

“দিগন্ত আহসানকেও কেউ এভাবে আঙুল উচিয়ে শাসানোর সাহস পায়নি মিস রাইমা খন্দকার। তাই নিজের লিমিট রেখে অন্যের দিকে আঙুল তাক করে কথা বলবেন। আর রাস্তায় দেখে শুনে চলবেন ওকে? এটা ঢাকা শহর। আমি খেয়াল করেছি বলে আজ গাড়ির তলায় না পি’ষেই এসে যেচেপরে জানিয়েছি। অন্য কেউ হলে পি”ষে দিয়ে যেতো এখানেই। যতো হোক মানুষের মনে এখন মানুষের জন্য দয়া মায়া কম আর ব্যস্ততা বেশি। আমার মতো কেউ নিজের টাইম ওয়েস্ট করে অন্যের প্রাণ এখানে বাচায় না।”

রাইমা ব্যথায় দাতে দাত পিষে চুপ করে ছিলো। সে দিগন্তের কথা শেষ হতেই ব্যথায় ককিয়ে বলে,

“আমার হাত টা ছাড়ুন মি: কি নাম বললেন! হোয়াটএভার আমার লাগছে। ছাড়ুন আমায়।”

দিগন্ত ধাক্কা দিয়ে রাইমাকে সরিয়ে দেয়। এরপর হুডির পকেট থেকে সানগ্লাস বের করে চোখে সানগ্লাস পরতে পরতে বললো,

“নিজের শক্তির সীমা জেনে অন্যের উপর আঙুল তুলবেন। এবার হাত আস্তোই ছেড়ে দিলাম। পরের বার আনফরচুনেটলি দেখা হলেও এরকম ঘটনার রিপিট হলে হাত ভেঙে দিবো। বাট আই উইশ আপনার সাথে আমার যেনো দেখা না হয়।”

দিগন্ত নিজের গাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। রাইমা চেঁচিয়ে বলে,

“পৃথিবীটা গোল মি:। দেখা তো অবশ্যই হবে। আর আমায় যে আ”ঘাত দিলেন। এটার শোধ না তুলে তো আমি ছাড়বোনা আপনাকে।”

দিগন্ত গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রাইমার কাছে এসে গাড়ির জানালার গ্লাস নামিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,

“আমি অপেক্ষা করবো। আপনার আ’ঘাত শোধ করার ধরণটা জানার জন্য হলেও আমাদের আবার দেখা হোক। গুড বাই।”

দিগন্ত চলে যায়। রাইমা ওখানেই দাড়িয়ে রাগে ফুসতে থাকে। মেজাজ তার রাগে সপ্ত আকাশে চড়ে গেছে। তখনই রাইমার ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের দিকে তাকিয়ে রাইমার আরও রাগ উঠে যায়। রাগের চোটে ফোন টাই ছুরে মা’রে রাস্তায়।

২,
রাস্তার পাশ ঘেষে হাঁটছে রাইমা। হাতে ভাঙা ফোনের সীম আর মেমোরী। নিজেই নিজেকে বকে চলেছে। তখনই পিছন থেকে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠায় রাইমা লাফ দিয়ে পিছনে তাকায়। কুকুরকে দেখে তার আত্মার পানি যেনো শুকিয়ে গেছে। সে ফাকা ঢোক গিলে সেখান থেকে জোড়ে হাটা ধরে। ব্যস্ত ঢাকা শহর, তার বুকে ব্যস্ত মানুষ তাদের কাজ নিয়ে। রাইমা চারদিকে তাকায়। কেউ তাকে দেখছে কিনা, তার যে অদ্ভুত কাজ। পাগল না ভেবে বসে। কিন্তু সবাই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত দেখে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাইমা। সকাল সকাল রিকশার দেখা পাওয়া যাচ্ছেনা তেমন, যে ক’টা নজরে পরে সবগুলোয় মানুষ। একটা ফাকা ভ্যান দেখে সে ডাক দেয়। ভ্যানটা থামতেই সে ভ্যানওয়ালাকে বলে,

“চাচা যাবেন? আমায় একটু বাসায় পৌছে দেন দয়া করে! আমি ভাড়া ডাবল দিয়ে দিবো পাক্কা প্রমিস।”

“ভাড়া ডাবল দেওন লাগবোনা মা। কোথায় যাবা কও! আমি পৌছায় দিতেছি।”

ভ্যানওয়ালার জবাবে রাইমা খুশি হয়। যাক অন্তত কিছু মানুষের মাঝে মানবতা আছে। সে খুশিমনে ভ্যানে উল্টোদিক ফিরে বসে। ভ্যান চলতে আরম্ভ করে। আর রাইমা ব্যস্ত হয়ে পরে ব্যস্ত ঢাকাকে দেখতে। কেউ রাস্তা পরিস্কার করছে তো কেউ ময়লার গাড়িতে ময়লা তুলছে। সাইকেলে পেপারওয়ালা পেপার ফেরি করছে। একমুঠো সুখের জন্য মানুষের কতো ছুটোছুটি। অথচ হাতের কাছে সব পেয়েও জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে গেছে রাইমা। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। ফোনটা অকারণে ভাঙলো এক অপরিচিত পুরুষের প্রতি রাগ দেখিয়ে। এখন বাবার কাছে গিয়ে ফোন কিনে চাইলে নিশ্চিত একগাদা ব’কা শুনবে। ফোন ঠিকই কিনে দিবে, সাথে ব’কা ফ্রি। প্রায় বাসার কাছাকাছি আসতেই রাইমা নিজের ছোটো ভাই আরফানকে দেখতে পায়। পিচ্চিটার বয়স সাত বছর। সাত সকালে একা একা কোথায় যাচ্ছে! এই ভেবে রাইমা ভ্যানওয়ালাকে থামিয়ে ভাড়া দিয়ে ছুট লাগায় ভাইয়ের পিছনে। ভাইয়ের পাশে দাড়িয়েই হাটু ধরে উপুর হয়ে হাঁপাতে থাকে রাইমা। একটু স্বাস্থ্যবতী হওয়ার দরুণ তার পক্ষে হাটাহাটি ব্যতিত হালকা দৌড়াতেই শরীর হাপিয়ে উঠে। আরফান বোনকে দেখে ভ্রু কুচকে তাকায়। জিগাসা করে,

“সকাল সকাল কোথা থেকে দৌড়ে আসলি আপা! বাসায় তোকে খুজে খুজে হয়রান সবাই।”

“তার আগে বলতো তুই কোথায় যাচ্ছিস একা একা?”

রাইমা সোজা হয়ে দাড়িয়ে প্রশ্নটা করে। আরফান উত্তরে বলে,

“শার্লিন আপুর বাসায়। আম্মু বললো ওখানে গিয়ে দেখতে, যে তুই ওখানে গেছিস কিনা!”

শার্লিন রাইমার বেস্টফ্রেন্ড। রাইমাদের বাসা থেকে ১০মিনিটের দূরত্বে শার্লিনদের বাসা। রাইমা আরফানের হাত ধরে বলে,

“বাসায় চল। হারাইনি আমি, সব একেবারে দেখছি হারিকেন লাগিয়ে আমায় খুজতে নেমেছে।”

“জলজ্যান্ত একটা মানুষ যে ভোরবেলা উঠে বাসায় দৌড়াদৌড়ি শুরু করে, তাকে সকাল সকাল না দেখলে মানুষ হারিকেন কেনো? পারলে পুরো শহরে তোলপাড় করে খোজা দরকার।”

পিছন থেকে কেউ একজন কথাটা বলায় আরফান আর রাইমা দুজনই পিছন ফিরে তাকায়। উপস্থিত মানুষটিকে দেখে রাইমার মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে পরে,

“আপনি এখানে? আপনি এখানে এতো সকালে! কি করে আসলেন?”

“তা আমার বিষয় আমি কি করে আসলাম। তোমার মাথার স্ক্রু যদি ঠিকঠাক থাকে, চলো এবার বাসায় যাই?”

“আসার সাথেই আমায় পাগল প্রমাণিত করতে উঠেপরে লেগেছেন?”

রাইমা কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন করে। আরফান পাশ থেকে বলে উঠে,

“পাগলকে নতুন করে আবার পাগল প্রমাণ করতে হয়?”

রাইমা ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে দুম করে কি’ল বসিয়ে দেয়৷ আরফান পিঠ বেকিয়ে দাড়ায়। রাইমা বলে,

“আমার ভাই হয়ে তুই আমার পক্ষে না থেকে অন্যের পক্ষে কি করে থাকিস তুই?”

“তুই আমার আপা হলে আমায় মা”রতে পারতি? তোকে নিশ্চিত আব্বু পচা ডোবা থেকে তুলে এনেছে। একদম পচা তুই।”

“চুপ কর পাকা ছেলে। আমি তোর বড়ো, তুই নস। তোকে আব্বু তুলে এনেছে পচা ডোবা থেকে। আমি দেখেছি। ”

“উফ থামবে তোমরা দু ভাইবোন। রাস্তার মাঝেই শুরু করে দিয়েছো?”

রাইমা আর আরফান ঝগড়ায় এতোটা মনোযোগ দিয়ে বসেছিলো যে তাদের সামনে আরও একজন উপস্থিত আছে ভুলেই বসেছিলো। তার ধম’কে রাইমা আর আরফান ভীতু চাহনীতে তাকায়। লোকটি বলে উঠে,

“গিয়ে বিচার দিবো তোমাদের আব্বুর কাছে?”

“না থাক, এতোটা উদার হতে হবে না। আমরাই আব্বুকে বলে দিবো। চল ভাই।”

রাইমা কথাটা বলে আরফানের হাত ধরে বাসার দিকে রওনা দেয়। লোকটিও ওদের পিছন পিছন যায়। যাওয়ার পথে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। আটটা বাজে। এতো সকালে রাইমা কোথায় গিয়েছিলো! রাইমাকে ফোন দিয়েও পাওয়া গেলো না! তার ফোন কোথায়? এসব চিন্তাতেই মগ্ন হয়ে পরেছে সে।

চলবে?

#আকাশেও_অল্প_নীল
#সূচনাপর্ব
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here