#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৬।
অর্ণব গভীর নিঃশ্বাস ছাড়ল। সেই বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্ত আজ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এবার তাকে সাহস করে সব বলতে হবে। অর্ণব তাই আর দেরি করল না। পৃথার দিকে চেয়ে নরম সুরে বলল,
‘তোমার আর আমার বিয়ে এক সপ্তাহ আগে নয় বরং ছয় মাস আগেই হয়েছিল।’
পৃথা হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে। অর্ণব আরো বলে,
‘আমাদের প্রথম পরিচয় সাজেকে হয়নি, হয়েছিল তোমার ভার্সিটিতে। ভার্সিটিতেই আমি তোমায় প্রথম দেখেছিলাম। তারপর অল্প কথা। সেই কথার সূত্রে প্রেম। আমি তখন পড়াশোনা শেষ করে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব নিই। তাই তুমি তখন বিয়ের জন্য আমার কথা তোমার বাবাকে জানিয়েছিলে। কিন্তু তোমার বাবা সেটা কোনভাবেই মেনে নেননি। তিনি তোমাকে সাফ বারণ করে দিয়ে ছিলেন। আমার পরিবার ও তোমার বাবার কাছে এসে অনুরোধ করেছিল, ভিক্ষা চেয়েছিল তোমাকে, কিন্তু তোমার বাবা কোনমতেই রাজি হননি। শেষে আর কোন উপায় না পেয়ে আমরা পালিয়ে গিয়েছিলাম, কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েও করেছিলাম। আর তারপর, একসাথে ৬ মাস ২ দিন সংসার করি। সব ঠিক ছিল, আমাদের সুন্দর ছোট্ট একটা সংসার ছিল; কিন্তু…(একটু থেমে) কিন্তু, এর মাঝেই ঘটে গেল এক ভয়ানক ঘটনা। তারিখটা আমার মনে আছে, ২৮ তারিখ। তোমাকে নিয়ে সেদিন রিক্সা ভ্রমণে বের হয়েছিলাম। হুট তলা রিক্সায় একটা সুন্দর বিকেল তুমি আর আমি উপভোগ করছিলাম। কিন্তু সেই উপভোগের সুখ আমাদের বেশিক্ষণ টিকল না। হুট করে একটা প্রাইভেটকার রিক্সাটাকে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দেয়। সেই ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে তুমি রিকশা থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ো। আমিও পড়ে যাই, ব্যথাও পাই খুব। কিন্তু, যখন আমার পাশে তোমার রক্তাক্ত শরীরটা পড়ে থাকতে দেখি, আমার সব ব্যথা যেন তখন উবে যায়। উঠতে পারছিলাম না তাও কষ্ট করে উঠে গিয়ে তোমাকে আগলে ধরি। তখন তুমি জ্ঞানহীন অবস্থায় পড়ে আছো। তোমার মাথার পেছনে কেটে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। সেই দৃশ্য ভাবলে এখনো আমার গায়ে কাটা দেয়। আশেপাশের লোক দেখে তোমাকে আর আমাকে নিয়ে একটা হসপিটালে যায়। আমি তখন তোমার বন্ধুদের কল দিয়ে আসতে বলি। তোমার অবস্থা তখন খুব করুন ছিল, ডাক্তার বলেছিল, হয়তো বাঁচানোই সম্ভব হবে না। আমার তখন পাগল প্রায় অবস্থা, কিন্তু ওরা কোনভাবেই আমাকে তোমার কাছে যেতে দিচ্ছিল না। কারণ, আমার তখন ড্রেসিং চলছিল। অন্যদিকে তোমাকে নিয়ে যাওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। তোমার বন্ধুরা এসে আমাকে আশ্বাস দেয়। আর তোমার অমন সিরিয়াস অবস্থা দেখে তারা আমাকে খুব জোর করে বলে তোমার বাবাকে একবার জানানোর জন্য। তখন আমি তোমার বাবাকে কল দিয়ে হসপিটালে আসতে বলি, তোমার কথা বলে। তোমার বাবা আসেন, অনেক টাকা খরচ করে তোমার চিকিৎসা করান। আর তারপর তুমি সুস্থ হয়ে উঠো ঠিকই কিন্তু, তোমার মস্তিষ্ক থেকে কিছু সময়ের স্মৃতি হারিয়ে যায়। পুরো এক বছরের স্মৃতি। তুমি ভুলে যাও সবকিছু। এর মাঝে ভুলে যাও আমাদের প্রেম, ভালোবাসা, আর বিয়ের সব স্মৃতি। আমি তখন তোমার সামনে গিয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে চিনতে পারোনি। তোমার ঐ অবস্থা দেখে আমি তখন খুব অস্থির হয়ে পড়েছিলাম, পাগলামি করছিলাম। আমি মানতেই পারছিলাম না, তুমি আমার কথা কী করে ভুলে যেতে পারো। তখন ডাক্তার আবার বলে, তোমাকে নাকি আমি কোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে পারব না, তাতে নাকি তোমার ব্রেইনে চাপ পড়বে। আর যদি এমন কিছু হয়, তাহলে নাকি তুমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমাকে তখন তোমার বাবা আর ডাক্তার অনেক ভয় দেখান। কোনোভাবেই উনারা আমাকে তোমার কাছে কিছু বলতে দিচ্ছিলেন না। আমি না পারছিলাম এসব মানতে আর না পারছিলাম কিছু করতে। ডাক্তার বলে, এখনি এত উত্তেজিত না হতে, তোমার নাকি আস্তে আস্তে সব কিছু মনে পড়বে। তোমার বাবাও তখন সেই সুযোগটা কাজে লাগান। আমার কাছ থেকে তোমাকে আলাদা করে ফেলেন। আর আমি তোমাকে হারিয়ে হয়ে যায় একেবারে নিঃস্ব। আমি কিন্তু তখন তোমার প্রেগনেন্সির খবর জানিও না। আমি তো তখন কেবল একটা চিন্তাতেই ছিলাম, তোমাকে আবার কী করে আমার জীবনে ফিরিয়ে আনব। অন্যদিকে তোমার বাবা চাইছিলেন, কীভাবে ফরহাদের সাথে তোমার বিয়েটা দেওয়া যায়। আর এসবের মাঝেই, হুট করে রুহা একদিন বলে, তুমি নাকি প্রেগন্যান্ট। তখন বুঝতে পারি, ও আমাদের ভালবাসার অংশ, আমাদের ছয় মাসের সংসারের অংশ, আমাদের সন্তান।’
শেষ কথায় এসে মানুষটার গলার স্বর আটকে যায়। যেন সে আর কিছু বলতে পারছে না, চোখ ভিজে উঠে তার। অন্যদিকে পৃথা আবেগাশূন্য হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভেতরে অনুভূতি যেন আজ সব শুকিয়ে গিয়েছে। এই ছোট্ট জীবনে তার সাথে এত কিছু ঘটেছে, অথচ সে কিছু জানেই না।
অর্ণব পৃথার দিকে চেয়ে বলল,
‘তোমার কি বিশ্বাস হচ্ছে না, পৃথা?’
পৃথা হালকা ঘাড় বাকিয়ে অসহায় সুরে বলল,
‘কী করে বিশ্বাস করব, অর্ণব? আমার জীবনে এত কিছু ঘটে গিয়েছে, আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, আমি আজ প্রেগন্যান্ট আর আমি এসব কিছু জানিই না। আপনিই বলুন, এখন হুট করে এসব শুনে আমি কী করে বিশ্বাস করব?’
অর্ণব তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘তোমার কি প্রমাণ লাগবে?’
ফরহাদ তখন বলে উঠে,
‘পৃথার না লাগলেও আমার লাগবে। আমাকে তোমাদের ছয় মাস আগের বিয়ের প্রমাণ দেখাও।’
অর্ণব রাগে কটমট করে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ঠিক আছে, তুমি দাঁড়াও আমি প্রমাণ আনছি।’
এই বলে সে তার মার কাছে যায়। গিয়ে তাকে বলে,
‘মা, আমার প্রথম বিয়ের কাবিননামা টা দাও।’
অর্ণবের মা ব্যাগের ভিতর থেকে একটি কাগজ বের করে অর্ণবের হাতে দিলেন। অর্ণব সেটি নিয়ে ফরহাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘দেখে নাও আমাদের এই কাবিননামা। এটাই আমাদের বিয়ের প্রমাণ।’
ফরহাদ কাবিননামা খুলে দেখে সত্যি সত্যি এখানে অর্ণব আর পৃথার স্বাক্ষর। তারমানে তারা সত্যি সত্যিই বিবাহিত। ফরহাদ এবার কী বলবে বুঝতে পারছে না, আর কীভাবে চাল চালা যায় সেটা তার জানা নেই। অর্ণব তার দিকে চেয়ে বলল,
‘কী হলো ফরহাদ, এখন বাকরুদ্ধ কেন, বল কিছু।’
ফরহাদ বলে,
‘এই ব্যাপারটা তো নকল ও হতে পারে।’
অর্ণব হাসে। বলে,
‘আচ্ছা তাই, নকল? ঠিক আছে দাঁড়াও, আমি আরো প্রমাণ দেখাচ্ছি।’
এই বলে অর্ণব তার ফোন থেকে তাদের প্রথম বিয়ের কিছু ছবি সবাইকে দেখিয়ে বলে,
‘ছবিগুলো দেখে নিশ্চয়ই আপনাদের মনে হচ্ছে না এগুলো এডিট করা। চাইলে কাছ থেকে নিয়ে জুম করে দেখতে পারেন।’
ফরহাদ এবারও মেনে নিতে পারে না। সে ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘অবশ্যই ছবিগুলো এডিট করা।’
অর্ণবের চোয়াল এবার শক্ত হয়ে আসে। সে ফরহাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
‘আর একটা বার যদি আমাদের বিয়ে নিয়ে আর কিছু বলেছ, তাহলে কিন্তু এবার খুব খারাপ হবে, ফরহাদ। তুমি তোমার এইসব নাটক বন্ধ করে এখান থেকে এক্ষুনি চলে যাও আর আমাদের বিয়েটা সুষ্ঠু মতে হতে দাও।’
ফরহাদ কিছু করতে না পেরে পৃথার বাবার কাছে যায়। বলে,
‘এসব কী হচ্ছে, আঙ্কেল? আপনি এখনো কেন কিছু বলছেন না? কেন এই বিয়েটা আটকাচ্ছেন না?’
পৃথার বাবা নতমস্তকে বলেন,
‘আর কি কোন উপায় আছে এই বিয়েটা আটকানোর?’
ফরহাদ রাগে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,
‘আরে আঙ্কেল, আপনি শুধু একবার বলুন এই বিয়েটা হবে না, তারপরই দেখুন আমি কী করি। আমি তো কেবল আপনার বলার অপেক্ষাই করছি।’
অর্ণব তখন হেসে বলে,
‘তোমার কি মনে হয়, ফরহাদ; এখন পৃথার বাবা বললেই বিয়েটা আমি না করে চলে যাব? আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, আজকে যদি বিয়েটা নাও হয় তাতেও আমার কিছু যায় আসে না কারণ, পৃধা অলরেডি আমার স্ত্রী। আমি তাকে আজকে যে কোন মূল্যে এখান থেকে নিয়ে যাব।’
ফরহাদ চেতে বলে,
‘আঙ্কেল, আপনি কিছু বলছেন না কেন? আমি কি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল চুষবো নাকি?’
পৃথার বাবা বরাবরের মতই বললেন,
‘আমার আর কিছু করার নেই। এবার যদি তুমি কিছু করতে পারো তাহলে করো।’
ফরহাদ নাক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। বলল,
‘ঠিক আছে, এবার যা করার আমিই করব।’
এই বলে সে পৃথার ডান হাতটা চেপে ধরে। পৃথা এতক্ষণ যথেষ্ট শান্ত থাকলেও এবার আর সে সেই রূপ ধরে রাখতে পারে না। সে উঠে সজোরে ফরহাদের গালে একটা চড় মেরে বসে। তারপর চেঁচিয়ে বলে,
‘খবরদার যদি আর একটুও বাড়াবাড়ি করেছেন। আপনি এক্ষুণি এখান থেকে চলে যান। আমি অর্ণবকেই বিয়ে করব। আমার আগের স্মৃতি মনে পড়ুক বা না পড়ুক তাতে কিছু বদলে যাবে না। আমি অর্ণবের স্ত্রী ছিলাম এখন আছি আর ভবিষ্যতেও থাকবো। আপনার মতো এই ঠুনকো একটা মানুষ আমাদের এই সম্পর্কটা বদলে দিতে পারবে না। চলে যান আপনি।’
ফরহাদ তার হাত দিয়ে চড় পড়া গালটা ঘষতে ঘষতে বলল,
‘তুমি, তুমিও আমায় চড় মারলে, এত সাহস তোমার?’
এই বলে সে পৃথার দিকে এগুতে নিলেই অর্ণব পেছন থেকে তার কলার ধরে জোরে টান দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। আর বলে,
‘উঁহু, আর এক পা ওর দিকে এগুবি না।’
ফরহাদ অর্ণবের দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে বলে,
‘অর্ণব, তুই কিন্তু ভালো করছিস না।’
কিন্তু সে উঠে দাঁড়ানোর আগেই সেখানে নিলয় এসে হাজির হয়। আর বলে,
‘তবে আমি কিন্তু খুব ভালো কাজ করে এসেছি, ফরহাদ ভাইয়া।’
এই বলে নিলয় পেছন ফিরে বলল,
‘আপনারা আসুন, অফিসার। এই অসভ্য লোকটাকে এখনই গ্রেফতার করুন।’
তার কথা বলার পরপরই রুমের মধ্যে কিছু পুলিশ অফিসার প্রবেশ করলেন। পুলিশ অফিসারদের দেখে সবাই বেশ অবাক হলো। উনারা কী করে এখানে এলেন?
নিলয় তখন সবার মুখ দেখে বলল,
‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। রুহা এতক্ষণ আমাকে মেসেজ দিয়ে এসব কাহিনী বলছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম এই লোকটাকে এখান থেকে সহজে সরানো যাবে না, তাই পুলিশ সাথে নিয়ে এসেছি।’
ফরহাদ এবার তার দিকে তেড়ে যায়। কিন্তু, পুলিশ অফিসার তার হাতটাকে চেপে ধরে বলেন,
‘অনেক গুন্ডামি দেখিয়েছেন, এবার জেলে গিয়ে বাকি গুন্ডামি দেখাবেন, চলুন।’
ফরহাদ রেগে যায়। বলে,
‘আরে আপনাদের সাহস তো কম না। আপনার কিসের ভিত্তিতে আমাকে গ্রেফতার করতে এসেছেন? আমি কি কাউকে খুন করেছি, না চুরি ডাকাতি করেছি?’
নিলয় হেসে বলে,
‘তার থেকেও বড়ো অপরাধ করেছেন। আপনি আরেকজনের বউকে জোর করে বিয়ে করতে চাচ্ছিলেন, এর থেকে বড়ো অপরাধ আর কিছু হতে পারে না।অফিসার, আপনারা উনাকে এখনই নিয়ে যান।’
পুলিশের লোকেরা আর দেরি করলেন না। ফরহাদকে টানতে টানতে সেখান থেকে নিয়ে থানায় চলে গেলেন।
যেন ঝড়ের মতো ঘটে গেল সবকিছু। পুরো পরিবার নিরব চোখে তাকিয়ে আছেন এবার পৃথার দিকে। পৃথা কী বলবে, কীভাবে নিবে এই জিনিসগুলো তারা সবাই সেটারই অপেক্ষা করছেন। অর্ণব তখন তার সামনে গিয়ে বসে,
আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘পৃথা, এবার কিছু বলো তুমি।’
পৃথা জিজ্ঞেস করে,
‘কী বলব?’
অর্ণব আবার মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি আমায় বিয়ে করবে তো?’
পৃথা ক্ষণিকের জন্য চুপ থেকে বলে,
‘তোমার আমার বিয়ে তো আগেই হয়ে গিয়েছে, অর্ণব।’
অর্ণব মৃদু হেসে বলে,
‘সেটা তো লুকিয়ে করেছিলাম। আর আজ করব সবার চোখের সামনে, সবাইকে সাক্ষী রেখে। তাতে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?’
পৃথা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, বলে,
‘না, আমার কোনো আপত্তি নেই।’
অর্ণবের চোখের কোণ ভিজে উঠে। সে ফিরে তাকায় পৃথার বাবার দিকে। জিজ্ঞেস করে,
‘আপনার কি আর কোন আপত্তি আছে?’
পৃথার বাবা তার দিকে একবার চেয়ে বলে,
‘আমার মতামতের গুরুত্ব তো আগেই দাওনি, এখন আর নতুন করে জিজ্ঞেস করে কোন লাভ আছে কি? তোমাদের যা খুশি তোমরা তাই করো আমার আর কোন আপত্তি নেই।’
অবশেষে এবার পৃথা আর অর্ণবের একটা পরিপূর্ণ বিয়ে হলো। পৃথা এবার কবুল বলার সময় কেন যেন খুব কাঁদল। কিসের কষ্টে কাঁদছে সেটা সে জানেনা, শুধু কেঁদে গিয়েছে। হয়তো কিছু হারিয়ে ফেলার শোক, আবার হয়তো কিছু নতুন করে পাওয়ার সুখ। এই তো তার জীবনের সাথে মিশে আছে। এছাড়া আর কিসের জন্যই বা সে কাঁদবে।
চলবে….#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৭।
পৃথা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ক্ষীণ সুরে বলে,
‘আমি চলে যাচ্ছি, বাবা। দোয়া করো।’
পৃথার বাবার গাল বেয়ে উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়ল। তিনি মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘আমাকে ভুল বুঝো না, মা। আমি তোমার ভালোর জন্যই এসব করেছিলাম।’
পৃথা ম্লান হেসে বলে,
‘আমার ভালো করতে গিয়ে যে বড্ড বেশি খারাপ করে ফেলেছ, বাবা। সেই খারাপটা এখন আমি কী করে পুষাব বলো?’
পৃথার বাবা ঠোঁট কামড়ে অন্য দিকে ঘুরে তাকালেন। পৃথা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাড়ির পরিচিত মানুষরা তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সে সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
‘কিছুক্ষণ আগেও আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছিলেন। জীবনে যে মানুষগুলোকে আমার সুখ দুঃখে আমার ধারে কাছেও দেখেনি আজ সেই মানুষগুলোও আমাকে কথা শুনাতে বাকি রাখেনি। আশা করি এখন আপনারা আপনাদের উপযুক্ত জবাব পেয়ে গিয়েছেন।’
পৃথার ফুপি তখন জবাবে বলে উঠেন,
‘আমরা কি আর এত কিছু জানতাম নাকি?’
পৃথা ফুপির দিকে তাকায়। খানিকটা শক্ত গলায় বলে,
‘কিছু না জানলে চুপ থাকতে হয়, ফুপি। অযথা কাউকে ছোট করতে হয়না।’
পৃথার এই কথার জবাবে তিনি আর কিছু বলতে পারেন না। তারপর পৃথা অর্ণবের মা বাবার কাছে যায়। মৃদু হেসে তাদের পা ধরে সালাম করে। অর্ণবের মা বলেন,
‘বেঁচে থাকো, মা। আমি আজ আবার আমার মেয়েকে ফিরে পেয়েছি। আজ তো আমার আনন্দের দিন।’
অর্ণব তখন পৃথার বাবাকে গিয়ে সালাম করে। আর বলে,
‘চিন্তা করবেন না, বাবা। আমি আপনার মেয়েকে ভালো রাখতে পারব।’
পৃথার বাবা ঢোক গিলে অর্ণবের মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘হ্যাঁ, আমিও তাই দোয়া করি।’
পৃথা তার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তার ফেলে আসা পুরোনো জীবনের আবার নতুন করে সূচনা হতে যাচ্ছে। তার মস্তিষ্কে পুরোনো স্মৃতির মেলা না বসলেও আজ থেকে আবার নতুন স্মৃতি জমা হবে, আপাতত সে তাতেই খুশী।
পুরোনো শ্বশুরবাড়িতে নতুন করে পা রেখে ভীষণ অভিভূত হয় পৃথা। চারদিকে কত কত ফুলে সাজানো। ঝকঝকে চকচকে কোনো কিছু চোখে না পড়লেও বেশ সুন্দর আর সুশীল সবকিছু। অর্ণবের মা পৃথাকে বরণ করে বাসায় তুললেন। তারপর তাকে সোফার রুমে বসিয়ে তিনি হালকা খাবারের আয়োজন করতে গেলেন। পৃথা বসে বসে সবকিছু চোখ বুলাচ্ছে। অর্ণব তার পাশে গিয়ে বসে। পৃথার হাতের উপর হাত রেখে বলে,
‘কিছু মনে পড়ে, পৃথা? আমাদের প্রথম পালিয়ে বিয়ে করার পর আমরা ঐ চাচার বাড়িতেই উঠি, তারপর আমি মা বাবাকে জানানোর পর, উনারা বিনা দ্বিধায় বললেন, তোমাকে নিয়ে এই বাড়িতে আসার জন্য। তুমি যখন প্রথম তোমার শ্বশুর বাড়িতে পা রেখেছিলে সেদিন তুমি আনন্দে আত্মহারা ছিলে। তারপর আস্তে আস্তে শুরু হয় তোমার সংসার জীবন। ঐ যে ঐ কেবিনেট’টা দেখছ? ঐখানে যা আছে সব তোমার কেনা। আর ঐ ফ্লাওয়ার ভাসটা, ঐটাও তুমি কিনেছিলে। এই বাড়ির প্রত্যেকটা জিনিসে তোমার হাতের ছোঁয়া আছে। তোমার অনুপস্থিতে এই জিনিসগুলো রুক্ষ শুষ্ক ছিল। আজ সেগুলো আবার প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছে।’
পৃথা অর্ণবের দিকে তাকিয়ে অসহায় সুরে বলে,
‘আমার কি কখনোই এসব মনে পড়বে না, অর্ণব?’
অর্ণব তার গালে হাত রেখে নরম সুরে বলে,
‘হ্যাঁ, পড়বে তো। কেন পড়বে না। সবকিছু তোমার মনে পড়বে। আস্তে আস্তে মনে পড়বে। শুধু তুমি উত্তেজিত হয়ে পড়ো না, তাহলেই হবে।’
‘আচ্ছা।’
অর্ণব তখন মৃদু হেসে এগিয়ে গিয়ে পৃথার ললাটে ওষ্ঠাধর ছোঁয়ায়। পৃথা খানিকটা চমকে বলে,
‘আরে, মা দেখবেন তো।’
অর্ণব হেসে বলে,
‘ছেলের ভালোবাসা দেখলে মা বরং খুশিই হবেন।’
পৃথা আবার কিছু বলার আগেই অর্ণবের মা খাবার নিয়ে এলেন।
এত এত খাবার দেখে পৃথা মুখ কালো করে বলল,
‘মা, এত খাবার কে খাবে?’
অর্ণবের মা হেসে বললেন,
‘কেন, তুমি খাবে।’
‘তাই বলে এত খাবার?’
অর্ণবের মা পৃথার পাশে বসলেন। বললেন,
‘হ্যাঁ, আজ থেকে এত খাবারই তোমার খেতে হবে। কারণ এখন থেকে তুমি আর একা নও, তোমার সাথে আরো একজন আছে। তাই আজ থেকে তোমাকে একসঙ্গে দুজনের খাবার খেতে হবে। আমাদের পুচকির কথাও তো তোমাকে ভাবতে হবে, তাই না?’
পৃথা মুচকি হেসে বলে,
‘ঠিক আছে।’
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পৃথা তাদের রুমে গেল। অর্ণব তার জন্য রুমটা খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। পৃথার সেটা দেখে খুব ভালো লাগে। পৃথা বিছানায় গিয়ে বসে। সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখে, সেখানে বড় একটা ছবির ফ্রেম। আর সেই ফ্রেমে অর্ণব আর তার হাস্যজ্জ্বল এক ছবি। এই ছবিটা দেখে পৃথার মনে হচ্ছে তারা হয়তো প্রচন্ড সুখী দম্পতি ছিল। কী সুন্দর দুজন হাসছে। তাদের আশেপাশে কেবল সুখ আর সুখ। অর্ণবের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে,
‘এই ছবিটা কখন তুলেছিলাম?’
অর্ণব বলে,
‘বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে হানিমুনে কক্সবাজার গিয়েছিলাম, আর এটা সেখানেরই ছবি।’
পৃথা অবাক হয় বলে,
‘আমি কক্সবাজারে গিয়েছি?’
অর্ণব বলে,
‘হ্যাঁ, গিয়েছ তো আমার সাথে।’
‘ও আচ্ছা, সেজন্যই আপনি সেদিন এত কিছু বলছিলেন। তার মানে কি, ওগুলো আপনার স্বপ্ন ছিল না সত্যিই আমার সাথে ঐরকম কিছু হয়েছিল?’
অর্ণব বলে,
‘হ্যাঁ, সত্যিই এমন কিছু হয়েছিল। সেদিন কক্সবাজারে তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলতে ফেলতে আবার ফিরে পেয়েছিলাম।’
পৃথা বলে,
‘আর সেজন্য আপনি আমাকে আর কক্সবাজার নিয়ে যাবেন না?’
‘উঁহু, আর যাওয়া যাবে না।’
পৃথা কিছুক্ষণ তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য। অর্ণব ওয়াশরুমের দরজায় নক করে বলে,
‘এই তুমি তো কাপড় নিয়ে যাওনি।’
পৃথা দরজা খুলে বের হয়। তার ব্যাগ খুলে কাপড়গুলো নিয়ে আলমারিতে রাখতে গেলেই সে দেখে আলমারিতে তো আরো কাপড় আছে। পৃথা অর্নবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এগুলোও কি আমার কাপড়?’
অর্ণব বলে,
‘হ্যাঁ, এগুলোও তোমার কাপড়।’
পৃথা তখন মৃদু হেসে তার কাপড় গুলো আলমারির এক সাইডে রেখে দেয়। তারপর সেখান থেকে একটি কাপড় নিয়ে আবার ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে।
,
রাতে খাবার টেবিলে বসে দেখে তার শাশুড়ি অনেক খাবার রান্না করে ফেলেছে। এত খাবার সে কী করে খাবে সেটাই বুঝতে পারছে না। তার উপর খাবারের গন্ধে হুটহাট তার আবার বমি চলে আসে। সে অসহায় চোখে খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। তার শাশুড়ি মা তখন জিজ্ঞেস করেন,
‘কী হলো, পৃথা? খাচ্ছো না কেন?’
পৃথা বলে,
‘এত খাবার?’ শাশুড়ি মা বলেন,
‘কেন, খেতে পারবে না?
পৃথা মুখ কাচুমাচু করে বলল,
‘না মা, কেমন যেন…’
তারপর সে থেমে যায়। শাশুড়ি মা বুঝতে পারেন। তিনি উঠে পৃথার পাশে এসে বসেন। আর বলেন,
‘ঠিক আছে, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
তিনি খুব যত্ন করে পৃথাকে খাইয়ে দিতে আরম্ভ করেন। তবে পৃথা বেশি খেতে পারে না, তার গা গুলানো শুরু হয়ে যায়। সে বলে,
‘মা, আর খেতে পারছিনা।’
পৃথার শাশুড়ি বলেন,
‘কিন্তু, এটুকু খেলে কী করে হবে? তোমার তো এখন বেশি বেশি খেতে হবে, মা।’
পৃথা অসহায় স্বরে বলে,
‘সত্যি আমি আর খেতে পারছি না, মা।’
তার শ্বশুর তখন বলেন,
‘থাক, ও যখন আর খেতে চাইছে না তখন আর জোর করো না।’
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পৃথা রুমে যেতেই দেখে রুমটা অন্ধকার। তবে তার মাঝেও কিছু ফেইরি লাইটের মিটমিটে আলোয় বেশ সুন্দর লাগছে রুমটা। পৃথা দরজা আটকে বিছানায় এসে বসে। তারপর সে মৃদু সুরে ডাকে,
‘অর্ণব, কোথায় আপনি? বারান্দায়?’
অর্ণব বারান্দা থেকে এসে তার পাশে বসে। পৃথার চোখের দিকে চেয়ে বলে,
‘তুমি জানো পৃথা, আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম, কীভাবে তোমাকে সবটা সত্যি জানাবো। তখন শুধু একটা কথাই মাথায় আসছিল, যদি সব সত্যি জানার পর তুমি আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ো, তাহলে তো তোমার শরীরও আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। সেই ভয়ে আমি তোমাকে কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু, আজ আমার মনে হচ্ছে হয়তো তোমাকে আরো আগেই সত্যিটা বলে দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে এই দিনটাও আমাদের জীবনে আরো আগেই চলে আসতো।’
পৃথা অর্নবের হাতের উপর হাত রেখে বলে,
‘সব কিছুরই সময় আগে থেকে নির্ধারণ করা থাকে। আর সেই নির্ধারিত সময়ের আগে কিছুই ঘটে না।’
‘হ্যাঁ, তাও ঠিক।’
পৃথা তারপর অর্ণবের কাঁধে মাথা রাখে। আর বলে,
‘আমার এই কথাগুলো ভেবে এখন যেমন কষ্ট হয় আবার মাঝে মাঝে খুব হাসিও পায়। এই যেমন, আমি মা হতে যাচ্ছি অথচ আমি এতদিন ধরে ভাবছিলাম আমি হয়তো মোটা হয়ে যাচ্ছি, তাই আমার পেট বড় হয়ে যাচ্ছে। আজও তো রুহাকে বলছিলাম, আমাকে ব্যায়াম করতে হবে পেট কমাতে হবে, পেটটা বেশি বড়ো। কিন্তু তখনও তো আমি জানতাম না, এই পেটে আমার অস্তিত্ব আছে। আপনার আমার ভালোবাসার অস্তিত্ব।’
অর্ণব তার কথা শুনে হাসে। তারপর তার পেটের উপর হাত রেখে বলে,
‘আমাদের বাবুও বোধ হয় তখন তোমার কথা শুনে হাসছিল।’
পৃথাও হেসে বলে,
‘হ্যাঁ, হয়তো।’
তারপর সারারাত দুজন আরো গল্প করে। তাদের জমিয়ে রাখা অনেক অনেক কথা আজ একজন অন্যজনের কাছে ব্যক্ত করে। তাদের ছোট্ট বাবুকে নিয়ে কত শত পরিকল্পনা করে। পৃথা তো তার নামও ঠিক করে ফেলে, কোন স্কুলে ভর্তি করবে সেটাও ঠিক করে ফেলে। বাবুকে বড়ো হয়ে কী বানাবে সেটাও ভেবে ফেলে সে। আর তার এত এত উত্তেজনা দেখে অর্ণব হাসে। আর প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবে,
‘এইতো আজ তার জীবন সার্থক হয়েছে, আজ তার জীবন পরিপূর্ণ হয়েছে। অগোছালো জীবনটা তার আবার নতুন করে সেজে উঠেছে। তার প্রেমাঙ্গনা তার জীবনে ফিরেছে। সাথে নিয়ে এসেছে একটা সুন্দর ফুলের কলি। এখন তো সে কেবল সেই ফুলের কলি থেকে ফুল ফোটার অপেক্ষা করছে।’
চলবে….