গল্পের নামঃ #প্রেমানুভূতি
#লেখিকা পর্বসংখ্যা_০৬
লেখনীতেঃ #ফারিহা জান্নাত
আজ আদনান-মহুয়ার রিসেপশন হওয়ায় আদনানের বাড়িতে মেহমানে গিজগিজ করছে। পা ফেলার সুযোগও পাওয়া যাচ্ছে না। ড্রয়িংরুমে সব বড় মুরুব্বিরা বসে কথা বলছে। শিল্পী খাতুনের রুমে সব মহিলারা বসে গল্প করছে। আর মহুয়া ও আদনানের রুমে কাজিনমহলের আড্ডা বসেছে। মহুয়া হলো তাদের আগৃরহের মূল কেন্দ্রবিন্দু। মহুয়া বিছানার মাঝে বসে আছে, আর সবাই তাকে আশপাশে বসে আছে। সবাই মহুয়াকে এটা-ওটা প্রশ্ন করছে, মহুয়া রোবটের মতো উত্তর দিচ্ছে। তার কাছে এ পরিস্থিতি নতুন, একেবারে নতুন। মানিয়ে নিতে পারছে না নিজেকে ঠিকমতো।
আদনানের এক কাজিন নাতাশা প্রশ্ন করে বলল,
– “ভাবি আর ইউ ওকে?”
সাথে সাথে সবাই মহুয়ার দিকে তাকালো। মহুয়া বিব্রত হয়ে জোরপূর্বক হেসে বলল,
– “না না, আমি ঠিক আছে।”
সবাই আবার গল্পে মশগুল হয়ে গেলো। মহুয়া আবারো নিজেকে তাদের মতো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলো। ওয়াশরুম থেকে মাথা ঝাড়তে ঝাড়তে বের হলো আদনান। সবাই এবার উৎসুক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। আদনান ওদেরকে এভাবে তাকাতে দেখে বলল,
– “হোয়াট? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন সবাই?”
আদনানের আরেক কাজিন রুহি বলল,
– “তুমি তো তাকিয়ে থাকার মতোই ভাইয়া!”
মহুয়া রুহির কথার মানে বুঝলো না। নাতাশা রুহিকে থামিয়ে বলল,
– “আরে রুহির কথা বাদ দাও তো। তুমি বলো তো ভাইয়া, এত পিচ্চি মিষ্টি বুড়ি কোথায় খুঁজে পেলে তুমি?”
আদনান মহুয়ার পাশ থেকে নাতাশাকে উঠিয়ে হেলান দিয়ে বসে বলল,
– “ভাগ্য লাগে বইন, ভাগ্য লাগে।”
তার কথার ধরনে সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। মহুয়া মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। তার লজ্জা লাগছে, গাল দুটো আবারো লাল হয়ে উঠছে। আদনান মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো মেয়েটা আবারো লজ্জা পেয়েছে। মাথা ঝুঁকিয়ে মহুয়ার মুখটা দেখার চেষ্টা করলো সে। মহুয়ার থুতনি এবার চিবুকে ঠেকলো। নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু সে তো দশদিনের পুরেনো বউ!
এই কয়দিনে তাদের সম্পর্কটা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। মহুশা আদনানের সাথে পুরোপুরি বন্ধুর মতো মেশে। যত আবদার, ইচ্ছা সব আদনানের কাছে। আদনানও সব হাসিমুখে পূরণ করে। তাদের সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তার চেয়েও বেশি কিছু হয়ত বা। আদনানকে দেখে মহুয়ার কেমন যেন অনুভূতি হয়, কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি। আর কিছু ভাবতে পারে না মহুয়া, গাল দু’টো লাল হয়ে আসে।
মহুয়া ও আদনানকে একা রেখে এক এক করে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আদনান মহুয়ার মুখ তুলে বলে,
– “কি ব্যাপার ম্যাডাম? গালগুলো এমন লাল হয়ে আছে কেন? কেউ কামড় দিয়েছে বুঝি?”
চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে মহুয়া আদনানের কথায়। ভেংচি কেটে বলে,
– “ছিঃ! আপনি এসব কথা কোথা থেকে শিখেছেন?”
আদনান এবার মহুয়ার আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
– “নিজে নিজে শিখেছি বুঝেছেন ম্যাডাম। এবার আসল কথায় আসি, বিয়েতে শাড়ি পড়েছিলেন তখন আমি দেখেছিলাম আপনি শাড়ির ভারে নড়তেও পারছিলেন না। আর হিল পড়ে তো পড়েও যেতে নিয়েছিলেন। আজ হালকা শাড়ি পড়বেন, এত ভারি শাড়ি পড়ার দরকার নেই। আর হিল পড়া লাগবে না, আপনি এমনিতেই যথেষ্ট লম্বা। আমার বউ যেমন আছে তেমনই সুন্দর, তাকে আমার পাশে সাধারণভাবেই সুন্দর লাগে।”
কথাগুলে বলে আদনান বারান্দায় চলে গেলো। মহুয়া তখনো স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। হ্যাঁ, সে মেয়ে হিসেবে লম্বা কিন্তু আদনানের পাশে তাকে একটু খাটো লাগে তাই তাকে হিল পড়তে বলা হয়েছিল। হিল পড়ার অভ্যাস তার নেই। তাই পড়তে প্রচুর সমস্যা হতো। আজ আদনানের কথার পর সে আর কোনদিন নিজেকে চেঞ্জ করার চেষ্টা করবে না।
______
বাড়ির সব মেয়েরা সাজতে ব্যস্ত। মহুয়াকে একজন মেক-আপ আর্টিষ্ট এসে সাজিয়ে দিচ্ছে। চুলের কাছ শেষ করে মুখে সাজানোর জন্য হাত দিতেই মহুয়া ধীর কন্ঠে বলে,
– “আপু আমাকে বেশি সাজাবেন না প্লিজ। আমি মুখে পাউডার ব্যতীত কিছু দিতে পারি না, মুখ ভারী লাগে। চোখেও কাজল ব্যতীত কিছু দিতে পারি না চোখ চুলকায়। আর ঠোঁটে কিছু দিলে সেটা মুখে চলে যায়। তখন সেটা অতি বিশ্রী ব্যাপার হবে। তাই আমাকে কম সাজাইয়েন।”
মেক-আপ আর্টিষ্ট কিছু তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে মহুয়ার কথায় সায় দিয়ে সাজানো শুরু করলো। সোনালী পাড়ের লাল শাড়িতে মহুয়াকে আবৃত করা হয়েছে। তার কথা মতোই হালকা করে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। কিছুসময় পর শিল্পী খাতুন মহুয়াকে দেখতে এলেন। তিনি এসেই ব্যস্ত স্বরে বলতে শুরু করেন,
– “কি হলো সাজানো হয়েছে?”
মেক-আপ আর্টিষ্ট বলল,
– “হ্যাঁ সাজানো শেষ, কিন্তু মেয়ে তো সাজতেই চায় না।”
শিল্পী খাতুন এবার মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– “আমার মেয়ে এমনিতেই অসাধারণ। তার কোন কৃত্রিম সাজের দরকার নেই তাই না মা?”
বলেই তিনি মহুয়ার কপালে চুমু খেলেন। নিজের হাতে থাকা খাবারের প্লেট টা নিয়ে ভাত মেখে মহুয়ার মুখের সামনে ধরে বললেন,
– “নে তো মুখ খুল তাড়াতাড়ি। সেই দুপুরে খেয়েছে, তারপর আর খাওয়ার নাম নেই।”
মহুয়া বিনা বাক্যে খেয়ে নিলো। এই মানুষটাকে সে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করে। তার গোটা জীবনে দুটো মা পেয়েছে। একজন জন্মদাত্রী মা, আরেকজন হলো তিনি। নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করে মহুয়াকে তিনি। যে বিয়েটা নিয়ে সে এতটা আপসেট ছিলো। সেই বিয়েটাই যে তার পুরো জীবনের মোড়টা ঘুরিয়ে দেবে সেটা কে জানতো? তার ছোট ছোট স্বপ্নগুলোও যে এখন পূরণ হচ্ছে। যা সে ছোট থেকে তার সবটাই এখন ধীরে ধীরে পেতে চলেছে। এজন্য সে কাকে ধন্যবাদ জানাবে? নিজের বাবাকে, যিনি জোর করে মহুয়ার বিয়ে দিয়েছিল নাকি এই মানুষগুলোকে যারা অতিদ্রুত তাকে নিজেদের পরিবারের সদস্যদের মতো স্নেহ-যত্ন, ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে। একসময় ভাবতো তার জীবনে সবসময় কষ্টই থাকবে। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে সব ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন ছাড়া অন্য কোন কৃতজ্ঞতা স্বীকারের পথ সে পায় নি। পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে চোখে নোনাজল এসে ভীর করলো। চোখের পানি আড়াল করতে পারলো সে, টপটপিয়ে পড়তে থাকলো। শিল্পী খাতুন তাকে কাঁদতে দেখে বললেন,
– “আরেহ্! বোকা মেয়ে, কান্না করছিস কেন? কাজল তো সব ধুয়ে-মুছে গেল।”
মহুয়া চোখে টিস্যু চেপে ধরলো। আবারো তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কাজল মনে হয় সব লেপ্টে যাচ্ছে। কিন্তু তার প্রচন্ড রকম সুখ অনুভব হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে মুহূর্তগুলো কেন তার জীবনে আগে এলো না? এই জীবনটা সুখে কাটবে বলে, ছোটবেলায় তাকে এত কষ্ট সইতে হয়েছে?
শিল্পী খাতুন মহুয়ার চোখের পানি মুছিয়ে বলল,
– “এত কান্নাকাটি করলে চলে? আমার মেয়ে হলে শক্ত মানুষ। তাকে সবসময়, সব পরিস্থিতিতে শক্ত থাকতে হবে। আমি না থাকলে এই সংসারটা তো তারই হাতে থাকবে।”
মহুয়া নাক টেনে অভিমানী স্বরে বলল,
– “আপনি সবসময় আমার সাথে থাকবেন আম্মু। সবসময়! আপনি না থাকলে আমি আবারো আগের মতো ভেঙ্গে পড়বো। আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না মা। একেবারেই পারবো না।”
শিল্পী খাতুন মিষ্টি হেসে মহুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। মহুয়া দরজার বাহির থেকে বউ-শ্বাশুড়ি নয় মা-মেয়ের কান্ড দেখতে থাকে আদনান।
চলবে,