সে এক মনগড়া প্রেমকাব্য পর্ব -০৮

#সে_এক_মনগড়া_প্রেমকাব্য
৮ম_পর্ব
~মিহি

সেই রাতে কথা হয়েছিল, এখনো ফোন বন্ধ। আমায় বললো তৈরি থাকতে। তৈরি হয়েই তো বসে আছি সেই দুপুরবেলা থেকে কিন্তু তার নিজেরই তো খবর নাই। আমি কি অভির জন্য অস্থির হচ্ছি? ধূর! এই ছেলের জন্য কেন অপেক্ষা করছি আমি? ওর যা ইচ্ছা হয় করুক। হঠাৎ করেই ডায়েরিটার কথা মনে পড়লো। ডায়েরিটা আশেপাশে খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে রাতে আমি ডায়েরিটা আমার বিছানার পাশেই রেখেছিলাম। সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও যখন ডায়েরিটা পেলাম না, তখন নিশ্চিত হলাম আমার ঘরে কেউ এসেছিল। কিন্তু ঐ ডায়েরিটা কার আর কে-ই বা এসেছিল ডায়েরি সরাতে? খালামণি ছাড়া তো তেমন কেউই আমার ঘরে ঢোকে না। খালামণিকে জিজ্ঞাসা করে দেখবো? খালামণি যদি না সরিয়ে থাকে, তাহলে আবার আরেক ঝামেলায় পড়বো। চুপ করে বসলাম। সবদিক থেকেই অস্থিরতার আভাস পাচ্ছি। অভির কোনো বিপদ হলো না তো? আরেকবার ডায়াল করলাম নম্বরটাতে, এখনো বন্ধ বলছে। এখন আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। এতক্ষণ ধরে কেউ ফোন বন্ধ করে বসে থাকে? এত ঘুমায় নাকি কেউ? ডায়েরির কথাটাও ঠিক ভুলতে পারছি না। কোনো না কোনোভাবে ডায়েরির প্রথম তিন পৃষ্ঠার কথা আমার জীবনের সাথে কিছুটা হলেও মিলেছে। একরকম কৌতূহল কাজ করছিল মনে যে পরবর্তী পৃষ্ঠায় কী আছে। এমন সময় ডায়েরি হারালে ভালো লাগে? এখন অবধি এটা জানতে পারলাম না “শঙ্খিনী” কে আর “মেঘবালক”ই বা কে। নাহ! এত রহস্য ভালো লাগছে না। খালামণির সাথে একবার কথা বলেই দেখি। খালামণির ঘরে গেলাম, তিনি তখন বসে বসে বই পড়তে ব্যস্ত।”

– “খালামণি!”

– “জানি ডায়েরির খোঁজ করতে এসেছিস কিন্তু ওটা আমার কাছে নেই।”

– “মা..মানে? তুমি কীভাবে জানো ডায়েরির কথা?”

– “মীরা, তুই কী ভাবিস? তোর উপর কেউ নজর রাখে না এ বাড়িতে? তোর মা নিজের চেয়ে তোর যত্ন বেশি নেয় কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। অভিকে তোর জন্য পছন্দ করেছে আপা কিন্তু আপা চায় তুই আগে তার সাথে ফ্রি হোস। তাই সরাসরি কিছু বলছে না কেউ। আপার মানসিক সমস্যা আছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে আপা তোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যত্নশীল।”

– “আমি সব গুলিয়ে ফেলছি খালামণি। আমি এখানে আছিই মাত্র কয়েকদিন। এর মধ্যে আমার বিয়েও ঠিক হয়ে গেল?”

– “তুই এখান থেকে কোথাও যাচ্ছিস না মীরা। দাদামশাই তোকে এখানে রেখে যাওয়ার দুদিন পর আবার কল করেছিলেন। তার হার্টে সমস্যা, কয়েকদিন মাত্র বাঁচবেন। তিনি চান তুই যেন তোর মায়ের কাছে থাকিস।”

– “তুমি ইয়ার্কি করছো খালামণি? দাদামশাইয়ের কিছু হলে তিনি আমায় সবার আগে বলবেন।”

– “অনেক কিছুই এখন তোর অজানা, শুধু জেনে রাখ অভি খুব ভালো। ওকে ভালোবাসতে ভুল নেই।”

– “ডায়েরিটাতে কী ছিল?”

– “তোর বাবা-মায়ের মনগড়া প্রেমকাব্য। আপা কখনো চায়নি তুই ডায়েরির শেষের পাতা পড়িস যেখানে তার জীবনের যন্ত্রণাগুলো সে লিখে রেখেছে। তোর বাবার পরকীয়া, তোকে অস্বীকার করা, আপাকে তালাক দেওয়া- সমস্ত যন্ত্রণা! তোর বাবা এখনো খুব সুখেই আছে তার নতুন বউকে নিয়ে কিন্তু আমার আপার জীবনটা যে নষ্ট হয়ে গেল মীরা।”

– “আমার কাছে এখনো সব ধোঁয়াশা লাগছে খালামণি। আমি উপরে গেলাম।”

– “যা।”

খালামণির ঘর থেকে আসার পর থেকে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। যেখানে আমি মায়ের চোখের আড়ালে থাকার চেষ্টা করতাম, সেখানে মা কিনা সবসময় আমায় নজরে নজরে রেখেছে? আমরা বাহ্যিক পরিস্থিতি দেখে মানুষকে ঠিক কতটা ভুল বুঝতে পারি আমি সেই মুহূর্তে বুঝেছিলাম। আমি আজীবন ভেবে এসেছি আমার মা আমাকে কখনো ভালোবাসে না, তার মনে আমার প্রতি কেবল ঘৃণার বসবাস। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমার জীবনের মোড় কোনদিকে যে ঘুরছে আমি নিজেও টের পাচ্ছি না। ভবিষ্যতে ভালো কিছু আসবে নাকি কোনো তীব্র ধাক্কা তা ভাবনাতেও আসছে না। ফোনের দিকে তাকালাম। ফোনটার কথাও কি মা জানে? হয়তো জানে। অভি এখনো কল দিল না। যদিও প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে কিন্তু এই মুহূর্তে রাগ ঝাড়ার কোনো উপায় নেই।

_____________________________

রূপমের মাথার যন্ত্রণা বেড়েছে, বাড়াটাই স্বাভাবিক। তার হাসপাতালে যাওয়া দরকার তা কিছুতেই তনয় তাকে বোঝাতে পারছে না। ওদিকে রূপমের দলের লোকেরা কোনোভাবে জেনে গেছে রূপম নিখোঁজ। সন্দেহটা প্রথম ক্ষেত্রেই মীরার পরিবারের দিকেই যাচ্ছে। রূপম এসব বিষয়ে দ্বিগুণ সচেতন। কোনোভাবেই মীরার কোনো ক্ষতি হওয়া যাবে না। আপাতত তার লক্ষ্য একটাই মীরাকে খুঁজে বের করে নিরাপত্তা দেওয়া। আচ্ছা, মীরা কি আদৌ চাইবে রূপমের আশ্রয় নিতে? নাকি বরাবরের মতো প্রত্যাখ্যান করে দিবে, জানা নেই রূপমের। মীরা মেয়েটা তার সামনে এলেই যেন পৃথিবীর সবচেয়ে জেদী-অভিমানী-রাগী মেয়েতে রূপান্তরিত হয় অথচ অন্য সকলের কাছে সে পুষ্পের ন্যায় কোমল।

রূপম ঠিক করে ফেলেছে মীরার খোঁজ সে বের করবেই। অবশ্য খুব কঠিন কোনো কাজ না। মীরার দাদামশাই যে তাকে গ্রামে রাখেননি তা যতটা সহজে সে বুঝেছে ঠিক ততটা সহজে এটাও বুঝে গেল মীরার যাওয়ার জায়গা আর একটাই বাকি থাকে। তা হলো মীরার নানাবাড়ি, যদিও সম্ভাবনা কম তবুও চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই।

মীরার নানাবাড়ি সম্পর্কে খুব একটা জানা নেই রূপমের। জানতে হলে দলের একজনের সাহায্য মারাত্মক দরকার। সে হলো ধ্রুব। ছেলেটা শুরু থেকেই রূপমের মনের সব কথা জানে। মীরাকে নিয়ে রূপমের যতশত অনুভূতি, সবকিছুর সাক্ষী ধ্রুব। ধ্রুবই পারবে মীরার ঠিকানা বের করে দিতে। রূপম তনয়ের ফোন থেকে ধ্রুবকে কল করে।

– “হ্যালো ধ্রুব! দলের সাথে থাকলে, যতদ্রুত সম্ভব একটু দূরে আয়। তোর সাথে জরুরী কথা আছে।”

– “আসছি! ভাই, আপনি কই? আপনারে খুঁজতে খুঁজতে সবার নাজেহাল অবস্থা। আপনি ঠিক আছেন তো?”

– “আমি ঠিক আছি। তুই একটা কাজ করে দে আমার, অন্য কেউ যেন না জানে।”

– “কী কাজ, ভাই?”

– “মীরা এখন সম্ভবত ওর নানাবাড়িতে আছে। আমাকে ওর নানাবাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে দে আর পারলে খোঁজ কর ও ওখানে আছে কিনা।”

– “আচ্ছা ভাই। আমি নিজে গিয়ে নজর রাখবো আজ।”

– “এসব যেন কেউ না জানে, কেউ না মানে কেউই না। আর মীরার পরিবারের সাথে কোনোরকম ঝামেলা করবি না তোরা।”

– “বস! ছেলেপেলে সব ক্ষেপে আছে। ওরা জানে আপনি শেষবার মীরা ভাবীর সাথে দেখা করতে গিয়ে আর ফেরত আসেননি। ওদের সামলাচ্ছি আমি। আপনি চিন্তা করবেন না। কোথায় আছেন আপনি?”

– “আমি ঠিক আছি, ব্যস! তোকে যেই কাজ দিলাম, ঐটা কর।”

– “আচ্ছা বস।”

কল কেটে দিল রূপম। ধ্রুবকে সে ভালোভাবেই চেনে। ধ্রুব কাজ নিয়েছে মানে অবশ্যই তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে কিন্তু রূপমের মনের সংশয় কিছুতেই কাটছে না। ঠিক কী কারণে তার মনে সংশয় দানা বেঁধেছে তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। মাছের কাঁটা গলায় বিঁধে থাকলে যে খচখচ ধরনের ব্যথা উপলব্ধ হয়, রূপমের মনের অবস্থা এখন ঠিক তেমনি। যেন সবকিছুই ঠিক আছে কিন্তু কিছুই ঠিক নেই। এসব চিন্তা করতে করতে মাথার যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে ফেলেছে সে। বালিশে হেলান দিয়ে আনমনে ভাবতে থাকে মীরার কথা। মেয়েটা এত নারাজ কেন তার প্রতি? মীরার এক পৃথিবী অভিমান কেন শুধু রূপমকে ঘিরেই? একটুও কি ভালোবাসা যায় না রূপমকে? নাকি ভালোবাসার যোগ্যই নয় সে? রূপমের বেখেয়ালি মন ধারণা করে নেয় মীরার উত্তর হবে, রূপমকে ভালোবাসা যায় না। সে ভালোবাসার যোগ্যই নয়।

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here