সে এক মনগড়া প্রেমকাব্য পর্ব -০৭

#সে_এক_মনগড়া_প্রেমকাব্য
৭ম_পর্ব
~মিহি

সকাল থেকে প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে। ঠিক কী কারণে অস্বস্তি হচ্ছে নিজেও বুঝে উঠতে পারছিনা। ঘুমোনোর আগে আর অভিকে জানানো হয়নি। আমার আর ইচ্ছে নেই কারো প্রতি মায়া বাড়ানোর। শ্রাবণ কেন আমায় প্রতারণা করলো সেটা ভাবতেই আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। নিজেকে এইমুহূর্তে পৃথিবীর চরমতম বিষণ্ণ মানুষ মনে হচ্ছে তবে আমি জানি তা মিথ্যে। এমন অনেক মানুষ আছে যারা হাসির আড়ালে পাহাড়সম দুঃখ লুকিয়ে রাখতে সক্ষম। আসলে একটা কথা আমি সবসময় বিশ্বাস করি, তা হলো নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্য কারো মানসিক অবস্থা বোঝা কখনোই সম্ভব না। সে ক্ষমতা আমাদের সৃষ্টিকর্তা দেননি তবুও আমরা প্রতিনিয়ত মানুষদের নিজের আঙ্গিকে অনুধাবন করি। কারো পায়ের শব্দ পেতেই চোখ মুছলাম। আমি চাইনা নতুন করে আমার চোখের পানি কারো নজরে আসুক।

খালামণি এলেন আমার ঘরে। হাতে থাকা ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

– “তোর কাকা কল করেছে বাড়ির নম্বরে। অন্য কেউ ধরলে হয়তো কথাই বলতে দিত না। আমি আমার নম্বর থেকে কল দিলাম আবার, এখন তুই কথা বল।”

– “আচ্ছা খালামণি।”

– “তুই কি কাঁদছিলি?”

– “না..তো।”

– “আচ্ছা বেশ!”

খালামণি সব বুঝেও চলে গেল তা আমি বেশ বুঝেছি। কাকাকে সালাম দিলাম। অপর পাশ থেকে তার বেশ ক্ষীণ ও চিন্তিত জবাবে আমি বেশ দুশ্চিন্তায় পড়লাম। বাড়িতে আবার কোনো ঝামেলা হলো না তো? এখন তো সবদিক থেকেই দুশ্চিন্তার খবরগুলোই এসে আমার ঝুড়িতে পড়ছে।

– “কী হয়েছে কাকা? কোনো সমস্যা হয়েছে কি বাড়িতে?”

– “না রে মা। তো..তোর ওখানে থাকতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে নাকি? হলে আমায় বল। কেউ বিরক্ত করছে না তো?”

– “না কাকা। আমি তো বাড়ি থেকেই বের হই না, বিরক্ত আবার কে করবে!”

– “ও মা সে কী! তোর কলেজ?”

– “ঐ আশা ছেড়েছি আমি কাকা। তুমি বলো, বাড়ির সবাই ভালো আছে? দাদামশাই কই? তাকে দাও তো, কথা বলি।”

– “আমি তো বাড়িতে নেই, ব্যবসার কাজে বাইরে এসেছি একটু। আমি বরং বাড়িতে গিয়ে বাবার সাথে তোর কথা বলাবো।”

– “না থাক, কাকা। খালামণিকে ফোন দিয়ে এসে আমি ঘুমাবো আর তুমিও এত রাতে বাইরে থেকো না। শুভ রাত্রি।”

– “শুভ রাত্রি।”

কল কাটলাম। খালামণির ওয়ালপেপারে জ্বলজ্বল করছে তার এবং খালুর একটা ছবি। দুজনে খোলা মাঠে বসে প্রাণখুলে হাসছে। কী মনে করে যেন আমার একটু কৌতূহল হলো। অভির দেওয়া ফোনটার গ্যালারিতে আমি এখনো ঢুকিনি কিন্তু এইমুহূর্তে কী ভেবে গ্যালারি ঘাটতে ইচ্ছে হচ্ছে তা আমার নিজেরও জানা নেই। খালামণির কাছে ফোনটা দিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালাম। অভির ওয়ালপেপারে তার নিজের কোনো ছবি নেই, একটা হার্টবিটের ছবি। ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো অকারণবশত। কৌতূহলী মন তীক্ষ্ম চোখকে সঙ্গী করে পাড়ি জমালো গ্যালারিতে। নাহ! একটাও ছবি নেই। অদ্ভুত তো, অবশ্য ছবি থাকলে নিশ্চয়ই ফোনটা আমাকে দিত না। হয়তো ব্যবহার করে না বলেই আমাকে দিয়েছে ফোনটা। ফেসবুক নামক নীল জগতটাকে আমি তখনো তেমন চিনতাম না, টুকটাক শুনেছি তার কথা। কৌতূহলবশত ফেসবুকে ঢুঁ মারার চেষ্টা করতে গিয়েই দেখলাম অভির আইডি লগইন করা। চোখ আটকে গেল প্রোফাইলে। কালো রঙের একটা শার্ট পড়ে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে অভি। ইশস! ভাব দেখে বাঁচিনা। ছবিটাতে ক্লিক করে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম। অভির হাসি! অদ্ভুত সুন্দর তো, আমি কি আগে খেয়াল করেছিলাম এ হাসিটা? অনেকক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকলাম ছবিটা। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। ফোন হাতে নিয়ে কল করলাম অভির নম্বরে। ঘড়ির কাঁটায় বারোটা পেরিয়েছে। খালামণি একবার বলেছিল অভি নাকি খুব ঘুমকাতুরে। সরাসরি আমাকে বলেনি, খালুর সাথে গল্প করছিল আর আমি শুনেছিলাম। তাহলে তো অভিকে বেশ ভালোই জ্বালানো যাবে। রাত বাজে সাড়ে বারোটা আর আমি কিনা আমার চেয়ে সাত বছরের বড় একজন মানুষকে ফোন করে জ্বালাবো? অভদ্রতা হচ্ছে না তো ব্যাপারটা? হলে হোক, মাঝেমধ্যে নিজের আত্মিক শান্তির জন্য অনেক কিছুই করা যায়। অভির নম্বরে কল দিলাম। রিং হলো বেশ কয়েকবার, অভি ধরলো না। কী কুম্ভকর্ণের ঘুম! আবারো কল দিলাম। কলটা রিসিভ হলো। ঘুমঘুম কণ্ঠে অপর পাশ থেকে শব্দ এলো, “হ্যালো।” আগেই বলেছিলাম অভির কণ্ঠ মোলায়েম, এবার বোধহয় আমিই গলে গেলাম তার কণ্ঠের কাছে।

– “ঘুমোচ্ছিলেন নাকি?”

– “বাঙালির এই এক সমস্যা, ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞাসা করবে ঘুমাচ্ছিলেন নাকি। বাহ!”

– “ওহ আচ্ছা, তাহলে কি রাখবো?”

– “না। মহারানি যখন এত রাতে আমায় কল দিয়েছে, তার জন্য আমি সামান্য ঘুম বিসর্জন দিতে পারবো না? বলো কী বলবে।”

– “না, তেমন কিছু না। এমনিই কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল।”

– “কাল ঘুরতে যাবে আমার সাথে?”

– “হঠাৎ এই কথা?”

– “আমায় লাইন মারছিলে তো, তাই সরাসরি অফার করলাম।”

– “তুমি প্রচণ্ড রকমের বেহায়া, অভি।”

– “ওয়েট অ্যা মিনিট! আমি নির্ঘাত স্বপ্ন দেখতেছি। তুমি আমায় নাম ধরে ডাকলা? তাও তুমি করে? সত্যিই? কেউ চিমটি কাটো আমাকে।”

– “ইশস! ঢঙ দেখে বাঁচিনা।”

– “আমারটা ঢঙ আর আপনি যে মাঝরাতে কল দিয়ে, আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে আহ্লাদিপনা করছেন, সেটা কী?”

– “কিছুনা, রাখেন।”

– “কাল ঘুরতে যাবা নাকি সেটা বলো।”

– “আমার বাইরে যাওয়া মানা।”

– “তৈরি থেকো, নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমার।”

– “কিন্তু …টুট টুট টুট… ”

কল কেটে গেল। ছেলেটা তো খুব বেয়াদব! কথা শেষ না হতেই কল কেটে দিল। কাল যে আমায় নিয়ে যেতে চাইলো, মানা করবো কি? হ্যাঁ, মানাই করে দিই। আবারো ডায়াল করলাম নম্বরটাতে, সুইচড অফ বলছে। এত ঘুমকাতুরে মানুষও হয়? আমি যাতে আর না জ্বালাই সেজন্য সুইচড অফ করে রেখেছে, বাহ! তোর ঘুমের বারোটা বাজুক, শালা! নিজের কথা শুনে নিজেরই হাসি লাগলো। ফোনটা নিয়ে বিছানায় বসলাম। বালিশে হেলান দিয়ে আনমনে অভির ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি কি আবারো ভুল করছি? শ্রাবণের প্রেমে পড়ার মতো দ্বিতীয় বড়সড় কোনো ভুল?

_________________________

– “তনয়, আমার দলের কেউ যেন কিছুই না জানে। আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমি রাজনীতি টানতে চাই না। ওরা আমার খোঁজ নিতে আসলে তুই বলবি আমি কাজের জন্য বাইরে গেছি, তোকে কল করে সব বলেছিলাম।”

– “কিন্তু সামনেই ইলেকশন। ওরা উতলা হয়ে আছে। দেখ তুই মীরার চিন্তা বাদ দে। ঐ মেয়ের বাপের চরিত্র ঠিক নাই। ঐও তো তারই মেয়ে। ওর চরিত্রে দাগ নাই কেমন শিউর তুই?”

– “মীরার ভুলটা মীরা এখনো বুঝছে না রে। ও শ্রাবণকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল আর হুট করেই কাউকে ভোলা যায় না সে যতই খারাপ হোক না কেন। এই মুহূর্তে আমি ওর পাশে থাকলেই ও স্বাভাবিক হবে দেখিস।”

– “ওর জীবনে এ ক’দিনে নতুন কেউ আসেনি তা তুই জানিস?”

– “আসলে আসুক, আমি তো শুধু স্যাক্রিফাইসই করে গেলাম মীরার খুশির জন্য। যদি কেউ এসেও থাকে, আবারো দূরে সরে যাবো। দূর থেকে ভালোবাসার অতৃপ্তিটাও অন্যরকম সুন্দর। যে অনুভব করে, সে ঠিক বোঝে।”

– “তুই কি ধারণা করতে পারছিস তুই মীরার জন্য ঠিক কতটা পাগল হয়ে যাচ্ছিস? আঙ্কেল-আন্টির সাথে তোর আগে থেকেই যে দূরত্ব, এখন যদি তারা এসব জানে তাহলে তোদের ফ্যামিলিতেও ঝামেলা শুরু হবে। বোঝার চেষ্টা কর, রূপম।”

– “কেন তনয়? সবসময় আমাকেই কেন বুঝতে হবে? আমাকে কেউ বুঝেছে কোনকালে? আমি আজীবন ঐ তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্কের মতো রয়ে গেলাম যাকে কেউ কখনো স্বেচ্ছায় বোঝার চেষ্টাই করে না।”

– “তুই শান্ত হ তো এবার। বস, আমি পানি আনছি।”

রূপম বসে ঠিকই কিন্তু কিছুতেই শান্ত হতে পারে না। মনের শান্তি না থাকলে কী আর মানুষ শান্ত হতে পারে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here