প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প পর্ব -১০

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|১০|

ফেব্রুয়ারির শীতল সকাল। বাতাসে কুয়াশা মাখানো ঠান্ডা স্পর্শ। হালকা করে বেঁধে রাখা চুলগুলো খুলে গিয়ে শা শা করে উড়ছে। তার থেকেও আদর নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে আমার অদ্ভুত অনুভূতির দল। রেললাইনের পাশটাতে ওই উশৃংখল ছেলেদের দল। মোড়ের কাছের বাড়িটির নুইয়ে পড়া জবাফুলের গাছ। মুক্ত আকাশে ক্লান্তি ঢেলে উড়ে যাওয়া ওই ছোট্ট আদুরে পাখি। আর এই রিক্সার নিরন্তর ছুটে চলা। সবকিছুতেই যেন ভরে আছে আজ অস্থির, দমবন্ধ অনুভূতি। বুকের ভেতর আলতো গুদগুদি হচ্ছে। একদম অযথায় লজ্জারাঙা হয়ে যাচ্ছে ঠোঁট। আমি চোখ তুলে চাইতে পারছি না। ঠোঁটের লজ্জাভাব লুকোতে পারছি না। বুকের ভেতর চঞ্চল তুলতুলে ভাবটাকে আটকে রাখতে পারছি না। প্রিয়তার অযথা কথাগুলো শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। ওড়নার আঁচলে মুখ ঢেকে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে পৃথিবীর সুপ্ত কোনো গহ্বরে। বরফ শীতল শব্দহীন কোনো হিমাগারে। যেখানে কেউ থাকবে না। চোখ তুলে চাইবে না। চাপা হাসবে না। শুধু থাকবো আমি আর আমার বুকভর্তি সহ্যহীন লজ্জা। উফ! সে কি অসহ্যকর লজ্জা! আমার এই দুঃসহ লজ্জার মাঝেই গন্তব্যে পৌঁছালাম আমরা। ঠিক তার পরপরই আমাদের পেছনে এসে থামলো ধ্রুবদের রিক্সাটা। আমি মুখ নিচু করে নেমে দাঁড়ালাম। আমার অ-শ্বশুর মশাই রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে গুরুগম্ভীর পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। ভারি একটা ব্যাগ হাতে আবিরও গেল তাঁর পিছু পিছু। ধ্রুব নামল সবচেয়ে আলস্য ভরে। আমি প্রিয়তাকে চোখ রাঙিয়ে তাড়া দিয়েই নিজেদের ব্যাগটা হাতে তুলে সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। যেভাবেই হোক ধ্রুবর আগে ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে হবে। কিছুতেই এই অসভ্য লোকটির মুখোমুখি হওয়া যাবে না। লোকটা দুর্দান্ত বদ। আর যায় হোক, লজ্জায় লাল, নীল হয়ে এই বদ লোকের সামনে যাওয়া চলবে না। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। আমার ভাগ্যটাকে শিলনোড়া দিয়ে পিষে ফেলে এগিয়ে এলো প্রিয়তা। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল,

‘ এই সাত সকালে হঠাৎ এমন লজ্জায় মরে যাচ্ছিস কেন নিশু? তোকে দেখে মনে হচ্ছে, তুই বাসর ঘরে বসে আছিস। আর তোর বর অতি অবশ্যই তোকে খুব দুষ্টু দুষ্টু কথা বলছে। কাহিনি কী জান?’

আমি অসহায় চোখে চাইলাম। প্রিয়তার ঠিক পেছনেই ব্যাগ হাতে ধ্রুবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটে গিয়ে সাত তলা থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো। ‘ভুল সময়ে ভুল কথা বলা’ প্রিয়তাকে কঠিন দুটো চড় বসিয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে বেদুইন হয়ে যেতে ইচ্ছে হলো। আমি নিরুপায় চোখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ধ্রুবর ঠোঁটে তখন অসহ্যকর চাপা হাসি। চোখদুটোতে চকচকে কৌতুক। নিজের এই করুণ পরিণতিতে আমার নির্দোষ অসহায় মন হাহাকার করে উঠে বলল, ‘ হোয়াই মি, বিধাতা? হোয়াই মি?’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কোমল মানসম্মানের ভয়াবহ পেষণটা হজম করে গম্ভীর মুখে সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। আবির দু’তলার গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলো। আমাকে উপরে উঠতে দেখেই টলমলে সমবেদনা জানিয়ে বলল,

‘ থাক, ভাবী। মন খারাপ করে না। আমরা সবাই ভেবে নিবো তুমি একদম লজ্জা পাচ্ছো না। কেউ তোমাকে দুষ্টু দুষ্টু কথাও বলছে না। কুল।’

আমি ‘কুল’ হতে পারলাম না। ঠোঁট ফুলিয়ে করুণ চোখে চাইলাম। প্রিয়তা নির্দোষ চোখে সমবেদনা জানালেও। ধ্রুব গলায় শব্দ করে হেসে উঠল। আমি মনে মনে নিজেকে কঠিন কিছু গালি দিয়ে আগুন চোখে চাইতেই ঠোঁটদুটো চেপে গা জ্বালানো হাসি হাসল ধ্রুব। হাত বাড়িয়ে আমার হাতের ভারি ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে চাপা বিদ্রুপের কন্ঠে বলল,

‘ ইট’স ওকে নিশু। আমরা কেউ বুঝিনি যে তুমি লজ্জা পাচ্ছো।’

আমি জ্বলন্ত চোখে চাইলাম। রুক্ষ কন্ঠে বললাম,

‘ আপনি হাসছেন কেন?’

ধ্রুব উত্তর দিলো না। আমার যেখানে শূন্য হাতেই হাঁফ ধরা অবস্থা। সেখানে দুই হাতে দুটো ভারি ব্যাগ নিয়ে অবলীলায় এক এক করে চারতলায় উঠে এলো ধ্রুব। নিঃশ্বাসে কোনো ক্লান্তি নেই। চোখদুটোতে টলমলে কৌতুক। আমাদের দরজার সামনে ব্যাগটা রেখে আমার দিকে চাইল। তার চোখে মুখে এখনও চাপা হাসির স্পর্শ। আমি তেজ নিয়ে বললাম,

‘ আপনি আবার হাসছেন!’

ধ্রুবর হাসি এবার চওড়া হলো। ঠোঁটের কোণে জ্বালাময় হাসি ল্যাপ্টে রেখে আমার মুখটা ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে দিয়ে বলল,

‘ আমাকে দেখে এমন লজ্জায় গলে যাওয়ার কারণ কী, ম্যাডাম?’

আমি হতভম্ব চোখে চাইলাম। একটা মানুষ কতটা বদ হলে মুখের উপর এমন একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারে তা বহু ভেবেও খুঁজে পাওয়া গেলো না। বুকের ভেতর বন্দী থাকা করুণ মনটা দেয়ালে মাথা ঠুকে সন্ন্যাস নেওয়ার আয়োজন করলো। ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে কেঁদে ফেলার জোগার হলেও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মুখের উপর দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে থমথমে কন্ঠে বললাম,

‘ বাজে কথা।’

দুপুর দিকে বাজার গোছাতে এসে মাছ দেখে চোখ কপালে তুললেন জমিলা আপা। আশ্চর্য হয়ে বলল,

‘ আজকে কী এই মাছ ছাড়া বাজারে কোনো মাছ উঠে নাই? উপরতলার খালাম্মাদেরও এই মাছই গুছাইয়া রাইখা আইলাম।’

জামিলা আপার মন্তব্যে মৃদু কেশে উঠলাম আমি। মাছটা নিয়ে মনের ভেতর কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগল। চেনা নেই জানা নেই এমন কারো থেকে এভাবে কিছু নেওয়া সম্ভব? কী ভাবলো তারা? কী মনে করেই বা দিলো এগুলো? আমার মনের খুঁতখুঁতে ভাবটা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। মাছগুলো এখন আর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় ভেবে আরও বেশি ছটফট করে উঠলো বুক। প্রিয়তাকে ডেকে বলতেই বিস্ময় নিয়ে চাইলো প্রিয়তা। পরমুহূর্তেই কৌতুক হেসে বলল,

‘ আরে ধুর! শ্বশুর বাড়ির জিনিস না? তোর বরই তো দিলো। চিন্তা কী?’

আমি কঠিন চোখে চাইলাম। ধমক দিয়ে বললাম,

‘ একদম শ্বশুর বাড়ি শ্বশুর বাড়ি করবি না। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি ওর সাথে দশ বছর যাবৎ সংসার করছি। আজ হঠাৎ সে মাছ কিনে দিয়েছে। চাইলে গোটা মাছের বাজারটাও কিনে দিতে পারে।’

প্রিয়তা উৎসাহ নিয়ে চাইলো। খুশি হয়ে বলল,

‘ চাইলে কিন্তু পারে। হিসেব করে দেখ, তোর শ্বশুরের কিন্তু বেশ ভালোই টাকা। একবার চিন্তা কর! আমরাই মাসে মাসে দশ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিচ্ছি। প্রতি ফ্লোরে যদি দুটো করে ফ্ল্যাট হয় তবে মাসিক ভাড়ায় আসছে এক লক্ষ টাকা। সামনের ছয় তলা বিল্ডিংটাও নাকি তাদের। হে খোদা! ভাবতে পারছিস?’

আমি উত্তর দিলাম না। প্রিয়তা হাহাকার করে উঠে বলল,

‘ এদের মাসিক টাকার হিসেব করে তো আমারই মাথা চক্কর দিচ্ছে, বন্ধু। দুনিয়া ঘুরছে। এরা মাসে মাসে এতো টাকা করে কী? হায় আল্লাহ! হে খোদা! হে বিধাতা! আমাকে দিয়ে দিতে পারে না?’

আমি ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেললাম। প্রিয়তার কথায় আকাশসম বিরক্ত হয়ে চিরচিরে মেজাজ নিয়ে ধ্রুবকে ফোন লাগালাম। কেউ টাকার বস্তা নিয়ে বসে থাকলেও তার থেকে বিনা পয়সায় মাছ নিয়ে খেয়ে ফেলব তা তো হতে পারে না। কক্ষনো না। আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলাম। দুইবারের মাথায় ফোন রিসিভ হলো। আমি কিছু বলার আগেই বলল,

‘ তুমি চকলেট?’

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ওপাশ থেকে বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠটা খুব আদর নিয়ে বলল,

‘ আমি চকলেট। তুমি চকলেট নিয়ে আসো। একটা পিও পিও গাড়ি নিয়ে আসবা। ছোট বাইয়া আমাকে… আমাকে….আমাকে এমন জোর-রে আছাড় মারছে। ছাদ থেকে ফেলে দিবে। তুমি ওকে মারবা।’

আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। চিরচিরে মেজাজটা হঠাৎ উৎফুল্লতায় ভরে উঠল। আলতো হেসে বললাম,

‘ তোমার বড় ভাইয়া কোথায় চিওমিও?’

চিওমিও থেমে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে ভারি অবাক হয়ে বড় ভাইয়াকে ডাকল। ধ্রুব বোধহয় ঘুমুচ্ছিল ভাইয়ের ডাকাডাকিতে সাড়া দিতেই চিওমিওয়ের বিস্মিত কন্ঠে ভেসে এলো,

‘ এখানে মেয়ে কতা কয়। বাবা নাই। আতা গাছে তোতাপাখি। ডালিম গাছে মউ। তুমি.. তুমি বউ?’

চিওমিও কার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম আমি। সেকেন্ড কয়েক পারিপার্শ্বিক শব্দের পর ধ্রুবর ঘুমু ঘুমু গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো। ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলছে,

‘ আবির যাও। আবির ডাকে।’

‘ আবির যাব না। আবির মারে।’

‘ আর মারবে না। মা যাও। দেখে আসো, বাবা এসেছে।’

তারপর কয়েক সেকেন্ড চপল পায়ের শব্দ। আমি চুপ করে রইলাম। চঞ্চল পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যেতেই ধ্রুব অদ্ভুত কৃতিত্বের স্বরে বলল,

‘ বলো।’

আমি চোখ ছোট ছোট করে চাইলাম। এই লোক বরাবরই এমন অদ্ভুত উষ্ণ কন্ঠে কথা বলে কেন? যেন কত দীর্ঘ এই পরিচিতির ব্যপ্তি। কত লম্বা এই সাংসারিক জীবন। কত ছোটখাটো অভিযোগ তাকে জানানো বাকি। আর সে উষ্ণ গলায় ঢেলে দিচ্ছে তারই আহ্বান। গম্ভীর প্রশ্রয়। আমি থমথমে কন্ঠে বললাম,

‘ মাছের দাম কত?’

ধ্রুব বুঝতে না পেরে বলল,

‘ কীসের মাছ?’

‘ আজ সকালে যে মাছ কিনলেন সেটা।’

ধ্রুব অবাক হয়ে বলল,

‘ কেন?’

আমি একটু থেমে অপ্রস্তুত কন্ঠে বললাম,

‘ আপনাদের মাছের একটা পুঁটলি আমাদের ব্যাগেও এসেছে। সেটা ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়৷ তাই দামটা বললে সুবিধা হতো….. ‘

বাক্যটা কীভাবে শেষ করব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। ধ্রুব স্বভাবজাত গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ মাছটা বাবা কিনেছেন। বাবাকে জিজ্ঞেস করো। আমাকে ফোন করেছ কেন?’

আমি একটু হোঁচট খেলাম। বললাম,

‘ আপনার বাবার নাম্বার তো আমার কাছে নেই ধ্রুব।’

‘ আচ্ছা। আমি পাঠাচ্ছি নাম্বার। ফোন করে জেনে নাও।’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

‘ মাছের পুঁটলিটা তো আপনার বাবা আমাদের ব্যাগে চালান করেনি ধ্রুব। যে চালান করেছে উত্তরটা তার কাছেই চাওয়া উচিত নয়?’

ধ্রুব বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে বলল,

‘ না। উচিত নয়। সকালে বাবার সামনে ওভাবে দেখা হওয়াও উচিত ছিল না। এখন আমায় ফোন করেও উচিত কাজ করোনি। কাল রাতে মানা করেছিলাম তোমায়।’

আমি ভয়াবহ এক ধাক্কা খেলাম। অপমানে জ্বলে উঠল বুক। থমথমে কন্ঠে বললাম,

‘ আমি শখ করে আপনার সাথে দেখা করতে যাইনি ধ্রুব। ইট জাস্ট হ্যাপেন্ড।’

ধ্রুবর স্বাভাবিক অথচ শীতল উত্তর,

‘ সেটা তুমি আর আমি জানি নিশু। বাবা জানেন না।’

তারপর একটু থেমে হাসিমুখে শুধাল,

‘ যায়হোক, তোমরা কবে শিফট হচ্ছো? কোনো প্রয়োজন হলে ইউ ক্যান আস্ক আবির৷ ও হেল্প করবে।’

ধ্রুবর শীতল বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। তার আকস্মিক পরিবর্তনে অবাক হলাম। হাসিমুখে বিষ ঢেলে দেওয়ার মতো শোনাল তার কথা। আত্মসম্মানের জ্বালাপোড়নটা সয়ে নিয়ে শক্ত কন্ঠে বললাম,

‘ থেংক্স বাট নো নিড।’

#চলবে….

[ রি-চেইক করা হয়নি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here