#প্রেমের_জোয়ার_ভাটা
#অন্তিম_পর্ব
#অধির_রায়
বিষণ্নতা ঘিরে রেখেছে প্রতিটি মানুষকে৷ কাউকে কেউ নিজে থেকে মুক্তি দিতে পারছে না৷ অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে প্রতিটি মানুষকে৷ আসক্তি থেকে বের হতে পারছে না৷ আরুশ নিকোটিনের ধোঁয়া আকাশ প্রাণে উঠিয়ে রাত পার করে দেয়৷ এতোদিন পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে মীরার কাছে ছুটে গেছিল আরুশ৷ মীরা আরুশকে ফিরিয়ে দিছে৷ এইতো আরুশ অফিসে বসে কাজ করছিল৷ তখন অফিসের কলিগ ঋতুর সাথে আরুশের দেখা৷ আরুশ ঋতুকে না চিনলেও ঋতু আরুশকে দেখেই চিনে ফেলে। ঋতু আরুশের অফিসেই কাজ করে প্রায় তিনমাস থেকে৷ আজ জানতে পারে আরুশই তাদের বস৷ মীরা সম্মানের সাথে বলল,
“স্যার মীরা কেমন আছে? মীরার সাথে আর কোন কথা হয়না৷ ফাইনাল পরীক্ষাও কমপ্লিট করল না৷ আমি মীরার ক্লাসমেট।”
মীরার কথা শুনে বুকের শূন্যতা হাহা করে উঠল৷ চিনচিন অসহ্য ব্যথা শুরু হয়েছে৷ মীরাকে ভুলার অনেক চেষ্টা করেছে৷ মীরা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়ায় ভুলা যায়না। আরুশ মুচকি হেঁসে বলল,
“মীরার সাথে আমার যোগাযোগ নেই৷ আমাদের ডিভোর্স হয়েছে৷”
ঋতু মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল৷ ঋতু উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“মীরা এমন কাজ করতে পারে না৷ মীরা আপনাকে পা’গ’লের মতো ভালোবাসে৷ মনে হয় আপনাদের মাঝে কোন ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে৷”
“কোন ভুল হয়নি৷ আমার কাছে মীরার রুপ ফুটে উঠেছে। প্রমাণ হিসেবে সেদিনের সেই ভিডিও ক্লিপ এখনও আছে৷ যেখানে মীরা নিজে বলেছে আমাকে হ*ত্যা করে জনিকে বিয়ে করবে?”
ঋতু মাথায় হাত দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“অনেক বড় ভুল৷ ভার্সিটিতে জনি মীরাকে খুব পছন্দ করত৷ সেদিন মীরা পরীক্ষার অয়নের সাথে কথা বলছিল৷ জনি সেটা পিছন থেকে ভিডিও করে৷ সবগুলো ভয়েস জনি নিজেই এড করে আপনার মা আয়াত চৌধুরীর কাছে পাঠান৷ আমি একথা জানতাম৷ কিন্তু কাউকে বলার সুযোগ পাইনি৷ কারণ জনি বলেছিল আমি বললে আমার ছেলেকে মে*রে ফেলব৷”
ঋতু আর কিছু বলতে পারল না৷ ঋতুর কান্নায় ভেঙে পড়ল৷ বুঝতে অসুবিধা হয়নি মীরার জীবনে কি ঝড় বয়ে গেছে৷ আরুশের চোখে মুখে রাগের ছাপ ফুটিয়ে উঠে৷ সামান্য একটা ভিডিওকে কেন্দ্র করে তাদের জীবনের ইতি টানছে৷ ডেক্সের উপর রাখা সকল ফাইল ছুঁড়ে ফেলে দেয়৷ ঋতু ভয় পেয়ে যায়। এই বুঝি তার জীবনের শেষ দিন৷ ঋতু অসহায় দৃষ্টিতে আরুশের দিকে তাকায়৷ আরুশ অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে পড়ে আকন্দপুরে৷
_____
আরুশের মা রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল,
“নিকোটিনের ধোঁয়া উঠিয়ে কি প্রমাণ করতে চাও? আমাদের তো শাস্তি পেতেই হবে৷ আমরা কিছু না জেনেই মীরাকে কতো কষ্ট দিছি৷ সৃষ্টি কর্তা আমাদের কৃতকর্মের ফল ফিরিয়ে দিয়েছেন৷”
আরুশ সিগারেট আগুন নিবিয়ে মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়৷ মা ছেলের নয়ন দ্বয় ছলছল করছে৷ দু’জনের মাঝে অপরাধবোধ কাজ করছে৷ মায়ের কোলে মাথা রেখে ছোট বাচ্চার মতো কান্না শুরু করে দেয়৷ ভেজা গলায় শুধালো,
“মা আমি কি আর মীরাকে ফিরে পাব না? আমার মেয়ে আরুকে আর দেখতে পাব না৷ আমি আবারও চাই মীরা, আরুকে নিয়ে থাকতে।”
আয়াত চৌধুরী কি বলবে বুঝতে পারছেন না৷ তিনিও ছেলেকে সুখী দেখতে চান৷ মীরার স্মৃতি ছেলেকে নেশায় পরিণত করেছে৷ মীরার একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য চাকত পাখির মতো আকাশের প্রাণে চেয়ে আছে৷ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমরা সবাই আকন্দপুরে যাব আজ৷ মীরার কাছে আমাদের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইব৷ আমি জানি মীরা কখনও আমাদের ফিরিয়ে দিবে না৷ আরুর জন্য হলেও মীরা আমাদের মেনে নিবে৷”
__________
মীরা আর ইহান বাড়ির পাশেই স্কুল খুলেছে৷ গ্রামের মানুষজন এখন বুঝতে পারছেন জীবনে বড় হতে গেলে লেখাপড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ প্লে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মীরাদের স্কুল৷ স্কুলের নাম আকন্দপুর মডেল স্কুল৷ মীরা ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত দেহ নিয়ে বাড়িতে ফিরে৷ আরুর কপালে ওষ্ঠ স্পর্শ করে বলল,
“মামুনি যাও ফ্রেশ হয়ে নাও৷ আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি৷”
আরু মাথা হেলিয়ে চলে যায়৷ ক্লান্ত দেহ নিয়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ায় মীরা৷ খাবার নিয়ে মেয়েকে খাইয়ে দিল৷ সারারাত ঘুমাতে পারিনি কান্নার জন্য৷ বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখে তন্দ্রা চলে আসে৷ চিৎকারের আওয়াজে তন্দ্রা বেড়ে যায়৷ ইহান আর আরুশের গলার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে বাহিরে আসে৷ ইহান আরুশকে এলোপাতাড়িভাবে লাহাড়ি ঘরের সামনে মা”রছে৷ মীরা দৌড়ে এসে ইহানকে আটকায়৷ রাগী কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া পা*গল হয়ে গেছো৷ এসব কি করছো? তুমি আরুশের একটা টুকাও দিবে না৷”
ইহান কর্কশ গলায় জবাব দিল,
“মীরা তুই বেইমানের জন্য আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস? তার জন্য আমাদের বন্ধুত্বের ফাটল ঘটেছে৷ আমাকে সবার সামনে অপমান করেছে৷ রঙ্গন সাদাফ আমাকে এখন দেখতে পারে না৷ তোর লাইফটা নষ্ট করে দিছে৷ তবুও তুই তার হয়ে কথা বলছিস?”
মীরা কিছু বলার আগেই আরুশ বলে উঠল,
“ইহান তোর যত ইচ্ছা আমাকে মা/র/তে পারিস৷ আমাকে আঘাত করে যদি তোর ভালো হয় আমাকে আঘাত কর৷ আমি আমার শাস্তি মাথা পেতে নিব৷”
“ইচ্ছা করছে তোকে খু*ন করে নদীতে ভাসিয়ে দিতে৷ কিন্তু আমি তোর মতো খারাপ নয়৷ মানুষের মনকে বিষিয়ে দেওয়া৷ কাউকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেওয়া তোর কাজ৷ এগুলো আমার কাজ নয়৷”
আরুশ কিছু বলতে নিবে তার আগেই ইহান সেখান থেকে প্রস্থান করে। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে৷ আরুশ তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু ছিল৷ সেই আরুশকে একটুও সহ্য করতে পারে না৷ নদীরে ধারে এসে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল৷ মীরার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আরুশ৷ আরু মায়ের ওড়না ধরে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে৷ পবিত্র শিশু মনটা বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে৷ নীরবে কেঁদে যাচ্ছে বুকের অনুভূতি। আয়াত চৌধুরী মীরার হাত ধরে বললেন,
“মীরা আমাদের সাথে ঢাকায় চলো৷ আমাদের আর শাস্তি দিও না৷ আমরা প্রতিটি মুহুর্তে অগ্নিতে দাহ হচ্ছি৷ আমাকে আর শাস্তি দিও না৷”
আয়াত চৌধুরীর স্নেহময় কথাগুলো মীরার হৃদয়কে ব্যথিত করল৷ কিন্তু মুখে চরম ঘৃণা অভিমান৷ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আপনার ছেলেকে এতো করে বলার পর আবার কেন আকন্দপুর এসেছে৷ আপনার ছেলে ভুলে গেছে আমাদের ডিভোর্সের কথা৷ ডিভোর্সের পর স্ত্রীর প্রতি কোন অধিকার থাকে না৷”
আয়াত চৌধুরী কি বলবেন বুঝতে পারছেন না৷ জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে৷ মীরার মনে আরুশের জন্য কোন অনুভূতি নেই৷ যা আছে শুধু ঘৃণা৷ আরুশ মীরার কাঁধ শক্ত করে ধরে বলল,
“সামান্য কাগজের উপর ডিপেন্ড করে কিছু হয়না৷ আমি মানিনা ডিভোর্স লেটারের কথা৷ তুমি আমার ছিলে আমার আছো আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুমি আমার থাকবে৷”
আরুশের কথাগুলো মীরার মনে প্রশান্তি নিয়ে আসে৷ তবুও হৃদয়ে পাথর চাপা রেখে ভালোবাসা সুপ্ত অবস্থায় রাখে৷ কঠিন রাগী গলায় বলল,
“আপনি এখান থেকে চলে যান৷ আমার জীবনে আরুশ নামের কোন কালো ছায়া আসতে পারবে না৷ যে ছায়া আমার জীবনকে নরগ বানিয়ে দিয়েছে৷ আমি আগের সবকিছু ভুলে মেয়েকে নিয়ে একা চলতে চাই৷ আপনি মা মেয়ের মাঝে আসার চেষ্টা করবেন না৷”
“মীরা তুমি চাওনা আরু বাবার ছায়াতলে বেড়ে উঠুক। সুন্দর একটা পরিবার তাকে উপহার দেওয়া আমাদের উচিত৷”
মীরা আরুশের কথা উপেক্ষা করে মীরার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মা আরুকে এখান থেকে নিয়ে যান৷ এখানে তাকে আসতে দিবেন না৷ আমি চাইনা শিশুর কোমল মনে কোন বাজে স্বভাব পড়ুক৷”
মীরার মা আরুকে নিয়ে যান৷ আরুশ বাঁধা দিতে গেলে আরুশের হাত ধরে নীরা আটকায়৷ আরুশ রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মীরার দিকে৷ মীরা মুচকি হেঁসে জবাব দিল,
“মি. আরুশ আইনের ব্যবস্থা নিয়েও আপনি কিছু করতে পারবেন না৷ কারণ আমি আইনের কাছ থেকে আরুকে নিজের করে রাখছি৷ আরুর জবাব সে তার মায়ের সাথে থাকবে৷ এখন আসতে পারেন৷”
আরুশ মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল৷ চোখের জল বাঁধ মানে না৷ তবুও এদিকে ওদিক তাকিয়ে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল৷ তাতেও কোন কাজ হলো না৷ আয়াত চৌধুরী সদূরে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে যাচ্ছেন৷ মীরা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“আমি ভালোভাবে বলছি এখান থেকে চলে যেতে৷ আপনি না গেলে গ্রামের লোকজন আপনাকে মে/রে ফেলবে৷”
“আমি কাউকে পরোয়া করিনা৷ তোমাকে না নিয়ে আমি কোথাও যাব না৷ যেতে হলে এই বাড়ি থেকে আমার মৃত দেহ যাবে৷”
“আপনি সীমা লঙ্ঘন করলে মা মেয়ে একসাথে মা/রা যাব৷ কোনদিন আমাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন না৷ শুধু জেনে রাখবেন আপনার জন্য আপনি সবকিছু হারিয়েছেন৷ যদি মেয়ের প্রতি সামান্য ভালোবাসা থাকে তাহলে চলে যান৷ জীবনের প্রতি আমার মায়া উঠে গেছে৷”
“আমায় মে*রে ফেলে তোমার প্রতিশোধ নাও৷ তাবুও আমায় ফিরিয়ে দিও না৷ তুমি হীনা আমি দগ্ধে দগ্ধে মা/রা যাচ্ছি৷”
“আপনার বাঁচা ম/রা নিয়ে আমার কোন আসে যায় না৷ শেষ বারের মতো বলছি আমার সামনে থেকে চলে যান৷ যদি না যান তাহলে মেয়ের মৃত দেহ দেখার জন্য প্রস্তুত হোন৷”
আরুশ মীরার দিকে ছলছল নয়নে তাকায়৷ এই মীরাকে আরুশ চিনে না৷ ভেজা কান্নাজনিত কন্ঠে বলল,
“তোমার অপেক্ষায় থাকব৷ তোমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করব৷ এই নিয়ে বেঁচে থাকব আমার মীরা, আরু পৃথিবীর এক প্রান্তে আকন্দপুরে শ্বাস নিচ্ছে৷”
আয়াত চৌধুরী ছেলেকে টানতে টানতে নিয়ে যান৷ কেন মানুষের জীবনে ভালোবাসার জোয়ার আছে৷ আবার ভাটার মতো চলে যান৷ জোয়ার ভাটা কি এক স্রোতে বইয়ে পারে না৷ আরুশের গাড়ি অদৃশ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত মীরা এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে৷ অদৃশ্য হলেই ধপাস করে মাটিয়ে বসে পড়ে৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,
“আরুশ তুমি ফিরে এসো৷ নদীর জোয়ার ভাটা প্রকৃতির নিয়মে থাকবেই, আমাদের প্রেমে জোয়ার ভাটা দুইটায় আসবে৷ তবুও আমার এক হয়ে থাকব৷ ছিন্ন হতে দিব না এই বাঁধন।
সমাপ্ত…………….
পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ভালোবাসা রইল সবার প্রতি।