প্রেমের মরা জলে ডুবে পর্ব -১৫

#প্রেমের_মরা_জলে_ডুবে

#তানিয়া

পর্ব:১৫

শুভ্র তিমিরকে নিয়ে সেই লেকের পাড়ে বসে আছে যেখানে শুভ্র সময় কাটাতো।ব্যস্ততার তাগিদে এতদিন আসা হয় নি তাছাড়া শহরের কলেজে এসে আর উল্টো দিকে যেতে শুভ্রর ভালো লাগে না তবে আজ কিছু সত্যের মুখোমুখি হতে তার কাছে এ জায়গাটা বেস্ট মনে হয়েছে। তিমির শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে, তিমির জানে না শুভ্র তাকে কি বলবে শুধু এতটুকু জানে বাসায় গিয়ে সে তিমিরকে নিয়ে এসেছে।

ঘন্টাখানেক আগে,তিমির কল রাখতে শুভ্র শুভাকে ডেকে পাঠালো।শুভা আসতেই শুভ্র তিমিরের সব কাপড়চোপড় গুছিয়ে দেওয়ার কথা বললো৷শুভা আলমারি খুলে এক এক করে কাপড়গুলো বের করতেই হঠাৎ কিছু একটা পড়লো কাপড়ের ভাজ থেকে।
শুভ্র এগিয়ে গিয়ে মেঝে থেকে নিতেই শুভা ভয় পেয়ে গেলো। মনে মনে বকতে লাগলো তিমিরকে।এ জিনিসও মানুষ এভাবে রাখে,আবার দোষ দিলো নিজেকে তার অসাবধানতায় এ কাগজ শুভ্রর হাতে গিয়েছে। শুভ্র কাগজটার দিকে চেয়ে বিমূর্ত হয়ে গেলো। এ কাগজটা দেখে তিমিরের প্রতি যতটা স্নেহ ছিল তাও উবে গেলো যখন দেখলো কাগজে সবকিছু একদম তাদের বিয়ের জন্য পারফেক্ট হয়ে আছে। অথচ তাকে বলার সময় সবকিছু তুরফার নাম নিয়ে বলা হয়েছিল তাহলে এ কাগজে সব ডকুমেন্টস তিমিরের তথ্য অনুযায়ী কেনো?চট করে তার মাথা ধরে গেলো। ধপধপ করতে লাগলো কপালের শিরা।সে শুভার খাটে বসে চোখ বন্ধ করলো।শুভা বুঝলো তার ভাই এখন কি নিয়ে ভাবছে।শুভার ভয় লাগলো এ বিষয়ে সে কিছু বলবে কি বলবে না।সেদিনের পর থেকে সে আর ভাইয়ের সাথে সহজে কথা বলেনি।কারণ নীলের বিষয়টা তাদের তিনজন ছাড়া আর কেউ জানে না, মাকে শুভা ভয় পায় যদি শুভ্র বলে দে তাহলে তিমির শুভা দুজনের বিপদ তাই সে ভাই থেকে দূরে থেকেছে।কিন্তু এখন তাকে কিছু একটা বলতে হবে নাহলে তিমিরকে ভাইয়া ভুল বুঝবে

ভাইয়া তোমার কি হয়েছে?

শুভ্র চোখ খুলে শুভার দিকে তাকালো।

শুভা তিমির তো তোকে সব বলে এ কাগজ নিয়ে কিছু বলেছে?

ভাইয়া আমি সবটা পরিষ্কার জানি না তবে আমার মনে হয় তুমি তিমিরের সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলো প্লিজ,ওকে ভুল বুঝো না?

শুভ্রর চোখ দেখে শুভার গলা শুকিয়ে যায়।ঢোক গিয়ে কথাটা বলে শুভা

শুভ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাথে সাথে শুভাকে সব গুছাতে বলে নিজে তৈরি হতে চলে যায়। তিমিরদের বাসায় গিয়ে শুভ্র কবির সাহেবের সাথে কুশল বিনিময় শেষ করে শান্তাকে দেখতে যায়। কিছুক্ষণ শান্তার সাথে কথা বলে শুভ্র কবিরকে জানায় যে তিমিরের কিছু কাজ আছে তাই তিমিরকে নিয়ে সে বের হবে?কথাটা শুনে কবির সাহেব মনে মনে খুশি হলেন।তিনি তাদের যাওয়ার অনুমতি দিলেন।যেহেতু শান্তা অসুস্থ তাই শুভ্র বেশি সময় নিবে না চিন্তা করলো।তিমির জানে না তার কি কাজ আছে তবুও শুভ্রর কথা রাখতে সে শুভ্রর সাথে গেলো।শুভ্র তাকে এ লেকের ধারে এনে বসালো অথচ কথা বলছে না।সে চোখ বন্ধ করে ঘাড় কাত করে বসে আছে।তিমির এবার প্রশ্ন করলো,যে তাকে কেনো আনা হয়েছে। শুভ্র পেছন থেকে কাগজগুলো দেখালো।কাগজগুলো দেখেই তিমিরের বুকটা ধ্বক করে উঠলো।এ সত্যের মুখে পড়বে সে জানতো তবে ইচ্ছে ছিল সম্পর্কটা গাঢ় হলে সে নিজে জানাবে কিন্তু বর্তমানে তাদের মধ্যে যে বাকবিতন্ডা চলছে তার ওপর এ অপ্রিয় সত্য না জানি আজ কি হয়?তিমির কাগজ হাতে নিরবে বসে রইলো।ভয়ে তার হাত পা অবশ লাগছে। কান্না আসছে এখন কি করবে ভেবে অথচ চুপ থাকলে বিষয় ্টা অন্যদিকে যাবে।

তিমির আমি জানতে চাই এ কাগজের মানে কি?বউ বদল হওয়ার কথা না হয় মানলাম তাই বলে ডকুমেন্টসও বদল হলো।কিন্তু কাজী তো মূর্খ নয় তিনি তাহলে কেনো তুরফার নাম নিয়ে সবটা করলেন।এসব কি তুমি জানতে,উত্তর দাও তিমির চুপ থেকো না?

তিমির কাঁদছে। কি জবাব দেবে সে,কীভাবে বলবে সব কিছুর পেছনে তার বাবার হাত ছিল।তাহলে তো শুভ্রর কাছে কবির সাহেব খারাপ হয়ে যাবেন,তিমির কীভাবে এটা করবে,বাবাকে ছোট করে কীভাবে নিজের দোষ ঢাকবে?তিমিরের কষ্ট হচ্ছে সে বাবাকে দোষী করতে পারবে না?

তিমির কথা বলো,আমার রগ গুলো লাফাচ্ছে তুমি যা সত্যি তাই বলো?

তিমির কান্না রত মুখটা শুভ্রর দিকে ফেরাতে শুভ্রর কঠোর চাহনি হঠাৎ করে শীতল হলো
সে ঠান্ডা স্বরে সত্যিটা জানতে চাইলো।তিমির ভাবলো ব্যাপারটা খুলে বলাই ভালো হবে।তিমির এক এক করে সবটা জানালো আর শুভ্র মনোযোগ সহকারে শুনলো।অবাক হলো যে কবির এটা করেছেন বলে?শুভ্র বুঝলো না দুই মেয়ের করা অন্যায়ে তিনি কীভাবে কলকাঠি নাড়লেন?

তার মানে আঙ্কেল এসব করেছে?ছিঃ আঙ্কেলকে আমি কত শ্রদ্ধা করতাম আর তিনি কিনা এমন একটা কাজ করলেন?

তিমির শুভ্রর হাতটা নিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় রাখলো।শুভ্র তিমিরের দিকে তাকাতে তিমির করুণ দৃষ্টিপাত করলো।

শুভ্র আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই, ভালো কিংবা মন্দ জানি না তবে আপনি সবটা শুনে তারপর মন্তব্য করবেন প্লিজ শুভ্র না করবেন না?

এ প্রথম তিমির শুভ্রকে নাম ধরে ডাকলো।এর আগে সে শুভ্রকে আপনি বলে কথা বললেও এতদিনের গোপন সাহসটা সে দেখিয়ে দিলো।অনেক হয়েছে লুকোচুরি আজ তার জীবনের সেরা সত্যিটা সে জানাবে।

শুভ্র মা যখন মারা যান আমি তখন পুরো অবুঝ ছিলাম।বাবা আমাকে মায়ের মৃত্যুর পর কিছুমাস আলাদা রাখলেও একটা সময় বুঝতে পারলেন আমাকে আর একা রাখা সম্ভব না তাই তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন শান্তা মায়ের কাছে।শান্তা মা আমার আসল পরিচয় জেনে বিস্ফোরিত হলেন।তিনি বাবাকে এতটাই গালমন্দ করতে লাগলেন যে আমার ছোট মন তখন ভয়ে বাবাকে জড়িয়ে কান্না শুরু করলো।বাবা মাকে কি জানি কি বললো মা তাতে আরো রেগে গেলেন। বাবা আমাকে নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন।তখনো বাহির থেকে আমি মায়ের চিৎকার শুনছি।এভাবে আমার জীবনে একটা কালো অধ্যায় শুরু হলো।বাবা বর্তমান অবর্তমান উভয় সময়েই মায়ের অত্যাচার ছিল ভয়াবহ।ছোট ছিলাম বলে একা ভয় লাগতো অথচ মা আমাকে একটা কুৎসিত রুমে একা করে রেখে দিলেন।খাওয়ার দেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই পচা খাবারগুলো আমার জন্য তুলে রাখতেন।তুরফা আপুকে বড় বোনের মতো ভালেবাসতে চাইলে সেও আমাকে দূরে ছুড়ে মারে।আপু দোষ করলে সেসব আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আমাকে মার খাওয়াতো। লেখাপড়ার পর্বটা তো আরো ভয়াবহ। তুরফা আপুর জন্য যেখানে চার পাঁচটা টিচারের আনাগোনা ছিল সেখানে আমাকে দেয়া হয়েছিল জগাখিচুরি এক প্রাইভেটে।যেখানে পড়া কিছু বুঝতাম তো কিছু বুঝতাম না।বাকিটা বাসায় এসে নিজ দায়িত্বে শিখতে হতো।তুরফা আপুর কাছে কখনো গেলে সে বিরক্ত নিয়ে বিদায় করতো।খুব কষ্ট পেতাম।বাড়িতে আমার আপনজন কেউ ছিলো না। বাবা সবসময় কাজে থাকতেন তাই যখনি বাবাকে পেতাম জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম। এভাবে সময় পার হচ্ছে।আমার বাচ্চা মন বুঝতে শিখেছে মা বিহীন দুনিয়ার নিষ্ঠুরতা।আমার ভারাক্রান্ত মনটা বারবার প্রশ্ন করতো নিজেকে,কেনো আমি এ পৃথিবীতে আছি?আর কতো কষ্ট আছে আমার জন্য অপেক্ষা করে?একদিন নিজের রুমে বসে একটা ছেড়া ফ্রক সেলাই করছিলাম তখনি বাইরে একটা মিষ্টি কণ্ঠ শুনি।কণ্ঠটা এত ভালো লাগলো যে,কণ্ঠের মালিককে দেখতে বাইরে উঁকি দিই।আর তখনি চোখ জোড়া থমকে যায়। কোনো ছেলে এত সুন্দর হয় আমি জানতাম না।আপনি খুব সুন্দর করে তুরফা আপুর সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলেন।হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে তুরফা আপুকে জিজ্ঞেস করলেন,তুরফা আপু আপনাকে আমার পরিচয় দিলো ঠিকই তবে বোন বলে নয় আশ্রিতা বলে।তুরফা আপু উঠে গেলে আপনি আমাকে ডাকেন। আমি লজ্জা পায় যে, এত সুন্দর ছেলেটা আমাকে ডাকছে?আমি বোকার মতো ছেড়া ফ্রক নিয়ে আপনার কাছে গেলে আপনি হেসে আমার নাম পরিচয় জানতে চান।আমি আপনাকে সব জানালে আপনি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন হাতে কি?তখন আপনাকে জানালে সেলাইয়ের কথা আপনি অবাক হোন আমার মতো বাচ্চা মেয়ের কথা শুনে।তারপর হাত থেকে ফ্রক নিয়ে পরম যত্নে সেটা সেলাই করেন।আমি অবাক হয়ে যায় হঠাৎ আপনার স্নেহ দেখে।এরপর আপনি বাড়িতে আসলে আপুর সাথে সাথে আমার জন্য ্ও এরা ওটা আনতেন।আমার খুব ভালো লাগতো।আমি প্রায়ইশ অপেক্ষা করতাম কখন আপনি আসবেন আর আমাকে কাছে নিয়ে কথা বলবেন।বাচ্চা মন নিয়ে আমার ব্যাকুল হৃদয় অপেক্ষা করতো একটু স্নেহের জন্য। আপনার দেওয়া ক্ষুদ্র স্নেহ যে আমার মনে দরুন ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে তা আমি বুঝতে পারি আমার বয়ঃসন্ধিতে।একা একা বড় হয়েছি বলে হয়তো দুনিয়ার ভালো মন্দ দ্রুত বুঝতে শিখেছি।বুঝেছি কোনটা আঘাত কোনটা ভালোবাসা। আপনি সেদিন বললেন না আমি উগ্র, উশৃংখল।খুব একটা ভুল বলেননি কারণ আমাকে শেখানোর মতো মানুষ ছিল না।যা শিখেছি নিজ দায়িত্বে শিখেছি।পরিস্থিতি শিখিয়েছে কীভাবে মানুষ আঘাত করলে সেগুলো হজম করে আবার সোজা হয়ে দাড়াতে হবে।কিন্তু আমার দুঃখ ্ী জীবনে আপনি সুন্দর কিছু মুহুর্ত নিয়ে এলেন।কৈশোর বয়সে এসে আমি বুঝলাম আমার কিশোরী মন ভয়াবহভাবে আপনার প্রেমে পড়েছে। অথচ এরমধ্যে এটাও বুঝলাম তুরফার আপুর প্রতি আপনার অগাধ ভালোবাসা। তাই নিজেকে শুধালাম যাতে আপনাকে ভুলতে পারি।কিন্তু দিন দিন আমার ব্যাকুল হৃদয় পাগল হতে লাগলো। আমি নামাজে বসলে কাদতাম শুধু আপনাকে ভোলার জন্য কিন্তু মন আমার প্রেমে মরেছে।সে প্রেম সাগরে ডুব দিয়েছে অথচ সাতার তার শেখা ছিলো না।আপনাকে দেখলে আড়ালে থাকতাম সামনে আসতাম না কিন্তু আমার অস্থির মন ঠিকই আড়াল থেকে আপনাকে দেখে নিজের চোখের তৃষ্ণা মেটাতো।কিন্তু ভাগ্য বড়ই বিচিত্র খেলা খেললো যখন তুরফা আপু জানালো সে আপনাকে বিয়ে করবে না।কথাটা শুনেই আমার মাথা ডিগবাজি খেয়ে গেলো। খুশিতে আমি আত্মহারা হয়ে গেলাম কিন্তু ভয় পেলাম যদি আপনি বা আপনার পরিবার আমাকে গ্রহণ না করে।কিন্তু কেমন কেমন করে যেন সবটা আমার দিকে ঘুরতে লাগলো।দেখতে দেখতে সময় চলে গেলো দিন চলে গেলো আর আপনার সাথে আমি সংসারও করে ফেললাম যদিও এ সংসারে আমি একাই লড়াই করছি টিকে থাকার কিন্তু জানেন শুভ্র আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি ঠিক ততটাই ভালোবাসি যতটা ভালোবাসলে একটা ছোট গাছ বীজ থেকে বড় হয়ে তার শাখা প্রশাখা প্রসারিত করে,আমিও আপনাকে ভালোবেসে আমার এ এক জীবন অতিক্রম করার আশা রাখি।শুভ্র রূপ বা গুণে আমি নগন্য হলেও ভালোবাসায় আমি আপনাকে কমতি রাখবো না।শুভ্র আপনাকে আমি জোর করবো না তবে আমি চাই আপনি সময় নিন, আমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করুন।আর তাতেও যদি আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা না আসে তবও বলবো আমাকে ছেড়ে দিবেন না।আপনি যদি অন্য কোনো সম্পর্কে যেতে চান আমি আপনাকে নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিব তবুও আপনার সাথে আমি সারাজীবন থাকতে চাই, প্লিজ শুভ্র আমাকে ত্যাগ করবেন না।

তিমির কান্না মিশ্রিত কন্ঠে এক এক করে কথাগুলো বলে যাচ্ছে। তার ভেতর জমে থাকা এতদিনের সকল অপরাধ আর ভালোবাসা সে আজ চোখ বন্ধ করে বলে দিলো।তিমির চোখ ভরা জল নিয়ে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে প্রত্যাশা করছে শুভ্র তাকে কিছু বলবে কিন্তু অবাক করে দিয়ে শুভ্র উঠে গাড়ির কাছে চলে গেলো।শুভ্রর এ ব্যবহারে তিমিরের বুকটা ছিড়ে যাচ্ছে কষ্টে।এতটা রূঢ় কিভাবে শুভ্র হতে পারলো?

শুভ্র তিমিরকে বাসায় দিয়ে চলে যেতে চাইলে কবির সাহেব তাকে আটকান কারণ যতই হোক মেয়ের জামাই প্রথমবার বাড়িতে এসেছে তাকে তো ভালো করে আপ্যায়ন করা উচিত।তাই কবির সাহেব শুভ্রকে রেখে দিলেন।তিমির ভয়ে ছিল যদি শুভ্র কবিরের সাথে বিষয়টা নিয়ে সমস্যা করে কিন্তু সেটা না করে সে খুব ভালোভাবে তার সাথে কথা বললো।

শুভ্রকে তুরফার রুম ঠিক করে দিয়ে তিমির বের হতে শুভ্র ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো।হয়তো শাওয়ার নিয়েছে তাই চুলগুলো সামনে চলে এলো,সারা শরীরে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা। তিমির শুভ্রর উন্মুক্ত বুকে চোখ দিকে চেয়ে রইলো।এগিয়ে এসে শুভ্রর বুকের ওপর হাত রাখলো।শুভ্র তিমিরের কান্ড দেখছে.।

আপনি বড় নিষ্ঠুর শুভ্র, বড়ই হৃদয়হীন।পুরুষ হিসেবে আপনি সুদর্শন আর কামনীয় কিন্তু নারী মনের আকাঙ্খা আপনি বুঝেন না।আপনি বুঝতে পারেন না আপনাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর মনের অবস্থা। আপনি নিজেকে আদর্শের শিখরে নিতে গিয়ে বড়ই কঠোর হয়ে গেছেন।তবুও আমি আপনাকে ভালোবাসি আর আপনাকেই বাসবো।শুভ্র একটু নরম হোন,একটু আমাকে ভালোবাসুন, বিশ্বাস করুন পৃথিবীর সব ভালোবাসা আমি আপনাকে উজার করবো।আমি উগ্র উশৃংখল হয়েছি, নির্লজ্জ হয়েছি দরকার পড়লে মৃত্যুকেও গ্রহণ করবো তবুও আমি আপনাকে চাই শুভ্র।

তিমিরের দুই গন্ড গড়িয়ে জল পড়ছে,আর একহাত এখনো শুভ্রর বুকে।শুভ্রর কোনো হেলদোল নেই সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিমিরের দিকে।তিমির এগিয়ে এসে শুভ্রর ঠোঁট জোড়া হালকা ছুয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো।

পরদিন সকালে শুভ্র বাড়িতে চলে গেলো অথচ একটিবারের জন্যও সে তিমিরের সাথে দেখা করে গেলো না।তিমির জানলায় হেলান দিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছে সেই সাথে হাত দিয়ে নিজের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টি মুছছে।এ কেমন পুরুষকে সে ভালোবাসলো যার কাছে নির্লজ্জের মতো সবটা বলেও কোনো সহানুভূতি পায় না,পায় না একটু করুণা।

শুভ্র দুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে গেলো ব্যক্তিগত কাজে আর কাজ শেষ করেই চলে এলো দুদিন বাদে।বাপের বাসায় থাকলেও কলেজ টিউশন কোচিং সবটা সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছে সেই সাথে শান্তার প্রতি কর্তব্যা।তিমিরের সেবা পেয়ে শান্তা বেগম কিছুটা সুস্থ হলো। কিন্তু মনের দিক দিয়ে তিনি মুষড়ে পড়লেন।যে মেয়েকে তিনি ছোট থেকে এত অবহেলা আর এত অপমান করলেন জীবনের গুরুতর সময়ে সে তাকে সেবা দিচ্ছে আর যেই মেয়েকে পেটে ধরে এতকিছু করলেন যার জন্য আজ তার এ অবস্থা সে কিনা তার খোঁজও করলেন না।বিছানায় শুয়ে তিনি মনে মনে ক্ষমা চাইলেন তিমিরের কাছে।কিন্তু লজ্জিত মুখ নিয়ে কথা বলার সাহস পেলো না।

তিমির ক্লাসরুমে ঢুকতেই দেখলো শুভা তার দিকে চেয়ে হাসছে।তিমির ভাবলো হয়তো সে রুম ভুল করে এসেছে চলে যেতে শুভা ডাক দিলো।

এই কোথায় যাচ্ছিস, এখানে আয়।আমি তোর রুমে এসে গেছি!

তিমির কথাটা শুনে চোখ বড় করে বিস্ময় দেখালো।এগিয়ে এসে ব্যাগটা রেখে শুভার দিকে ফিরলো।

সত্যি! হঠাৎ এখানে কি করে,তোর ভাই বকা দিবে না?

আরে দূর ভাইয়ায় তো সব করলো।আমাকে এ রুমে আবারও শিফট করলো।গতকাল ভাইয়া রুমে এসে জানালো আজ থেকে আমি এ রুমে বসবো।আর হ্যাঁ আর কতদিন ও বাড়িতে পড়ে থাকবি চলে আয় না?

তিমির হেসে জানালো বিকেলে সে রওনা দিবে।শান্তার শরীর আপাতত ভালো।তাছাড়া সামনে পরীক্ষা এখন হেলাফেলা করা যাবে না।ক্লাস শুরু হতে শুভ্র ক্লাসে এলো।চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলো তিমির শুভা একসাথে। মনে মনে হাসলো কিন্তু চেহারায় সেটা প্রকাশ পেলো না।তিমিরের দিকে চোখ পড়তে তিমির হেসে দিলো ঠোঁট ফাক করে জানালো ধন্যবাদ!

তিমির বাসায় আসার পর থেকে পরিবেশটা কেমন জানি অচেনা লাগলো।এ পরিবারের মানুষ ্গুলো যেন কেমন আচরণ করছে।যে নিপা তাকে উঠতে বসতে কথা শুনাতো সে তিনি এখন তিমিরের সাথে শান্ত স্বরে কথা বলে।শুভা যেন খানিকটা বদলে গেছে। সে এখন তিমির থেকে দূরে দূরে থাকে।শুভ্র, তাকে দেখলে কেমন একটা পরিবর্তন লাগে কিন্তু ধরা যায় না এমন কিছু।

শুভা তিমির কলেজ থেকে বাসায় পৌঁছাতেই নিপা জানালো আজ বিকেলে যেন কেউ বাসা থেকে বের না হয়।বাসায় অতিথি আসবে।আর তিমির যেন তার সাথে হাতে হাতে কাজ করে।তিমির বিষয় ্টা হালকা ভাবে নিলো।দুপুরে খাওয়া শেষ করে তিমির নিপার সাথে কাজে লেগে গেলো।বিভিন্ন নাস্তা, এটা সেটা করতে করতে তিমির প্রায় ক্লান্ত। এমন সময় শুভা এসে তিমিরকে টেনে রুমে নিয়ে গেলো।

আরে কি করছিস দেখছিস না কতো কাজ,এখানে আনলি কেনো?

কারণ ভাইয়া আমাদের জন্য কাপড় এনেছে তোকে দেখাতে আনলাম, দেখ তোর পছন্দ হয় কিনা?

হঠাৎ কাপড়?

হঠাৎ কি করে অনেক আগে এনেছে তোকে দেখাতে মনে ছিলো না।জানিস আজ কারা আসবে,আজ মেয়ের বাড়ি থেকে লোকজন আসবে ভাইয়ার এনগেজমেন্ট করাতে।

শুভার কথা শুনে তিমিরের সারা শরীর শক খেলো।তার মাথা নড়ে ওঠলো।সে শুভার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

শুভা পাগলের মতো কথা বলছিস, কে আসবে?

ভাইয়ার জন্য যে মেয়েটা ঠিক করা হয়েছে তারা আসবে তাই তো আজ এত সব করছে।

শুভার কথা শুনে তিমির কান্না করে দিলো।

শুভা তুই যা বলছিস ঠিক তো,তোর ভাইয়ের এনগেজমেন্ট আজ?

হ্যাঁ মিথ্যা বলবো কেনো বলতো,তাছাড়া আমি ভেবে দেখলাম তোর সাইড নিতে গিয়ে আমি সবার চোখে খারাপ হয়ে যাচ্ছি তারচেয়ে তুই পরের মেয়ে পর হযে থাক আমি ঘরের মেয়ে ঘরের হয়ে থাকি।

শুভা তুই, তুই এসব বলছিস,আমি পরের মেয়ে?

তা নয়তো কি?তাছাড়া সত্যি বলতে আমার একটাই ভাই তোর জন্য তো তার জীবন নষ্ট হতে পারেনা।ভাইয়ের বউ হিসেবে একটা সুন্দর ভাবি তো আমি পেতে পারি কিন্তু তুই থাকলে সেটা সম্ভব না তাই ভাবলাম ভাইয়া মা যা করছে ঠিক করছে?

শুভা তুই এত বড় কথা বলছিস আমাকে? তোর ভাইয়ের সিদ্ধান্ত কি?

তারই মতামত নিয়ে এসব করা হয়েছে। যদি সন্দেহ থাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।

তিমির কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো শুভ্রর রুমে।তিমিরকে দেখে শুভ্র বিরক্তিকর চোখে তাকালো।

শুভ্র শুভা যা বলছে তা কি সত্যি, আজ আপনার এনগেজমেন্ট?

শুভা তোমাকে বলে দিয়েছে। এ মেয়েটা কোনো কথা হজম করতে পারে না।বললাম তোমাকে না জানাতে?যাই হোক সত্যিটা জেনে গেছো তাহলে,আমি চাই না তুমি কোনো সমস্যা করো তাই বলিনি এতদিন?

শুভ্র আমি তো বলেছিলাম আপনাকে জোর করব না আপনি আপনার মতো সময় নিন তাহলে হঠাৎ এসবের মানে কি?

আমি সময় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।তাছাড়া তোমাকে ভালোবাসার মতো মন আমার নেই। অনেকদিন হলো একসাথে আছি এখনো তোমার প্রতি মনকে ফেরাতে পারিনি তাই ভাবলাম অযথা টেনে হিঁচড়ে এ সম্পর্ক না এগোনোই ভালো।আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে মুক্তি দিব।

শুভ্র আপনার মনে কি একটুও মায়া নেই। নির্লজ্জের মতো কতবার বলবো ভালোবাসি।এত করে বলার পরও আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা আসে না,আমার দিকে মন টানে না?শুভ্র আজ তাহলে তুরফা আপুর কথায় সত্যি হলো,আপনাকে আমি যতটা মহৎ ভাবতাম আপনি তা নন,আর পাঁচ ্টা পুরুষের মতো আপনিও রূপের পূজারি।নিজেকে এতটাই ছোট করেছি যে বাদ ছিলো পায়ে পড়া এখন আর না।আপনার মন যখন আমার দিকে ফিরবে না তখন আর জোর নাই। আপনি যা ইচ্ছে করুন।আমি অপেক্ষায় থাকবো আপনার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার।

তিমির এক টানা কাট কাট করে কথাগুলো শেষ করলো।শুভ্রর রুমে থেকে বের হলো টলতে টলতে।জীবনের শেষ আশাটাও আজ সে হারালো।এতকিছুর পর যে শুভ্র তাকে ছেড়ে দিবে তিমির সেটা ভাবে নি।

শান্তা কবির সবাই এসেছেন নিপাদের বাড়িতে।মেহমানরাও চলে এসেছে। এদিকে তিমির কাজ শেষ করে রুমের দরজা লাগিয়ে কাঁদছে। নিজের চোখে এ সর্বনাশ সে কীভাবে দেখবে।শুভা এসে দরজা ধাক্কালো।

কিরে তিমির তৈরি হয়েছিস,একটু পর অনুষ্ঠান তুই ঘরে কি করছিস?

আমি যাবো না শুভা।তুই যা তোর ভাইয়ের নতুন সম্বন্ধে আমাকে টানিস না।

আরে তুই ছাড়া হবে নাকি। দেখ নতুন ভাবি কত সুন্দর, তুই না দেখলে কি করে হবে?

শুভার কথায় তিমির হু হু করে কেঁদে দিলো।না অন্যের জন্য নিজেকে কষ্ট দিবে ন সে।ভাই বোন যখন তাকে আঘাত করে সুখে আছে সেও তাদের সুখ মেটাবে।তিমির দরজা খুলে বের হতে শুভা চমকে গেলো।

কিরে কত কাঁদবি। আয় সাজিয়ে দিই।

নাটক করিস না।চল তোর নতুন ভাবিকে দেখবো।

শুভা তিমিরকে দাঁড়াতে বলে রুমে গিয়ে নিজেকে দেখে নিলো,মাথায় ওড়না দিয়ে তিমিরকে নিয়ে বের হলো।তিমির নিচে চেয়ে আছে, শুভা ঠেলা দিয়ে বললো,

তিমির ওদিকে তাকা দেখ নতুন ভাবি কত সুন্দর।

শুভার কথায় তিমিরের মনে হলো তার কলিজটা কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে চোখ তুললো না।মাথাটা আরো নিচু করে চোখ মুছলো।
,
,
,
চলবে……

১৪.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here