#প্রেমোবর্ষণ
৩.
‘কলি ওঠ জলদি তোর চৌদ্দ গুষ্টি চলে এসেছে।’
আনিকার চেঁচানো ডাক আর লাগাতার ধাক্কায় ধড়ফড় করে উঠে বসেছে কলি। ঘড়িতে সবে সাতটা বেজে পাঁচ মিনিট। আজ ক্লাস ছিল বারোটা থেকে তাই ঘুম থেকে এত সকালে উঠার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আনিকার এই ঝড়ের বেগে ধাক্কা খেয়ে এখন হাত পা কাঁপছে তার। আনিকার সে খেয়াল নেই সে আবারও কলির কাঁধে ধাক্কা মারল, ‘কি অঘটন ঘটিয়েছিস দোস্ত তোর বাপ তো রাগে লাল টমেটো হয়ে আছে।’
পুরো শরীর ঝিমঝিম করছে, বুকের ভেতর ক্রমাগত ধকধক আওয়াজ আর হৃৎপিণ্ডটা লম্ফঝম্প দিচ্ছে যেন সেকেন্ডে দশ বার। কলির মনে হচ্ছে হয়ত এখনি তার নিঃশ্বাস থেমে যাবে, টিকটিক করতে থাকা হৃদয়টা ধপাস করে পড়ে যাবে কোন ফাঁকা জায়গায়। আনিকা আবারও কলির গায়ে হাত দিতে গেলে কলি ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল বান্ধবীর গালে। কয়েক মুহূর্ত পিনপতন নীরবতা তারপরই আনিকা চেঁচালো আবার, ‘মারলি ক্যান কুত্তা তোর ভালোর জন্যই তো…’
‘রাখ তোর ভালো। জিন্দা মানুষ জমের দুয়ারে পাঠাইয়া তুই কি ভালো করতি? আক্কেলহীন মহিলা এভাবে কেউ ঘুমের মানুষকে ধাক্কায়!’
আনিকা এতক্ষণে বুঝতে পারলো ভুলটা। সত্যি বলতে হোস্টেল গেইটে কলির বাবাকে দেখে সে প্রথমে সালাম দিল কিন্তু ভদ্রলোক জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কলি কোথায়? আনিকা জবাব দেয়ার আগেই গেইট দিয়ে প্রবেশ করলো কলির বড় চাচা, চাচাতো ভাই আরিফ, কলির আম্মু, তার ফুপু এমনকি তার ছোট ভাইও। অভিভাবক একের অধিক পুরুষদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই তবুও তারা কেমন করে ঢুকছে তা দেখেই অবাক সে। অবশ্য খুব বেশি সময় ভাবার সুযোগ পায়নি তার আগেই সকলে হোস্টেলের ওয়েটিং রুমে ঢুকে গেছে। কলি আরও কিছু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করতে চাইছিল এরই মাঝে হোস্টেল কর্মী এক খালা এসে জানালেন কলির অভিভাবক এসেছে। পড়ার টেবিলটার ওপর রাখা পানির বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে ওড়না ঠিক করে বেরিয়ে গেল সে। আনিকা তখনো কলির বেডে বসে ভাবছে কোথায় কি কোনো অঘটন ঘটলো!
‘তুমি ঘুমিয়ে ছিলে?’
কলির বড় চাচা গম্ভীর স্বর তুলে প্রশ্ন করলেন।
‘জ্বী চাচ্চু।’
‘ফোন কোথায় তোমার?’ এবারও প্রশ্নটা চাচাই করলেন৷
‘রাতে চার্জে লাগিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম এখনো সেখানেই আছে।’
‘তাইলে তোর ফোন বন্ধ রাত থেকে আর তোর মামা কিনা উল্টাপাল্টা শুরু করছে?’
আরিফ ঔদ্ধত্য সুরে কথা বলছে। তা বুঝতে পেরে বড় চাচা ধমকালেন, ‘তুই থাম তো।’
কলি প্রচণ্ডরকম বিষ্ময় চেপে তাকাল বাপ, চাচাদের দিকে। বড় মামা কি করেছেন? সবাই কি উনার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে এখানে এসেছে!’
কলির নীরব ভাবনা বেশিদূর গড়ায়নি তার আগেই হোস্টেল কতৃপক্ষ এসে হাজির হলেন। একদল লোক এসে গার্লস হোস্টেলে ঢোকার দায়ে দু চারটা কথার সাথে কলিকে নোটিশ হিসেবে জারি করলো মাসের শেষ তারিখে হোস্টেল ছাড়তে হবে। আম্মুর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করলে তিনি অন্য সুরে ধমকে উঠলেন, ‘আমার ভাতিজা কোথায় গেল তবে?’
– মানে?
‘পরশ ভাই কাল রাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় এসেছে।’ আরিফ জবাব দিল।
‘তাই তোমরা ভেবে নিয়েছো আমিও তার সাথে পালিয়ে যাচ্ছি। রিডিকিউলাস!’
‘ বাকি কথা বাড়ি গিয়ে হবে তোমার মাল পত্র গোছাও আমরা বাড়ি ফিরব। বাকি কথা বাড়ি গিয়েই হবে।’ বড্ড শীতল গলায় বললেন বড় চাচা। কলির বাবা আপাতত তার ভাইয়ের ওপর কিছু বলবেন না বলেই মনস্থির করেছেন৷ কিন্তু কলির মা হুট করেই নাকি সুরে কাঁদতে লাগলেন। মাত্র কিছুদিন হয় হোস্টেলে এসেছে কলি। বাড়ি থেকে থেকে মানসিক অবস্থা বিধ্বস্ত হওয়ায় সে এখানে উঠেছিল। কোন কুক্ষণে যে পরশ ভাইকে ভালোবেসেছে আল্লাহ জানে। নিজের ওপরই চরম বিরক্ত এখন তবুও মনকে সরাতে পারে না ওই পাষাণ, অসভ্য লোকটা থেকে। বাড়ির মানুষদের সাথে পেরে না ওঠায় আপাতত কিছু বইখাতা নিয়ে চলে গেল বাড়ি।
…..……….
‘পরশ উঠবি এখন না আরও পরে?’ রিয়াদ শার্টের স্লিভ ফোল্ড করতে করতে প্রশ্ন করলো।
‘তুই বেরুচ্ছিস?’
‘হু, ক্লাস আছে, ডেট আছে সব মিলিয়ে সারাদিন আর ঘরমুখো হবো না।’
‘আচ্ছা গুডলাক। আমার বাড়ির কেউ কল দিলে বলিস আমার সাথে অনেকদিন কথা হয় না তোর।’
কথাটা বলেই পরশ পাশ ফিরে শুলো। রাতের জার্ণি এখন ক্লান্তিতে ঘুম হয়ে নামছে দু চোখে। রাত তিনটায় এসে ঢাকায় পৌঁছুতেই সে রিয়াদকে কল করেছে। বেচারা সাধের ঘুম মাটিচাপা দিয়ে বাইক নিয়ে ছুটেছে বাসস্ট্যান্ডে। পরশকে নিয়ে ফিরে আর ঘুমাতে পারেনি একফোঁটা। একটু পর পর নানা রকম পরিকল্পনা বলতে বলতে পরশ না নিজে ঘুমিয়েছে আর না রিয়াদকে ঘুমুতে দিয়েছে। এক ঘন্টা আগেই পরশ ঘুমে ডুব দিলো কিন্তু রিয়াদের সে সৌভাগ্য হয়নি। তার নতুন গার্লফ্রেন্ড কলেজের নিব্বি ভোর না হতেই ডেটে যাবে বলে মাথা খাচ্ছে এদিকে বন্ধুর হাভভাবেও টেনশন হচ্ছে এখন।
‘ আমার কিন্তু টেনশন হচ্ছে দোস্ত তোর ফুপা মানুষ ভাল হলেও তার ভাই, ভাতিজা গুলা ভীষণ ডেঞ্জারাস। কিছু উল্টাপাল্টা করিস ন। কলির ওই যে কি ভাই জানি মোটা করে ওই পোলা কিছুদিন আগে আমাগো এলাকার রকিবরে পিটাইছে ক্যাম্পাসে মাইয়ার হাত ধরছে বলে।’
রিয়াদ বরাবরই ভীতু কিসিমের তারওপর কলিদের পাশাপাশি এলাকা হওয়ায় কলির গুষ্ঠির সবাইকে চেনে। আরিফ একটু গরম মাথার মানুষ এ কথা তার ভালই জানা। কিন্তু বন্ধুর অতিরিক্ত চিন্তান্বিত মুখ দেখে বিরক্ত লাগছে পরশের। সে শোয়া থেকে উঠে বসল তারপরই রিয়াদকে বলল, ‘তোর ফোনটা দে তো।’
‘কি করবি?’
‘দে আগে।’
রিয়াদ পকেট থেকে ফোনটা বের করে দিলো পরশকে।
‘ব্যালেন্স আছে?’
রিয়াদ কাতর মুখে জবাব দিল, হ্যা।
‘জিরো ওয়ান এইট ফাইভ…’ পরশ টপাটপ নম্বর তুলে ডায়াল করলো।
‘কাকে কল দিচ্ছিস?’
‘হুসসসসস’ রিয়াদকে থামিয়ে দিলো।ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই পরশ কণ্ঠস্বর গম্ভীর করে কথা বলল, ‘কলি বলছো?’
ওপাশের জবাব রিয়াদ শুনলো না এপাশে পরশ বলল, ‘আন্টি কলির কাছে আমার দরকারি একটি নোট ছিল তাকে বলবেন দশটার মধ্যে যেন ক্যাম্পাসে এসে দিয়ে যায়।’
ওপাশে আবারও কিছু বলতেই পরশ বলল, ‘না না তাকে ডাকার দরকার নেই এতটুকু বললেই হবে।….. জ্বী আল্লাহ হাফেজ। ‘
রিয়াদ হা করে তাকিয়ে রইলো পরশের দিকে।
‘এটা কি করলি?’
‘যা দরকার ছিল। এবার তুই যা আর হ্যাঁ আন্টিকে বলে যাস যেন আমার জন্য নাশতা না রাখে। দরজা ভেজিয়ে বিদায় হ এবার।’
পরশের কথা শুনে মনে হচ্ছিল পরশ নয় রিয়াদই এসেছে পরশের বাড়ি। রিয়াদ সত্যিই চলে গেল আর যেতে যেতে মাকে বলে গেল নাশতার জন্য পরশকে যেন জোরাজুরি না করে।
………..
‘ নিজেকে কি টিন এজার মনে করছো আজকাল?’
ক্রোধান্বিত দৃষ্টি কলির।
‘কিছুটা। কিন্তু তুই এমন আশি বছরের দাদী আম্মা সুর দিচ্ছিস ক্যান।’
‘ফাইজলামি না করে বলো এসবের মানে কি?’
পরশ হাতে থাকা বার্গারে কামড় বসিয়ে বড্ড ধীরেসুস্থে খেতে লাগল। কলির রাগ বাড়তে লাগল পরশের আচরণে। সে আবারও কিছু বলতে মুখ খুলতেই পরশ তাকে ইশারা করলো চুপ থাকতে। নিজেই বলতে লাগল, নাশতা করে আসিসনি বুঝতেই পারছি। আগে বার্গার খা পরে কফি খাওয়াব৷ আর শোন বার্গারটাতে চিলি সস বেশি দিয়ে এনেছি যাতে ঝালে তোর মুখ পোড়ে তারপর…’
মেয়েলি ঢংয়ে মুখ লুকিয়ে হেসে দিল পরশ যেন কথাটা বলতে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে সে। আদতে লজ্জা নয় ফাজলামো করে কলিকে রাগাতেই এমন আচরণ করছে সে।
‘এমন শুরু করলে কেন তুমি? এমন ঢং তোমার সাথে একদম যাচ্ছে না বরং অসভ্য অসভ্য লাগছে।’
‘ইয়েসসসস তোর সামনে অসভ্যই আমি। এবার সরাসরি কথা বলি শোন, বার্গার খা তারপর কফি এরপর বসুন্ধরায় যাব আমার ফোন নেই একটা ফোন কিনতে হবে।’
‘আমি যাচ্ছি তোমার যা খুশি করো। আর হ্যাঁ ফারদার যদি রং নাম্বার থেকে কল দাও তবে আমি মামাকে সে নম্বর গুলো পাঠিয়ে দেবো।’
‘তারমানে বলতে চাইছিস নিজের নম্বর থেকে কল দেব!’
কলি বসা থেকে উঠে পড়ল। সকালে মায়ের মুখে ফোনকলের কথা শুনেই তার মনে হয়েছে পরশ ভাই করেছে কলটা। আন্দাজ নিয়েই নির্দিষ্ট সময়ে ক্যাম্পাসে পৌছুতেই তার ধারণা সত্যি হলো। পরশ ভাই কোথা থেকে বেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। সিনক্রিয়েট না হয় সে ভয়ে পরশ ভাইয়ের কথামত একটা ক্যাফেতে এসে বসলো। কিন্তু তাতে কি হলো পাষাণ লোকটা এখন ফাজিল হয়ে গেছে। ফালতু সব কথাবার্তা বলে যাচ্ছে একের পর এক। তার এখন মনে হচ্ছে এই পরশ ভাইকে সে ভালো বাসে না একটুও। সে তো তাকে পাত্তা না দেওয়া পরশ ভাইকেই ভালোবাসে। আর সময় নষ্ট না করে সে বেরিয়ে গেল ক্যাফে থেকে। যেতে যেতে শুনলো পরশ ভাই বলছে, ‘হাতে একটা মাস সময় আছে প্রেম করে নে পরে কিন্তু আফসোস করবি কলি।’
-রূবাইবা মেহউইশ
(রি চেক করা সম্ভব হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)