#প্রেমোবর্ষণ
৭.
‘হলুদ কি শুধু কনের হবে নাকি!’
বন্ধু রায়হানের গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়লো। গাছের গুঁড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে পরশ৷ সকল বন্ধুই এখন ঢাকায় অবস্থান করছে তবে কেউ কেউ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কেউ কেউ আবার পরশের সাথেই থাকছে। পরশ এতদিন ছিল রিয়াদের বাড়িতেই কিন্তু কাল থেকে সব বন্ধুরা এসেছে বলে সেও উঠেছে হোটেলে। সন্ধ্যেতে কলিকে হলুদ লাগিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে বসে আছে মাঠের এক পাশে৷ রিয়াদদের বাড়ির পাশেই এ মাঠে তারা কাটাবে অনেকটা সময়। রাতটা পার করে সকালেই বেরুবে শেষ মুহূর্তের কিছু কেনাকাটায় তার মধ্যে লিস্টের প্রথমেই আছে একটা লাল টুকটুকে বেনারসি। টাকা বেশি থাকলে হয়ত স্বর্ণের এক জোড়া দুল আর একটা চেইনও কিনতো সে। আফসোস তার হাতের যে টাকা সবটাই হিসেব করা দরকারের তাই আপাতত সাধ শুধু বেনারসির পূরণ করবে বলে মনস্থির করেছে। উপরওয়ালা চাইলে দেশে ফিরে সকল সাধ পূরন করেই ঘরে তুলবে সে তার ঘরণীকে৷ পরশের ভাবনা অনেক ভবিষ্যৎ নিয়ে কিন্তু আপাতত মশার সাথে সাথে রায়হানের চিমটিও তাকে অসহ্য করে তুলছে।
-শা *লা কি শুরু করলি এমন চিমটাস ক্যান!
-তো কি করব রাত বাড়তাছে না! তোরে হলুদ দিমু না আমরা?
রায়হান আগের মতোই আক্ষেপ শোনালো। রিয়াদ পাশেই ছিল সেও এবার একজোট হলো, ‘ঠিকই বলতেছে ও। চল আমাদের ছাদে বসে কিছু একটা করি!’
-ফাইজলামি পাইছিস তোরা!
-একদমই না।
একই সাথে বলে উঠলো দুই বন্ধু। পরশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো তাদের দিকে। কাজের কাজ কিছুই হলো না উল্টো শেষ পর্যন্ত ঠিক আকস্মিক ধরে বেঁধে পরশকে নিয়ে গেল রিয়াদদের বাসায়। রিয়াদের মা বাড়ি ছিলেন না আজ তাই আরেকটু সাহস করে রিয়াদ বাকি বন্ধুদেরও ডাকতে বলল পরশকে। অন্যের বাড়িতে একসাথে পনেরো -বিশজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে রাত বিরাতে হল্লা করা বড্ড অবিবেচক কাজ বলে মনে হলো পরশের। তাই সে বেছে বেছে সবচেয়ে কাছের চারজন বন্ধুকে কল করে আসতে বলল। রিয়াদরা স্থানীয় এবং বাড়িতে কয়েকটা ফ্ল্যাট ভাড়াটিয়া থাকায় খুব বেশি হৈ চৈ ছাড়া ছাদে উঠে গেল। অন্য বন্ধুরা আসার আগেই রিয়াদ বাজারে গেল আবারও একটু হলুদ কিনতে। রায়হান গেল একটা সাদা লুঙ্গি, গেঞ্জি আর তোয়ালে কিনতে। পরশ একা বসে ফোনে এটা সেটা অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ঘাটাঘাটি করে ঠিক করলো আজও মাকে কল করবে। গতকালই সে নতুন আরও একটা সিম কিনেছে মায়ের সাথে কথা বলতে। পরশ জানে বাবা তার পেছনে লোক লাগিয়েছে এমনকি মায়ের ফোনটাও হয়ত চেক করছে প্রতিনিয়ত। তাই সে এ কদিনে অনেকগুলো নাম্বার থেকে কল করেছে মাকে এবং অবশ্যই সে কথা বলার জন্য জায়গা পরিবর্তন করেছে। রিয়াদদের বাড়িতে থাকছে বলে এ বাড়ি থেকে সে কখনোই মাকে কল করেনি। ফলে তার লোকেশন বাবা আজ অবধি ঠিকঠাক পায়নি খুঁজে। এখন ভাবছিলো আর তো মাত্র একটা দিন। কাল সন্ধ্যের আগেই সে উড়াল দেবে এ দেশের মাটি ছেড়ে তাই এখন বাবা লোকেশন জানলেইবা কি হবে! রাতের মধ্যে নিশ্চয়ই এসে পৌছুতে পারবেন না তিনি! এমন ভেবেই সে পুরনো সিম থেকেই মায়ের নম্বরে কল করতে ডায়াল করল মায়ের নম্বরে।
– দোস্ত দ্যাখ কি কি আনছি।
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে রায়হান কথাটা বলে সামনে এলো পরশের। সাথেই তার আরও এক বন্ধু আদনান। রায়হানের কণ্ঠ শুনেই কল ওপাশে পৌছানোর আগেই কেটে দিল পরশ।
– কি কি আনলি?
বিরক্তির সাথে প্রশ্ন করলো।
-এই দ্যাখ পাঞ্জাবি, পাজামা, টুপি, কাচা হলুদ, আর হাতের জরিওয়ালা ফুল।
এক এক করে শপিংব্যাগ থেকে বের করে দেখালো রায়হান। পরশ দেখলো হাতের ফুল বলতে সে জরির চকমকে সুতোয় বানানো একটা ফুল এনেছে । হ্যা, গ্রামের বিয়েতে এসব বর, কনেকে পরতে দেখেছে সে। কিন্তু এখন এসব করা হাস্যকর ব্যাপার যেখানে বিয়েটা সত্যিই হবে কিনা সন্দেহ! সে তার চেষ্টায় একান্তই নিজ প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে দূর বহুদূর। হাতে সময় মাত্র কয়েক ঘন্টা এরপরই হয় আজীবনকার নয় কোনো দিনকার নয় দুজন৷ বুকের খাঁচা শূণ্য অথবা পূর্ণ হবে কাল৷ পরশকে গম্ভীর চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখে রিয়াদ বুঝতে পারলো কি চলছে তার মনের ভেতর। এক বন্ধু গেছে রাতের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে ততক্ষণে রিয়াদ ভাবলো হলুদটুকুর একটা ব্যবস্থা করা যাক। দোতলায় এক মুরুব্বি দম্পতি থাকেন ভাড়া তাদের বাড়িতেই গিয়ে সে হলুদ বেটে দিতে অনুরোধ করল। মহিলা প্রথমে সন্দিগ্ধ হয়ে তাকায় রিয়াদের দিকে পরে বিনা প্রশ্নেই হলুদ পেস্ট করে দেন। ছাদের এক পাশে শতরঞ্জি বিছিয়ে পরশকে বসিয়ে সব বন্ধু মিলে হলুদে একদম মাখিয়ে ফেলল কয়েক মিনিটেই। হঠাৎই রায়হান বলল, এত কিছু হচ্ছে আর একটা ছবি তুলব না! পরশ পাত্তা দিতে চাইলো না সে কথায়। বন্ধুরা তো নাছোড়বান্দা তারা জোর করেই সল্প আলোর মাঝেই নানা ভাবে ছবি তোলে আর জোর করেই ছবিগুলো সেন্ড করে কলির হোয়াটসঅ্যাপে। তৎক্ষনাৎ সেগুলো সিন করে কলির মাথায় বাজ পড়ল যেন। অবিশ্বাস্য নজরে অনেক অনেকক্ষণ সে দেখতে থাকলো ফটোগুলো৷ এই মুখটা আজ লাগছে ঠিক সেই বৃষ্টি রাতের মত। কেউ প্রেমে পড়ার প্রথম মুহূর্ত মনে করতে পারে কিনা জানে না কলি কিন্তু তার সে প্রথম দমকা হাওয়ায় ভেসে যাওয়ার মুহূর্তটুকু কখনোই ভুলবে না। বর্ষণের সেই রাতে চিলেকোঠায় বসে পরশের গাওয়া গানটার প্রত্যেকটা লাইন আজও ভাবলেই শিহরিত হয় সে।
‘তুই আরেকটু আনমনে থাক
উড়ে যাক তোর কবিতা মাখা চুল’
প্রতিটা অক্ষরেই যেন ছিল পরশ ভাইয়ের সুক্ষ্ম অনুরাগের প্রকাশ। পুরনো সেই ক্ষণ ভেবেই ঠোঁট চওড়া হলো হাসলো কলির চোখ দুটোও। কে বলেছে সে আগ্রহ হারিয়েছে ওই পাগলাটে মানুষটার প্রতি! এই যে মাত্রই মানুষটাকে ভেবে তার ভেতরে সুখ সুখ হাওয়া বইছে এখন।
-রূবাইবা মেহউইশ