#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১৩
‘তিথি? এই তিথি? শুনছো না কেন?’
সম্পদের হুড়মুড় ডাক তিথি অগ্রাহ্য করতে পারলো না। হাতের রিমোট টা কাউচের উপর রেখে সে সম্পদের রুমের দিকে পা বাড়াল। দরজা অল্প একটু খোলা। তিথি বাকি অংশ ঠেলে ভেতরে ঢুকল। সম্পদ বিছানায় শুয়ে ছিল। তিথিকে দেখে একটু নড়েচড়ে উঠলো। এক অপ্রতিরোধ্য আবেগে ভেসে গেল। রক্তের ভেতর ছড়িয়ে পড়লো অনাকাঙ্ক্ষিত অস্থিরতা। হাড়গোড়ের ভেতর কেমন কড়কড়ে আওয়াজের টের পেল। নিজের অস্বাভাবিক দশার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সে কড়া গলায় বলল,
‘সেই কখন থেকে ডাকছি! এত দেরি হলো কেন? মানুষ মনে হয় না আমাকে? এতটা সময় নিয়ে তোমায় না ডেকে একটা উদ্ভিদকে ডাকলেও সে এতক্ষণে আমার ডাকে সাড়া দিতো। হেঁটে চলে আসতো। আর তুমি?’
‘তো উদ্ভিদ কে ডাকুন না। আমি কি বাঁধা দিয়েছি? আপনার বেলকনির অপজিটে নিমগাছ আছে৷ নিমগাছকে ডাকুন। নিমের হাওয়া বড্ড উপকারী।’
সম্পদের মুখটা পাংশুর মতো হয়ে গেল। তাকে থম মেরে থাকতে দেখে তিথি নরম গলায় বলল,
‘কেন ডাকছিলেন? এসে গেছি, বলুন।’
সম্পদ আর কথা খুঁজে পেল না। এতক্ষণ চেপে রাখা অস্থিরতা আলোর বেগে বাড়তে লাগলো যেন। সত্যি তো! সে কেন ডাকছিল তিথিকে? নিজের মনকে জিগ্যেস করে উপযুক্ত উত্তর পেল না। তাকে চুপ থাকতে দেখে তিথি তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। বিছানার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
‘কেন ডাকছিলেন আমায়? কোনো প্রয়োজন?’
‘হ্যাঁ! প্রয়োজন ছাড়া ডাকবো কেন তোমায়? তোমার সাথে বসে বসে গল্পগুজব করার মতো সম্পর্ক এখনো সৃষ্টি হয়নি।’
‘কি প্রয়োজন?’
‘পানি খাব।’
সম্পদের নির্বিকার উত্তরে তিথি আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাতটা বাড়ালেই সম্পদ পানির গ্লাস স্পর্শ করতে পারে। তার বিছানার কাছে টেবিলের উপর গ্লাস। সে আর প্রতিবাদে গেল না। গ্লাসটা সম্পদের হাতে তুলে দিল। মাথাটা সামান্য উঁচু করে সম্পদ গ্লাস হাতে নিল। কোনো রকম ঠোঁটটা ভিজিয়ে সে গ্লাস সরিয়ে রাখলো। এবারে তিথি কৌতূহল দমাতে না পেরে প্রশ্ন করলো,
‘শুধুমাত্র ঠোঁট ভেজানোর জন্য আপনি পানি চাইলেন?’
চোখ ছোট ছোট করে তিথির দিকে তাকালো সম্পদ। পরক্ষণে গ্লাসটা পুনরায় হাতে নিল। ঢকঢক করে পানি খেয়ে সম্পূর্ণ গ্লাস খালি করলো। শূন্য গ্লাসটা একটু জোরেই টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলো। ভেজা ঠোঁট মুছে বলল,
‘এবার খুশি?’
‘আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন না কেন? ঘুমিয়ে পড়ুন।’
‘ঘুম আসছে না!’
সম্পদের বাচ্চাদের মতো নাঁকি সুর শুনে তিথি তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পেল না। আশপাশে নজর বুলিয়ে বেলকনির দিকে এগিয়ে গেল। বেলকনি দিয়ে দুপুরের কড়া রোদ রুমে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। চুপচাপ পর্দা টেনে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রুমে আবছা অন্ধকার হয়ে গেল। সরে এসে বলল,
‘এত আলোতে ঘুম হবে কি করে! এখন চেষ্টা করুন। ঘুম আসবে।’
সম্পদের ভেতরে স্বপ্ন ভাঙার বেদনায় মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। সে ঘুমাতে চাচ্ছে না। তিথিকে পাশে বসিয়ে রেখে তার অগোছালো কথা শুনতে মন চাইছে। কিন্তু কোথায় যেন বাঁধা। মন খারাপ করে নড়েচড়ে আবার শুয়ে পড়লো সে। চোখ বন্ধ করে আবার খুলে ফেলল। অস্ফুট স্বরে বলল,
‘আমার মাথা ব্যথা করছে। ঘুম আসবে না।’
‘ওষুধ খাবেন?’
‘না!’
‘তাহলে? কি করবেন?’
সম্পদের বলতে ইচ্ছে করলো, তোমার সাথে গল্প করবো। একটু আমার পাশে এসে বসো তো। কিন্তু ইচ্ছেকে শব্দে রূপান্তর করে মুখ নিঃসৃত করতে পারলো না। ভেতরটা হতাশায় ছেয়ে গেল। তিথিকে তার কত কিছু বলার আছে। তার তার সাতাশ বছরের জীবনের খুঁটিনাটি সব মেয়েটাকে বলতে চায় সে। কিন্তু কোথায় যেন জড়তা। বলতে গিয়েও বার বার ফিরে আসতে হচ্ছে। খুব করে চেয়েও মেয়েটার কাছাকাছি যেতে পারছে না। তার সাথে সহজ সম্পর্ক সৃষ্টি করতে প্রতিবার ব্যর্থ হচ্ছে। হতাশ হয়ে সে চোখ বন্ধ করলো।
কিছু সময় কেটে গেল। মনে মনে তিথির কন্ঠ শোনার প্রতীক্ষায় রইলো সে। শুনতে পেল না। বুঝতে পারলো হয়তো তিথি চলে গেছে। শ্বাস ফেলল সে। অপেক্ষার পাহাড় যখন ধ্বসে পড়লো ঠিক তখনি কপালে কারো হাতের স্পর্শ পেল। কি নিদারুণ সে স্পর্শ! কুয়াশাচ্ছন্ন, শিশিরভেজা ভোরের মতো শীতল আর প্রশান্তিদায়ক! উৎকন্ঠার দূষিত শহরে একটুখানি নির্মল ছোঁয়া! সম্পদের ঠোঁটের কোণে অস্পষ্ট হাসি ফুটে উঠলো।
হাতটা আস্তে ধীরে তার চুল স্পর্শ করলো। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো তিথি তার চুল টেনে দিচ্ছে। সুনিপুণভাবে চুলের ভাঁজে ভাঁজে হাত তার আঙুল গুলো বিচরণ করছে। এতক্ষণ ঘুমেরা অধরা থাকলেও কেন জানি এখন সম্পদের চোখের পাতা ভারী হয়ে আসতে লাগলো। মেঘাচ্ছন্ন মনের আকাশ ঝলমলে রোদে ছেয়ে গেল। শরতের স্নিগ্ধতা দোলা দিয়ে গেল মনে। ঠিক এই মুহূর্তটা তার সাতাশ বছরের জীবনের সেরা মুহূর্ত মনে হলো। অনুভূত হলো, এই মুহুর্তটার জন্যই তার শ্বাস নেওয়া। এ ধরায় বেঁচে থাকা! প্রশান্তিতে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল সে।
১৭.
অনেক ক্ষণ হলো ফোন বাজছে। তিথি ওয়াশরুম থেকে তার স্পষ্ট শব্দ শুনতে পাচ্ছে। চোখে মুখে দ্রুত পানি দিয়ে বের হলো সে। ভেজা হাত মুছতে মুছতে কল কেটে গেল। মুখ মুছে বিছানার উপর পড়ে থাকা ফোনের দিকে এগিয়ে গেল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো তার একমাত্র ফুপি ফোন দিয়েছে। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো তার। এই মানুষটা তার খুবই কাছের। তার পছন্দের মানুষদের তালিকা খুবই ছোট। যে গুটিকয়েক মানুষ পছন্দের তালিকায় রয়েছে তার মধ্যে ফুপি অন্যতম। ফুপির সাথে তার আলাদা একটা সম্পর্ক। হয়তো ছোটবেলা থেকে কোলেপিঠে করে বড় করে সেজন্য। তার এখনো সেই দিনটির কথা মনে আছে। শীতের কুয়াশায় মোড়ানো এক ভোরবেলা। কনকনে শীতে চুলার পাশে বসে সে হাত গরম করছিল। সূর্যের মুখ তখনো আকাশের বুক চিঁড়ে উঁকি দেয়নি। সেই ভোরবেলা তার ফুপি ছোট্ট একটা কাপড়ের পুঁটলি হাতে তাদের বাড়িতে চলে এলো। খুশিমনে দৌঁড়ে গিয়ে সে ফুপিকে জড়িয়ে ধরেছিল। এমন ভাবে আঁকড়ে ধরেছিল যেন ছাড়লেই ফুপি হারিয়ে যাবে। কিন্তু ফুপি হারিয়ে যায়নি। সেদিনের পর থেকে এতগুলো বছর ফুপি তাদের সাথেই থেকেছে। কিছুদিন পর বুঝতে পেরেছিল ফুপির সংসার ভেঙে গেছে। এতে বড়রা মনঃক্ষুণ্ন হলেও সে ভীষণ খুশি হয়েছিল। সেদিনের পর থেকে তার প্রতিটা মুহূর্ত ফুপির সাথে কেটেছে।
কল ব্যাক করলো সে। দু বার রিং হতে ওপাশে থেকে ফুপির ঝরঝরে কন্ঠ শুনতে পেল। মন ভালো লাগায় ছেয়ে গেল তার। আহ্লাদী স্বরে বলল,
‘ফুপি!’
‘কি হয়েছে? মন খারাপ?’
‘উঁহু। তোমরা সবাই কেমন আছো?’
‘ভালো রে। তোরা গ্রামে ফিরবি কবে? এক মাস হতে চলল। তোর মা উতলা হয়ে গেছে তোকে দেখার জন্য।’
তিথির মনটা আনচান করে উঠলো। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সবকিছু ছেড়েছুড়ে এক্ষুণি গ্রামে ফিরে যাক। ওখানে তার প্রাণশক্তি ঘুমিয়ে আছে। পরক্ষণে মনের আয়নায় সবুজের বীভৎস হাসিমাখা মুখটা ভেসে উঠলো। গ্রামে ফেরার কথা ভুলে গেল। ফুপিকে সান্ত্বনার সুরে বলল,
‘আমিও তো তোমাদের দেখতে চাই। এখানে চলে আসো না ফুপি।’
‘সেটা কি করে সম্ভব? আচ্ছা, থাক। আমি সম্পদের সাথে কথা বলে নিব। সম্পদ ভালো আছে তো?’
তিথির আবার মন খারাপ হয়ে গেল। উত্তরের দেয়ালের দিকে তাকালো একবার। দেয়ালের ওপাশের রুমে সম্পদ শুয়ে আছে। সে সুস্থ না। তবুও মিথ্যা করে সবাইকে বলতে হচ্ছে সে সুস্থ আছে! মন খারাপ ভাব লুকিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, সুস্থ আছে। তুমি শরীরের যত্ন নিও ফুপি।’
‘ঠিক আছে। তোর মায়ের সাথে কথা বলবি? বসার ঘরে আছে। ডেকে দিবো?’
‘থাক। বিকেলে কথা বলেছি একবার। তোমরা সবাই সাবধানে থেকো।’
সালাম দিয়ে ফোন রেখে দিল তিথি। তার ফুপি বর্তমানে গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা পদে নিয়োজিত আছে। তার নিজের পড়াশোনার ব্যাপারে যাবতীয় সাহায্য এই মানুষটা করেছে। ফুপি নামক মানুষটা তার জীবনের সব বাঁকের খবর জানে। শুধু তার জীবনের সর্বোচ্চ ঘৃণ্য সত্যটা জানতে পারেনি। সে-ও জানাতে পারেনি!
ফোন ফেলে রেখে সম্পদের রুমের দিকে পা বাড়াল সে। রাতের খাবার খাইয়ে সময় মতো ওষুধ খাওয়াতে হবে। রুমের দরজা ভিড়ানো। দরজায় নক করতে গিয়েও সে করলো না। ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। বিছানার দিকে চোখ পড়তে কপাল কুঁচকে এলো তার। সম্পদ আধ শোয়া হয়ে বুকের উপর ল্যাপটপ নিয়ে টেপাটেপি করছে। তিথি ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে বলল,
‘এখানে কি হচ্ছে?’
সম্পদ কিছুটা চমকে উঠলো। সেই সাথে তীব্র একটা সুগন্ধি ঢেউয়ের মতো নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করলো। তিথির দিকে চোখ পড়তে কেমন অপ্রশম্য আহ্বানের অস্পষ্ট শক্তি দেখতে পেল। বুকের রক্ত হীম হয়ে গেল তার। তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নিল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিল দ্রুত। ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে রিনরিনে গলায় বলল,
‘ক-কিছুই হচ্ছে না তো!’
‘আপনি অসুস্থ শরীর নিয়ে আবার কাজ শুরু করেছেন কেন?’
‘কাজ করছি না। কোম্পানির বসকে একটা ইমেইল পাঠালাম। ছুটির জন্য আবেদন আর কি!’
সম্পদের কথায় সন্তুষ্ট হলো না তিথি। সন্দেহের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর এগিয়ে এসে ল্যাপটপের স্ক্রিণের দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো সম্পদের। কিছুক্ষণ দম মেরে স্থির হয়ে রইলো। নিঃশ্বাস আটকে আসতে সে হুড়মুড় করে ল্যাপটপটা তিথির হাতে ধরিয়ে দিল। নিজের শরীরটা বাঁকিয়ে একটু সরে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল,
‘দূরে গিয়ে দেখো। যাও! যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ দেখো! আমি এখন ঘুমিয়ে পড়বো।’
‘ঘুমিয়ে পড়বেন মানে? মাত্র না ঘুম থেকে উঠলেন। এখন আবার ঘুমিয়ে পড়লে রাতের খাবার, মেডিসিন খাবে কে?’
‘তুমি আছো কি জন্যে? তুমি খাবে!’
বেপরোয়া উত্তর দিয়ে সম্পদ সত্যি সত্যি শুয়ে পড়লো। দুই পা টান করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। শুধু চোখ বন্ধ করে ক্ষান্ত হলো না। হালকা গরমের মধ্যেও ব্লাঙ্কেট টেনে মুখ ঢেকে ফেলল। তিথি ল্যাপটপ হাতে নিয়ে বোকার মতো চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এটা কি হলো? সারা বিকেল ঘুমিয়েও মন ভরেনি? চোখ দুটো তীক্ষ্ণ হয়ে এলো তার। ল্যাপটপ টা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে একটানে সম্পদের মুখের উপর ব্লাঙ্কেট সরিয়ে ফেলল।
(চলবে)
আসসালামু আলাইকুম। এতদিন অনেকেই গল্পের জন্য অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু আমার গল্প লেখার বা এক্টিভ হওয়ার পরিস্থিতি ছিল না। খুবই দুঃখীত সেজন্য। ইনশাআল্লাহ এখন থেকে নিয়মিত গল্প পাবেন। আর অপেক্ষা করতে হবে না। স্যরি এগেইন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।