#প্রেম_পায়রা 🕊️🕊️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#উনবিংশ_পর্ব
পরদিন সকালে সূর্যের আলো ফোটার কিছুক্ষণ পরই মিশরাত ঘুম থেকে উঠে লাগেজ গোছানো শুরু করে দেয়। কেননা আজ যে ও বাড়ি ফিরতে হবে। লাগেজ গোছানো শেষ হলে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে মিশরাত। মায়ের সাথে নাশতা বানানোর কাজে লেগে পড়ে সে।
সকাল ৮:৩০ মিনিট,,
ডাইনিং টেবিলে বসে রুটি চিবোচ্ছে স্নিগ্ধ। পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিশরাত সবাইকে সার্ভ করে দিচ্ছে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে মিশরাত আর স্নিগ্ধ। এ কদিন মেহেরের সাথে বেশ ভালোই সময় কেটেছে মিশরাতের।
গাড়ির সিটে বসতেই মাথা এলিয়ে দেয় মিশরাত। স্নিগ্ধ সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে বলে উঠলো,
– ” বাড়িতে গিয়ে মা যদি কিছু জিজ্ঞেস করে আমাদের ব্যাপারে তাহলে বলো যে সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। আর তুমি তো জানোই যে মা ছোট খাটো বিষয় নিয়েও সন্দেহ করে তাই আমাদের সাবধানে থাকতে হবে!”
স্নিগ্ধর কথায় মিশরাত শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। বাইরের ঠান্ডা হাওয়া গাড়ির জানালার গ্লাস ভেদ করে মিশরাতকে ছুঁয়ে দিচ্ছে বারবার।
প্রায় তিন ঘন্টা পর গাড়ি এসে থামে চৌধুরী বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে লাগেজ গুলো এক সাইডে বের করে নেয় স্নিগ্ধ। মিশরাতও অন্য পাশ থেকে বের হয়ে যায়। কলিং বেলে চাপ দিতেই অপর পাশ থেকে মিনিট দুয়েক পর মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী দরজা খুলে দিলেন। মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীকে দেখা মাত্র মিশরাত সামনে এগিয়ে গেল।
মিসেস ইয়ামিন ও মিশরাতকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর স্নিগ্ধ আর মিশরাত দুজন একসাথে বাসায় প্রবেশ করে। ড্রয়িং রুমে সোফার উপর চোখ যেতেই স্নিগ্ধর চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। অস্ফুট স্বরে শুধু বলে উঠলো,
– ” ব,বা,বাবা!!”
মিস্টার ইফতেখার চৌধুরী সোফার উপর বসে চায়ের কাপে চুমুক বসিয়েছিলেন সবেমাত্র কিন্তু পেছন থেকে হঠাৎ স্নিগ্ধর গলার আওয়াজ পেয়ে তিনি থেমে গেলেন।
স্নিগ্ধ একপ্রকার দৌড়ে ইফতেখার চৌধুরীর কাছে চলে গেল।
– ” বাবা তুমি? বাবা তুমি ঠিক হয়ে গিয়েছো?”
অতি উৎসুক হয়ে ইফতেখার চৌধুরীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে জিজ্ঞেস করে উঠলো স্নিগ্ধ। মিশরাতও গুটিগুটি পায়ে স্নিগ্ধর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ইফতেখার চৌধুরী আলতো হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝান।
– ” হ্যাঁ বাবা, স্নিগ্ধ! দেখ আমি ঠিক হয়ে গিয়েছি! এইযে দেখ আমি এখন কথা বলতে পারছি!”
ইফতেখার চৌধুরীর কথা শুনে স্নিগ্ধ খুশি হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
– ” আ’ম সো মাচ হ্যাপি,বাবা! আমি সত্যি কল্পনাও করতে পারি নি আমি বাড়ি এসে এত বড় সারপ্রাইজ পাবো! কিন্তু মা তুমি তো একবারও আমাকে ফোন করে জানাও নি এ ব্যাপারে!!”
মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী এগিয়ে আসলেন।
– ” যদি তোকে বলেই দিতাম তাহলে সারপ্রাইজ থাকতো কিভাবে?
আর এ সবকিছুই হয়েছে তোর আর মিশরাতের জন্য। মিশরাতকে আমি যতই ধন্যবাদ দেই না কেন সেটা কম হয়ে যায়। মেয়েটার তোর বাবার প্রতি যত্ন, দায়িত্বে তোর বাবা আরো তারাতাড়ি রিকভার করেছে।”
মিসেস ইয়ামিনের কথার সাথে ইফতেখার চৌধুরীও তাল মিলিয়ে বলে উঠলেন,
– ” হ্যাঁ তোর মা ঠিকই বলেছে, আজ যদি তুই আর মিশরাত না থাকতি তাহলে আমার সুস্থ হওয়া বোধ হয় এবার হয়ে উঠতো না।”
দুজনের কথা শুনে মিশরাত হালকা হেসে বলে উঠলো,
– ” এসব কি বলছেন আপনারা? আপনারা আমার বাবা মায়ের মতো! আর বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের যে কর্তব্য থাকে সেটাই আমি পালন করেছি!”
মিশরাতের কথা শুনে স্নিগ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে মিশরাতের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে রইলো।
রাতের বেলা,,
ডিনার শেষ করে প্রায় রাত দশটার দিকে রুমে আসে স্নিগ্ধ। রুমে এসে খেয়াল করে মিশরাত ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে বসে আনমনে চুলে বিনুনি পাকাচ্ছে। এদিকে রুমে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মাথা তুলে তাকায় মিশরাত। স্নিগ্ধর দিকে চোখ যেতেই স্নিগ্ধ বিনিময়ে একটা হাসি দেয়।
– ” থ্যাঙ্ক ইউ মিশরাত।”
বিছানার উপর বসতে বসতে বলে উঠলো স্নিগ্ধ।
– ” থ্যাঙ্ক ইউ? কিন্তু সেটা কিসের জন্য?”
ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে মিশরাত।
– ” এইযে বাবা আজ পুরোপুরি সুস্থ! আমি তো কল্পনাও করিনি বাবা এতো তাড়াতাড়ি রিকভার করবে! বাট সেটা সম্ভব হয়েছে শুধু তোমার জন্য!
তার জন্য এই ছোট্ট একটা থ্যাঙ্ক ইউ।”
মিশরাত নিঃশব্দে হাসে।
– ” হয়েছে হয়েছে এবার থামুন!
আমি জানি আমাদের বিয়েটা নরমাল না বাট এ কয়েক মাসে এ বাড়ির সবার সাথে একটা ভালো বন্ডিং হয়ে গিয়েছে আমার। সেটাকে ভুলি কি করে? আর ঐ যে বললাম আপনার বাবা মা আমার বাবা মায়ের মতোই!
সো থ্যাংকস ইজ নট এলাউড! মাইন্ড ইট!!”
সোজাসাপ্টা ভাবে বলে দিল মিশরাত। তবে প্রথম বাক্যটা বলার সময় কেন জানি গলাটা বারবার কেঁপে উঠছিল যেন এ কথাটা বলা অন্যায়।
– ” আচ্ছা বাদ দিন! আপনার কাছে আজ একটা আবদার চাইবো? পূরণ করবেন?”
রিকোয়েস্ট করে বললো মিশরাত।
– ” হ্যাঁ অবশ্যই কেন না?
ওয়েট আমি আসছি!”
বলেই পাশ থেকে উঠে গিয়ে একটা গিটার নিয়ে আসলো স্নিগ্ধ।
– ” আপনি গিটার ও বাজাতে পারেন?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো মিশরাত।
– ” ইয়েস ম্যাম!
কলেজ লাইফে থাকতে শখের বশে গিটার বাজানো শিখেছিলাম। অনেকদিন বাজানো হয় না অবশ্য!”
বলেই মিশরাতের ঠিক সামনে বসে পড়লো স্নিগ্ধ। কিছুক্ষণ পর ই গিটারের টুংটাং শব্দ কানে আসে মিশরাতের।
” তো কেয়া হুয়া জুদা হুয়ে
মাগার হ্যায় খুশি মিলে তো থে,,
তো কেয়া হুয়া মুড়ে রাস্তে
কুছ দূর সাঙ্ চালে তো থে
দুবারা মিলেগে কিসি মোর পে
যো বাকি হ্যায় বাত ও হোগি কাভি,,,
চালো আজ চালতে হ্যায় হাম,,,,,,,
ফির মুলাকাত হোগি কাভি
ফির মুলাকাত হোগি কাভি,,
জুদা হো রাহে হ্যায় যো হাম,,,,
ফির মুলাকাত হোগি কাভি,,,
দুখাও ম্যায় দিল
জাতে জাতে তেরা
মেরা অ্যায়সা কোই ইরাদা নেহি
ছুপা লুগা ম্যায় হাসকে আসু মেরে
এ তেরি খুশি সে তো জাদা নেহি
জো বিছরে নেহি তো ফির ক্যায়া মাজা
জারুরি বি হ্যায় রেহনি থোরি কামি,,
নেহি হোগা কুছভি খাতাম,,,
ফির মুলাকাত হোগি কাভি,,
ফির মুলাকাত হোগি কাভি,,
জুদা হো রাহে হে কাদাম,,,,,
ফির মুলাকাত হোগি কাভি,,,,,,,,
সিতারো কি ভীড় কো গরছে
এক আখরি বার ফির দেখলো
এ যো দো আলাগ সি হ্যায় বেয়ঠে হুয়ে
এ তুম হো এ ম্যায় হু
ইয়েহি মানলো
এ দিন মে নেহি নাজার আয়েগে,,
মাগার কাল কো যাব রাত হোগি কাভি
যো ইয়ে রশনি হোগি কাম,,
ফির মুলাকাত হোগি কাভি,,
ফির মুলাকাত হোগি কাভি,,
জুদা হো রাহে হ্যায় কাদাম
ফির মুলাকাত হোগি কাভি,,,”
পুরোটা গান শেষ হতেই একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্নিগ্ধ। মিশরাতও এতক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল স্নিগ্ধের দিকে। গানের প্রতিটা লাইন গাইতে গিয়ে গলাটা কিঞ্চিৎ কেঁপে কেঁপে উঠছিল স্নিগ্ধর।
– ” আপনি আমায় ভালোবাসেন স্নিগ্ধ?”
আনমনে তাকিয়েই বলে উঠলো মিশরাত।
স্নিগ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মিশরাতের দিকে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না তার। অতিমাত্রায় অবাক হলে যা হয়?
– ” কি বলছো এসব মিশরাত?”
ধ্যান ফিরে আসে মিশরাতের। মনে পড়ে সে তার অজান্তেই কত বড় কথা বলে ফেলেছে!
অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে। কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছোট একটা দম নিয়ে বলে উঠে,
– ” আপনি কি আমায় ভালোবাসেন স্নিগ্ধ?”
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায় স্নিগ্ধ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছে।
– ” এসব কি ধরনের কথা, মিশরাত?
আমি তো তোমাকে সবকিছু আগে থেকেই বলে দিয়েছি!! তারপর ও তুমি এসব কথা বলছো কি করে??”
স্নিগ্ধর কথা শুনে মিশরাতও বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর স্নিগ্ধর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
– ” হ্যাঁ আমি জানি সবটা!!
সবটা জেনেও আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি! আমাকে কি ভালোবাসা যায় না?”
আরেক দফা অবাক হয় স্নিগ্ধ। এসব কি বলছে মিশরাত!
– ” মিশরাত!!
আর ইউ লস্ট ইউর সেন্স? কি সব হাবিজাবি বকছো?
ওয়েট, ওয়েট!! কেউ কি তোমাকে কিছু বলেছে?”
মিশরাত মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।
– ” তাহলে?
তুমি হঠাৎ এমন সিরিয়াস হয়ে গেলে কিভাবে!
তুমি তো জানতে তাই না যে আমাদের বিয়েটা জাস্ট একটা ডিল!”
– ” হ্যাঁ আমি জানি আমাদের বিয়ে একটা ডিল!
কিন্তু আমার মন? আমার মনকে কি করে কন্ট্রোল করবো আমি!
হ্যাঁ আমি আমি চাই আপনার ভালোবাসা! শুনেছেন?
আই ওয়ান্ট টু লাভ ইউ!!”
একপ্রকার চিল্লিয়ে বলে উঠে মিশরাত।
এদিকে মিশরাতের কথা শুনে রাগ উঠে যায় স্নিগ্ধর। রাগের কারনে পাশ থেকে ফুলদানি হাতে নিয়ে সেটা মেঝেতে সজোরে ছুড়ে মারে। ভয়ে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে মিশরাত। মিশরাতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়লো মিশরাত।
স্নিগ্ধকে পিছু ডাকতে গিয়ে আহ্ শব্দ করে উঠলো মিশরাত। ভাঙা কাঁচের টুকরো গুলো পায়ের তালুতে গেঁথে গিয়েছে।
ভোর রাতে রুমে প্রবেশ করতেই আতকে উঠে স্নিগ্ধ। সারা রুম জুড়ে ছোপ ছোপ রক্তের চিহ্ন। মেঝেতে হেলান দিয়ে ঘুমন্ত মিশরাতের দিকে চোখ পড়ে তার। রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করে তাকাতেই চোখ যায় মিশরাতের পায়ের দিকে। রক্তের লম্বা স্রোত বয়ে যাচ্ছে আশপাশ জুড়ে।
ঘুমের ঘোরে পায়ের মধ্যে শীতল স্পর্শ পেয়ে হালকা নড়েচড়ে উঠে মিশরাত। তবে ঘুম পুরোপুরি ভেঙে যায় না। পায়ে মলম লাগিয়ে দিয়ে খুব সাবধানে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় স্নিগ্ধ। তারপর নিজে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে আকাশপানে চেয়ে!
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে মিশরাত। পায়ের দিকে চোখ যেতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে তার। ফ্রেশ হয়ে স্নিগ্ধর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও স্নিগ্ধ তাকে বরাবরের মতই এড়িয়ে চলেছে। এতে কিছুটা মন খারাপ হয় মিশরাতের।ভাবে সময়ের সাথে হয়তো সব আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু সময় প্রবাহমান। দিন যেতে যেতে প্রায় দেড় মাস কেটে যায়। কিন্তু স্নিগ্ধর মাঝে কোনো পরিবর্তন আসে নি। সে পূর্বের তুলনায় মিশরাতের থেকে দূরে দূরে থাকে। হাজার চেষ্টার পরও স্নিগ্ধকে নরমাল করতে পারে নি সে।
ডার্ক ব্লু রঙের শাড়ি, পার্লের অর্নামেন্টস্, চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। পুরো রুমটাকে সুন্দর করে ক্যান্ডেল আর ফুলের সংমিশ্রণে সাজিয়ে বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধর জন্য অপেক্ষা করছে মিশরাত।
আজ স্নিগ্ধের কাছে নিজের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে মিশরাত। বলে দিবে নাম না জানা সব অনুভূতির কথা। কাঙ্ক্ষিত সময়েই বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে। অতি উৎসুক হয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে সে। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলতেই বিস্ময়ের সীমা থাকে না তার। চোখকে যেন বিশ্বাস করা খুব কঠিন মনে হচ্ছে মিশরাতের। শুধু অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে,
– ” স,স্,স্ন,স্নিগ্ধ!!!”…………..
#প্রেম_পায়রা 🕊️🕊️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#বিংশ_পর্ব
– ” স,স্,স্ন,স্নিগ্ধ!!!!”
কম্পিত কন্ঠে অবাক হয়ে বলে উঠলো মিশরাত। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে। এ কি করে সম্ভব!
অরিনের কাঁধের উপর স্নিগ্ধর এক হাত আর অরিনের এক হাত স্নিগ্ধর কোমরে। নেশায় টলমল হয়ে গিয়েছে স্নিগ্ধ। গায়ে লেপ্টে থাকা সাদা শার্টের বোতাম তিন চারটা খোলা। স্নিগ্ধ কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে একটা জায়গায় চোখ আটকে যায় মিশরাতের। শার্টের কলার আর স্নিগ্ধের নেক এরিয়াতে লাল রঙের লিপস্টিক যুক্ত ওষ্ঠের ছাপ।
এ পাঁচ মাসে এ প্রথম স্নিগ্ধকে এভাবে নেশায় বুঁদ হয়ে বাড়ি ফিরতে দেখেছে মিশরাত। কি এমন হয়েছিল যে তাকে এভাবে নেশাক্ত হতে হলো!
অরিন ও ঢুলুঢুলু ভাবে স্নিগ্ধ কে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। মিশরাত একবার ভালো করে পরখ করে নিল চারপাশে যে মিসেস ইয়ামিন বা ইফতেখার চৌধুরীর মাঝে কেউ আছে কিনা? কাউকে আশেপাশে না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। উপরে রুমে পৌঁছাতেই মিশরাত স্নিগ্ধ কে তড়িঘড়ি করে বিছানার উপর শুইয়ে দেয়।
– ” স্নিগ্ধ, স্নিগ্ধ! উঠুন! এসব কি অবস্থা করেছেন নিজের?”
স্নিগ্ধকে জাগ্রত করার চেষ্টা করে বলতে থাকে মিশরাত।
– ” সকালের আগে স্নিগ্ধর জ্ঞান ফিরবে না মিশরাত! তাই অযথা চেষ্টা করে লাভ নেই।”
পাশ ফিরে তাকায় মিশরাত। অরিনের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
– ” স্নিগ্ধ হঠাৎ করে এতো ড্রিংকস কিভাবে করলো? আর উনার এই অবস্থা কেন?
আপনি তো উনার সাথে ছিলেন তাই না, অরিন আপু?
উনার শার্টে এসব কিসের চিহ্ন!!”
অরিন মুখটাকে ইনোসেন্ট বানিয়ে বলে উঠল,
– ” আমি জানি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না মিশরাত!
কিছু দিন ধরেই স্নিগ্ধ স্যার আমার সাথে অদ্ভুত আচরণ করছে। হুটহাট কাছে এসে পড়ে আমার।
আসলে আজকে অফিস শেষে বেরোনোর সময় হঠাৎ করে স্নিগ্ধ স্যার আমার হাত ধরে ফেললেন। আমি বারবার বারণ করছিলাম কিন্তু তার মাঝে কোনো ভাবান্তর ছিল না।
সে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে জোরে জোরে ড্রাইভ করা শুরু করলেন। মিনিট বিশেক পর শুনশান একটা ক্লাবের সামনে গাড়ি থামিয়ে আমাকে টেনে হিচড়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ক্লাবে সারি সারি মদের বোতল রাখা একটা টেবিলে গিয়ে সেখান থেকে বোতল নিয়ে একের পর এক গ্লাসে খাওয়া শুরু করেন। আমি সেখান থেকে কোনো মতে ছুটে পালিয়ে আসতে চাইলে স্নিগ্ধ স্যার আমাকে আবারো ঐ নেশালো অবস্থায় ধরে ফেলেন। ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকলেও তিনি আমাকে ছাড়েন নি!! একটা সময় পর যখন পুরোপুরি নেশায় বুঁদ হয়ে যায় তখন আমার সাথে জোরাজুরি করার চেষ্টা করেন তিনি!!”
বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো অরিন। এদিকে অরিনের এসব কথাবার্তা শুনে রাগে, দুঃখে চোখ নাক লাল হয়ে এসেছে মিশরাতের। অরিন আবারো নাক টেনে বলে উঠলো,
– ” আমি অনেক চেষ্টা করেছি মিশরাত কিন্তু আমি নিজের সর্বনাশ হওয়াকে বাঁচাতে পারি নি!!
আমি এখন কি করবো বলো?”
অরিনের বলা প্রতিটা কথা যেন বিষের মতো অসহ্যনীয় মনে হচ্ছে মিশরাতের কাছে! তাহলে তার এতদিনের ধ্যান ধারণা সবটাই কি মিথ্যে ছিল। তার মানে কি?
– ” আমি স্নিগ্ধকে খুব ভালো ভাবে চিনি। সে আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের সাথে এমন আচরন করেনি! তাহলে আপনার সাথে এমন জঘন্য কাজ করার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে?
আর স্নিগ্ধের শার্টে আর গলায় লিপস্টিকের দাগ গুলো তো আপনার!!
সেগুলো লাগলো কি করে?”
মিশরাতের কাঠকাঠ গলায় কথা শুনে হালকা ভড়কে গেল অরিন। কপালে হালকা ঘাম জড়ো হয়ে গিয়েছে। তবুও মুখটাকে কাঁদো কাঁদো করে বলে উঠলো,
– ” মিশরাত তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো? আমি একটা মেয়ে হয়ে কি নিজের মান সম্মান বিলিয়ে দিবো নাকি?
আর ঐ দাগগুলো হয়তো কোনো ভাবে লেগে গিয়েছে!”
অরিনের কথা গুলো ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না মিশরাত।
এদিকে স্নিগ্ধ বিছানায় জ্ঞান হীন অবস্থায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে রয়েছে।
– ” আমি ঠিক কী বলবো বুঝতে পারছি না! এতো রাতে মা বাবা আপনাকে এখানে দেখলে নিশ্চয়ই সবটা জেনে যাবে যেটা আমি চাই না এখন। বাবা হার্টের পেশেন্ট। আমি আপনার সাথে কাল কথা বলবো!”
বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মিশরাত। এদিকে অরিন বাম হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
– ” যাক, প্ল্যান টা অন্তত কাজে দিয়েছে। সো স্যাড তাই না মিশরাত!
তোমার মনে জমে থাকা স্নিগ্ধর প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে!
আর বাকিটুকু ধামাকা না হয় কাল সকালেই হবে। কেননা এটাই তোমার স্নিগ্ধর জীবনে লাস্ট দিন। এর পর ভালোবাসার দুটো পাখি দু প্রান্তে চলে যাবে!!”
এই বলেই বাঁকা হেসে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো অরিন।
এদিকে মিশরাত অনুভূতিহীন মূর্তির মত রুমের ফ্লোরে বসে রয়েছে। কি থেকে কি হয়ে গেল তার জীবনে? শুনেছে আকাশের মেঘের রং ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়। তাই বলে তার জীবনের সবটুকু রং এভাবে মেঘেদের আড়ালে হারিয়ে যাবে?
– ” কীভাবে করতে পারলেন এমনটা, স্নিগ্ধ?
আমি তো চেয়েছিলাম সব কিছু ভুলে নতুন করে আবারো সবটা শুরু করতে। কিন্তু আপনি কি করে ফেললেন এটা স্নিগ্ধ!!
আর তাছাড়া অরিন আপুই বা মিথ্যে কথা বলবে?
কাকে ছেড়ে কাকে বিশ্বাস করবো? এ কেমন গোলক ধাঁধায় পড়ে গেলাম আমি!!”
মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে মিশরাত।
সকালের আলোর ছিটেফোঁটা চোখকে স্পর্শ করতেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে স্নিগ্ধ। পিটপিট করে তাকাতেই নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে সে। মাথাটা প্রচুর পরিমাণে ঝিমঝিম করছে। কোনোমতে হেলান দিয়ে উঠতেই চোখ পড়ে নিচে মিশরাতের হেলান দিয়ে ঘুমন্ত চেহারাকে। ঘুমন্ত মায়াবী চেহারা দেখে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মিশরাতের দিকে। কিন্তু পরমুহূর্তেই গত রাতের কথা মনে পড়তেই চেহারার রং ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে থাকে স্নিগ্ধর। ফর্সা চেহারায় লাল রক্তিম আভা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
হঠাৎ করে চোখে মুখে পানির ঝাপটা এসে পড়তেই ধড়ফড় করে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে মিশরাত। মাথার চুল বেয়ে টুপটুপ করে পানি ঝড়ছে। সকাল বেলা এভাবে ঘুমের মধ্যে এমন পানির ঝাপটা পেয়ে অবাক হয়ে যায় সে। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে সামনে পানিশূন্য জগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধ। চোখেমুখে রাগের আভা।
– ” এসব কি ধরনের আচরণ স্নিগ্ধ? আপনি এগুলো কি শুরু করেছেন?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মিশরাত।
– ” কি শুরু করেছি বুঝতে পারছিস না তুই?
একটু পরেই সব বুঝতে পারবি, ওয়েট!!”
রাগে গজগজ করতে করতে আলমারির কাছে গিয়ে সেটা খুলে একের পর এক শুরু করে মিশরাতের সব জামাকাপড়, শাড়ি সব মেঝেতে ফেলতে থাকে স্নিগ্ধ। এদিকে স্নিগ্ধর হঠাৎ এমন আচরণ দেখে ঘাবড়ে যায় মিশরাত।
– ” কি হচ্ছে কি এসব স্নিগ্ধ! আপনি এভাবে আমার জিনিসপত্র মেঝেতে ছুড়ে ফেলছেন কেন?
কি শুরু করেছেন আপনি!!”
মিশরাতের কথা শুনে থেমে যায় স্নিগ্ধ। পেছনে ফিরে ধীর পায়ে মিশরাতের সামনে এসে দাঁড়ায়। মিশরাত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেই স্নিগ্ধ হুট করেই মিশরাতের বাহু খামচে ধরে। যার ফলস্বরূপ মিশরাত ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে।
– ” এই জিনিসপত্র গুলোর মতো একটু পর ঠিক তোকেও এভাবে আমি ছুড়ে ফেলবো বাড়ির বাইরে। তোর মতো একটা নষ্টা মেয়ের আমার বাড়িতে কোনো জায়গা নেই!!
এক্ষুনি তুই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবি!!”
স্নিগ্ধর বলা প্রতিটা কথা মিশরাতের কানে বাজছে। কি বলছে কি এসব স্নিগ্ধ।
– ” আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে স্নিগ্ধ?
কি সব হাবিজাবি বকছেন!! কি করেছি আমি যে আমায় এত বড় অপবাদ দিচ্ছেন!”
– ” আমি হাবিজাবি বকছি? আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?
ঐ রাসকেল রবিনের সাথে নষ্টামি করার আগে এসব মনে ছিল না?
আই জাস্ট হেট ইউ মিশরাত! জাস্ট গেট লস্ট ফ্রম মাই হাউজ!!”
স্নিগ্ধর চিৎকারে কেঁপে উঠে মিশরাত। মাথা ঝিমঝিম করছে তার? রবিনের সাথে তার কি সব সম্পর্ক বানিয়ে দিয়েছে স্নিগ্ধ!
– ” স্নিগ্ধ নিশ্চয়ই আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে! আমি এসবের কিছুই করি নি!
প্লিজ বিশ্বাস করুন! না জেনে আমায় এত বড় অপবাদ দিবেন না।”
অনুনয়ের চোখে বলে উঠলো মিশরাত। কিন্তু স্নিগ্ধর মাঝে তেমন কোনো ভাবান্তর হলো না। সে উল্টো মিশরাতের বাহু পূর্বের তুলনায় আরো জোরে চেপে ধরলো।
– ” আমার ভুল হচ্ছে? আমার?
তাহলে এগুলো কি!!”
বলেই ফোন থেকে স্নিগ্ধ মিশরাতের সামনে যা দেখালো তাতে মিশরাতের চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম!…………
#চলবে 🍂
( আসসালামুয়ালাইকুম। সবাই কেমন আছেন। আজকের পর্ব কেমন হয়েছে জানাবেন।
ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
ভালোবাসা অবিরাম 🖤🖤)
#চলবে 🍂
(আসসালামুয়ালাইকুম। সবাই কেমন আছেন। আজকের পর্বের টুইস্ট কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাবেন।
ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
ভালোবাসা অবিরাম 🖤🖤)