প্রেম_পায়রা পর্ব ১৭+১৮

#প্রেম_পায়রা 🕊️🕊️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#সপ্তদশ_পর্ব

– “শুভ্রতা কোথায় স্নিগ্ধ?
আর ডায়েরির ছেঁড়া পাতা গুলোতেই বা এমন কি ছিল যার কারণে আপনি সেগুলো ছিঁড়ে ফেলেছেন?”

শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো মিশরাত‌।
দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা। স্নিগ্ধ ভালো করেই জানে মিশরাত সবটা না জেনে থামবে না। আর কতোই বা লুকোবে তার অতীতকে। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবতা কাটিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠল,
– ” শুভ্রতা ইজ ডেড!”

স্নিগ্ধর কথা কর্ণপাত হতেই মিশরাতের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। অতিমাত্রায় শক খেলে যা হয় সাধারণত। বিস্ময়ের সুরে বলে উঠল,
– ” মানে!
কিন্তু কি করে! ঐদিন রাতেও তো সবকিছু ঠিকঠাক ছিল!”

মিশরাতের কথা শুনে স্নিগ্ধ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

ফ্ল্যাশব্যাক,,

” সেদিন রাতে রাগে ক্ষোভে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার শুভ্রতার বারংবার ডাক কানে যাওয়া সত্বেও পেছন ফিরে তাকাই নি আমি। কেনই বা তাকাবো! যেখানে আমি তাকে আমার সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছিলাম, যেই বেস্ট ফ্রেন্ড ছাড়া আমার দুনিয়া অন্ধকার ছিল তারা দুজনেই আমাকে বাজে ভাবে ঠকিয়েছে।
দ্রুত পায়ে হাঁটার এক পর্যায়ে শুভ্রতার আত্ম চিৎকার কানে পৌঁছাতেই আমার পা আপনাআপনি থমকে গেল। পেছনে তাকাতেই আমার হিতাহিত জ্ঞান টুকু হারিয়ে গিয়েছিল। কেননা চোখের সামনেই নিজের ভালোবাসার মানুষটির রক্তাক্ত শরীর রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা মোটেও কম কথা নয়। একটা বড় বাসের ধাক্কায় মুহূর্তেই পুরো শরীর রক্ত বর্ণ ধারণ করতে থাকে শুভ্রতার‌।

সেদিনের চেয়ে মর্মান্তিক কোনো স্মৃতি আমার জীবনে আদৌ আছে কি না আমি মনে করি না। সেদিন খুব কষ্টে নিজেকে সামলে শুভ্রতাকে নিয়ে হসপিটালে পৌছেছিলাম। এক্সিডেন্টের কারণে চেহারার এক পাশের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। লাস্ট তিন ঘন্টা যাবৎ অপারেশন থিয়েটারের সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে একসময় ডক্টর বেরিয়ে আসে। আর এসে আমাকে যা বলে তাতে আমার পায়ের তলা দিয়ে মাটি সরে যায়।

ডক্টর: “সো সরি মিস্টার স্নিগ্ধ!
উই ট্রাইড আওয়ার‌ বেস্ট। বাট শি ইজ নো মোর!”
থমকে গিয়েছিলাম আমি। নিজের কানকে যেন ঐ মুহুর্তে বিশ্বাস করতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ঐযে নিয়তি!
সে আমাদের কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে দেয়। সেদিন আনান ও হসপিটালে উপস্থিত ছিল। এরপর থেকে আনানের সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক রাখিনি। কয়েকমাস পরেই এক্সাম দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিডিতে ব্যাক করি। তবে বিডিতে ব্যাক করি সম্পূর্ণ নতুন রূপে।
একদম নতুন স্নিগ্ধ যাকে কেউ কখনো দেখেনি। অবশ্য মা এ ব্যাপারে আগে থেকেই জানতো আর এটা কোনোভাবে বাবার কানে পৌঁছাতেই বাবা আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। আর যেটাতে অবাধ্য হওয়ার কারণেই বাবা হার্ট অ্যাটাক করে।”

মিশরাত এতক্ষণ একদৃষ্টে খুব মনোযোগ সহকারে স্নিগ্ধের বলা প্রতিটা কথা শুনছিল। কথাগুলো বলতে গিয়ে স্নিগ্ধের গলা বারবার কেঁপে উঠছিল। চোখের কোণে অশ্রু জমে গিয়েছে ইতিমধ্যে।
মিশরাতও ঠিক কি বলবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। তার কিই বা বলা উচিত!
মিশরাতের টনক নড়ে স্নিগ্ধের আওয়াজ পেয়ে।
– ” তবে হ্যাঁ একটা কথা কি জানো, ভালোবাসার মানুষটি যতই ভুল করুক না কেন, তার প্রতি অভিমান, অভিযোগ জমুক না কেন দিনশেষে তার প্রতি কখনোই আমাদের মনে ঘৃণা জন্মাবে না।
আর যদি কখনো তোমার ভালোবাসার মানুষটির প্রতি ঘৃণা জন্মায় তাহলে বুঝে নিও আসলে তুমি ঐ মানুষটিকে কোনোদিন ভালোই বাসো নি।”

মিশরাত মলিন হেসে বলে উঠলো,
– ” এখনো খুব ভালোবাসেন শুভ্রতাকে, তাই না?”
মাথা তুলে তাকালো স্নিগ্ধ। মিশরাতের দিকে তাকিয়ে সোজাসাপ্টা গলায় বলে উঠলো,

– ” ভালোবাসি কি না জানি না তবে সে এখনো আমার হৃদয়ের একটা স্থানে গেঁথে রয়েছে যা আমি চাইলেও ভুলতে পারবো না।”

– ” আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে। আমি বিছানা ঠিক করে দিচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”

বলেই উঠে চলে যেতে নিলে স্নিগ্ধর ডাক শুনে থমকে দাঁড়ায় মিশরাত‌।

– ” তুমি কাউকে ভালোবাসো না?”
পেছন ফিরে তাকায় সে। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে উঠে,

– ” না কাউকে তেমন করে কোনোদিন ভালোবাসা হয়নি!”
বলেই গটগট করে রুমে চলে আসলো মিশরাত‌। আর স্নিগ্ধ বাইরের খোলা আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
পরদিন সকালে সূর্যের আলোর ঝলকানি মুখের উপর পড়তেই নড়েচড়ে উঠে মিশরাত। চোখ পিটপিট করে তাকাতেই পাশে স্নিগ্ধের ঘুমন্ত চেহারা চোখে পড়ে তার। কপালের চুল গুলো এলোমেলো, খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলোও হালকা অগোছালো তবে দেখতে অনেক কিউট লাগছে।
– ” কে বলবে এই মানুষটার ভেতরে এতো গুমোট কষ্ট লুকায়িত!”

স্নিগ্ধর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করলো মিশরাত‌।

– ” আচ্ছা ঠিক আছে! তুমি ওদের উপর নজর রাখো আর হ্যাঁ প্রতিটা ইনফরমেশন আমাকে টাইম টু টাইম সেন্ড করবে!”
বলেই খট করে কল কেটে দিলো অরিন।

– ” কি মনে করেছো স্নিগ্ধ? তুমি ওখানে থাকবে আর আমি এখানে থেকে কিছুই জানতে পারবো না?
উহু মিস্টার আশফিন চৌধুরী স্নিগ্ধ, আমি তোমার আশেপাশে না থাকলেও সবকিছু একাকীই আমার জানা হয়ে যাবে!”
বলেই কিছুটা বাঁকা হাসলো অরিন‌।

বিকেলের দিকে স্নিগ্ধ, মিশরাত‌, মেহের, ইরফান, মিসেস ইবনাত আর আজীজ সাহেব সকলেই ঘুরতে বেরিয়েছেন একসাথে। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর গাড়ি এসে থামে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। সবাই বেরিয়ে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে। কর্ণারের সাইডে গিয়ে একটা টেবিলে বসে পড়ে মিশরাত আর স্নিগ্ধ। আর পেছনের সারিতেই বাকি সবাই বসে। মেহেরের প্রেগন্যান্সির তিন মাস চলছে। ওয়েটার এসে সবার টেবিল থেকে অর্ডার নেয়া শেষ করে স্নিগ্ধ আর মিশরাতের টেবিলে এসে অর্ডার নিতে চাইলে স্নিগ্ধ বলে উঠে,
– ” শুধু এক কাপ ব্ল্যাক কফি!”
ব্ল্যাক কফির নাম শুনতেই নাক সিঁটকায় মিশরাত‌।
– ” এই তেতো লোকের পেটে কি আর মিষ্টি জিনিস হজম হবে!
নিরামিষ কোথাকার!”
মনে মনে কথাগুলো আওড়াতে থাকে সে।

গল্প গুজবের একসময় মিশরাত বলে উঠে,
– ” আচ্ছা আপনি এখানে বসুন!
আমি একটু আসছি!”

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে শাড়ির আঁচল ভালোভাবে ঠিক করে নিচ্ছিলো মিশরাত‌। এমন সময় কোমড়ে কারো বাজে স্পর্শ পেতেই আঁতকে উঠে সে। সচরাচর লেডিস ওয়াশরুমে তো পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাহলে কে হতে পারে? পেছনে তাকিয়ে যাকে দেখে তাতে যেন আরেক দফা অবাক হয় সে।

এদিকে স্নিগ্ধ মোবাইল স্ক্রল করলেও তার মাথায় একটা জিনিস ঘুরপাক খাচ্ছে।
– ” কি ব্যাপার! মেয়েটা সে কখন বেরিয়েছে কিন্তু এখনো আসার কোনো নাম গন্ধ নেই!!”

– ” রবিন ভাই আপনি!!!”
অনেকটা বিস্মিত হয়ে বলে উঠে মিশরাত‌।
রবিন বিশ্রী ভাবে হেসে বলে উঠে,
– ” হ আমি! কেন তুই কারে আশা করছিলি? তোর নাগর, স্নিগ্ধরে?”

ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় মিশরাত‌। একটা মানুষ কতটা নিচে নামতে পারলে এমন ভাষায় কথা বলতে পারে!
– ” আপনার সাহস হয় কি করে আমার সাথে এমন ভাবে কথা বলার! আর আপনি এখানে কি করছেন?”
রক্তচক্ষু নিয়ে বলে উঠে মিশরাত‌।
এদিকে রবিনের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে পূর্বের মতোই বিশ্রী হেসে এগোতে থাকে মিশরাতের দিকে।
– ” কি ব্যাপার ফারাহ্! তোরে তো রাগলে আরো মারাত্মক সুন্দরী লাগে এটা তো জানতাম কিন্তু এখন বিয়ার পর দেখি তোর সৌন্দর্য আরো কয়েক গুণ বাইড়া গেছে!”
এমন বাজে মন্তব্য পেয়ে রাগে মুখ হাত শক্ত হয়ে আসে মিশরাতের‌। কিন্তু এখন সে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। স্নিগ্ধ আর বিশেষ করে মেহেরের সামনে কোনো ঝামেলা হলে এটার সাইড‌ ইফেক্ট মেহেরের উপর পড়তে পারে। তাই যথাসম্ভব রাগটা কে কন্ট্রোল করে দরজা খুলে বের হতে নিলেই রবিন খপ করে মিশরাতের বাম হাত ধরে ফেলে।
নিয়ন্ত্রণে থাকা রাগটুকু‌ আরো বেড়ে যায়। হাত মোচড়ামুচড়ি করার এক পর্যায়ে মিশরাত না পেরে ঠাস করে চড় বসাতে যাবে তখনি পেছন থেকে কারো কন্ঠস্বর পেয়ে পেছন ফিরে তাকায় মিশরাত‌।
স্নিগ্ধ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে রবিনের দিকে। চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে তার ইতিমধ্যে।
এগিয়ে গিয়ে রবিনের দিকে তেড়ে যেতেই রবিন ভয়ে মিশরাতের হাত ছেড়ে দেয়। রবিনের সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলে উঠে,

– ” এই ভুল একবার করেছিস তো করেছিস! এর পর এটা করার চিন্তাও করিস না!
নাহলে ধরার জন্য ঐ হাত দুটোই তোর কাছে থাকবে না! মাইন্ড ইট!!”
বলেই মিশরাতের হাত মুঠোয় নিয়ে গটগট করে হাঁটা শুরু করলো স্নিগ্ধ। আর মিশরাত‌ শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধের দিকে।

বাসায় ফেরার পথে স্নিগ্ধ একটা কথাও বলেনি মিশরাতকে। চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে সে এই মুহূর্তে ভীষণ ভাবে রেগে আছে। মিশরাতও তেমন একটা কথা বলেনি। রুমে শুধু গুটিগুটি পায়ে প্রবেশ করতে দেরি কিন্তু স্নিগ্ধের গর্জে উঠায় দেরি নেই।

– ” কোন সাহসে ঐ রাসকেল তোমার হাত ধরলো!!
আমি যদি আর একটু যেতে দেরি করে ফেলতাম তাহলে ভাবতে পারো কি থেকে কি হয়ে যেতে পারতো!!
ইডিয়ট কোথাকার!!”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে উঠে স্নিগ্ধ।
আর এদিকে স্নিগ্ধের এমন গর্জে উঠায় কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে মিশরাত‌। তাকে নিয়ে এতোটা পসেজিব হওয়ায় অনেকটা অবাক ও হয় সে।

– ” আমি তো ভাবতে পারিনি যে ঐ রবিন হঠাৎ করেই ওখানে চলে আসবে!! আমি তো জাস্ট,,,”
কম্পিত গলায় বলতে যাচ্ছিল মিশরাত‌ কিন্তু পুরোটা বাক্য পূর্ণ করতে পারলো না কেননা তার পূর্বেই স্নিগ্ধ তার ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা মিশরাতের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।

– ” নো, নো! এটা হতে পারে না!
স্নিগ্ধ আর মিশরাত এতটা ক্লোজলি হতে পারে না! আমি হতে দিবো না সেটা!
কি মনে করেছিলে স্নিগ্ধ, এত সহজেই আমি সবকিছু ভুলে যাবো!!
নো! সেদিন শুধু মাত্র তোমার জন্য আমাকে ওভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে হতো না! আমার চেহারা পাল্টাতো না! আনান ও আমায় ছেড়ে চলে যেত না! সবকিছু হয়েছে শুধুমাত্র তোমার জন্য! আর তোমাকে এত সহজেই তো আমি ছেড়ে দিবো না মিস্টার আশফিন চৌধুরী স্নিগ্ধ!!”
বলেই হাতে থাকা শোপিজ সামনে থাকা আয়নাতে ছুড়ে মারলো অরিন। আর মুহুর্তে সেটা চুড়চুড় করে খন্ডে পরিণত হতে থাকে!

– ” আই এম ব্যাক স্নিগ্ধ! শুভ্রতা ইজ ব্যাক!!”…………….
#প্রেম_পায়রা 🕊️🕊️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#অষ্টাদশ_পর্ব

মিশরাতের মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না একটু আগেই তার সাথে কি হয়ে গেল। আর তার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরেই স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে খুব স্বাভাবিক ভাবে যেন একটু আগে কিছুই হয় নি।
মিশরাতকে এভাবে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্নিগ্ধ এগিয়ে গিয়ে মিশরাতের সামনে তুড়ি বাজাতেই ধ্যান ভাঙে মিশরাতের।
– ” কি ব্যাপার এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন! আ’ম টায়ার্ড! একটু ঘুমোতে চাই!”
বলেই মিশরাতেকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে মিশরাতের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো স্নিগ্ধ।
এদিকে মিশরাত পারছে না একটু পর হার্ট অ্যাটাক করতে। একের পর এক স্নিগ্ধের সব উদ্ভট আচরণ তাকে অনেক ভাবিয়ে তুলছে!

– ” এসব কি হচ্ছে আমার সাথে!!
আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি না তো?
স্নিগ্ধ হঠাৎ এমন উদ্ভট আচরণ করছে কেন আমার সাথে?
পরশু রাতেই তো কত কিছু শুনিয়ে দিয়েছিল আমাকে! তাহলে আজকে হঠাৎ এমন পরিবর্তন!!!”
ভাবতে ভাবতেই মিশরাতের নজর যায় স্নিগ্ধর দিকে। গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা নিষ্পাপ চেহারা দেখে ভাবনা মিলিয়ে গেল মিশরাতের‌। তাই কয়েক পলক তাকিয়ে আস্তে আস্তে মিশরাতও ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল।

সকালে আলোক রশ্মি চোখের উপর পড়তে চোখ মুখ ঘুমের ঘোরেই কুঁচকে ফেলে স্নিগ্ধ। নড়েচড়ে আড়মোড়া দিয়ে উঠতেই মিশরাতের ঘুমন্ত চেহারা তার চোখে পড়ে। মিশরাত হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। খোঁপা করা চুলগুলো আলগা হয়ে ঘাড়ের নিচে পড়ে রয়েছে। আর ছোট ছোট চুলগুলো বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে উড়াউড়ি করছে। নিষ্পলক ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চুপচাপ উঠে গেল স্নিগ্ধ।

এদিকে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে আস্তে আস্তে নড়েচড়ে উঠে মিশরাত। চোখ পিটপিট করে আশেপাশে তাকিয়ে স্নিগ্ধ কে না দেখে ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতেই খেয়াল করে মেহের দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

– ” কি ব্যাপার ননদিনী! ঘুম এখনো ভাঙেনি আপনার?
নাকি রাত জেগে জেগে গল্প করতে করতে ঘুমানোর টাইম পান নি!”

চোখে লেগে থাকা বাদবাকি ঘুম টুকুন উবে যায় মিশরাতের। ভ্রু কুঁচকে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
– ” কিসের গল্প, বউমনি? আর কিসের কথা বলছো তুমি?”

মেহের হালকা হেসে বলে উঠলো,
– ” থাক আর না জানার ভান করতে হবে না তোকে!
আমাদের ফারাহর একমাত্র হাজবেন্ড তো ফারাহ্কে চোখে চোখে হারায়।”
বলেই মুখ টিপে হাসলো মেহের। আর এদিকে মিশরাত বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে।
– ” বউমনি তুমি কিন্তু দিন দিন ভারী দুষ্ট হয়ে যাচ্ছো!
ভাইয়াকে যেয়ে কিন্তু সব বলে দেব।”
মুখ ফুলিয়ে বলে উঠে মিশরাত‌।

– ” হয়েছে বাবা মুখ ফুলিয়ে রাখতে হবে না। আমি তো মজা করছিলাম!
এই নাও তোমার ভাইয়া এগুলো তোমাদের দিয়েছে। আজ রাতে বাহিরে আমাদের দুই কাপলকে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে পাঠানো হবে!”
বলেই একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল মেহের মিশরাতের হাতে।
মেহেরের কথা শুনে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল মিশরাতের‌। ক্যান্ডেল লাইট ডিনার? তাও আবার স্নিগ্ধ আর মিশরাত একসাথে? স্নিগ্ধ শুনতে পেলে তো নিশ্চয়ই চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিবে। আফটার অল সে এই বিয়েটা মানে না। এর মাঝে মেহের চলে যায়। আর মিশরাত ভাবতে ভাবতে প্যাকেট টা নিয়ে রুমে চলে আসে।
স্নিগ্ধ ফ্রেশ হয়ে বেরোতে মিশরাতকে অন্যমনস্ক থাকতে দেখে চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করে উঠে,

– ” কি ব্যাপার? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন!
আর এই প্যাকেট কিসের?”
স্নিগ্ধর গলার কন্ঠস্বর কানে যেতে পাশ ফিরে তাকায় মিশরাত‌। আমতা আমতা করে বলে উঠে,
– ” আসলে,,আসলে বউমনি,,”

– ” কি হয়েছে? এভাবে আমতা আমতা করছো কেন? কি হয়েছে সরাসরি বলো!”
বলেই সোফার উপর সোজা হয়ে বসে পড়লো স্নিগ্ধ। মিশরাত কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেট টা স্নিগ্ধর দিকে এগিয়ে দিল।
– ” আসলে ইরফান ভাইয়া আমাদের চারজনের জন্য ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের এরেঞ্জমেন্টস করেছেন। আর আমাদের দুজনের জন্য এটা পাঠিয়েছেন!”
আমতা আমতা করে বলে উঠলো মিশরাত‌।

এদিকে স্নিগ্ধ একদৃষ্টে প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে অতঃপর শান্ত গলায় যা বললো তাতে মিশরাতের বিস্ময়ের সীমানা রইলো না।

কালো রঙের জর্জেটের শাড়ি, হোয়াইট স্টোনের ইয়ারিং, হোয়াইট স্টোনের ব্রেসলেট, কোমর অবধি চুলগুলো স্ট্রেট করে ছেড়ে দেয়া আর ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিকের ছোঁয়া। চুলগুলো ঠিক করতে করতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে দাঁড়ালো মিশরাত‌। পেছনে ফিরে স্নিগ্ধ কে চোখে পড়তেই চোখ আটকে গেল তার। মিশরাতের সাথে মিলিয়ে পুরো ব্ল্যাক স্যুট পড়নে, চুলগুলো সুন্দর করে সেট করা! একদম ড্যাশিং লুক নিয়ে সামনে হাজির হয় স্নিগ্ধ।
এদিকে মিশরাতকে কালো রঙের শাড়িতে দেখে চোখ আটকে যায় স্নিগ্ধর। ফর্সা শরীরে কালোর আবরণ যেন একদম ফুটে উঠেছে।
নিচ থেকে ইরফানের গলার আওয়াজ পেয়ে দুজনের ধ্যান ভাঙে।
– ” চলো, যাওয়া যাক!”
স্নিগ্ধর কথায় মিশরাত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। পাশ দিয়ে পার্স নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে দুজনেই‌।
ইরফান আর মেহের দুজনেই ম্যাচিং করে পার্পেল কালারের ড্রেস পড়েছে। স্নিগ্ধ আর মিশরাত সিঁড়ি দিয়ে নামতেই চারজন মিলে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো।
গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে ড্রাইভ করছে স্নিগ্ধ। আর পাশেই মিশরাত বসে আছে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আর পেছনের সিটে বসে আছে মেহের আর ইরফান। স্নিগ্ধ ড্রাইভিং করার ফাঁকে ফাঁকে বারবার আড়চোখে মিশরাতের দিকে তাকাচ্ছে।
প্রায় এক ঘন্টা পর গাড়ি এসে থামে গন্তব্যে।

ছোট বড় ক্যান্ডেল, ফুল মিলিয়ে খুব সুন্দর করে টেবিল সাজানো হয়েছে। একটু পর ওয়েটার এসে দুজনের টেবিলে খাবার দিয়ে চলে যায়। এদিকে মিশরাত মুখ দিয়ে টু শব্দ ও বের করছে না। সে এ কদিনের মধ্যে স্নিগ্ধের বদলে যাওয়া আচরণ নিয়ে ভাবছে সে।
– ” স্নিগ্ধ আসলে চাইছেন টা কি? কদিন আগেও তো অন্য রকম ছিলেন! তাহলে দুদিন ধরে এতো কেয়ারিং, কোনো রাগারাগী ভাব নেই, হুটহাট উদ্ভট সব আবদার, আচরণ সবকিছুই কি নাটক মা বাবা সবাইকে দেখানোর জন্য নাকি সবকিছুর পেছনেও অন্য কোনো গল্প রয়েছে!”

মিশরাতকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে স্নিগ্ধ হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে।
হালকা চমকে উঠে মিশরাত।
– ” কি হয়েছে মিশরাত‌? আজ সকাল থেকেই দেখছি একটু অন্যমনস্ক হয়ে আছো! এনিথিং রং?”
মিশরাত মাথা দু পাশে নাড়িয়ে না বোঝায়। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসতে যাবে তখনই মেহেরের গলার আওয়াজ পেয়ে মাথা তুলে তাকায় মিশরাত‌।

– ” আরে বউমনি, তুমি এখনো জেগে রয়েছো?
তোমাকে তো ডক্টর বলেছে ঠিক টাইম মতো ঘুমোতে! নাহলে তো শরীর খারাপ করবে!”

– ” একদিন দেরি করে ঘুমোলে আমার তেমন একটা ক্ষতি হবে না কিন্তু তোর সাথে আজ কথা না বললে হয়তো অন্য কিছু হয়ে যাবে!”

মেহের গম্ভীর কন্ঠে বলে মিশরাতের পাশে গিয়ে বসে পড়লো। আর এদিকে মেহেরের কথা ঠিক বোধগম্য হলো না মিশরাতের যে মেহের ঠিক কি বলতে চাইছে!
– ” হ্যাঁ বলো, বউমনি!
কি এমন কথা যে না বললে অন্য কিছু হবে!”

জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো মিশরাত‌।

– ” তোর আর স্নিগ্ধের মাঝে সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? নাকি কিছু লুকাচ্ছিস আমার কাছ থেকে?”

কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছে ইতিমধ্যে। গলাটাও শুকিয়ে এসেছে মিশরাতের।
– ” হায় আল্লাহ! এখন কি হবে? বউমনি এসব কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? তাহলে কি বউমনি কোনোভাবে কিছু টের পেয়েছে?
না না এটা তো সম্ভব না?”
মনে মনে বিড়বিড় করে মিশরাত‌।
– ” কি হলো কোথায় হারিয়ে গেলি? আমি তো কিছু জিজ্ঞেস করেছি!”

– ” আরে কি হবে আমার বউমনি? কিছুই হয় নি তো? আমার আর স্নিগ্ধের মাঝে সবকিছুই তো ঠিক আছে!”
আমতা করে বলে উঠলো মিশরাত‌।
মেহের একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিশরাতের হাতের উপর হাত রেখে বলে উঠলো,
– ” দেখ মিশরাত, আমি জানি তুই আমার থেকে কোনোকিছু লুকিয়ে রাখিস নি আজ পর্যন্ত। আর আমার বিশ্বাস তুই কিছু লুকাবিও না। তবে হ্যাঁ স্নিগ্ধের মতো ছেলে পাওয়া কম কথা নয়। এ কদিন আমি স্নিগ্ধকে খুব ভালো ভাবে খেয়াল করেছি। তোর প্রতি পসেজিবনেস, কেয়ারিং তোদের দুজনের মাঝে বন্ডিং সবকিছু সত্যিই মুখ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। আমি জানি তুই এখনো স্নিগ্ধকে ভালোবেসে উঠতে পারিস নি। কিন্তু স্নিগ্ধ ছেলে হিসেবে অসাধারণ। ছেলেটা সত্যিই তোকে ভালোবাসে। আমি জানি তুইও ঠিক একদিন স্নিগ্ধ কে ঠিক ভালোবাসবি! আর সেটা দেরিতে হলেও!!”
বলেই মেহের উঠে দাঁড়ালো। আর বাইরের দিকে হাঁটা ধরলো।

আর মিশরাত‌ ঠায় বসে আছে এখনো। তার মাথায় মেহেরের বলে যাওয়া কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।
– ” বউমনির কথাগুলো কি আদৌ সত্যি? আসলেই কি স্নিগ্ধ আমাকে ভালোবাসে? আর আমিও কি আসলেই কোনোদিন স্নিগ্ধ কে ভালোবাসতে পারবো!!!”……..

#চলবে 🍂
( আসসালামুয়ালাইকুম। কেমন আছেন সবাই। আজকের পর্ব কেমন হয়েছে জানাবেন।
ভালোবাসা অবিরাম 🖤🖤)
#চলবে 🍂

( আসসালামুয়ালাইকুম। আশা করি আপনাদের কাছে রহস্যের জট কিছুটা হলেও খুলেছে‌।
সামনের পর্বে বাকিটুকু ও জানতে পারবেন!!

কেমন হয়েছে জানাবেন অবশ্যই।
ভালোবাসা অবিরাম 🖤🖤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here