প্রেয়সী পর্ব – ১৩+১৪

#প্রেয়সী🥀🖤
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ১৩

২৪.

বড় খালামনির কল পেয়ে বেশ খানিকক্ষণ কেঁদেছিলাম। বাবা ঠিক আছে, ওখানে উনারা ঠিক ভাবেই পৌঁছেছেন এ সবটাই বড় খালামনি আমাকে বুঝিয়ে বললেন তবুও মন মানছিলো না! হয়তো বাবার সাথে আমি যেতে পারলে বাবা সুস্থ আছে জেনেও এতোটা ক/ষ্ট হতো না। শুয়ে আছি কাঁথার নিচে। রুমের মধ্যে এসি চলছে। এসির গন্ধে থেকে থেকে আমার গা গুলিয়ে উঠছে! মাথাটা ভীষণ ভার ভার হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে না উঠে গিয়ে এসি টা বন্ধ করে দিতে। এসির রিমোট টা নিয়ে রিম্মি আপু কতক্ষণ পাওয়ার কমিয়ে বাড়িয়ে কোথায় রাখলো সেটাও দেখা হলো না। এখন এই ঘর দুপুর বেলা কাকেই বা ডেকে বলবো এসি বন্ধ করতে। আর বললে উনারাই বা কি ভাববেন?

পুরো বেডটা ভাইব্রেট করছে। কাঁথার নীচ থেকে ফোন হাতাচ্ছি। কল এসেছে। নিতু আপুর কল নাকি হৃদের কল? ফোনটা হাতে তুলতে তুলতে নামটায় চোখ বুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে কানে ধরলাম। ওপাশ থেকে নিতু আপু বলে উঠলো,

—-” নিধি, আমি আর রাফিন আজ পাঁচ টার দিকে একবার তোর ওখানে আসছি। তুই কিন্তু রেডি থাকবি.. তোকে নিয়ে আজ বেরোবো।”

—-” কোথায় যাবে?”

—-” ইবনাত গার্ডেন। তোর ফেভারিট প্লেস।”

—-” হঠাৎ?”

—-” তোর মনটা তো একদমই ভালো নেই রে। তাই ভাবলাম ওখানে গিয়ে কিছুক্ষন সময় কাটালে তোর ভাল্লাগবে।”

—-” আপু আজ থাক না প্লিজ। আমরা কাল যাই?”

—-” কাল? কেন রে? আজই চলনা! প্লিজ…”

—-” বলছি কি, শুনো না? আজ কোথাও না যেয়ে তুমি আর রাফিন ভাইয়া বরং এখানেই চলে আসো না।

—-” ওখানে চলে আসবো বলছিস?”

—-” হ্যাঁ গো তোমরা এখানেই চলে এসো। এখানে আরও অনেকে আছে। তোমরা আসলে সবাই মিলে জমপেশ একটা আড্ডা হবে।”

—-” আচ্ছা সোনা আসবো। আচ্ছা তোর শরীর ঠিকাছে তো? গলার স্বর তো ঠিক নেই মনে হচ্ছে! আবার জ্বর আসলো নাকি?” (আতংকিত গলায়)

—-” উঁহু তেমন কিছু নয়! কাল থেকে তো কম ধকল গেলো না সবার উপর থেকে। সারা রাত তো একফোঁটাও ঘুমানোর জো ছিলো না। ভোর রাতে বাসায় ফিরেও আর ঘুম আসলো না। অবশেষে বড় খালামনির সাথে কথা বলে তবেই শান্তি। এখন সব শান্তি শেষে শরীরও আর সঙ্গ দিচ্ছে না। হাত পা সব ভেঙেচূড়ে আসছে। তাই হয়তো ক্লান্তির জন্য ভয়েস এমন লাগছে।

—-” হ্যাঁ রে। সেটাই কথা। আচ্ছা সোনা রেস্ট নে তুই। আমি এখন রাখলাম,আর শোন? যদি বেশি শরীর খারাপ লাগে তবে কল দিস আমায়।”

—-” হু দেবো। আচ্ছা শুনো, তুমি আসার সময় আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে?”

—-” হ্যাঁ বলনা?”

—-” আসলে, গত কাল সকালে ভার্সিটির সিনিয়র ভাইয়ারা আমায় তাদের এসাইনমেন্ট গুলো ধরিয়ে দিয়েছিলেন র‍্যাগিংয়ের সূত্রে। তুমি ঐ ফাইল গুলো সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারবে প্লিজ? তাহলে আমি এখানে বসেই সেগুলো কমপ্লিট করে উনাদের দিতে পারতাম।”

—-” এই অবস্থায় তুই কি করে….”

—-” হয়ে যাবে। তুমি চাপ নিও না। তুমি একটু কষ্ট করে নিয়ে এলেই হবে। প্লিজ!”

—-” আরে প্লিজ বলছিস কেন? আমি নিয়ে আসবো তুই টেনশন করিসনা।”

—-” থ্যাংকস আপু”

নিতু আপু আর কথা না বাড়িয়ে কল কাটলো। আমিও ফোনটা পাশে রেখে চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার খুব ঘুমানোর প্রয়োজন বুঝতে পারছি কিন্তু ঘুম আসছে না একফোঁটাও। চোখ বন্ধ করতেই হঠাৎ হৃদের কথা মাথার মধ্যে বারি খেয়ে উঠলো। ইদানীং তার হালচাল কিছু ঠিক বলে মনে হচ্ছে না। কেমন যেন হঠাৎ পরিবর্তন। এই এক মাস আগেও সে এমন ছিলোনা! সারাক্ষণ তো শুধু কলের উপরই রাখতো। রোজ দুই বেলা মিট করতে আসতো। এই সেই করেই তো আমাদের সম্পর্কের একটা বছর অনায়াসে পার হয়ে গেলো। টেরই পেলাম না কখন একবছর হয়ে গেলো। হৃদ পরিবর্তন হয়েছে! একটু নয় বেশ অনেকখানিই তার পরিবর্তন চোখে পড়ছে। সময় করে ভাবা হয়নি বলেই আগে মনে হয়নি। আমি তো ভেবেছিলাম বাবার এই অবস্থায় ও আমাকে একা ফেলে কখনোই যাবেনা। সারাক্ষণ আমার সাথে থাকবে কিন্তু ও এমন কিছুই করলো না। কেবল আমায় অবাক করে গেলো। একেরপর এক আ/শ/ঙ্কা জাগিয়ে তুলছে আমার মনে। দায়িত্বের খাতিরেও তার একটা কল তো প্রাপ্যই ছিলো তাই না? বাবা এখন কেমন আছেন বা ডক্টররা বাবার শারীরিক কন্ডিশন দেখে কি বললেন? তাছাড়া বাবার কি হয়েছে? এই প্রশ্নটাও সে একটাবারও করলো না! হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গিয়ে সে একটা বার কলও করলো না! কি করে? কি হয়েছে তার? তার হঠাৎ এমন আমূল পরিবর্তন কি করে হতে পারে? আর কেনই বা হবে?

এসব প্রশ্ন নিজেই নিজেকে করতে করতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম। যখন ঘুম ভাঙল তখন প্রকৃতি সূর্য মামাকে বিদায় দিতে ডালা সাজাচ্ছিলো। আমি নড়েচড়ে উঠতেই শরীরের ভার সহ্য করতে পারলাম না। মৃদুস্বরে আ/র্ত/না/দ করে আবারও বিছানা আঁকড়ে পড়ে রইলাম। শরীরে এমন ব্যাথা হলো কেন? শরীরের উষ্ণতায় অস্থির হয়ে গা থেকে কাঁথা সরিয়ে ফেললাম। কিন্তু কাঁথা সরাতেই আবার পড়লাম আরেক বিপাকে। শরীর কাঁপিয়ে শীত লাগছে। থরথর করে কেঁপে উঠলাম। মনে মনে ভাবলাম, সারাবছরের শীতেও তো এমন করে কাঁপিনি। বুঝলাম হাড় কাঁপানো জ্বর এসেছে। শরীরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। শুয়ে থাকতে থাকতে শরীর যেন আরও বি/ষে/র মতো ব্যাথা করছে। উঠে বসে কাঁথা টা হাত বাড়িয়ে নিতে গেলেই মনে হলো কপাল খুলে পড়বে। জ্বরের ঘোরেই চমকে উঠলাম। ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো।

আসলেই কি আমার কপাল খুলে পড়লো নাকি? কি অদ্ভুত! লোকে দেখলে কি বলবে? ঐ দেখো দেখো মেয়েটার কপাল নেই! আশ্চর্য, সত্যিই কি আমার কপাল নেই? দেখতে হচ্ছে তো। আমার সামনেই বিশাল এক আয়না। আমি সেখান থেকেই নিজের কপালে হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলাম। মন যা বলছে মস্তিষ্কও তাই বলছে! সত্যিই আমার কপাল খুলে পড়েছে। সেই দুঃখে আমার ভীষণ কান্না পেয়ে গেলো। আমি হাত পা ছড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগলাম। কি সাং/ঘা/তি/ক ব্যাপার হ্যাঁ? নিধির কপাল খুলে পড়েছে! এখন আর খুঁজেও পাচ্ছি না!

কে কোথায় আছো প্লিজ আমার কপাল টা খুঁজে দাও। খুঁজে দাও! আমার কান্নার আওয়াজ ঠিক কতদূর গেলো বুঝতে পারলাম না! কোত্থেকে এক যুবক দৌড়ে এলো। তার সুঠাম দেহে মিষ্টি রঙের শার্টটায় এলোমেলো করে দিলো আমার মন। ঘোর লাগানো চোখে তাকে দেখতে লাগলাম। ভারি পল্লব বিশিষ্ট তার চোখ। সে কি মায়াবী। মাথার চুল গুলো স্পাইক করা। ঠিক একপাশে সবাই চুপটি করে পড়ে আছে। এই মাত্র তাকে দরজার কাছে দেখলেও এখন সে আমার অনেক কাছে চলে এসেছে। তার কাছে আসার ধরন দেখে মনটা হৃদ বলেই ডেকে উঠলো। এটা হৃদ! আঁকড়ে ধরলাম তাকে। বুকের মাঝে মুখ ঢেকে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম,

—-” দেখো না হৃদ, আমি আমার কপাল খুঁজে পাচ্ছি না। আমার কপাল খুলে পড়েছে! প্লিজ আমাকে আমার কপাল খুঁজে এনে দাও! এনে দাও। খুঁ,,জে এ,,নে দা,,,ও বলছি।(টেনে টেনে)”

নিজের এমন অদ্ভুত কার্যকলাপে মানুষ টার কি অবস্থা হয়েছিলো জানা নেই। কিন্তু আমি একটুও ভাবছিনা! আমার বেশ শান্তি লাগছে তার বুকে। তাকে হৃদ ভাবতে। ভীষণ শান্তি লাগছে।

সে আমাকে তার বুক থেকে টেনে তুলে শান্ত কন্ঠে বলল,

—-” নিধি তোমার শরীর জ্ব/রে পু/ড়ে যাচ্ছে। তুমি প্লিজ এভাবে উঠে বসো না। এখানটাতে শুয়ে পড়ো। আমি বউমনিকে ডেকে আনছি।”

সে চলে যাবে ভেবে আমার আবারও কান্না পেয়ে গেলো ভীষণ। আমি আবারও বাচ্চাদের মতো করে কাঁদতে লাগলাম। ঠোঁট উল্টে নাক ডলে তাকে বললাম,

—-” আ,,মা,,র ক,,পা,,ল খুঁ,,জে না দ,,দিয়ে তুমি কো,,,,থা,,,ওওওও যাবে,,,না হিহি।”

সে অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-” হোয়াট? কপাল খুঁজে না দিয়ে মানে? নিধি সি, তোমার কপাল এই যে তোমার যথাস্থানেই আছে!”

উনি আমার কপাল খুঁজে না দিয়ে বেশি বেশি কথা বলছেন। তা দেখে আমিআবারও ঠোঁট উল্টে তাকালাম। অতঃপর বলতে লাগলাম,

—-” তুমি মিথ্যে ব,,,ল,,ছো! আমার কপাল নেই। নেই। তুমি খুঁজবে এখনই খুঁজবে।”

উনি আমার কথায় বিরক্ত না অবাক ঠিক ঠাহরে উঠতে পারলাম না। উনি আমার কপালে হাত ঠেকিয়ে অসহায় কন্ঠে বললেন,

—-” না জানি কতটা জ্ব/র এসেছে তোমার।”

কথাটা বলেই কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন তিনি। আমার পায়ের সাথে পেঁচানো কাঁথা টা টেনে আমার গায়ে পেঁচাতে পেঁচাতে কিছু একটা তুলে নিলেন হাতে। অতঃপর কতক্ষন তার হাতে ধরে রাখা জিনিসটার প্রতি তাকাচ্ছেন তো কতক্ষণ আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমি ঠোঁট উল্টে উনার কান্ড দেখছিলাম। উনি হঠাৎ হেসে ফেললেন। আমি যেন আর লোভ সামলাতে পারলাম না। উনার হাসি মুখটা দেখতেই আমি ঘোর লাগানো কন্ঠে বলে উঠলাম,

—-” আই লাভ ইউর স্মাইল হৃদ, এন্ড আই লাভ ইউ অলসো।”

উনি কিছু বললেন না। আমি “আই লাভ ইউ” বলাতেও উনি ফর্মালিটির খাতিরে “আই লাভ ইউ টু” বললেন না। আমার দিকে শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে বলে উঠলেন,

—-” হেয়ার ইজ ইউর কপাল!”

আমি চোখ দুটো বড় বড় করে উনার হাতের দিকে তাকালেন। সাদা কাপড়ে কিছু একটা ভাজ করা। আমি প্রশ্ন সূচক মুখ করে ঠোঁট উল্টে তাকালাম উনার দিকে। উনি আমার হাত ধরে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। গায়ে কাঁথা দিয়ে হাতের সাদা কাপড় টা একটা বাটিতে চুবিয়ে আমার কপালে লাগিয়ে দিয়ে বললেন,

—-” এটা তোমার কপাল নয়,এটা জলপট্টির কাপড়। আমিই এটা তোমার মাথায় দিয়ে রেখে গিয়েছিলাম ডক্টর আঙ্কেল কে কল করতে। তোমার জ্ব/রে/র গতিবিধি তেমন সুবিধার নয় তাই ডক্টর আঙ্কেলকে একবার ডাকা খুব জরুরিই মনে হলো। এই যে আবার লাগিয়ে দিলাম এটা। এতে তোমার জ্ব/র/টা একটু হলেও হাল্কা হবে। ডোন্টওয়ারী, ডক্টর আঙ্কেল তোমাকে একবার চেকাপ করে মেডিসিন দিলেই তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে। এখন একদম গুড গার্লের মতো চুপটি করে শুয়ে থাকো। একদম নড়বে না কিন্তু। তুমি এখন নিজের সেন্সে নেই! তাই এমন করে আবোল তাবোল বকছো। আই আন্ডারস্ট্যান্ড নিধি। তুমি হৃদকে ভীষণ ভালোবাসো। কিন্তু হৃদ… যাক ছাড়ো। তোমার ভালোবাসা নিষ্পাপ সেটা আমি জানি। আর হৃদের ভালোবাসাতেও যে কতটা পা/প মিশ্রিত সেটাও আমি জানি!”

উনি এভাবেই এক নাগাড়ে আরও কতক্ষণ বকে বকে চলে গেলেন। আমি আবারও ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছি। এতক্ষণ ধরে যে কান্ড করেছি তার সবই গুলে খেয়েছি আরও তিনঘন্টা ঘুমিয়ে।

২৫.

রাত ৯ টা বেজে ৩০ মিনিট। ঘরের নিস্তব্ধ পরিবেশে ঘড়ির কাটা সরে যাওয়ার আওয়াজ আমার কানে বিরক্তির ধ্বনি তুলছে। মাথার উপর এখনো জলপট্টির কাপড়টা অবস্থানরত। আমি চোখ খুলতেই পায়ের কাছে নিতু আপুকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠলাম। এক লাফে উঠে বসার ইচ্ছে থাকলেও তা মোটেও সম্ভব হলো না। শরীরের সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যার্থ হলাম। কাতর কন্ঠে আপুকে ডেকে উঠতেই সামনে থেকে পেছন থেকে আরও অনেকজন উপস্থিত হলো আমার চোখের সামনে। আদ্রিতা আপু আর রিম্মি আপু অসহায় কন্ঠে জানতে চাইলেন, “এখন আমার কেমন লাগছে?”

আমি মিষ্টি হেসে জবাব দিলাম,” ভালো লাগছে।” আমার জবাবে নিশ্চিন্ত হয়েই আদ্রিতা আপু বের হয়ে গেলো। রিম্মি আপু মিষ্টি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমার পাশে বসল। অন্য পাশ থেকে নিতু আপু উঠে এলো আমার মাথার কাছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল,

—-” তোর এতোটা জ্ব/র এসে যাবে ভাবতে পারিনি। যখন রাফিদ কল করে জানালো তোর এতো জ্ব/র আমার তো যায় যায় অবস্থা! চাচা নেই এখানে। কে সামলাবে তোকে? সবসময় তো তোর জ্ব/রে চাচা কাছে না থাকলে জ্ব/রই সারতো না। কত ডক্টর দেখালেও চাচার সেবা ছাড়া তুই সুস্থ হোসনা। আর তার-উপর থাকতো তোর জ্ব/রের ঘোরে পাগলামি! কিন্তু এবার যে চাচা চাইলেও আর তোর কাছে আসতে পারবেনা। আমার সেই চিন্তাতেই তো…”

নিতু আপুকে থামিয়ে দিলো রিম্মি আপু। ভরসা দিয়ে বলল,

—-” একদম টেনশন নেই। যেখানে আমাদের রাহিয়ান ভাই আছে সেখানে নিধি এক চুটকি বাজাতেই দেখবে ঠিক হয়ে গেছে। আমার ভাইয়ের কাছে জাদু আছে কিন্তু। দেখেছ, বিকেলের জ্ব/র রাতের মধ্যে প্রায় অর্ধেক সেরে গিয়েছে।”

আমি অবাক চোখে রিম্মি আপুর দিকে তাকাতেই নিতু আপু হেসে উঠে বলল,

—-” হ্যাঁ গো রিম্মি। তুমি কিন্তু ভুল বলোনি। ব্যাপার টা নিয়ে কিন্তু আমিও বেশ শকড।”

—-” আরে শকড কি গো? এখনো কত ধামাকা বাকি, বাস দেখতে রাহো।”

কথাটা বলে দুজনেই হেসে উঠলো। আমার অবাক নয়ন কারোরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছেনা। কি অদ্ভুত! উনাদের হাসির ইতি টেনে রুমে ঢুকলেন রাফিদ ভাইয়া। সঙ্গে আছেন ফাহিম ভাইয়া আর আর রাফিন ভাইয়াও। রাফিদ ভাইয়ার কাজিন হিমাদ্র ভাই নাকি বড় খালামনিদের সাথে গিয়েছেন। সেকথা জানলাম খালামনির সঙ্গে কথা বলার পর।

রাফিদ ভাইয়া সবাইকে মোটামুটি একচোখে উপেক্ষা করে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমি আঁড়চোখে উনাকে দেখছিলাম। কোনো চিন্তায় বিরক্ত তার কপাল। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে রিম্মি আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—-” রিম্মি, বউমনিকে বল নিধিকে খাবার দিতে। ঠিক দশটা নাগাদ এই মেডিসিন গুলো ওকে দিতে হবে। সবটা টাইমলি করতে হবে কিন্তু। গো ফাস্ট।”

রিম্মি আপু উনার আদেশ পালনে মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে ফাহিম ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—-” বাবাকে কল করে বলে দিস রাতের খাবার ফ্রিজে তুলে রাখা আছে।”

রিম্মির আপুর কথায় ফাহিম ভাইয়া মুখ কুঁচকে বললেন,

—-” আমি বাবাকে কল করে কিছুই বলতে পারব না। তুই এসে নিজে থেকে কল দিস।”

রিম্মি আপুর কোনো জবাব এলো না। রাফিদ ভাইয়া রাফিন ভাইয়া আর নিতু আপুর উদ্দেশ্য বললেন,

—-” ডিনার না সেরে কেউ কিন্তু কোথাও যাওয়ার চিন্তা মাথায় আনিস না!”

নিতু আপু অসহায় কন্ঠে বলল,

—-” আমাদের এক্ষনি বের না হলে ঝামেলা হতে পারে।”

রাফিন ভাইয়াও একই সুরে বলল,

—-” হ্যাঁ রে রাহিয়ান। নিতুর প্রবলেম হবে।”

নিতু আপু আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” এখন বরং বাসায় ফিরি রে। কাল সকাল সকাল আবার চলে আসবো তোর কাছে।”

আমি করুন সুরে বললাম,

—-” আজ রাতটা আমার কাছে থেকে গেলেই পারতে!”

—-” ইচ্ছে ছিলো রে। কিন্তু ভাইয়া কল করে একগাদা কথা শোনালো। তাই থাকতে পারছিনা।”

—-” হিমেল ভাই বকলো তোমায়?”

—-” তেমন কিছু না। ওর যেমন ন্যাচার।”

—-” চলে যাবে তাহলে?”

—-” হ্যাঁ রে। কাল আবার চলে আসবো দেখিস। জলদি সুস্থ হয়ে ওঠ সোনা। তোকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে ভালো লাগেনা!”

আমি ছোট্ট করে হাসলাম। নিতু আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে গেলো। রাফিন ভাইয়া আর নিতু আপুর সাথে ফাহিম ভাইয়াও কল পেয়ে বেরিয়ে গেলো। এখন এই আবদ্ধ রুমে কেবল আমি আর রাফিদ ভাইয়া। উনি শুঁকনো মুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার ঔষধ গুলো চেক করে যাচ্ছেন। আর আমি আঁড়চোখে উনাকে দেখছি। উনি আমার দিকে না দেখেই হঠাৎ মোটা স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,

—-” কিছু বলবে?”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। উনি এবার নরম গলায় বললেন,

—-” বলো?”

আমি শুঁকনো মুখে বললাম,

—-” বাড়িতে সবাই আপনাকে রাহিয়ান বলে কেন ডাকে?”

আমার প্রশ্নে উনি আঁড়চোখে তাকালেন। কিছু একটা ভেবে বলে উঠলেন,

—-” কেন? নামটা তোমার পছন্দ নয় বুঝি?”

আমি ভাবনায় পড়ে গিয়ে বললাম,

—-” না না! পছন্দ নয় কি বলছেন? আমার তো এই নামটাই বেশি ভালো লেগেছে!”

উনি এবার নিঃশব্দে হাসলেন। আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

—-” বাড়ির সবারও হয়তো এই নামটা বেশি পছন্দ তাই এই নামে ডাকে। চাইলে তুমিও ডাকতে পারো,আই হ্যাভ নো প্রবলেম।”

উনার সম্মতি পেয়ে মনে হলো আকাশের চাঁদ হামলে নিয়েছি। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুঁটিয়ে বললাম,

—-” আচ্ছা আপনার এই নাম কে রেখেছিলো?”

আমার প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। আমার পানে চেয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে বলে উঠলেন,

—-” আমার নাম টা ছোটমনি রেখেছিলো। আর রাহিয়ান নাম টা ছোট মনির বরাবরই ভীষণ প্রিয় ছিলো বলে বাড়ির সবাই আমাকে ভালোবেসে এই নামেই ডাকে।”

মায়ের কথা শুনতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য দম আঁটকে এলো আমার। তার কথার পিঠে কথা তুলে আর জবাব দিতে পারলাম না। উনি ঢোক গিলে আবারও বলে উঠলেন,

—-” আমার মায়ের বিয়ের এক বছরের মাথায় যখন আমি মায়ের গর্ভে আসি তখন ছোটমনি আর ছোট খালুর প্রথম দেখা হয়েছিলো। ছোটমনি যখন মাকে ছোট খালুর কথা বলতে আসে তখন মা আমার আসার কথা সর্বপ্রথম ছোটমনিকেই জানায়। ছোটমনি আমার কথা শুনতেই আনন্দিত হয়ে বলেছিলে,” দেখিস বুবু তোর প্রথম সন্তান ছেলে হবে আর তার নাম তুই রাহিয়ান রাফিদ রাখবি কেমন? রাহিয়ান নামটা কিন্তু আমার ভীষণ পছন্দের। কখনো যদি আমি না থাকি তাহলে আমার কথা মনে করেই ওকে এই নামে ডাকবি!” ছোটমনির কথা অনুযায়ী মায়ের প্রথম সন্তান ছেলেই হলো। মানে আমি আসলাম এই দুনিয়াতে। আমি পৃথিবীর আলো দেখতেই সর্বপ্রথম ছোটমনির কোলে উঠেছিলাম। সবার আগে ছোটমনিই আমাকে কোলে তুলেছিলো। আর স্নেহ ভরা কন্ঠে আমায় রাহিয়ান নামে ডেকেছিলো। এর পর আস্তে আস্তে আমি ছোট মনির কোলেই মানুষ হতে থাকি। আমার যখন তিন বছর তখন ছোটমনি চলে যায় বাড়ি থেকে। তাদের সম্পর্কটা কেউ মেনে নিতে চায়নি। নানা ভাই বা মামুরা কেউই ছোটমনির ভালোবাসাকে গ্রহণ করেননি। তাই ছোটমনি অভিমান করেই বাড়ি ছাড়লো। পরিবারের প্রত্যেক টা মানুষের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। মা সারাটা জীবন ঐ মানুষটা কে ফিরে পাওয়ার আশায় কেঁদেছে। কিন্তু আর কখনো কোনো হদিশ মিলল না তার। আমি বড় হতে লাগলাম। আর আস্তে আস্তে ছোটমনির ভালোবাসা গুলো ভুলে যেতে লাগলাম। কিন্তু তবুও কোথাও না কোথাও এসে কারোর খুব স্নেহ ভরা ডাকটা মিস করতাম। এতো এতো মানুষের মুখে রাহিয়ান নাম টা শুনলেও ছোটমনির ডাকের মতো সেই তৃপ্তিটুকু পেতাম না।”

আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। এই মানুষ টাও মায়ের থেকে তিন তিনটে বছর পেলো। তিনটে বছর ধরে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পেলো! কিন্তু আমি? আমি এই অভাগী দুটো দিনও তো ঐ মানুষ টার থেকে পেলাম না! উনি আমাকে স্রেফ দুটো দিনও কাছে রাখতে পারলো না! তার আগেই সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে পালিয়ে গিয়েছে। স্বার্থপরের মতো হারিয়ে গিয়েছে মা।

#চলবে____________________#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ১৪

২৬.

“যে নেই তার উপর অভিমান করা অর্থহীন।” নিজের মনকে এমন বুঝ দিয়েই তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লাম। রাহিয়ান ভাইয়া আঁড়চোখে তাকালেন। হয়তো মনের আবেগে বলে ফেলা কথা গুলোতে আমার মনের ক্ষ/ত স্থান গুলো পূনরায় ক্ষ/ত-বি/ক্ষ/ত হওয়ার আগাম বার্তা পেয়েছেন। তাই নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করে তুলতেই আমাকে কিছু বলতে চান তিনি। কিছু বোঝাতে চান যাতে আমার ক্ষ/ত স্থানের ঘা শুঁকিয়ে যেতে পারে। তবে, সেই সুযোগ আমি তাকে দিলাম না। মা-কে নিয়ে ভাবা আমার অভ্যাস। আর মায়ের স্মৃতি গুলোকে ভেবে ক/ষ্ট পেয়ে কাঁদার পেছনে বাবাকে নিজের মতো আগলে রাখা আমার দায়িত্ব।

মা নেই বলে নিধি হারিয়ে যায়নি। নিজেকে হারাতেও দেয়নি। বরং আরও শক্ত হয়ে বাঁচতে শিখেছে। কেবল হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া নিধির অভ্যাস হয়নি সেই হোঁচটের আ/ঘা/ত নিয়ে আবারও উঠে দাঁড়াতে শিখেছে। তাই এই মুহুর্তে রাহিয়ান ভাইয়া মায়ের ব্যাপারে আমাকে আলাদা করে “ক/ষ্ট পেও না,সবাইকেই তো একদিন ওপারে হিসাব দিতে যেতে হবে ব্লা ব্লা” এগুলো বললে আবারও যে আমার পুরনো ক্ষ/ত/তে আ/ঘা/ত পড়বে। মাকে ভেবে বাবাকে সামলাতে গিয়ে আমায় আবারও হোঁচট খেতে হবে। আবারও ভাবতে হবে। ক/ষ্ট পেতে হবে।

—-” নিধি.. প্লিজ তুমি….”

আমি হাত উঠিয়ে উনার কথা মাঝপথেই থামিয়ে দিলাম। উনার কথাতে বাঁধা পড়ায় উনি থমকে গিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমতাআমতা করে আবারও কিছু বলতে নিলে আমি শক্ত গলায় বললাম,

—-” তেমন কিছুই হয়নি ভাইয়া। যা হওয়ার তাই হয়েছে। তার অভিমানের পাল্লা এতটা ভারী ছিলো যে সে আর কোনো পিছুটান রাখতে পারেনি! কেবল একা একা গুমরে ম/রে/ছে। হয়তো কখনো তার কাছের মানুষ টাকেও বুঝতে দেয়নি। লোকে বলে আমি নাকি অপ/য়া! জন্মের সময় মা-কে খেয়েছি!”

—-” হোয়াট!! আব… তুমি…”

—-” হু! তবে আমি লোকের কথায় কান দিয়ে চলিনা। এমনকি তাদের কানাঘুঁষাও আমার কানে তুলিনা। সমাজের এই মানুষ গুলো কে আমি এক চোখে দেখলে অন্য চোখে উপরে তাকাই। কেননা, মায়ের চলে যাওয়ার পেছনে তো কয়েক ঘন্টা আগে জন্ম নেওয়া সেই নবজাতক শিশুটির কোনো হাত ছিলো না তাই না? যা করেছেন সবটা উপরওয়ালা উনার ইচ্ছে তে করেছেন। মায়ের যা ভবিতব্য ছিলো মায়ের সাথে ঠিক তাই ঘটেছে। এখানে বিশেষ নিধির কোনো হাত ছিলো না! তবে অতীত কে আঁকড়ে আর কতদিন? এবার যে আমায় বাবাকে ভালো রাখার সময় এসেছে। বাবাকে আগলে বাঁচার সময় এসেছে। এমন নয় যে আমি ছোট থেকে বাবাকে আগলে রাখতে চেষ্টা করিনি, বাবাকে ভালো রাখতে চেষ্টা করিনি! করেছি। সব ধরনের চেষ্টাই আমি করেছি বিশ্বাস করুন! কিন্তু কোথাও না কোথাও এসে ঠিকই অসহায় হয়ে পড়তাম। মাকে ছাড়া বাবার একাকিত্ব সারাদিন দূর করতে পারলেও সেই রাত টুকু… যখন বাবা একা থাকতো! সেই সময় টুকু আর নিধি কিছু করতে পারতো না! সেই সময় টুকুই আমার বাবাকে আরও পি/ষে নিয়েছে।”

এটুকু বলেই থেমে গেলাম আমি। গলাটা কাঁপছে আমার। আর কিছু বলতে পারছি না! উনি অসহায় মুখে আমার পানে তাকিয়েই ছিলেন। আমি থামতেই মুখে কৃত্রিম হাসি রটালেন। হাত থেকে ঔষধের বক্স পাশে রেখে আমার পাশে বসলেন। পাশে রাখা পানির গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকালেন। মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,

—-” আঙ্কেলের কিছুই হবেনা নিধি। আঙ্কেল একদম সুস্থ হয়ে খুব জলদিই ফিরে আসবে তোমার কাছে। আর দেখো আঙ্কেলের তো তেমন কিছুই হয়নি! স..সামান্য একটা কিডনিতে প্রবলেম দেখা গিয়েছে! এ..এটুকুই ব্যাস! ভালো ট্রিটমেন্ট পেলে এক মাসও লাগবে না আঙ্কেলের ঠিক হতে। দেখে নিও।”

তার নির্লিপ্ত কণ্ঠে আমি শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম। বাবার রোগটাকে সম্পূর্ন ভাবে উপেক্ষা করে “বাবা জলদি ঠিক হয়ে যাবে!” সেই আশায় বুক ভাসালাম। কে-ই বা কি করতে পারবে? যা করার তো ঐ উপরওয়ালা করবেন। এবার নিশ্চয়ই তিনি আর নিধিকে একা করার ফন্দি করবেন না। বাবা কে ঠিক সুস্থ করে খুব শীঘ্রই নিধির কাছে ফিরিয়ে দিবেন।

—-” ছোট সাহেব আসবো?”

পেছন থেকে লিয়ার গলা পেতেই চমকে উঠলাম আমি। উনি ঘাড় ফিরিয়ে লিয়াকে খাবারের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চটজলদি উঠে দাঁড়ালেন। গলা খাঁকারি দিয়ে পেটের কাছ থেকে কুঁচকে যাওয়া টি-শার্ট টেনে সোজা করতে করতে বললেন,

—-” হ্যাঁ হ্যাঁ আয়।”

লিয়া হাসি মুখে ঢুকে এলো ভেতরে। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করলো,

—-” আপু আপনার শরীর এখন কেমন লাগছে? একটু উঠে বসে খাবারটা খেতে পারবেন তো? নাকি ক/ষ্ট হবে?”

আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। ক্লান্তস্বরে বললাম,

—-” না সমস্যা নেই। পারবো।”

লিয়া খাবারের ট্রে টা পাশে রাখতে রাখতে বলল,

—-” আচ্ছা, তাহলে আমি আপনাকে উঠে বসতে সাহায্য করি?”

—-” হু।”

আমার জবাব লিয়ার কান অব্দি পৌঁছানোর পূর্বেই ঝড়ের বেগে সামনে এসে দাঁড়ালেন রাহিয়ান ভাইয়া।
লিয়া তাকে প্রশ্ন করার আগেই তার উত্তর তৈরী,

—-” সাবধানে ধরে উঠাবি…ওর শরীর ঠিক নেই কিন্তু।”

উনার কথায় লিয়ার রিয়াকশন শূন্য। আমি ভাবলাম মাইরি একখানা রিয়াকশন দিবে লিয়া। কিন্তু না, আমাকে অবাক করে দিয়ে লিয়া মুখ টিপে হাসলো। ওর হাসিতে যোগ হলো আরও দুজন। আদ্রিতা আপু আর রিম্মি আপু।

রাহিয়ান ভাইয়া পেছন ফিরে তাদের দাঁড়িয়ে হাসতে দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলেন নিজেও। একহাত তুলে মাথা চুলকে গলা খাঁকারি দিয়ে আমতা আমতা করে কিছু বলতে নিলেই বাঁধ সাধলেন আদ্রিতা আপু। মিটমিট করে হাসছে সে। আমাকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে রাহিয়ান ভাইয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। রসিকতা করে বলল,

—-” তা এতোই যখন দুঃশ্চিতা হচ্ছে মশাই, তো নিজে ধরে বসালেই তো পারো?”

রাহিয়ান ভাইয়ার হঠাৎই কাশি উঠে গেলো। কাশতে কাশতে আঁড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আদ্রিতা আপুর দিকে তাকালো। আদ্রিতা আপু আবারও হেসে ফেললো। রিম্মি আপু আমার পাশে এসে বসলো সেই প্রথমেই। আমাকে উঠে বসতে সাহায্য করে বলল,

—-” এই বাড়িতে রিম্মির দিন শেষ এখন নিধির বাংলাদেশ। কি বলো বউমনি?”

কথাটা বলে খটখট শব্দ করে হেসে উঠলো রিম্মি আপু। তাদের এই উল্টোপাল্টা জোক্সে কেন জানিনা আমার মোটেই হাসি পাচ্ছে না। কেননা, আমি তাদের কথার আগাগোড়া কিছুই ধরতে পারছিনা। হঠাৎ রাহিয়ান ভাইয়া ধমকে উঠলেন রিম্মি আপুকে। বকার সুরে বললেন,

—-” কান লাল করে অনেক দিন হলো চড় খাসনা আমার হাতে। এবার মনে হচ্ছে খাওয়ার সময় এসে গেছে।”

রিম্মি আপু হাসতে হাসতেই হাসি কন্ট্রোল করে নিলো। আদ্রিতা আপু মুখ টিপে হেসে এবার বেশ সহজ গলায় বলল,

—-” আচ্ছা অনেক হয়েছে। এবার তুমি যাও আর তোমার ভাইকে একবার কল করে কথা বলে নাও! তোমাকে খুঁজছিলো কথা বলবে বলে!”

—-” ওকে যাচ্ছি। তুমি এখানের কাজ শেষ করে একটু নীচে এসো। কিছু কথা আছে তোমার সাথে।”

আদ্রিতা আপু মাথা ঝাকালো। রাহিয়ান ভাইয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েও আবার পেছন ফিরে তাকালো। বলল,

—-” আচ্ছা বউমনি, তোমাকে কি আবির কল করেছিলো?”

“বউমনি” উনার মুখে এই ডাকটা শুনতেই আমার চোখ দুটো ডিম্বাকৃতির আকার নিলো! ঝামেলায় ঝামেলায় তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি আদ্রিতা আপুকে উনার বউ ভেবে বসে আছি! অদ্ভুত! কেউ নিজের বউকে বউমনি বলে ডাকে? হাউ ডিজগাস্টিং!

আদ্রিতা আপু মৃদু হেসে জবাব দিলো,

—-” আবির কাল আসবে এখানে। তোমার উপর
মা/রাত্মক ক্ষে/পে আছে। তোমাকে নাকি পঞ্চাশ বারের উপরে কল করে ফেলেছে কিন্তু তুমি ওর কলই তুলোনি!”

রাহিয়ান ভাইয়া ফ্যাকাশে মুখে জবাব দিলেন,

—-” এতো ঝামেলার পরে কখন সময় পেলাম বলো? কাল থেকে তো আমার ফোনই গায়েব।”

রিম্মি আপু বলল,

—-” তোমার ফোন ফাহিম ভাইয়ের কাছে। নিয়ে নিও!”

আদ্রিতা আপু বলল,

—-” এমন হলে হবে? বেচারাও তো নিধির ব্যাপার টা নিয়ে বেজায় টেনশনে আছে। তুমি একটা কল করে নিলেও পারতে।”

—-” আবির কে?”

মনের প্রশ্ন মুখে এসে বাইরে চলে আসবে নিজেও বুঝতে পারিনি। খানিকক্ষণের জন্য ভড়কে গিয়ে জিভ কাটলাম। যদিও কেউ দেখেনি। সবার দৃষ্টি এখন আমাতে নিবদ্ধ। রাহিয়ান ভাইয়া অলস ভঙ্গিতে বললেন,

—-” আরফান।”

এদের এতো এতো নাম কেন? কেউ দেখি একটা নামে মোটেই খুশি নয়! যদিও তাদের বলেই না কি লাভ? আমি নিজেই তো দু-দুটো নাম চেপে বসে আছি।”

—-” আরফান ভাইয়া?”

—-” হু। আরফান আবির।”

আমি বোকা হেসে বললাম,

—-” নাইস নেইম!”

আমার হাসিতে উনার অলস ভঙ্গিমা কেটে গেলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বললেন,

—-” ইট’স নরমাল। নাইস-ফাইস কিছুনা!”

কথাটা বলেই উনি বেরিয়ে গেলেন। উনার হঠাৎ অলস ভঙ্গিমা ছেড়ে স্পষ্ট ভঙ্গিমাতে আমি আবারও খানিক ভড়কে গেলাম।

২৭.

মধ্যরাতে জ্ব/র ছেড়েছে আমার। রাতে রিম্মি আপু শুয়েছিলো আমার সাথে। তখন খাওয়া দাওয়ার পরে ঔষধ খেয়ে শুতেই শরীর আবারও নিস্তেজ হয়ে এসেছিলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ভ/য়ং/ক/র ঘুম হানা দিলো আমার দু-চোখের পাতায়। আবারও সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেলাম। মাঝরাতে যখন জ্ব/র ছেড়েছে তখন কয়েক মিনিটের জন্য ঘুমটা ভাঙলেও ক্লান্তিতে আবারও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘড়িতে সময় এখন ৮ টা ১০। ঘুম ভাঙলো ঠিক ৭ টায়। উঠে মিনিট দশেক পুরো রুমে পায়চারি করলাম। শরীর এখন বেশ চাঙ্গা তাই শুধু উরাধুরা দৌড়াদৌড়ি করতে ইচ্ছে করছে। ভাবলাম ব্যালকনিতে গিয়ে ভাঙা গলায় কতক্ষণ চেঁচাই। পরক্ষণেই মনে হলো, “নিধি এটা তোর বাড়ি নয়!” তাই আপন মনেই আবার দমে গেলাম। রিম্মি আপু বেশ আয়েস করে ঘুমচ্ছে। নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় তার মুখটা মৃদু হা হয়ে যাচ্ছে। আবার যখন ভেতরে টেনে নিচ্ছে তখন আবার মুখটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে আপুর শ্বাস নেওয়া দেওয়ার পর্যবেক্ষন চালালাম কতক্ষণ। অতঃপর নিজের এমন বেহুদা কাজে নিজেই বিরক্ত হয়ে নিঃশব্দে পা টিপেটিপে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। আশেপাশে সর্তক নজর দিচ্ছি, মুলত ছাদের সিঁড়ি খুঁজছি। ঠিক কোন পাশ থেকে এগোলে ছাদের হদিশ পাবো? হঠাৎ বাম পাশে চোখ পড়তেই রাহিয়ান ভাইয়ার রুমের অর্ধেক খোলা দরজাটা দেখতে পেলাম। আমার কপালের মাঝখানে কতেক চিন্তাদের আনাগোনা শুরু হতেই মনে মনে বলে উঠলাম,

—-” এতো সকালে উনি রুম ছেড়ে কোথায় গেলেন?”

মনের এ ভাবনাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে আমি আবারও মনে মনে বুলি আওড়ালাম,

—-” হয়তো বেরিয়েছেন!”

—-” নিধি? এতো সকালে! কি গো শরীরে জ্ব/র কেমন এখন?”

পেছন থেকে হাওয়ায় ভেসে আদ্রিতা আপুর গলা পেতেই থমকে গেলাম আমি। মুখে মিষ্টি হাসি জুড়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে বললাম,

—-” জ্ব/র ছেড়েছে সেই মধ্যরাতে। আমার আবার অসুস্থতা বেশি কাবু করতে পারেনা! এই হঠাৎ চলে আসবে আবার হঠাৎ চলে যাবে।”

আদ্রিতা আপু অমায়িক হেসে বলল,

—-” সুস্থ হয়ে গিয়েছো সেটাই আলহামদুলিল্লাহ। এখন চলো নিচে চলো, তোমায় ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি!”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। আদ্রিতা আপুর সাথে হাঁটার পথেই আবারও একবার তাকালাম রাহিয়ান ভাইয়া খোলা দরজার দিকে। মনের মধ্যে নেচে বেড়ানো প্রশ্ন টা আদ্রিতা আপুকে জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই জিজ্ঞেস করে বসলাম,

—-” আপু, রাহিয়ান ভাইয়া এতো সকালে কোথাও বেরিয়েছেন বুঝি?”

আদ্রিতা আপু যেতে যেতে পেছন মুড়ে উনার দরজার দিকে একবার তাকিয়ে মথা নাড়লো। বলল,

—-” হু। এতো সকাল কি বলছো? রাহিয়ান তো সেই ভোরে উঠে।”

—-” ভোরে উঠে? কেন?”

—-” তার লাইফে রুলসের কোনো শেষ আছে? সারাক্ষণ তার লাইফ চার্ট মেইনটেইন করা। ভোর সকালে উঠে কি করে জানিনা তবে সাড়ে ছয়টার দিকে জগিংয়ের জন্য বের হয় রোজ।”

—-” এতো ভোরে?”

—-” হু। আর জানো একদিনও মিস হবেনা। একদম টাইমলি রোজ বের হবে।”

—-” রোজ! মনে করো কখনো শরীর খারাপ হলেও মিস হবে না?”

আদ্রিতা আপু আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। না সূচক মাথা নেড়ে বলল,

—-” একদম নয়! রুলস উজ রুলস! আমি বলিনা। রাহিয়ান বলে!”

#চলবে_____________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here