প্রেয়সী পর্ব – ৩৭+৩৮

#প্রেয়সী 🧡(৩৭)

৭২.

—-” বাবা-মা তো আমাকে ছেড়ে গিয়েছে! আপনি কি করে বুঝবেন আমার ক*ষ্টটা? আপনি তো দয়াশীল মানুষ! বিয়ে করে আমাকে দয়া করেছেন! ক*ষ্টের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন! এখন বুঝতে পারছেন তো কতটা ভালো রাখতে পারবেন আমায়?”

আরফান ভাই আ*হ*ত নয়নে তাকালেন রাইয়ের দিকে। জড়ানো গলায় বললেন,

—-” এভাবে কেন ভাবছ তুমি? আমি তোমার উপর কোনো প্রকার দয়া করিনি রাই! রূপ,অরিন যা করেছে তার জন্য আমরা প্রত্যেকেই ভীষণ আপসেট! আর তাছাড়া তুমি ভাবো না তুমি যে এখনও রূপের কাছে ফিরতে চাও সেটা কি ঠিক? রূপ তো বিয়ে করে ফেলেছে। সামান্য ভরসা টুকুও দেখাতে পারেনি তোমার প্রতি! সেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তুমি নিজেকে ক*ষ্ট দিয়ে যাচ্ছো প্রতিনিয়ত! আমি সেটা মেনে নিতে পারছিলাম না রাই! আর তাই আমি তোমায় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই! বিলিভ মি রাই, আমি সবটা ঠিক করে দিবো!”

রাই চোখের জল মুছে কঠিনস্বরে বলল,

—-” বললেই কি সবটা ঠিক হয়ে যায়? আপনিও যে আপনার ফ্রেন্ডদের মতো আমার সাথে ছলনাবাজি করবেননা তার কি নিশ্চয়তা আছে?”

—-” প্লিজ রাই! একটু ভরসা রাখো আমার প্রতি! আমি কথা দিচ্ছি…”

রাই হাত তুলে থামিয়ে দিলো আরফান ভাইকে।

—-” আপনি প্লিজ আমায় একটু একা ছেড়ে দিন! আমি সহ্য করতে পারছিনা আপনাকে!”

আরফান ভাই ঢোক গিললেন। রাইকে তার আরও কিছু বলার থাকলেও সাহস জুগিয়ে বলতে পারলেননা কিছুই। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে মনে হতেই আমি পর্দা ঠেলে ওদের রুমে প্রবেশ করলাম। আমাকে হঠাৎ দেখতে পাবেন বলে হয়তো আরফান ভাই প্রস্তুত ছিলেন না। নিজের অসহায়ত্ব মুখটা আমার থেকে আড়াল করতেই জোরপূর্বক হেসে বলে উঠলেন,

—-” আরে নিধি তুমি!”

আরফান ভাইয়ের মুখে আমার নাম শুনতেই রাইয়ের টনক নড়ল যেন। আরফান ভাইয়ের থেকে মুখ ফিরিয়েই ছিলো ও। হঠাৎ তড়িঘড়ি করে সেও মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টানল। থমথমে স্বরটা পরিস্কার করতে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো রাই,

—-” নিধু। গ..গুড মর্নিং বেব।”

দু’জনেই চমৎকার ভাবে নিজেদের ভোল পাল্টে ফেলল। কিন্তু আমি পারলাম না! ওদের কথা গুলো না চাইতেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনা যদিও বা আমার অ*প*রা*ধ হয়েছে কিন্তু রাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার খাতিরে ওর জীবনের সমস্যা গুলো অনেকাংশে আমার সমস্যার মধ্যেই পড়ে। তাই সেগুলো ঠিক করে দেওয়াও আমার দায়িত্বের বাইরে নয়! আমি অ*প*রা*ধী চোখে দু’জনের দিকেই তাকালাম। থমথম কন্ঠেই বললাম,

—-” আমায় ক্ষমা করবেন আরফান ভাই! আমি ইচ্ছে করে আপনাদের কথা গুলো শুনতে চায়নি! কিন্তু চেয়েও যেন দরজার ওপাশ থেকে চলে যেতে পারেনি! দরজাটাও খোলা ছিল তাই সবটাই বাইরে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো! পরিস্থিতিটাও এমন যে পারমিশন না নিয়েই ঢুকে পড়লাম! তার জন্য প্রথমেই সরি বলে নিচ্ছি!”

আমার কথায় যেন দু’জনেই চমকে উঠলো! রাই শুঁকনো হাসি দিয়ে আঁড়চোখে একবার আরফান ভাইকে দেখে নিয়ে বলল,

—-” আরে ধুর! কি যে বলিসনা তুই? নিজের ঘরে আসবি তাতে আবার এতো ফর্মালিটি দেখাতে হবে কেন?”

আরফান ভাইও রাইয়ের কথার রেশ টেনে বলল,

—-” হ..হ্যাঁ তাই তো। আর দরজা যেহেতু খোলাই ছিলো সেহেতু পারমিশন আবার কেন নিতে হবে?”

বুঝলাম দু’জনেই অতি ফর্মালিটি মেইনটেইন করার চেষ্টা করছে। তারা যে নিজেদের প্রবলেম আমায় দেখাতে ইতস্ততবোধ করছে সেটুকু ঠিক বুঝে নিলাম। তাই আমিই কথা তুললাম তাদের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে! জানি ঠিক নয় কিন্তু, দু’জনকেই যে নর্মাল হতে হবে।

—-” দেখ রাই, আরফান ভাই যে তোর প্রতি দয়াশীল হয়ে তোকে বিয়ে করেছে তেমনটা কিন্তু নয়! সে তার বন্ধুর কর্মকান্ডে খুবই লজ্জিত আর তাদের সবার মাঝেই কিছু অপরাধবোধ ছিলো বিধায় সে তোকে তোর ক*ষ্টগুলো থেকে বের করে আনতে সাহায্য করতে চেয়েছে। তুই রূপ ভাইয়াকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছিস তা হয়তো আমার থেকে তুই-ই বেটার জানিস! আর সেই ভালোবাসার দ*হনে পু-ড়তে পু*ড়তে তুই নিজেও ক*ষ্ট পাচ্ছিস আর এই মানুষ গুলোকেও ক*ষ্ট দিচ্ছিস! রূপ ভাইয়া যে কাজ করেছে তাতে তোর কোনো দো*ষ নেই আর বাকিদেরও কোনো দো*ষ নেই! সে মানুষটাই এমন ছিলো যে বাইরের লোকের কথায় ভালোবাসার মানুষটাকে দো*ষী করে চলে গিয়েছে! অথচ যেখানে তোর কোনো ভুলই ছিলো না! ভুল রূপ ভাইয়া করেছে কিন্তু শা*স্তি তুই পাচ্ছিস! কেন বলতো? ভালোবেসেছিস বলে সব অ*ন্যা*য় মেনে নিয়ে চুপসে থাকতে হবে? এটা কি সত্যিই তোর ব্যাক্তিত্বের সাথে যায় বল? ক্ষমা তো রূপ ভাইয়ার তোর কাছে চাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু উল্টে তুই বারবার উনাকে কল করে অনবরত ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছিস! নিজেকে এতোটা ব্যাক্তিত্বহীন কবে থেকে ভাবা শুরু করলি বলতো? আর যে মানুষটা তোকে এই খাদ থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে তুই তাকেই পাল্টা আ*ঘা*ত করছিস? এমন বোকা কবে থেকে হলি রাই? ঠিক ভুলের বিচার করাটাও কি ভুলে গেলি?”

রাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরফান ভাইয়ের দিকে তাকালো। আরফান ভাই মাথা নীচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো উনার রাইকে বোঝানোর মতো আর কিছু নেই!

আমি আবারও বলে উঠলাম,

—-” ভুল মানুষটাকে ভুলে গিয়ে, ঠিক মানুষটাকে আগলে রাখ রাই! আর যদি বলিস আন্টি আর আঙ্কেলের তোর প্রতি ঘৃ*না বা আ*ক্রো*শে*র কারন আরফান ভাই তাহলেও তুই ভুল!”

—-” মা আমাদের এই বিয়ে কখনই মেনে নিবেনা নিধু! তুই মাকে খুব ভালো করেই জানিস! আমাদের এই বিয়েটা না হলে মা আজ কখনই আমার সাথে সম্পর্ক না রাখার কথা বলতে পারতনা!”

—-” তুই ভুল ভাবছিস রাই! আন্টি এই বিয়ের জন্য তোকে ভুল বুঝেনি বা আরফান ভাইয়ের জন্যও তোর সাথে সম্পর্ক ভা*ঙা*র কথা বলেনি! বলেছে এই সমাজের জন্য! সমাজটা এমনই এক জিনিস যেখানে ভালোর দাম তুই কখনই পাবিনা! ভালো কাজে তোকে কখনও কেউ সাবাসি দিবেনা বা উৎসাহ দিয়ে বলবেনা ‘বাহ্ তুমি কাজটা বেশ করেছ’! সমাজ তখনই তোর দিকে ফিরে তাকাবে যখন তুই সমাজের বি*রু*দ্ধে কিছু করবি! রাই, সমাজকে ভেবে কখনও কিছু করা উচিৎ নয়! কেননা, তুই সমাজের জন্য ম*র*লেও সমাজ কখনও তোর জন্য ভালো কিছু রাখবেনা! সর্বদা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে তোর মনটা আরও বি*ষি*য়ে দিবে। ভেবে দেখ তো রাই, আন্টি তোকে দু’চার কথা শোনালেও আঙ্কেল কি তোকে এমন কিছু বলেছে? বলেনি! বলেনি কারন আঙ্কেল সমাজের ধার ধারেনা! সে এই নি*কৃ*ষ্ট সমাজ থেকে অনেকটা ব্যবধানে বাস করে আর তোকেও কিন্তু সেভাবেই মানুষ করেছে রাই। একদিন দেখবি আন্টিও নিজের থেকে এসে তোকে আবারও বুকে আগলে নিবে! যেদিন দেখবে এই সমাজ তাকে কিছু দিচ্ছে না কেবল কেড়েই নিচ্ছে! যেদিন এই সমাজের আসল রূপটা আন্টির কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠবে সেদিন থেকে আন্টিও আর সমাজের ধার ধারবেনা! সেও মেয়েকে আপন করে নেওয়ার জন্য ছুটে আসবে। মানুষের জীবনে সবসময় ভালো সময় থাকেনা! ভালো-মন্দ মিশিয়েই তো জীবন বল! তাই জন্য ভালো সময়টাকে প্রশংসা করব আর খারাপ সময়টাকে নিন্দা করব সেটা তো হতে পারেনা তাই না? বেঁচে থাকতে হলে ভালো-মন্দ দুটোকেই সমান ভাবে আপন করে নিতে হবে আর ইনজয় করতে হবে। এই যে মানুষটা তোকে বিয়ে করেছে না? আমি কিন্তু বড় মুখ করে তোকে কথা দিতে পারি সে কখনও তোর এই প্রতিকূল পরিবেশে তোকে একলা ছাড়বেনা রে। সবসময় শক্ত করে তোর এই হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে আঁটকে রাখবে! কেন বলতো? দয়া করে? উঁহু… নতুন করে ভালোবাসার মানে শিখিয়ে ভালোবেসে আগলে রাখতে চায় তোকে! তুই এভাবে ভুল বুঝে মানুষটালে হেলাফেলা করিসনা যেন! তুইও তাকে ভালোবেসে মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলতো দেখি। দেখবি জীবনটা এভাবেই কত সুন্দর।”

আরফান ভাই পেছন থেকে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো আমার সামনে। তার চোখ জোড়া কৃতজ্ঞতায় চিকচিক করছে। হাত গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। আমি মৃদু হেসে রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,

—-” তোর এই হিরোর জন্য কিন্তু ভার্সিটির অর্ধেক মেয়ে শুধু হা-হুতাশ করে! অর্ধেক উনার জন্য আর অর্ধেক আমার উনার জন্য।”

চোখে জল নিয়েই ফিক করে হেসে ফেললো রাই। আমি মুগ্ধ নয়নে মেয়েটার হাসিতে ঝলমল করা মুখখানা দেখতে লাগলাম। পাশ থেকে আরফান মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,

—-” থ্যাংক্যু নিধি! আমাদের ব্যাক্তিগত সমস্যা তোমার ব্যাক্তিগত সমস্যা ভাবার জন্য! বিশ্বাস করো তুমি যেভাবে রাইকে বোঝালে না সেভাবে হয়তো আমি নিজেও কখনও বেঝাতে পারতাম না! কখনও রাগ আর কখনও অভিমান বুকে চেপেই সরে আসতাম ওর সামনে থেকে! ওকে বেঝাতে গিয়েও ওর ক*ষ্ট হবে ভেবে চুপ করে যেতাম। কিন্তু তুমি পারলে! তুমি সত্যিই প্রমান করে দিলে ইউ আর দ্য বেস্ট নিধি।”

আমি মুচকি হাসলাম। রাইকে আগলে ধরে বললাম,

—-” এই পা*গ*লি*টা তো আমার কলিজা আরফান ভাই। আর আমার কলিজাটা এভাবে ক*ষ্ট পাবে আর আমি চুপ করে সইবো তা কি করে হয়? ওকে তো আমার এসব কথা বলতেই হতো।”

রাই চোখের জল মুছতে মুছতে আরফান ভাইয়ের দিকে তাকালো। কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,

—-” আমায় প্লিজ ক্ষমা করে দিবেন! আমি না বুঝে আপনাকে অনেক বেশি হার্ট করে ফেলেছি। আসলে…”

রাইকে থামিয়ে দিয়ে মাঝপথেই বলে উঠলেন আরফান ভাই,

—-” এভাবে ক্ষমা চেয়ে আমার মনের ক্ষ*ত*টা আর বাড়িয়ে দিও না প্লিজ। আমি এমনিতেই তোমায় খুব বেশি ক*ষ্ট দিয়ে ফেলেছি! তোমার অমতে আমি তোমায় বিয়ে করে তোমার বাবা-মাকে তোমার থেকে দূরে করে দিয়েছি! এই অ*প*রা*ধ*বোধেই যে আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো।”

রাই আমাকে পাশ কাটিয়েই আরফান ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলো। তার হাত ধরে অসহায় ঘেরা কন্ঠে বলে উঠলো,

—-” মাথায় উল্টা পাল্টা ঘুরছিলো বলেই তো আপনাকে ওসব কথা বলে ফেলেছি! এখন আপনিও যদি ওটাকেই আমার মনের কথা ধরে নেন তখন যে আমার নিজকেই সব থেকে বেশি অ*প*রা*ধী লাগবে।”

আরফান ভাই কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো রাইয়ের দিকে। এখন মন দেওয়া নেওয়ার পালা চলবে। সেখানে আমি কি করে থাকতে পারি? আমি তাদের আড়ালেই রুম থেকে প্রস্থান করলাম। সবশেষে শান্তির এটাই যে, ওদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিটা তো মিটল। এখন শুধু রাইয়ের মাকে মানানো বাকি। চিন্তা নেই, সময়ের ফেরে পরে সে নিজেও বুঝবে মেয়ের শূন্যতা। আর দিনশেষে সেও মেয়েকে আপন করে নিতে সমাজের কটু কথাকে গ্রাহ্য করবে না আর।

৭৩.

বৈঠক হচ্ছে রাহিয়ান আর আমার মাঝে! তাও আবার শাড়ি নিয়ে। বড় খালামনি আর বউমনি মিলে আমাদের বিয়েতে আসা সব গিফ্টবক্স গুলো লিয়ার হাতে আমাদের ঘরে পাঠিয়ে দিলো। সেই সাথে বড় খালামনি আমার শাশুড়ী মা হওয়ার সুবাদে গুনে গুনে ঠিক আটখানা তাঁতের শাড়ি পাঠালো আমার জন্য। মূলত বাসায় পড়ব বলে। এখন সমস্যা টা হলো এখানে যে গিফ্ট বক্সের বেশিরভাগ গিফ্টই শাড়ি আর শাড়ি। হয় কাজ করা ভারী শাড়ি,নয় সিল্ক,নয় কাতান আর নয় তাঁতের শাড়ি। তাই আমি ভাবলাম শাড়ির সংখ্যাই যখন এতো বেশি তখন অন্যান্য ড্রেস না পড়ে কিছুদিন শাড়িই পড়ি। তাতে নিজের মধ্যে একটা বউ বউ ভাব থাকবে আর আমার শাড়ি পড়ার হাতও পাঁকা হবে। আমার ভাবনাকে অহেতুক ভেবেই রে*গে গেলেন রাহিয়ান। সব ড্রেস রেখে কেন শুধু শাড়িই পড়তে হবে? শাড়ি পড়লে নাকি আমাকে পে*ত্নীর মতো লাগে! আর পে*ত্নীদের নাকি শাড়ি পড়তে মানা! ব্যস, আমার ক্ষে*পে যাওয়ার জন্য উনার এইটুকু মন্তব্যই বহুদূর কাজ করল। আমিও জে*দ দেখিয়ে বললাম,

—-” যদি কোনো ড্রেস আমাকে পড়তেই হয় তা হবে অলনি শাড়ি। আদারস কোনো ড্রেস নয়!”

উনি আরও রে*গে গেলেন। বিছানা থেকে সমস্ত শাড়ি তুলে নিয়ে আলমারির এক কোনে ফেলে রেখে লক করে দিলেন আলমারি। আমি কোমরে হাত চেপে উনার সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া দিতে রেডি হয়ে গেলাম। উনি চাবিটা আঙ্গুলের মাথায় পেঁচাতে পেঁচাতে বললেন,

—-” আমার পারমিশন ছাড়া তুমি কখনও শাড়ি পড়বেনা নিধি!”

আমি রা*গে ফুঁসে উঠে বললাম,

—-” আমি শুধু শাড়িই পড়ব। কারন শাড়ি আমার খুব পছন্দের। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আলমারিতে শাড়ি ছাড়া আমার যে বাকি ড্রেসগুলো আছে আমি সব গুলো লিয়াকে আর রানিকে দিয়ে দিব!”

উনি তেড়ে এলেন আমার দিকে। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,

—-” আমি যখন বলেছি তুমি শাড়ি পড়বেনা সো পড়বেনা। নো মিনস নো!”

আমি থতমত খেয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলাম। কাচুমাচু করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বললাম,

—-” এমন কেন করছেন? খালামনি নিজেই তো বলল শাড়ি পড়ার কথা! আর গিফ্টগুলোও তো দেখলেন বেশিরভাগই শাড়ি। তাই ভাবলাম সব শাড়ি গুলো এভাবে ফেলে রাখলে অযত্ন হবে আর পড়লে তারও যত্ন হবে আর আমারও শাড়ি পড়ার হাত পাঁকা হবে।”

—-” মা বললেও পড়তে হবেনা তোমাকে! বাড়িতে বাইরের লোকের অভাব নেই। আর আমি চাইনা কোনো বাইরের লোক আমার বউকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখুক! শুধু এই রুমের ভেতরে থেকে শাড়ি পড়বে। এই রুমের বাইরে শাড়ি পড়ে পা রাখলে আমি তোমার পা কে**টে ফেলবো বলে রাখলাম।”

আমি আঁতকে উঠে উনার দিকে তাকালাম! অসহায় মুখ করে বললাম,

—-” আ..আপনি এমন কেন করছেন সত্যি করে বলুন তো? কিছু হয়েছে?”

উনি সরে গেলেন আমার সামনে থেকে। ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বললেন,

—-” শাড়ি পড়তে আগে শিখো তারপর বাইরে আসবে।”

—-” আমি শাড়ি পড়তে জানি!”

—-” জানলে পেটের একটা পাশ পুরোটাই কেন বের হয়ে থাকবে?”

আমি আবারও আঁতকে উঠে নিজের দিকে তাকালাম! এখনও পেটের একটা পাশ অনেকাংশে বেরিয়ে আছে! ছিহ্! কি লজ্জা কি লজ্জা!

উনি আবারও কপট রা*গ দেখিয়ে বললেন,

—-” আর যখন তোমার শাড়ি এখান থেকে একটু, ওখান থেকে একটু সরে যায় তখন তোমার নিজের দিকে কোনো খেয়ালই থাকেনা! ইডিয়ট মেয়ে!”

আমি ভড়কে গিয়ে তাকালাম! উনি আমায় ইডিয়ট বললেন! এতবড় অপবাদ! শাড়ি পড়লে তো একটু অসাবধানতা বশত সরে যেতেই পারে! তার জন্য এমন রিয়াক্ট করার কি আছে?

—-” আমি কি ইচ্ছে করে সরাই নাকি?”

আমার প্রশ্নে উনি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। কপালের রগ ফুলিয়ে বললেন,

—-” তুমি আমার সামনে ইচ্ছে করে সরালেও সমস্যা নেই কিন্তু বাইরের লোকের সামনে অসাবধানতা বশত সরে গেলেও আমার প্রচুর সমস্যা হয়। রা*গ হয় খুব। ইচ্ছে করে সবার সামনেই তোমায় ঠাটিয়ে এক চড় বসিয়ে দেই!”

আমি ঠোঁট উল্টে তাকালাম। উনি যেভাবে রে*গে যাচ্ছেন যেন তৃতীয় বিশ্ব*যু*দ্ধ হওয়ার পেছনে এই অসহায় আমিই দায়ী! ধূর বাবা ভাল্লাগে না।

#চলবে____________________#প্রেয়সী 🖤(৩৮)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

৭৪.

রাহিয়ানদের বেশ বড় বিজনেস। খালুর নিজ হাতে তিলতিল করে গড়ে তোলা এই সম্পদ। বড় খালুর ইচ্ছে রাহিয়ানের পড়াশোনা শেষ হলে সেখানেই জয়েন করবে। হিমাদ্র ভাই আর খালুই পুরো বিজনেসটা দেখাশোনা করে। রাহিয়ানের পড়াশোনার শেষ ধাপটাও অতিবাহিত হলো গত রোববার। আজ বুধবার! খালুর আজ অফিস থাকলেও রাহিয়ানের অফিস জয়েন করার ব্যাপারে গোল মিটিং করছেন ড্রয়িং রুমে। বেশ কিছুদিন যাবৎ ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু ঝা*মে*লা*য় পড়েছে খালু আর হিমাদ্র ভাই। তাদের টক্কর দিতেই হাত ধুয়ে তাদের পেছনে পড়েছে কিছু বিদেশি বিজনেসম্যানরা। খালু বেশ চিন্তিত! কারন যারা তাদের সাথে টক্কর দিতে নেমেছে তাদের আসল মালিক হলো এক পুঁচকে ছেলে। রাহিয়ানের সমবয়সী। যদিও সে এখনও অব্দি সামনে আসেনি যা করার পেছনে থেকেই করছে। খবর নিয়ে যতদূর জানা গেলো সে নিজেকে হাইড রাখতেই বেশি পছন্দ করে। খালু আর হিমাদ্র ভাইয়ের থেকে সবটা ডিটেইলসে জেনে বাঁকা হাসি হাসলেন রাহিয়ান। তার অদ্ভুতরকমের হাসিটা কারোর চোখে না পড়লেও আমার চোখ এড়ালো না। মনের মধ্যে অজানা ভ*য় কাজ করল! উনার এমন হাসির মানে কি?

ভার্সিটির গেটে নামিয়ে দিয়ে নিজেও ছুটলেন অফিসে। খালুর আদেশ ঠিক ১১ টার মধ্যে মিটিং রুমে রাহিয়ানকে প্রেজেন্ট থাকতে হবে। যদিও হাতে সময় আছে কিন্তু ঢাকা শহরে ভোরের আবহাওয়া দেখে সারাদিনের আবহাওয়া বিবেচনা করা ক*ষ্টসাধ্য! মূলত জ্যামে আটকালে ঘন্টা দুই এমনেই গায়েব হয়ে যায়।

উনার কঠোর আদেশে বাড়ির বাইরে শাড়ি পড়ে বের হইনা! যদিও আদেশ টা নিজের রুম পর্যন্তই বরাদ্দ ছিলো। কিন্তু খালামনির আদেশ উনার আদেশকে ডিঙিয়ে গেলো। সুতরাং, নিজের বাড়িতে শাড়ি পড়ে ঘোরা যাবে। সেটা খালমনির কঠোর আদেশ হয়ে উঠলো রাহিয়ানের বি*রু*দ্ধে। বাড়ির বউ শাড়ি না পড়লে ভালো লাগে নাকি? যখন বাইরে বের হবে তখন দেখা যাবে। কিন্তু নিজের বাড়িতে যদি যেমন খুশি তেমন ড্রেস পড়া না যায় তাহলে শান্তি থাকে? খালামনির মতে শান্তি থাকেনা। আমার মতেও শান্তি থাকেনা। কিন্তু সাহস দেখিয়ে উনার বি*রু*দ্ধে কিছু বলতে পারিনা। স্বামীর আদেশ শিরোধার্য।

এক এক করে রাহিয়ানের সব ফ্রেন্ডরাই বেরিয়ে গেলেন ভার্সিটি থেকে। এখন উনাদের পরিবর্তে ভার্সিটির সিনিয়র হলেন তাদের জুনিয়র ব্যাচ। বড়ভাইদের রেকর্ড ধরে রাখতে তারাও এখন ফার্স্ট ইয়ারের এডমিশন নেওয়া স্টুডেন্টদের সাথে র‍্যাগিং করে!

আরফান ভাই ভালো একটা জব হায়ার করেছেন। আরফান ভাইয়ের পরিবার বলতে উনি একাই। বাবা-মা নেই! রাইকে নিয়ে সে নিজেদের ছোট্ট রাজপ্রাসাদটাতে একাই থাকে। যদিও আরফান ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ নিজের জোগাড় করতে হতো না। তার বড় ভাই আবরাহাম দিতেন। তিনি এদেশে থাকেননা। ফ্যামিলি নিয়ে বিদেশে থাকেন। বিয়ের পর বউয়ের খরচ ভাইয়ের থেকে নিবেনা বলেই নিজের যোগ্যতায় ভালো জব অ্যারেঞ্জ করেছেন।

রাহিয়ানদের মাস্টার্সের ফাইনাল হতে হতে আমাদেরও ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল কমপ্লিট হয়ে গেলো। আজ আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম ক্লাস। রাই আর আমি একসাথেই ক্লাসে ঢুকলাম। আরফান ভাই কিছুক্ষণ হলো ওকে দিয়ে সেও ছুটলো অফিসে। আমরা দুই সখি মনের আনন্দে নাচতে নাচতে ক্লাসে এসে বসলাম। সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসে যদিও বিশেষ পরিবর্তন নেই তবুও বাচ্চাদের মতো ঐ যে আনন্দ। আগে ছিলাম ক্লাস ওয়ানে আর এখন প্রমোশন হলো ক্লাস টু-য়ে। এর আনন্দই আলাদা।

—-” মিসেস রাহিয়ান রাফিদ যে। দু’হাত ভর্তি অভিনন্দন। কেমন আছেন?”

পাশাপাশি আমি আর রাই বেশ মজা করছিলাম নিজেদের মাঝে। আচমকা টিচারের আগমনে দু’জনেই ভড়কে গেলাম। কোনো রকম শব্দ বিহীন তার আগমন! আমরা দু’জনেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। স্যারের কন্ঠে স্বাভাবিকতার বিপরীতে যেন তাচ্ছিল্যের টান বেশি এলো। আমি ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টানলাম। নিতান্তই জোরপূর্বক। স্যার আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। পূনরায় একই কন্ঠে বলে উঠলেন,

—-” বিয়ে হতে না হতে ভালোই সুন্দরী হয়ে গিয়েছো দেখছি।”

স্যার চোখা দৃষ্টিতে তাকালো। আমার মুখটা মলিন হয়ে গেলো। রাই পাশ থেকে ক্ষু*ব্ধস্বরে বলল,

—-” আপনি এসব কি বলছেন?”

রাইয়ের আওয়াজে স্যার ঘোর কাটাতে পারলেননা! আমার থেকে চোখ তুলতে উনার বেশ বেগ পেতে হলো। রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বি*কৃ*ত হেসে বললেন,

—-” হ্যাঁ? কিছু বলছো?”

রাই ফুঁসে উঠলো মুহুর্তেই! ওর মেজাজ ঘেটে ঘ হয়ে গিয়েছে সেটা বুঝতেই মুখ খুললাম আমি। ভদ্রতা দেখিয়ে বেশ জোরালো কন্ঠে বললাম ,

—-” আসসলামু আলাইকুম স্যার। আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? বাড়িতে ম্যাম কেমন আছেন?”

আমার উচ্চস্বরে স্যার চমকে উঠলেন। উনার ঘোরও কাটলো বুঝি। আমার দিকে তাকিয়ে আমতাআমতা করে বললেন,

—-” ওয়ালাইকুম আসসালাম! ভ,,ভালো আছে তোমাদের ম্যাম। তোমরা কথা বলছিলে কেন দু’জনে? খেয়াল করো না টিচার কখন ক্লাসে ঢুকে? আর কথা বলবেনা না, বসো বসো।”

স্যারের পারমিশন পেয়েও একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা দু’জনেই! রাই বাঁকা হেসে জোরেশোরে বলে উঠলো,

—-” স্যার আমাদের দু’জনের কিন্তু একসাথেই বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর কিন্তু নিধি একাই সুন্দরী হয়নি আমিও কিন্তু হয়েছি। কমপ্লিমেন্ট দিলে আমাদের দু’জনকেই দিন, একজনকে কেন দিচ্ছেন?”

রাইয়ের কথায় পুরো ক্লাস ঘুরে তাকালো স্যারের দিকে। স্যার পড়ল বিপাকে। বোকার মতো দাঁত কেলানো হাসি হেসেও কারোর তীক্ষ্ণ চাহনি থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারছেনা! স্টুডেন্টদের মাঝে চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। রাই মুচকি হেসে আমার কাঁধে হাত রাখল। স্যার কাশতে লাগলেন অপরাধ বোধের হাত থেকে বের হতে। বারবার গলা খাঁকারি দিতে দিতে এগিয়ে গেলেন বোর্ডের সামনে। বইটা হাতে নিয়ে শঙ্কিত মনে পড়াতে শুরু করলেন! আমরাও আর কিছু বললাম না। চুপচাপ পড়ায় মনোযোগী হলাম।

ব্রেক টাইমে আরফান ভাই এলেন রাইকে নিয়ে যেতে। তাদের আজ কোথাও একটা যাওয়ার প্ল্যানিং ছিলো হয়তো। রাই আমার থেকে কোনো মতে বিদায় নিয়েই চলে গেলো আরফান ভাইয়ের সাথে। ওদের ছোট্ট সংসারটার আমি নাম দিয়েছি টোনাটুনির সংসার। দু’জনকে পাশাপাশি বেশ বানায়। খুব সম্ভবত তারা দু’জন দু’জনকে কাছে টেনে নিয়েছে। রাখেনি আর কোনো পিছুটান। আমি এটুকুনি শুনেই বেশ খুশি হয়েছি। রাই ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকতে পারব। রাই বলছিলো, ওর মা মাঝেমধ্যে ফোন করে। ওর ভালোমন্দের খবর নেয়। কি রান্নাবান্না হয়,কি খায় না খায় সব কিছুই সে জানতে চায়। বুঝলাম আন্টিও মেয়ের শূন্যতা অনুভব করে ক*ষ্ট পাচ্ছে। রাইয়ের ভাই প্রায়ই বোনের খোঁজ নিতে একদম বাড়িতে এসে হাজির হয়। আর আসলেই গাড়ি ভর্তি করে ফল-পাকুড় নিয়ে আসে। সবটা জেনে আমি নিজেও খুব আনন্দিত।

৭৫.

ক্যান্টিনে বসে রাহিয়ানের অপেক্ষা করছি। কল করে বললেন, আড়াইটা নাগাদ উনি আসবেন ভার্সিটিতে। ভেবে খুশি হয়েছিলাম উনি হয়তো আমাকে নিতে আসছেন। কিন্তু উনি নাকি কোনো এক কাজেই আসছেন এখানে। আর তারপর একসাথে বাসায় ফিরবেন। তাই অপেক্ষা করছি। দু’দিন ধরে বেশ গা গোলাচ্ছে আমার। খাবার দেখলেই উল্টি প্রসেস অন হয়ে যেতে চায়। সমস্যাটা অবশ্য এর আগে কখনও হয়নি! তবুও বাসায় কাউকে কিছু জানাইনি। জানি কোনো বড় সমস্যা নয়! গ্যাস জনিত সমস্যা হচ্ছে হয়তো। কয়েকদিনের মাঝেই ঠিক হয়ে যাবে। জানায়নি বললে হয়তো ভুল হবে, জানাতে গিয়েও বারবার ফিরে এসেছি উনার ভ*য়ে।

উনি এই সমস্যার কথা জানতে পারলেই কপট রা*গ দেখিয়ে বকতে আরম্ভ করবেন। আর দো*ষ হবে আমার খাবারের! উনার বক্তব্য, আমি নাকি ঘরের খাবারের চেয়ে বাইরের খাবারের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হই। এটা সত্যি নয়, আমার বি*রু*দ্ধে সবচেয়ে বড় অ*পবাদ। বিয়ের আট মাসের মাথায় ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল টার্ম শেষ করে যেখানে আজই প্রথম ক্লাস করতে এলাম সেখানে বাইরের খাবার কিভাবে খাওয়া হলো?

—-” ম্যে আই সিটেড প্লিজ?”

প্রত্যাশা ছিলো রাহিয়ানের! পরিবর্তে মুখে অদ্ভুত রকমের হাসি এঁটে সামনে এসে দাঁড়ালেন কেশব। কম করে হলেও উনাকে এই আটমাস বাদে দেখা। আমাদের বিয়ের আগে উনাকে নিয়ে অনেক কাহিনী হলেও বিয়ের পর উনাকে আর দেখা যায়নি কোথাও। রিম্মি আপু জানিয়েছিলো উনি নাকি আবারও বিদেশে ফিরে গিয়েছেন! কবে এলো কে জানে?

আমি নড়েচড়ে বসলাম। উনি অনুমতির অপেক্ষা করলেন না। আমার সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লেন। মুখে পূর্বের ন্যায়ই হাসি জুড়ে বললেন,

—-” কেমন আছেন নিধি?”

—-” ভ্ ভালো। আপনি দেশে ফিরলেন কবে?”

কেশব নিঃশব্দে হেসে উঠলেন। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে ডান হাত টা তুলে ভ্রু চুলকে বললেন,

—-” দেশে থেকেই কি দেশে ফেরা যায়?”

আমি ভাবুক কন্ঠে বললাম,

—-” মানে?”

—-” আমি তো দেশেই ছিলাম। কোথাও যায়নি তো!”

—-” তবে যে রিম্মি আপু বলেছিল…”

—-” কারন ওরা জানে আমি দেশের বাহিরে আবারও ব্যাক করেছি তাই।”

—-” মানে?”

—-” মানে এটাই যে আমি কোথাও যায়নি! আমি দেশেই ছিলাম তবে ফ্যামিলির থেকে আলাদা। এই যে আমি আপনার সামনে আছি এটাও কেউ জানেনা আপনি ব্যাতীত। ইভেন আপনার হাজবেন্ডও নয়। আশাকরি জানবেও না। কি বলুন?”(ভ্রু নাচিয়ে)

আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। উনি কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে কথা বলছেন! উনি এতদিন দেশেই ছিলেন কিন্তু কাউকে না জানিয়ে! কিন্তু কেন? আর এতোদিন পর হঠাৎ করে আমার সামনেই বা এলেন কেন? কি উদ্দেশ্য উনার?

—-” আপনি হঠাৎ এতোগুলো দিন বাদে আমার সামনে কেন এলেন? কি দরকার?”

আমার কথায় উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। এতক্ষণ চেয়ারে পিঠ লাগিয়ে ঠেস দিয়ে বসলেও এবার সোজা হয়ে বসলেন। ঘাড়টা দু’বার এপাশ ওপাশ কাত করে আমার চোখের দিকে তাকালেন। উনার চোখের মাঝে লালচে দাগ। হিং*স্র*তা ভরপুর। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম উনার থেকে। উনি চেয়ার টেনে আরেকটু এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমি পিছিয়ে যেতে নিলেই উনি বলে উঠলেন,

—-” সিক্রেট কথা। এটা শুধু আমার আর রাহিয়ানের মধ্যেই হয়েছে। আর কেউ জানেনা। ভাবলাম আপনাকেও জানাই কারন আপনি আর রাহিয়ান তো একই হলেন তাই না?”

আমি চমকে উঠলাম উনার ফিসফাস আওয়াজে। ঢোক গিলে বিরস মুখে বললাম,

—-” রাহিয়ান আর আপনার মধ্যে সিক্রেট কথা!”

—-” হু। কেন? আপনি জানেন না? রাহিয়ান আপনাকে কিছু জানায়নি?”

আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,

—-” কি জানাবেন?”

—-” এই যে ওর আর আমার মাঝে আপনাকে নিয়ে ডিল হয়েছে?”

আমি হোঁচট খেলাম উনার কথায়। মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হতেই আমি কঠিনস্বরে বললাম,

—-” আপনি কি বলতে চাচ্ছেন স্পষ্ট করে বলুন?”

উনি বাঁকা হাসলেন। গলার স্বর পরিস্কার করে বললেন,

—-” রাহিয়ানের ধারনা আমি আপনার বাবাকে মা**র্ডা**র করেছি! তাই সে ঠিক এক বছর সময় নিয়েছে এটা প্রুফ করতে। আর এই এক বছরের মাথায় আমি দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না! সো, আমার এই ক্ষ*তিপূরণ চুকাতে আমিও ওর সামনে একটা ডিল রেখেছি, ও যদি সত্যি প্রুফ করতে পারে আমি আপনার বাবাকে মা**র্ডা**র করেছি তবে আমি নিজে সারেন্ডার করবো পুলিশের কাছে। আর যদি ও প্রুফ করতে না পারে তাহলে ও আপনাকে ছেড়ে দিবে। আমার জন্য।”

আমি নির্বিকার চোখে তাকালাম। বুকের ভেতরটা আজ বহুদিন পর যেন আবারও বাবার শূন্যতায় খা খা করে উঠলো। লোকটা এসব কি শোনালো? তবে কি আমার বাবার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিলো না? নাকি স্বাভাবিক ছিলো! রাহিয়ান কি করে উনার এই ডিলটা মেনে নিতে পারলো? উনার কি একবারও মনে হলো না আমার কথা?

আমার মাথার মধ্যে চিনচিন করে ব্যাথা আরম্ভ হলো। নিজেকে কেমন ভার শূন্য লাগছে। কেশবের থেকে আর একটা কথাও শোনার জন্য রুচিতে টানলো না। উনারা দু’জনেই সমান! লোকটা আমার বাবার খু**নি! আমি কম্পিত শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চারপাশে প্রকৃতির যথেষ্ট আলো থাকলেও আমার চোখ দুটোতে ভর করেছে অন্ধকার। যেদিকে তাকাচ্ছি সেদিকেই কেবল অন্ধকার! সামনের দিকে বোধকরি দুই পা এগিয়েছিলাম। আর হাঁটা সম্ভব হলো না। ওখানেই শরীরের ভার ছেড়ে লুটিয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি জীবনের শেষ দিন। চোখ খুলে আরও একবার দুনিয়া দেখার শখ জেগে উঠেলো না। কিন্তু কথায় আছেনা, মানুষ যা চায় তা পায়না। আর যা চায়না তা-ই পায়!

#চলবে____________________

]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here