#প্রেয়সী 🤎🥀(২৫)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৪৮.
সবার চোখ এড়িয়ে ছাদ থেকে নেমে এলাম আমি। ড্রয়িং রুমের পাশ থেকে হেঁটে যেতেই চোখ পড়ল রিম্মি আপুর হবু শশুর – শাশুড়ীর দিকে। দুজনে একসাথে পাশাপাশি বসে সুখ দুঃখের আলাপ পাড়ছেন। মানুষ দুটো খুব অমায়িক। একজন আরেকজন প্রতি খুব সফ্ট। তাদের দুজনের নাকি বরাবরই সা/পে নে/উ/লে সম্পর্ক ছিলো। কেউ কাউকে চোখের নী/লেও সহ্য করতে পারতেননা। কিন্তু এই বাহ্যিক সম্পর্কের চেয়ে আত্মিক সম্পর্কটা ছিলো বেশ গভীর। দুজন দুজনকে হঠাৎই ভীষণ ভালোবেসে ফেলেন। একজন আরেকজনের মায়ায় জড়িয়ে গেলেন। একজন আরেকজনকে হারানোর ভ/য়ে সর্বদাই তটস্থ হয়ে থাকতেন। তবুও মুখ ফুটে কেউ কখনো কারোর মনের কথা বলতে পারেননি। হঠাৎ এলো সেই দিন, দু’জনের মনের কথা একে অপরকে বলে ফেলার সেরা সুযোগ টা হাতে পেলো দু’জনেই। কিন্তু পরিস্থিতিটা ছিলো তাদের বিপক্ষে। আন্টির বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। আঙ্কেল
পা/গ/লে/র মতো রাতদিন ছটফটিয়ে ম/র/তে লাগলো। হঠাৎ আরেক কান্ড হলো। আন্টির বিয়ের রাতে কিছু লোক আন্টিকে তুলে নিয়ে গেলো। আর আঙ্কেলের কাছে সে খবর পৌঁছতেই পাত্রের থেকেও আগে পৌঁছে গেলো আঙ্কেল। লোকগুলোর হাত থেকে আন্টিকে উদ্ধার করে যখন বাড়ির পথ ধরে তাকে নিয়ে আসা হচ্ছিলো তখন আন্টি কান্নায় ভে/ঙে পড়ে আঙ্কেলকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে, এই লোক গুলো আমারই ঠিক করা। আমি চাই না এই বিয়েটা করতে! আমি তোকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি! তুই প্লিজ আমায় নিয়ে আর বাড়ি ফিরিস না। নিয়ে চল তোর সাথে। আমি তোর সাথে যেতে চাই।”
আঙ্কেল হতবাক হয়ে আন্টির কথা গুলো শুনে হঠাৎই আন্টির গাল বরাবর চড় বসায়। আন্টি ভ/য় পেয়ে সিঁটিয়ে গেলো। আঙ্কেলের চোখে চোখ রাখতে না পেরে মাথা নীচু করেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। কিন্তু আঙ্কেল নরম হলো না। আন্টিকে জোর করেই বাড়ি নিয়ে গেলো। অতঃপর তার ঠিক করা পাত্রের সাথেই আন্টির বিয়ে পড়াতে বলল।
—-” নিধি? ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছো মামনি? এদিকে এসো না?”
দূর থেকেই ভেসে আসলো আন্টির গলা। আমি চোখ ঝাপটে আন্টির দিকে তাকালাম। তাদের বাকি কাহিনি টুকু ভাবার আগেই ঘোর কেটে গেলো আমার। আন্টির সাথে ঠিক করা পাত্রের বিয়ে হলে তবে তারা দুজনে আজ একসাথে কি করে? বাকি গল্প টুকু বলার পূর্বেই কিভাবে যেন থেমে গেলেন তারা। শেষ টুকু শোনা হলো না! আচ্ছা এখন গিয়ে কি শুনে নিবো শেষটুকু?
—-” এসো এসো?”
আবারও ডাকলেন আন্টি। আমি নড়েচড়ে দাঁড়ালাম। গলা খাঁকারি দিয়ে ছোট্ট করে হাসলাম। আসল কথা হলো আমি তাদের ব্যক্তিগত সময়ের মাঝে এই মুহুর্তে ঢুকতে চাচ্ছি না। আমি আন্টির দিকে তাকিয়ে আমতাআমতা করতে লাগলাম। হঠাৎই আমার ফোনের দিকে চোখ পড়লো। মনেমনে এসেও পড়লো একখানা তরতাজা বুদ্ধি। আমি ফোনটা তুলে মিনমিনে গলায় বললাম,
—-” ফোন! আমার একটা কল এসেছে আন্টি। আমি কথা বলে এক্ষুনি আসছি।”
আন্টি অমায়িক হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। আমিও আর দাঁড়িয়ে না থেকে বাইরে চলে এলাম। বাড়ির মেইন গেট থেকে বাইরের গেট অব্দি আলো জ্বলছে। এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রাহিয়ান ভাইয়াকে কোথায় দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। গেলেন কোথায় মানুষটা? আমি শাড়ির কুঁচি ধরে সাবধানে হাঁটা ধরলাম। এই মুহুর্তে উনাকে চোখের সামনে রাখাও যেন আমার স্বস্তির কারন হবে। কিন্তু কেন? জানা নেই।
ধীরপায়ে এগিয়ে এসে বাইরের গেটে পা রাখতেই চোখ এড়ালো না উনার কালো গাড়িটা। গাড়ির উপর অন্যমনষ্ক হয়ে বসে আছেন তিনি। উনার গোছালো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। বাতাসের তান্ডবে মৃদু ভাবে উড়ছে তারা। ভাঁজহীন শার্টের হাতা দুটোতে ভাঁজ পড়ে গিয়েছে। ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে, উনার কি মন খারাপ?
আমার বুক চিঁড়ে তপ্ত শ্বাস বের হলো আমারই মনের অগোচরে। আমি উল্টো পথ ধরলাম। উনার একাকী সময়টাতে আর হস্তক্ষেপ করে উনাকে বিরক্ত না-ই বা করলাম।
—-” শাড়ি পড়াটা কি খুব বেশি দরকার ছিলো?”
উনার শান্ত কন্ঠ বিচলিত করল আমার মন। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে পুড়লো যেন। আমি থমকে দাঁড়ালাম। শুঁকনো গলাতেই ঢোক গিললাম। পেছন মুড়ে উনার দিকে তাকাতে তাকাতে আবারও বলে উঠলেন তিনি,
—-” যে জিনিসে অশান্তি হয় তা না পড়াই শ্রেয়।”
—-” রিম্মি আপু জেদ করলো বলেই তো পড়লাম।”
আমিও শান্ত কন্ঠে জবাব দিলাম। উনি মুখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। কিছুক্ষন একই ভাবে চেয়ে থেকে চোখ ফেরালেন। কঠিন গলায় বললেন,
—-” কেশব তো দেখি তোমাকে চোখে হারাচ্ছে।”
—-” তাতে আমার কি দোষ? (অভিমানী কন্ঠে)
দু’হাতে ভর করেই নেমে এলেন উনি। অন্ধকারে আন্দাজে পা ফেলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভরাট কন্ঠে বললেন,
—-” তোমার এই শাড়ি। তুমি কি জানো রেড ওর ফেভারিট কালার। রেড ওর দুর্বলতা। আর আজ তো আরও বেশি প্রিয় হয়ে গেলো এই কালার। এই শাড়ি, আর এই শাড়ি পরিহিত নারী।”
আমি ধাক্কা খেলাম। শুঁকনো মুখে বললাম,
—-” সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত সমস্যা! আমি নিশ্চয়ই এই রঙ পড়ায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দোষী হয়ে যায় নি!”
—-” ওর থেকে দূরে থাকবে!”
আবারও হু/ম/কি! আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
—-” আমি কেন দূরে থাকবো। সে কি করছে বা করবে তার দায়ও নিশ্চয়ই আমার নয়! আপনি সবসময় আমাকেই কেন….”
—-” আমি বলেছি তো ব্যস। তুমি ওর থেকে দূরে থাকবে মানে দূরে থাকবে।”(দাঁতে দাঁত চেপে)
—-” অসম্ভব!”
কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেলেই বি/প/দ বাড়ালাম বুঝি! মনেমনে ঠিকই এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে উনার ঝাঁ/ঝ সহ্য করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম। কথা বলার আগে তো জীবনে একবার ভেবে বললাম না। যা মাথায় আসতো তাই গড়গড় করে বলে এসেছি।
উনি চোখের মাঝে সূর্য এঁটে তাকালেন আমার দিকে।
রা/গে বিদিশা হয়েই আমায় ঠেসে ধরলেন উনার গাড়ির সাথে। আমার আত্মা হুড়মুড় করছে বেরিয়ে আসার জন্য! ভ/য়ে আমার সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে উঠল।
উনি আমার হাত দুখানা শক্ত করে চে/পে ধরে বললেন,
—-” তুমি আমার কথার অমান্য করছো? কেশবের সাথে কথা বলার জন্য আমাকে অসম্ভব বলছো? হাউ ডেয়ার ইউ ইডিয়ট? আমি তোমাকে যেহেতু বারন করেছি তুমি ওর সাথে কথা বলবেনা তো বলবে না! ওর থেকে দূরত্ব রাখবে তো রাখবে, ব্যস! আমি আর কিছু শুনতে চাই না! আর নেক্সট টাইম থেকে যদি দেখি আবারও শাড়ি পড়ে কোথাও বের হয়েছো তবে তুমিও দেখবে রাহিয়ান কি কি করতে পারে? জি/ন্দা মাটিতে পুঁ/তে ফেলবো তোমাকে!”
আমার দম আঁটকে গেলো। লোকটা স্বাভাবিক সেন্সে নেই তা ঠিক বুঝতে পারছি! আমার হাত দু’খানা মড়মড় করে ভে/ঙে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। আমি ব্যাথায় আরও বেশি সিঁটিয়ে রইলাম। তারউপর উনার এই ধাঁচের কথা! কোন খুশিতে যে নাচতে নাচতে এলাম উনার এখানে খোদা মালুম!
আচমকাই কিছু না বলে একটানে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন আমায়। উনার কাঁপা কাঁপা হাত টা আমার শাড়ি ভেদ করে পেটর উপর রাখতেই আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এলো। অনুভূতির মাত্রাতিরিক্ত তেজ সহ্য করতে না পেরেই দু’হাতে খামচে ধরলাম উনার শার্ট। উনি উনার অন্য হাতটাও চেপে ধরলেন আমার পেটে। আমার সহনশক্তি লোপ পেলো। অনুভূতি শক্তি ভারি হয়ে উঠলো। আমি নিঃশ্বাস আঁটকেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। উনার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে জাগলেও পরমুহূর্তেই সামলে নিলাম নিজেকে! হাতে গোনা কিছু মুহুর্ত উনাকে জড়িয়ে ধরে জোর করেই ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। আর এক মুহুর্তও নিজেকে উনার সামনে রাখার দুঃসাহস করতে পারলাম না৷ উনার থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে এক দৌড়ে চলে এলাম বাসার ভেতর। সিঁড়ির পাশ থেকে সোজা গিয়ে আমাদের জন্য সাজিয়ে রাখা গেস্ট রুমে ঢুকেই দরজা আঁটকে দিলাম। বুকের ভেতরটা থেকে থেকে লাফ মা/র/ছে। হাত-পা তো সেই থেকেই কেবল কেঁপেই চলেছে। নিঃশ্বাস গুলো ভ/য়ং/ক/র ভাবে জড়িয়ে আসছে। জমে যাচ্ছি আমি! বিছানায় বসে জোরে জোরে দম ফেলতেই অপরিচিতর ম্যাসেজের কথা গুলো আরও একবার মাথার মধ্যে বেজে উঠলো,
—-” আমার বড় সাধ হয়
তোমার নিঃশ্বাস আটকায়ে দেখি,
তুমি ম-রো, না আমি!
ইঁচালি-বিঁচালি শরীরের,
ভাঁজে ভাঁজে ~~
আ-গু-ন জ্বা-লা-য়ে দেখি,
তুমি পো-ড়,না আমি!”
৪৯.
জমিয়ে কাজ চলছে নবীন বরন প্রোগ্রামের। কানাঘুঁষায় শোনা গেলো সিনিয়রদের লিডার রাহিয়ান রাফিদ এই প্রথমবার সব কিছু নিয়েই ভীষণ হেলাফেলা করছেন যা এর আগে কখনো কোনো কাজেই করেননি। কারন? কারোর জানা নেই। এমনকি স্বয়ং রাহিয়ান রাফিদেরও জানা নেই। অনেকেই কৌতুহল বশত আলোচনায় বসে যাচ্ছে এরকমটা হওয়ার কি কারন? সেকি প্রেমে পড়েছে নাকি ছ্যাঁ-কা খেয়েছে ব্যাকা হয়েছে। এমন কথায় বেশিরভাগ জনগন সেইরাম ভাবে চটে যাচ্ছে। রাহিয়ান রাফিদকে ছ্যাঁ-কা দেওয়ার মতো কোনো মেয়ে আজও অব্দি এই ভুবনে জন্মায়নি! এর মানে বুঝছেন তো? তাকে ছ্যাঁ-কা দেওয়া অসম্ভব। কেননা, লাখো মেয়ে নিজেই তো প্রতিনিয়ত ছ্যাঁ-কা খেয়ে ম-রে যাচ্ছে একা একা!
আমি আর রাই ভার্সিটির আর্টকলা ভবনের নিচতলায় বসে আছি। আর রাহিয়ান ভাইয়াকে নিয়ে এতো এতো আলোচনা সব আমাদের পাশে বসেই হচ্ছে। রাই আমাকে খোঁচা মে-রে নাকি সুরে বলল,
—-” তোর ইচ্ছে করছেনা মেয়েগুলোর চুলগুলো টেনে উগলে নিয়ে আসতে?”
আমি হতবাক হয়ে বললাম,
—-” কেন?”
রাই অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
—-” তুই আমাকে এখনো জিজ্ঞেস করছিস ‘কেন’? তুই কি সত্যি বুঝতে পারছিস না?”
আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। মেয়েগুলোর দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে পূণরায় রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-” না! কি হয়েছে বুঝলাম না তো কিছু?”
রাই রা-গে ফুঁসছে। গাল ফুলিয়ে বলল,
—-” তোর জায়গায় আমি থাকলে না ঠিকই ওদের চুল ছিঁড়ে নিয়ে চলে আসতাম। রাহিয়ান ভাইয়ার ছ্যাঁ-কা খাওয়া বা প্রেমে পড়া অব্দি তো ওদের কথা ভালোই লেগেছে কিন্তু এখন? এখন উনাকে স্বপ্নের পুরুষ ভেবে কেমন হা-হুতাশ করে ম-র-ছে দেখ!”
আমি ফিক করে হেসে দিলাম। রাইয়ের চটে যাওয়ার কারন হয়ত ধরতে পেরেছি আমি। তাই খোঁচা মা-রা-র সুরে বললাম,
—-” তোর উনাকে কেমন লাগে?”
রাই নেভানো চোখে তাকালো। আ-হ-ত গলায় বলল,
—-” রূপকে দেখার আগে উনাকে দেখলে হয়ে যেতো কাজটা। কিন্তু কি করার?”
—-” তোর তো তাও একজন আছে। কিন্তু ওদের দেখ, তোর মতো ওদের তো কেউ নেই! যে আছে সে হলো রাহিয়ান ভাইয়া! কাছে টেনে সোহাগ তো আর করতে পারবেনা তাই দূর থেকেই এমন করছে। কি আর করার? যার যা খুশি করতে দে না?”
রাই নড়েচড়ে বসলো। আমার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় প্রশ্ন করল,
—-” তোর কি আসলেই খারাপ লাগছেনা?”
আমি পূর্নদৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম রাইয়ের পানে। না সূচক মাথা নেড়ে বললাম,
—-” না, হঠাৎ খারাপ কেন লাগবে? আমার তো শুনে বেশ মজাই লাগছে!”
রাই মুখ বাঁকাল। চোখ দুটো সরু করে বলল,
—-” এই একই প্রশ্ন আগামী সপ্তাহে আমি তোকে আবারও জিজ্ঞেস করবো এন্ড আমি ড্যাম শিওর তুই ভিন্ন উত্তর দিবি।”
—-” মানে?”
—-” কিছু না। চল ক্লাসে যাই, তিনতলা অডিটোরিয়ামে তোর নাচের প্রাকটিস হবে।”
নাচের কথা শুনলেই তাল উঠে যায় আমার। আই লাভ নৃত্য। আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমোদে মেতে উঠে রাইকে নিয়ে চলে গেলাম তিনতলায় অডিটোরিয়ামে।
অডিটোরিয়াম রুমটা যথেষ্ট বড়। কিন্তু আজ নাচের প্রাকটিসের জন্য আসা স্টুডেন্টদের ভীরে ভরপুর হয়ে উঠেছে জায়গাটা। আমি রাইকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা মিলল অনন্যা আপুর। সাথে বাঁকা মুখওয়ালি অরিন আপুও রয়েছেন। বুক ধড়ফড় করছে যেন রাহিয়ান ভাইয়া না থাকেন। সায়তানকা নাম লিয়া তো সায়তান হাজির। তাদের পুরো গ্যাং-ই সাউন্ডবক্সের পাশে রাউন্ড হয়ে বসে আছেন চেয়ারে। আমাকে দেখতেই স্রেফ একবার তাকালেন উনি। আর ফিরে তাকালেন না আমার দিকে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে নাচের টিচার মারুফা ম্যামের দিকে এগিয়ে যেতেই ডেকে উঠলেন আরফান ভাইয়া। ঝা-মে-লা-র শুরুটা সব সময় এই ব্যাক্তির থেকেই হয়। রাহিয়ান ভাইয়ার ও-য়া-র্নিং-য়ে-র কথা মনে পড়তেই তার ডাক সম্পূর্ণ রূপে উপেক্ষা করে নিজের গন্তব্যেই হেঁটে চললাম। কিন্তু না নিধি থাকবে যেখানে বিপদ যাবে সেখানে! মেনে নিতে শিখ প্রিয়! নিজের মনকে বুঝ দিতে দিতেই সামনে এসে খাম্বা হয়ে দাঁড়ালেন আরফান ভাইয়া। আমি ভ-য়ে ভ-য়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা চালালাম। আঁড়চোখে রাহিয়ান ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি রেখেছি! তিনি তার সম্পূর্ণ ধ্যান জ্ঞান ফোনের মাঝে ডুবিয়ে বসে আছেন। এদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে তাতে যেন তার কোনো মাথা ব্যাথাই নেই।
—-” তুমি নৃত্যকলাতে নাম দিয়েছো?”
আরফান ভাইয়ের সহজসরল প্রশ্ন। আমি ঢোক গিলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। আরফান ভাই খুশিতে আটখানা হয়ে অনন্যা আপুকে ডাক দিলেন। অনন্যা আপু বসে থেকেই ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলেন কি হয়েছে। আরফান ভাইয়া তার সঠিক জবাব না দিয়েই আবারও ডেকে উঠলেন। অনন্যা আপু তার ডাকে অতিষ্ট হয়েই উঠে এলেন।
—-” কি রে কি হলো তোর হঠাৎ?”
—-” তুই নাচে তোর লাস্ট একটা পার্টনার খুঁজছিলিস না? নিধিও তো নাচবে। তুই ওকেই নিয়ে নে তোর টিমে?”
অনন্যা আপু মিষ্টি হেসে আমার দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
—-” তাই নাকি? নিধি নৃত্যকলাতে নাম লিখিয়েছো?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
—-” হ্যাঁ আপু। তাই ম্যামের কাছেই যাচ্ছিলাম কোন দলে কি গানে নাচ হবে সেটা কনফার্ম করতে।”
—-” যাক তাহলে তো হয়েই গেলো। তোমাকে আর ম্যামের কাছে যেতে হবেনা তুমি বরং আমার সাথে চলো। আমার টিমে পুরো ছয়জন কমপ্লিট। আর একজন হলেই ডান। আচ্ছা তুমি নাচ কেমন পারো? একটু ভালো নাকি বেশি ভালো?”
আমি মুখ খোলার আগেই পাশ থেকে উৎসাহিত কন্ঠে বলে উঠলো রাই,
—-” এক কথায় চমৎকার আপু। আমি হলফ করে বলতে পারি নিধির মতো এতো ভালো ডান্সার হোল এরিয়াতে তুমি পাবেনা!”
রাইয়ের কথায় গর্বে বুক ফুলে যাওয়ার কথা আমার। কিন্তু আমি যে তা পারছিনা। ভ-য় হচ্ছে হুতুমপেঁচাকে নিয়ে! আমার সাধের নাচেও আবার বাগড়া দিয়ে বসবে না তো?
আমার মনকে স্বস্তি দিয়েই বাঁধা দিলেন না তিনি। রাইয়ের মুখে আমার ছোট থেকে বড় হওয়ার সাথে সাথে নাচের সম্পর্কটাকে এমন ভাবে উপস্থাপন করলো যে সেও খুশি হয়ে অভিনন্দন করলেন। সবার দৃষ্টির অগোচরেই মাতাল হেসে ছোট্ট করে বলে গেলেন,
—-” অল দ্যা বেস্ট।”
#চলবে____________________#প্রেয়সী 🤎🥀(২৬)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৫০.
অস্থির মনটাকে শান্ত করেই বাবার আদরের ডাকে সাড়া দিলাম।
—-” কেমন আছো তুমি বাবা?”
—-” নিধি কি কাঁদছে?”
—-” না, নিধি কিন্তু কাঁদেনা! বাবা কি তা জানেনা?”
বাবা ছোট্ট করে হাসলো। বাবার হাসির শব্দে মন জুড়ালো আমার। ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবারও বলে উঠলাম আমি,
—-” নিধিকে ছেড়ে ওখানে আর কতদিন থাকার মতলব করছো বলবে একটু? তুমি তো দেখছি দিন দিন ভীষণ সেলফিশ হয়ে উঠছো খান সাহেব? তোমার নামে আজই আদালতে মা-ম-লা ঠু-ক-তে যাবো দেখে নিও।”
বাবা আবারও হেসে উঠলো খানিক। আদুরে কন্ঠে বলল,
—-” ডক্টরই যে আমাকে ছাড়ছে না মা। তবে আমিও এই হসপিটালের পাট চুকিয়ে দিয়েছি আজ। ডক্টরকে এক ধমক দিয়ে বলেছি, অনেক হয়েছে আপনার ডাক্তারি পেশার পাঠশালা। এবার আমাকে যেতে দিন দেখি মশাই। আর কতদিন থাকব এখানে? ওখানে যে আমার প্রাণ ভোমরাটা বাবাকে ছাড়া ভীষণ একলা পড়ে গেছে।”
চোখ থেকে গড়িয়ে দু’ফোটা জল পড়লো বুঝি। খেয়াল করলাম না। বাবার বাচ্চামো টাইপ কথা শুনে এবার আমিও বকে উঠলাম,
—-” শুনো খান সাহেব? নিধি তোমায় একটু মিস করে ঠিকই তবে তাই বলে ডক্টরের উপর থেকে তোমার রায় দেওয়া মোটেই বরদাস্ত করবে না বুঝলে? ডক্টর যা বলবেন একদম বিনাবাক্যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। আর তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।”
—-” নিধি কি বাবাকে একটুই মিস করে নাকি তার থেকেও সামান্য বেশি?”
—-” নিধি বাবাকে একটু নয় অনেক বেশিই মিস করে। আর নিধির এই বাবাকে ছাড়া ক-ষ্টে-র সময়টা ঠিক করে দিতে হলেও তো বাবাকে আগে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে হবে তাই না? ও বাবা? সত্যি করে একটা কথা বলবে তুমি?”
—-” হ্যাঁ মা। বলনা কি কথা?”
—-” তুমি মাকে আজও ভীষণ মিস করো তাই না?”
—-” তোর মাকে? আরে ধুর কি যে বলিস না তুই? ওকে তো আমি সেই কবেইইই ভুলে গ..গেছি! আমি এখন আর ওকে একটুও মনে করিনা। এখন আমার নিধি মা আছে না? আমার নিধির মতো একটা মেয়ে থাকতে আর কারোর কথা ভ..ভাবতে হয় নাকি? সেই সময়ই পাই না আমি!”
বাবার কন্ঠটা কিঞ্চিৎ কাঁপল বুঝি। কথা গুলো বেশ বাঁধছিলো গলার কাছে। আমার ভেতরটা মোচড় দিলো। প্রশ্নটা করে কি বাবার ক-ষ্ট-টা আরও দু’গুন করে দিলাম? মায়ের কথা ভেবে বাবার ক-ষ্ট পাওয়াটাই কি খুব স্বাভাবিক নয়?
—-” কি রে মা? তুই আবার চুপ হয়ে গেলি কেন?”
—-” বাবা, মানুষ একবার হারিয়ে গেলে আর কখনও ফিরে আসেনা তাই না?”
—-” কেন এসব কথা তুলে নিজের ক-ষ্ট-টা বাড়াচ্ছিস মা? তোর মা আর এই দুনিয়াতে নেই রে। বহুবছর আগে নিজের অস্তিত্ব গুটিয়ে হারিয়ে গিয়েছে সে। আর কখনও ফিরেনি। ফিরবেও না। তাই বলে কি আমরা বোকার মতো তার ফেরার আসায় প্রহর গুনবো?”
—-” সরি বাবা! আমি না বুঝেই বোকার মতো তোমায় এমন একটা প্রশ্ন করে ফেলেছি! আমায় ক্ষমা করে দাও বাবা!”
ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। নিজের উপর আর নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
—-” আমার পা-গ-লি মেয়েটা। এই শোন, নিধি নাকি কাঁদেনা? এই মাত্র কে যেন খুব বড় মুখ করে আমাকে বলল, নিধি যে কাঁদেনা তা কি তার বাবা জানেনা? কি রে মা? কাঁদছিস তুই?”
আমি ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলাম। কান্নার বেগটা নিয়ন্ত্রণ করা যে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবুও চেষ্টা চালালাম। অবশেষে সামান্য হলেও সফল হলাম। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে ফুঁপিয়ে উঠে বললাম,
—-” নিধি বাবাকে ভীষণ মিস করছে খান সাহেব। জলদি ফিরে এসো তার কাছে।”
—-” আসবো মা। আজই ডিসচার্জ হলো। পারলে আজই চলে আসতাম। কিন্তু রাহিয়ানের বাবা বললেন যে আজই যাওয়া যাবেনা। যেহেতু আজই ছাড়ল হসপিটাল থেকে। তো একদিন বেড রেস্ট না করে হঠাৎ জার্নি করা ঠিক হবে না তাই আজ থেকে গেলাম। কাল ঠিক আমি আমার মা-টার সামনে থাকব দেখে নিস। আর কখনো তোকে একলা করে বাবা কোথাও যাবে না মা। বাবাও যে তার নিধিকে ছাড়া খুব একলা পড়ে গেছে।”
—-” বাবা? কাল তুমি কি খাবে বলো? নিধি তোমার সব পছন্দের খাবার নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবে। কতদিন পর তুমি আসছো বলোতো? কি খাবে জলদি জলদি বলো? তোমার ফেভারিট খিচুড়ি, বিরিয়ানি, চিকেন পাস্তা, আলুপরোটা, আলুপোস্তা, মুগের ডাল, হাসের মাংস, ঝাল মাংস, পোলাও? কি খাবে বাবা? তোমার যা যা ভালো লাগে সব বলো? কাল শুধু একদিনের জন্য তোমার সকল স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সব কিছু খাওয়ার পারমিশন দিয়ে দিলাম।”
বাবা বাচ্চাসুলভ কন্ঠে বলে উঠলো,
—-” সত্যি বলছিস মা? কাল আমি সব খেতে পারবো তো?”
—-” একদম পারবে। বলো তোমার কি খেতে ইচ্ছে করছে। আমি সব রাঁধব।”
বাবা আমোদিত গলায় বলে উঠলো,
—-” তোর যা যা রাঁধতে সুবিধা হবে তুই সেগুলোই রাঁধিস কেমন?”
—-” আমার কোনো কিছুই রাঁধতে অসুবিধা হবে না বাবা। তুমি শুধু নাম গুলো বলো?”
বাবা মিনমিনে সুরে বলল,
—-” তাহলে সবই রাঁধিস।”
আমি হেসে ফেললাম। আদুর কন্ঠে বললাম,
—-” আচ্ছা ঠিকাছে বাবা। কাল আমি তোমার পছন্দের সব খাবারই রাঁধব। খুশি?”
বাবা সন্দিহান সুরে বলল,
—-” হ্যাঁ রে মা? তুই কি আসলেই এতো ভালো হয়ে গেছিস?”
আমি তীক্ষ্ণস্বরে বললাম,
—-” কেন? আমি খারাপ ছিলাম নাকি কখনো?”
—-” না না! আসলে আগে তো খুব কড়াকড়ি করতিস আমার সাথে! এই যেমন, বাবা তুমি এটা খাবে না, বাবা তুমি ওটা খাবে না। এটাতে এলার্জি আছে,ওটাতে ফ্যাট আছে। আজ হঠাৎ সব রাঁধবি বলছিস তো তাই একটু সন্দেহ হচ্ছে!”
—-” এতো এতো বারন করেও কখনো তোমাকে একটা কথাও শোনাতে পেরেছি বলো তো? তুমি তো তোমার ইচ্ছে মতোই খেয়ে এসেছো!”
বাবা খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। বাবা আমার আজও ছেলেমানুষী ছাড়তে পারলো না।
৫১.
সূর্য মামা সময়ের স্রোতে ডুবে গিয়েছে অনেক্ষন। প্রকৃতির বুক চিঁড়ে আঁধার নামলেও মেঘেদের যে মন খারাপ তা ঠিকই ধরা যাচ্ছে। সূর্যাস্ত হওয়ার পর প্রকৃতির হলদেটে রূপ ছাপিয়ে অন্ধকারে ঢেকে উঠছে সময়ের আগেই। আজ বৃষ্টি হবে। এবছরের প্রথম বৃষ্টি। মনটা আনন্দে নাচ পেড়ে উঠলো। বছরের প্রথম বৃষ্টি আর আমি ভিজব না সে যেন অসম্ভব! আগেই বলেছিলাম আমার ঠান্ডার ব্যামো আছে। কিন্তু বাবার মতো আজ আমারও একটু অনিয়ম করতে ইচ্ছে করছে!
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অনন্য রূপে বিমোহিত হয়েই রুমে চলে এলাম। সামনেই নবীন বরন। নাচের প্রোগ্রামে টিম লিডার আমি। যেহেতু বৃষ্টি বৃষ্টি গন্ধ আসছে সেহেতু অনন্যা আপুর সিলেক্ট করে দেওয়া গানটা কয়েকবার শুনে নেওয়া যাক। কয়েক লাইন মুখস্থ হলেও হবে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই প্রাকটিস করব। উফফ ভাবতেই কি যে আনন্দ হচ্ছে। গানটা ছেড়ে বাবার দেওয়া নুপুরটা পায়ে জড়লাম। নুপুরটা বেশ আগের হলেও এই যুগে এসেও এমন সুন্দর কাজ পাওয়া মুশকিল। এক কথায় অসাধারণ। নুপুরটা মায়ের। বাবাই মা কে উপহার দিয়েছিলো। আজ মা নেই তাই মায়ের সব জিনিস আমার।
খাটের উপর বসেই পা দুটো নাচাতে লাগলাম। সাথে সাথে নুপুরের ঝনঝন শব্দে মুখরিত হচ্ছে চারিপাশ। খাট থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে গানের তালে তালে নাচ ধরলাম। নাহ্, কোনো স্টেপই ভুলিনি। সবই ঠোঁটের আগায় মুখস্থ।
বাইরে দমকা হাওয়ার ছুটেছে। বাতাসের তোড়ে রুমের সব পর্দাগুলো উড়ছে। দৌড়ে গেলাম ব্যলকতি। ঝুপ করে বৃষ্টি নামলো। মনটা আর আটকালো না রুমে। ফোনের গান টা কোনো রকমের বন্ধ করেই এক দৌড়ে ছাদে এসে হাজির হলাম। দুনিয়া অন্ধকার করে বৃষ্টি হচ্ছে। ছাদের মাঝ বরাবর এসে দাঁড়ালাম। ঘুরে ঘুরে ভিজতে লাগলাম। কত না আনন্দ হচ্ছে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। হাতে গোনা ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায়ই বৃষ্টির সাথে সাথে ঠান্ডা বাতাসে শরীরে কাঁপুনি উঠে গেলো। তবুও ভিজছি, ভিজতে ভিজতে বৃষ্টির গন্ধে মাতাল হয়ে তাও ভিজছি।
—-” হেই ইডিয়ট! এই সন্ধ্যা বেলায় বৃষ্টিতে কেন ভিজছো?”
কারোর কন্ঠ শোনা যাচ্ছে! স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। চোখ দুটো আশেপাশে ঘোরাতেই নজরে এলো রাহিয়ানকে। মনের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠলো। উনি এখানে কি করছেন?
—-” কি হলো কথা কানে যাচ্ছে না? ভেতরে এসো! কাম ফাস্ট?”
রীতিমতো ধমকে উঠলেন। বুঝিনা বাপু, এই লোকের আমার সব কিছুতেই এতো সমস্যা কেন?
ধীরপায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। সে চিলেকোঠার দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বোধকরি উনি ছাঁদেই ছিলেন। হঠাৎ বৃষ্টি আসায় এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।
—-” বৃষ্টিতে ভিজছো কেন? জ্বর, ঠান্ডা না বাঁধালেই কি চলছিলো না?”
আমি ঠোঁট উল্টে তাকালাম। এটা তো বছরের প্রথম বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে তো মানুষ সখেও ভিজে।
—-” বৃষ্টিতে ভেজা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।”
উনি বুঝি হোঁচট খেলেন আমার আজগুবি কথায়। ভ্রু যুগল কুঁচকে নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। কি বলবেন বুঝতে না পেরে বোকা গলায় প্রশ্ন করলেন,
—-” হোয়াট।”
—-” জ্বী৷ কেন আপনি জানেন না?”
আমার বুকভরা আত্নবিশ্বাস দেখে উনি চটে গেলেন। একে তো আজগুবি কথা তার উপর উল্টে পাল্টে উনাকে কনফিউজড করা! উনি ক্ষে-পে গিয়ে আমার হাত টেনে ধরলেন। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো কারেন্ট বয়ে গেলো শরীরে। আমি সম্পূর্ণ বরফ আর উনি সম্পূর্ন আগুন। ঠান্ডা শরীরে আরও যেন ঠান্ডা জমে গেলো। উনি আর কোনো কথা না বলেই আমার হাত টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন। চিলেকোঠার এই ঘরটাতে আমার প্রথম পদচারণ। এর আগে একবারও আসা হয়নি এ-ঘরে। এখানে মুলত এই মানুষটারই আসা যাওয়া বেশি চলে তাই বাকিরা তেমন আসেন না। চিলেকোঠায় দুটো ছোট ছোট রুম। দুটোতেই উনার প্রয়োজনীয় অপ্রোয়জনীয় জিনিসপত্রে ভরপুর হয়ে আছে। উনি আমাকে একটা রুমের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন,
—-” এই ভিজে কাপড়ে তো নীচে যাওয়া সম্ভব নয়। তুমি ভেতর থেকে যেকোনো একটা ড্রেস নিয়ে ঝটপট চেঞ্জ করে নাও। ঠান্ডা লেগে যাবে এন্ড দ্যেন জ্বর আসতে সময় লাগবে না।”
আমি বোবা চোখে তাকিয়ে আছি। কত শখ করে এসেছিলাম বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু লোকটা তাতেও বাগড়া দিয়ে দিলেন। উনার সমস্যাই সমস্যা। আমি আর কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলাম। আমার সামনে বড় বড় দুটো আলমারি। একটা আলমারি খুলতেই দেখি এখানে সব শাড়ির দুনিয়া। ভরপুর শাড়ি। অন্যটাতেও একই অবস্থা! শাড়ি ব্যাতিত একটা সুতোও নেই! বাহ্!
দুঃখে হাত পা ছড়িয়ে কেঁদে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। হামলে পড়লাম আলমারির উপর এই আশায় যদি শাড়ি ছাড়া অন্য কোনো ড্রেস কপালে জুটে। কিন্তু জুটলো না। হাতড়ে হাতড়ে যা পেলাম সবই শাড়ি। সব রেখে একখানা কালো শাড়ির উপর চোখ পড়ল। শাড়ি পড়তে পারিনা জেনেও এই শাড়িটা পড়ার জন্য মনটাও বিচলিত হলো। শাড়িটা পড়ার জন্য রুমটাই ব্যবহার করলাম। রুমের দরজা লক করে শাড়ি পড়ায় মনোনিবেশ করলাম। বউমনির টেকনিক গুলো মনে করে করে শাড়ি পড়ায় উত্তির্নও হলাম একসময়। কিন্তু এই শাড়ি এভাবেই ঠিক কতক্ষন টিকবে সঠিক আন্দাজ করা গেলো না। চারপাশে পানি পিপাসুদের মতো আয়না খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু পো-ড়া কপাল, ঘরের এক কোনেও একটা আয়না নেই। তাই নিজেকে ঠিকঠাক না দেখেই বাইরে বের হতে হলো।
দুটো রুম ছাড়িয়ে সামনের রুমটাতে পা রাখতেই রাহিয়ান ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। মনের মধ্যে খুশির ঝিলিক মারলো। উনাকেই আয়না হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু মনে সাহস জুগিয়ে উনাকে ডাকতে পারলাম না। তাই আস্তে করে গলা খাঁকারি দিলাম। যেন উনি বুঝতে পারেন আমি এসেছি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আস্তে করে গলা খাঁকারি দিতেই ফোনের থেকে ধ্যান সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন উনি। কি হলো বুঝলাম না কিন্তু উনি আমাকে দেখতেই দাঁড়িয়ে গেলেন। গভীর চোখে আমার পা থেকে মাথা অব্দি তাকাতেই আমি নড়েচড়ে উঠলাম। উনি এভাবে কেন দেখছেন? শাড়িটা কি ঠিকমতো পড়া হলো না?
আমার ভাবনার মাঝেই উনি শান্ত কন্ঠে বললেন,
—-” মেয়েদের ভেজা চুল নিয়ে কোনো ছেলের সামনে আসা বারন! একথা জানা নেই তোমার?”
আমি করুন চোখে তাকালাম তার দিকে। আমার চুল থেকে এখনো টপটপ করে পানি পড়ছে। চুল মোছার জন্য তো তেমন বিশেষ কিছুই পায়নি! তবে কি করে মুছতাম?
—-” কোনো তোয়ালে তো পাইনি! তাই….”
—-” তোমায় দেখে আমার বুকের ভেতরটায় একটা অসহ্যনীয় ব্যা-থা হচ্ছে নীলাদ্রিতা। এর জন্য কি শা-স্তি দেওয়া যায় তোমায়?”
‘নীলাদ্রিতা’ নামটা শুনতেই ধাক্কা খেলাম বুঝি। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠতেই উনি আবারও বলে উঠলেন,
—-” তোমার ভেজা চুল গুলো মুছিয়ে দেওয়ার এই ছোট্ট অনুমতিটা কি পাওয়া যাবে প্লিজ?”
আমি যেন না বলতে চাচ্ছি। কিন্তু পারছিনা! আমি আমার অদ্ভুত অনুভূতিগুলোর কাছে নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে চাচ্ছি কিন্তু তাও যে পারছিনা। উনি ধরে নিলেন মৌনতাই সম্মতির লক্ষন। উনার হাতের পাশেই সাদা তোয়ালেটা উনি হাতে তুলে নিলেন। আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে এলেন। উনার কাছে আসাতে আমার শরীর অবস হয়ে আসতে চাচ্ছে। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সুযোগ পেলেই দৌড়ে পালাবো এখান থেকে। মনে মনে এমন আউলাঝাউলা বুদ্ধি করে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি আলতো করে ছুঁয়ে দিলেন আমায়। আমি না চাইতেও চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলাম। উনি তোয়ালে পেঁচালেন আমার চুলে। কোমল ভাবে আমার চুল মুছতে লাগলেন। আমি চোখ বুঁজেও ঠিক অনুভব করতে পারছি উনার গভীর চোখ জোড়া আমাকেই দেখছে।
আচমকাই ঘোর লাগানো কন্ঠে বলে উঠলেন তিনি,
—-” সে রাতে একটা কবিতার জন্ম হয়েছিলো,
খোলা বারান্দায় হাসনাহেনার সুবাস এসেছিলো~~
চাঁদ-মেঘের লুকোচুরি আর ঝুম বরষার বৃষ্টিপাতে,
আমার মনের কাগজ-কলম, কাব্যে ভরেছিলো~~
সে রাতে মৃদু বাতাস ছিলো,
এক টুকরো অলস আকাশ, একাই কেঁদেছিলো~~
ঘোর লাগানো মাতাল হাওয়া, হৃদয় ছুঁয়েছিলো,
চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষে,ভীষণ ভেবেছিলো!
সে রাতে মেঘের আঁধার ছিলো,
অল্প আলোর ক্যানভাসে, এক রঙিন ছবি ছিলো,
ইচ্ছে মতো রঙ লাগিয়ে, কল্পনাতে মন ডুবিয়ে,
মেঘলা আকাশ,জোৎস্ন্যা নিয়ে,
ঝুম বৃষ্টির সুর মিশিয়ে,
হৃদয় যেন কেমন করে,
তোমায় এঁকেছিলো🥀
উনার কবিতার লাইন গুলো এক ধাক্কায় অপরিচিতর কল দেওয়ার প্রথম দিন থেকে সবটাই যেন মনে করিয়ে দিলো। তার মানে উনিই সেই অপরিচিত! অসম্ভব এক ভালোলাগায় শরীর কাঁপতে লাগলো আমার। অদ্ভুত এক শিহরণে মনখানা মত্ত হতেই চোখ খুলে উনার চোখের দিকে তাকালাম। মোহাচ্ছন্নতায় ছেপে আছে উনার চোখ আর ঠোঁট। আমি বেশ বুঝতে পারছি উনার এই অনুভূতিতে একই ভাবে আসক্ত বোকা আমিও। আমি চোখ ঝাপটে উনাকে কিছু বলতে নিলেই উনি আমার দু’গালে হাত চেপে মুখটা আরেকটু উঁচিয়ে ধরে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালেন আমার ঠোঁটে। এ যেন এক
ভ/য়ং/ক/র অনুভূতি। আমার শিরদাঁড়া সোজা হয়ে উঠলো অদ্ভুত যা/ত/না/য়। শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে শিহরনে লুটেপুটে যাচ্ছে। আমার চেতন ফিরতেই নিজেকে উনার থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলাম। কিন্তু আমার চেষ্টাকে বৃথা করে দিলেন উনার হাতজোড়া। উনার শক্তির কাছে পেরে ওঠা আমার সাধ্যে নেই প্রমান দিয়েই আমার কোমর চেপে মিশিয়ে নিলেন নিজের সাথে।
#চলবে____________________
[ কমেন্ট তো বানতাহে! হ্যায় কি নেহি?😏]