প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব -২৪+২৫

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

২৪.
আজকাল তন্ময় খাচ্ছে না, ঠিকঠাক ঘুমোচ্ছে না। ঠিক সময় বাড়ি ফিরছে না। এসব আলোচনা শাহজাহান বাড়ির কোণায় কোণায় হচ্ছে। অরু যেখানে যায় সেখানেই এগুলো শুনছে। যেমন
ভোর সকালে উঠে এসেছে রান্নাঘরে। পেটে কিছু ঢুকিয়ে পড়তে বসবে বলে। এখানেও শুনছে জবেদা বেগমের অভিমানী স্বর,
-‘ আমার ছেলেটার কি হয়েছে হঠাৎ করে! কার নজর পড়লো! কিছুই খেতে চায়না। কয়েকদিনে শুঁকিয়ে বাজান আমার কাঠকাঠ হয়ে গেছে। ‘
পানি খেতে নিয়ে অরু কেশে উঠলো। আলগোছে বেরিয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে চলে এসেছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখল তন্ময় দাঁড়িয়ে। তাকে দেখতেই অরু পায়ের গতি বাড়াল৷ তন্ময় সামনে এসে দাঁড়ালো। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রশ্ন করলো,
-‘ কী সমস্যা তোর? ‘
অরু পাশ দিয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা ঘেঁষে বসে পড়লো মেঝেতে। মাথাটা এলিয়ে রেখেছে পেছনে। কীভাবে বলবে তন্ময়কে সমস্যা কোথায়! সমস্যা তো অরুর মধ্যে। সে না জেনেশুনে প্রেমে পড়েছে। এই প্রেম নিয়ে তন্ময়ের সামনাসামনি হবার দুঃসাহস আর তার মাঝে নেই। একদম নেই! ন’টায় বোর্ড এক্সাম দিতে বেরোবে। তাই সকাল সকাল উঠে রিভিশন দিতে শুরু করেছে। এক ফাঁকে সুমিতা বেগম চা দিয়ে গেছেন। অরু চায়ে চুমুক বসিয়ে পড়াশোনায় বিভোর। ঘড়ির কাঁটা আটটায় যেতেই তৈরি হয়ে নিলো। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুঁছিয়ে নিচে নেমে এসেছে। সে আজ যাবে আনোয়ার সাহেবের সাথে। সাধারণত বোর্ড এক্সাম দিতে সবসময় তন্ময় নিয়ে যায়৷ তবে গতকাল রাতে অরু পরিষ্কার করে আনোয়ার সাহেবকে বলেছে, তাকে নিয়ে যেতে। নাহলে পরিক্ষা দেবেনা। অগ্যত আনোয়ার সাহেব তৈরি হয়ে মেয়ের জন্য সোফায় বসে। ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পড়বেন৷ মোস্তফা সাহেব হাতের নিউজপেপার সরিয়ে বললেন,
-‘ প্রিপ্রারেশন কেমন? ‘
-‘ ভালো চাচ্চু। ‘
-‘ ঠান্ডা মাথায় পরিক্ষা দিবে। ‘
-‘ জি। ‘
ব্রেকফাস্ট করে বের হতেই তাদের সামনে তন্ময়ের গাড়ি থামলো। কাঁচ নামিয়ে তন্ময় আনোয়ার সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘ চাচ্চু! তোমার না ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিলো? ‘
-‘ ছিলো। কিন্তু মেয়েটা জেদ ধরেছে আমার সাথে যাবে। তাই থাক কাজ। পড়ে করে নিব।’
-‘ আচ্ছা উঠে এসো। আমি ড্রপ করে দেই। ‘
আনোয়ার সাহেব মেয়ের দিক তাকালেন। অরু মুখমণ্ডল অন্ধকার করে রেখেছে। যেমন এই গাড়িতে করে যাবেনা। গাড়িতে সে উঠবে না। আনোয়ার সাহেব ধীর স্বরে শুধালেন,
-‘ কি হইছে মা? উঠো! ‘
অরু কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। সময় নিয়ে পেছনে উঠে বসলো। চুপচাপ বসে সে। গাড়ি চলছে। এখন শুধু আনোয়ার সাহেব আর তন্ময়ের আলোচনা শোনা যাচ্ছে।

ইদানীং অয়ন খুব ব্যস্ত। সামনে তার অনার্সের ফাইনাল। তারউপর নতুন প্রজেক্ট শুরু করেছে সে। শাবিহাকে দেখতে যাবার সময় নেই। সপ্তাহ খানেক হয়ে গিয়েছে শাবিহাকে একপলক দেখতে পারেনি। তাই আজ খুব হন্তদন্ত ভঙ্গিতে বাস স্ট্যান্ডের সামনে এসে পৌঁছেছে। কর্নারে বাইক পার্ক করে দাঁড়িয়েছে। ঘড়ির কাঁটা ছয়টা পঁয়তাল্লিশে। শাবিহা বেরোবে সাতটায়। দাঁড়িয়ে থেকে অয়ন হাতে হাত ঘষছে। শীত নেমেছে। প্রচুর শীত। ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে, জ্যাকেট পরেও শীতে থরথর করে কাঁপতে হচ্ছে। মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে একরাশ ধুয়া। শাবিহা বেরোতে বেরোতে সাতটা বিশ। তাকে দেখেই অয়ন ছুটে গেল। অথচ তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছে শাবিহা। ভাব এমন যে সে অয়নকে চেনে না। অয়ন হেসে পিছু ছুটেছে। ধীর স্বরে শুধালো,
-‘ রেগে? ‘
-‘………’
-‘ এইযে শাবিহা! আল্লাহ ওদিকে যায়না। আমার বাইক এখানে! ‘
শাবিহা কথাই শুনছে না৷ শুনবে কেন? একটা সপ্তাহে একবার কলও করেনি। দেখাসাক্ষাৎ তো দূরের বিষয়। শাবিহা কল করেছে ধরে শুধু ‘ হু, হা ‘ বলে কেটে দিয়েছে। এতটাই ব্যস্ত? এখন শাবিহা ও ব্যস্ত। অয়ন হেসে দৌড়ে ফিরে গেল স্ট্যান্ডের সামনে। হেলমেট পরে, বাইকে চাবি ঢুকিয়ে, বাইক স্টার্ট করলো। একটানে শাবিহার সামনে চলে এলো।
আজ শাবিহা বাসও নেয়নি। কার জন্য নেয়নি তা তো অজানা নয় অয়নের। সে খুশি মনে প্রিয়তমার রাগ ভাঙাতে প্রস্তুত৷ অয়ন একটানে সামনে চলে গেল। ব্রীজের একপাশে বাইক পার্ক করে, শাবিহার কাছে ফিরে এলো৷ পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো দুজন। শাবিহা বুকের কাছটায় দুহাত পেঁচিয়ে রেখেছে। মুখে গম্ভীর ভাব। অয়নের হাসি পাচ্ছে কিন্তু সে না হাসার চেষ্টা করে চলেছে। একপর্যায়ে মাথা ঝুকিয়ে বলল,
-‘ ব্যস্ত ছিলাম সত্যি। এরপর থেকে এমন ভুল আর হবেনা। তুমি ফার্স্ট বাকিসব লাস্ট ওকে?’
অয়ন আবারো বলল,
-‘ আচ্ছা গেইস করো ত, আমি বাড়িতে কী পরে ছিলাম? ‘
শাবিহা মনে মনে অয়নকে ভেঙাল। সে কীভাবে জানবে অয়ন বাড়িতে কি পরেছিল? অবশ্য বাড়িতে ছেলেরা ট্রাউজার পরে। নাহলে শর্ট প্যান্ট? এগুলোই তো। কিন্তু জবাব দিলে সে রাগ দেখাবে কীভাবে? তাই শাবিহা জবাব দিলো না। অয়ন নিজেই বলল,
-‘ লুঙ্গি! লুঙ্গি পরে ছিলাম। একটানে খুলে আরেক টানে প্যান্ট পরে চলে এসেছি। ‘
শাবিহা চমকে তাকাল। তার চাহনিতে বিষ্ময় অনিবার্য। অয়ন শব্দ করে হাসছে। হাসতে হাসতে চোখের কোণে জল জমেছে। শাবিহা বিরক্ত সুরে বলল,
-‘ মিথ্যে বলার যায়গা পাওনা। ‘
-‘ তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি বাবার দেখাদেখি মাঝেসাঝে পরি। কী যে আরাম! আরাম আর আরাম। কোন দিক দিয়ে বাতাস যায় আর বেরোয় টেরই পাওয়া যায়না। ভেতরের সবকিছু আমার উড়ন্ত পাখির মতো ফ্রি। আহা! ‘
শাবিহা ‘ ছিঃ ‘ বলে আগে পা বাড়ালো। অয়ন আবারো উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। তার হাসি আজ ফ্রি বিতরণ হচ্ছে। দেখা গেল শাবিহার ঠোঁট জুড়েও হাসি। কোনোভাবেই হাসি মুছতে পারছেনা। বাইকের সামনে আসতেই বাইকে উঠে বসলো অয়ন। শাবিহা পেছনে উঠে বসলো। বাইক স্টার্ট করতে নিয়ে অয়ন বলল,
-‘ শক্ত করে ধরো৷ ‘
শাবিহা ধরলো। শক্ত করে দু’কাধ চেপে ধরলো। কয়েকটি চিমটি ও কাটলো। অয়ন হাসছে। যেমন শাবিহার এতটুকু শক্তি, চিমটি তার কিছুই করতে পারছেনা।
___________
ড্রয়িংরুমে সকলেই উপস্থিত। সাধারণত এসময় মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব বা ওহী সাহেব তারা থাকেন না। কাজ থেকে বাড়ি ফিরতে তাদের আটটা, ন’টা বেজে যায়। কিন্তু আজ তারা অসময়ে বাড়িতে কেন? শাবিহা চিন্তিত চেহারায় বাড়িতে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়লো। মোস্তফা সাহেব মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
-‘ ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এসো। কথা আছে। ‘
শাবিহা ‘ জি বাবা ‘ বলে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নিজের রুমের দিক এগোল। মনের মধ্যে সন্দেহ জাগছে। সে যা ভাবছে তা নয়তো? শাবিহা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো। মোস্তফা সাহেবের ইশারায় পাশের সোফায় বসলো। তার চিন্তাভাবনা সত্যি’তে রুপান্তরিত হয়েছে। যা ভেবেছে তাই শুনছে। তারজন্য বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। উচ্চবিত্ত পরিবার। ছেলে ভালো। একজন নামকরা ডাক্তার। বিয়ের পর শাবিহাকে ইতালি নিয়ে যাবে। সেখানেই স্যাটেল হবে নাকি। পাঁচ মাসের মধ্যেই বিয়েটা শেষ করতে চায়। মোস্তফা সাহেব খুব করে বলেছেন, তাকে ভেবে দেখতে। দেখে বোঝা যাচ্ছে তার বাবা এই বিয়ের সম্বন্ধে সন্তুষ্ট! শাবিহার পৃথিবী ঘুরছে। ঝামেলা কী শেষ হবার নয়? এই বিয়ে নামের দাগ জীবনে কেন থাকে? অতিষ্ঠ লাগছে তার সবকিছু।

রাতে খেতে বসে সম্বন্ধের বিষয়টি আবার উঠেছে। মুলত তন্ময়কে বলার জন্য। তন্ময় ইদানীং বাড়িতেই থাকেনা। ভোর সকালে বেরোয়, গভীর রাতে ফিরে। আজ দ্রুত ফিরেছে মোস্তফা সাহেবের আদেশে। বিয়ের বিষয় উঠতেই তন্ময় খাওয়া বন্ধ করল। মোস্তফা সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘ শাবিহাকে জিজ্ঞেস করেছ ও বিয়ে করতে চাচ্ছে নাকি? ‘
-‘ বিয়ে তো করতে হবে। আর কতো? মাস্টার্স শেষ হয়ে যাবার পথে প্রায়। তারপর? তোমার বোনের বয়স হচ্ছে! ছোট নেই আর। বাসায় আরও মেয়ে আছে। তাদের ও বিয়ে-শাদির ব্যাপার আছে। ওর জন্য অন্যদের আটকে রাখা হয়েছে।’
-‘ ও এখন বিয়ে করবে না! জোড়াজুড়ি করো না।’
-‘ বোনের প্রতি দায়িত্ব বলতে কিছু আছে তোমার মাঝে? ‘
-‘ আমার মধ্যে নেই! ‘
-‘ সেটা থাকবে কীভাবে? তবে শুনে রাখো! পরিবার ভালো। ছেলে ভালো। আমার ইচ্ছে… ‘
-‘ বিয়ে কী তোমরা করবে নাকি? তোমাদের ইচ্ছে দিয়ে কিছু আসবে যাবে না। বিয়ে যে করবে সে এসে যেদিন বলবে সেদিন বিয়ে হবে। ‘
-‘ শাবিহা রাজি। ‘
-‘ শাবিহা বলেছে? ‘
-‘ অবশ্যই। আমি যা বলবো আমার মেয়ে তাই করবে। ‘
বাবা-ছেলের তর্কের মধ্যে বাকিরা নিশ্চুপ। সকলেই কান পেতে শুনছে। তবে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। অরু মাথা নিচু করে খেয়ে চলেছে। তর্কাতর্কি যেমন সে শুনছে না। আনোয়ার সাহেব বেশ কিছুক্ষণ পর বলল,
-‘ ভাইয়া… ‘
মোস্তফা সাহেব আগেই তাকে থামিয়ে দিলেন,
-‘ তুই যদি এই ছেলের সাপোর্ট করার জন্য মুখ খুলিস, তাহলে এখানেই চুপ করে যা। ‘
আনোয়ার সাহেব চুপসে গেলেন। তন্ময় খেতে নিয়ে বলল,
-‘ সামনে ইব্রাহিমের বড়ো ভাইয়ের বিয়ে। কার্ড পাঠিয়েছে। দেখে নিও। ‘
চুপচাপ খেতে থাকা রুবি খানিক নড়ে বসলো। আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক তাকাল। মোস্তফা সাহেব ও গম্ভীরমুখে ছেলের দিক তাকিয়ে। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। সেসময় বিনা আমন্ত্রিত মেহমান চলে এসেছে। অরুর মামা বাড়ির লোকজন। দলবেঁধে এসেছে। অরু আঁড়চোখে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। মোস্তফা সাহেব সাহেব গম্ভীরমুখে ডাইনিং থেকে উঠে দাঁড়ালেন। অতিথিদের ড্রয়িংরুমে বসতে ইশারা করলেন। আনোয়ার সাহেব ও ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সুমিতা বেগম হাত মুছে এগিয়ে এসেছেন। আজ শুধু অরুর বড়ো মামামামী আসেনি। সাথে তার মেজো মামামামী এবং তাদের ছেলে এসেছে। হানিফ! এই হানিফের জন্যই অরুর হাত চেয়েছে। হ্যাংলা পাতলা এবং কালো দেখতে। একদম অরুর মেজো মামার মতো। মোস্তফা সাহেব ওপর পাশের সোফায় বসেছেন। নাস্তা তৈরি করছেন জয়া বেগম। ফটফট কিছু খাবার ট্রে করে এনে সামনে দিয়েছেন। অরুর বড়ো মামা প্রশ্ন করলেন ,
-‘ অরু কোথায়? ‘
সুমিতা বেগম বললেন,
-‘ খাচ্ছে! ‘
-‘ আসতে বল। ‘
আনোয়ার সাহেবের গম্ভীরমুখে বললেন,
-‘ ওর পরিক্ষা আছে৷ এখানে আসতে পারবেনা। ‘
-‘ দু মিনিটের বিষয়! ‘
মোস্তফা সাহেব ডাকলেন,
-‘ অরু! ‘
অরুকে বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়ালো। তার সামনেই তন্ময় দাঁড়িয়ে। মুলত এই লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে এতক্ষণে যেতে পারেনি৷ নাহলে কখন নিজের রুমে চলে যেতো। ধীর পায়ে ড্রয়িংরুমে এলো। অরুকে দেখেই ইশারা করলেন তাদের মধ্যে বসতে। অরু এবার মহা বিরক্ত হলো বটে। দুজনের মধ্যে গিয়ে বসতে হবে কেন? অরু গিয়ে বসলো। অরুর মাথায় হাত বোলাচ্ছেন তার মেজো মামী। তার বড়ো মামা হাসিমুখে মোস্তফা সাহেবকে বললেন,
-‘ সুমিতা বলেছে নিশ্চয়ই? ‘
-‘ বলেছে। আমিও জবাব দিয়ে দিয়েছিলাম সেটা বলেনি? ‘
-‘ বলেছে! তাই আমরা সামনাসামনি কথাবার্তা বলতে এলাম৷ ‘
উপস্থিত সকলের কাহিনি বুঝতে সময় লাগলো না। অরুও সবকিছু বুঝে অবাকের চুড়ান্তে। তাকে আরও অবাক করতে হুট করে তন্ময় সামনে চলে এলো। চোখমুখ তার লালচে হয়ে আছে। মোস্তফা সাহেব আঁড়চোখে ছেলেকে চোখ রাঙালেন। তন্ময় সেদিকে তাকায়নি অবদি। গম্ভীরতম স্বরে সে অরুকে আদেশ দিল,
-‘ অরু! তোর রুমে যা! ‘
অরুর হাতের পশম দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সে হুড়মুড়িয়ে উঠে চলে যাচ্ছে। এতটা ভয়ংকর সুরে বলেছে যে, অরুর শ্বাস গলায় আটকে গিয়েছে প্রায়। তন্ময়ও পরপরই চলে গিয়েছে। মোস্তফা সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হেসে বললেন,
-‘ অরুর পরিক্ষা তো! তাই আরকি! ‘
কিন্তু তন্ময়ের ধমকের পর পরিবেশ থমথমে রয়ে গেল।
________
আজ অরুর পরিক্ষা শেষ হয়েছে। মাস খানেক লাগিয়ে পরিক্ষা দিয়েছে। দিন কোনটা রাত কোনটা তফাৎ করতে পারেনি। চোখমুখ বন্ধ করে পড়তে হয়েছে শুধু। তবুও এবারের পরিক্ষায় সে সম্পুর্ন মনোযোগ দিতে পারেনি। মনমেজাজ পরিক্ষা দেবার জন্য তৈরিও ছিলো না। কেমন রেজাল্ট আসবে তাতেও বেশ চিন্তিত অরু! কিন্তু এখন তার ঘুমানো প্রয়োজন। কিছুদিন ধরে ঘুমাতে পারেনি। তাই পরিক্ষা দিয়ে এসেই বিছানায় মরার মতো পড়ে রইল। কিন্তু তাকে ডিস্টার্ব করতে সুমিতা বেগম চলে এলেন। তখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে সবে। তিনি উচ্চস্বরে বললেন,
-‘ মাজারে যাবো। তৈরি হয়ে নে। ‘
-‘ আমি যাবো না৷’
-‘ সবাই যাচ্ছি। তুই যাবি না মানে? ‘
-‘ মা আমার ঘুমে মাথা ব্যথা করছে। ঘুমাতে দাও প্লিজ! ‘
-‘ একা থাকবি কীভাবে? ‘
-‘ এভাবেই। ‘
-‘ তোর চাচ্চু বলেছে এক্ষুনি উঠে তৈরি হয়ে নিতে।’
-‘ আমার পায়ে চিনচিন ব্যথা করছে। রেস্ট নিতে হবে। ‘
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন সুমিতা বেগম। এই মেয়ের সাথে তিনি তর্কে পারবেন না৷ বললেন,
-‘ তোর ছোট চাচী বাসায় আছে। কিছু লাগলে ডেকে নিস। ‘
-‘ হুম.. ‘
সুমিতা বেগম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েকে চোখ রাঙিয়ে, চলে গেলেন। অরু পড়ে পিটে ঘুমিয়ে রইলো। এরমধ্যে আবার মারজি ফোন করেছে। অরু ধরলো না৷ মেয়েটা কল দিয়েই যাচ্ছে। অতিষ্ঠ হয়ে অরু ধরলো। ওপাশ থাকে মারজি চেঁচিয়ে উঠলো,
-‘ জানিস কী হইছে? ‘
-‘ জানতে চাই না। ফোন রাখ। ‘
-‘ আরে কাটিস না। শোন। আব্রাহাম ভাইয়ার বিয়ে পরশু জানিস তো? ‘
-‘ হু। ‘
-‘ আজ তারা ব্যাচেলর পার্টি করছে। ‘
-‘ তো? ‘
-‘ কাকে দেখেছি আমি এখানে বলত? ‘
-‘ তোর চাচাকে? ‘
-‘ উঁহু! তোর তন্ময় ভাইয়াকে। আমাদের বিল্ডিং থেকে তাদের বিল্ডিংয়ের ছাঁদ দেখা যায়। ভাইরে ভাই! মদ, ভোটকা খেয়ে যা’তা অবস্থা। তুই যদি দেখতি… ‘
অরু কল কেটে দিলো। মদ খাক, নাহলে তেল খাক। তার কিছুই আসে যায়না। অরু আবারো ঘুমাতে চোখজোড়া বুঝল। কিন্তু এবার ঘুম ধরা দিচ্ছে না। মনে মনে মারজিকে ইচ্ছে রকম ধুয়ে দিলো। এই মেয়েটা ঘুম ভেঙেছে তার। তবে কথায় আছে, চেষ্টায় সফলতা মিলে। কথাটি সত্য! কারণ একপর্যায়ে অরু আবারো ঘুমিয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা রাতে পরিনত হয়েছে তবুও তার ঘুম থেকে উঠার নামগন্ধ নেই৷ মুফতি বেগম কয়েকবার দরজায় টোকা মেরে ডেকে গিয়েছেন,
-‘ এই অরু! তোর চাচ্চুদের ফিরতে মধ্যরাত হবে। আমি এখন ঘুমাবো৷ তুই কী কিছু খাবি না?’
-‘ আমি নিজে নিয়ে খাব। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। ‘
-‘ আচ্ছা! খেয়ে নিস। ‘
ঘুমঘুম চোখে সেলফোনে নজরে বুলালো। বারোটা এগারো। এতো রাত হয়েছে?

চলবে~প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

২৫.
দেয়াল ঘড়িতে নজর বুলিয়ে অরু বাইরে বেরিয়ে আসল। খিদে পেয়েছে। তবে খেতে ইচ্ছে করছে না!এর থেকে বড়ো কোনো জ্বালা আছে বলে মনে হয়না। পিটপিট নাক নিয়ে বাম পাশে তাকাতেই চমকে গেল। সামনেই কলি দাঁড়িয়ে। একদম তন্ময়ের রুম বরাবর। এই মেয়ে এখানে কেন! কলিও ঘাবড়ে গিয়েছে হঠাৎ অরুকে দেখে। সে মুলত তন্ময়ের অপেক্ষায়। যখন শুনেছে তন্ময় মাজারে যাবেনা। সেও যায়নি! বাসায় থেকে গেছে।
এতরাত হলো, তন্ময় এখনো ফিরছে না। কলির চিন্তা হচ্ছে! অরুকে দেখে এগিয়ে গেল। বিচলিত কন্ঠে শুধালো, ‘তন্ময় ভাইয়া আসেনি?’
‘আসলে তো দেখতেই পেতে।’
‘উনার নাম্বার আছে তোমার কাছে।’

অরুর মাথাটা ভনভন করছে। ‘ এই উনি, উনি ‘ শুনে সে ক্লান্ত। ক্লান্ত ‘নাম্বার আছে’ শুনতে শুনতে ও। স্কুল, কলেজ সবখান থেকে একবার অন্তত অরু শুনেছে ‘ তন্ময় ভাইয়ের নাম্বার আছে?’
ব্যাচমেট গুলো প্রায়শই তন্ময়ের নাম্বার, ফেইসবুক আইডি চেয়ে বসত! তখন চোয়াল শক্ত করে অরু পরিষ্কার করে বলে দিতো, ‘নেই।’
আজও তাই বলল, ‘নেই।’
‘নেই? তাহলে কি মুফতি চাচীর কাছে আছে?’
‘তার কাছেও নেই।’
কলি বিরক্ত হলো। বলল, ‘আমাকে সে নাম্বার দিয়েছিল। আমি বাড়িতে রেখে চলে এসেছি।’
ওহ্। নাম্বার আদান-প্রদানও হয়েছে বুঝি। তবে অরুর বিষয়টি ঠিক হজম হচ্ছেনা। নাম্বার দিবে তাও তন্ময়? হাদাটিলা মানুষ সে। নাম্বার দিবে তো দূরে বিষয়, কথাবার্তা টুকু তো বলেনা। কলির কথা অরুর বিশ্বাস হবে হবে করেও হলোনা।
সে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। পুনরায় বিছানায় শুয়ে পড়লো।

নরম বালিশে মাথা গুঁজে অরুর মনে হচ্ছে, মস্তিষ্কের একটি নিউরনের কাজ সর্বক্ষণ তন্ময়কে নিয়ে ভাবা। এইযে সে মনেপ্রাণে লোকটাকে ভুলতে চাইছে, বাতিল করতে চাইছে মস্তিষ্ক থেকে। কিন্তু কোনোমতে পারছে না। ঘুম ভেঙেছে ধরে চোখের পাতায় তন্ময় ভাসছে। বায়ুমন্ডলের ন্যায়ে ঘুরছে চারপাশে। মদ খেয়েছে? খাক! অরুর কী! মদ খাক, গাঁজা খাক, সিগ্রেট খাক বা না খাক, তাতে অরুর কিছুই আসবে যাবেনা। তাকে কলি খুঁজুক, নাহলে ঢলি খুঁজুক৷ ইট ডাজে’ন্ট ম্যাটার। কিন্তু মনের কোণে এটা আসলেই ম্যাটার করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছাড়ল। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রুমের বাতি জ্বালিয়ে জানালা খুলে দিলো। হুড়মুড়িয়ে একরাশ বাতাস ছুঁয়ে গেল সর্বাঙ্গ জুড়ে। আবেশে চোখবুঁজে রইলো। পূর্নিমার চাঁদ আকাশে। আঁধার রাতে চারপাশ পরিষ্কার ঝকঝকে। সেসময় দরজায় করাঘাতের শব্দ। অন্যমনস্ক অরু শুনতে পেল না৷ দু’একবার করাঘাত লাগাতার আসতেই নড়ে উঠলো। চুলগুলো পেঁচিয়ে নিতে নিয়ে চেঁচাল,
‘ চাচী তুমি এখনো জেগে? আমি বলেছিলামনা খেয়ে নিব? একদম কথা শুনো না!’

কাটা দিয়ে চুল বাঁধতে নিয়ে কাটা ভেঙে গেল। বিরক্ত চোখমুখে অরু দরজার দিক অগ্রসর হলো। কোমর সমান চুলগুলো বাতাসে দুলছে। মুখশ্রীর সামনে ভীড় জমিয়েছে। বিরক্তির রেশ বেড়ে গেল যেন। কাটা ভাঙার সময় পায়না নাকি? আবারো দরজায় করাঘাত। উফ! অরু শব্দ করে দরজা সম্পুর্ন খুলে দিলো। সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিকে দেখে হকচকিয়ে উঠল। বড়বড় চোখে তাকিয়ে রইলো। বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে সে। তন্ময়ের গোলান্দায মুখশ্রী লাল বর্ণ ধারণ করেছে। সাথে চোখজোড়া ও। চোখের কোণা লালচে দেখাচ্ছে সামান্য। ভ্রু দু’য়ের মাঝখানে সূক্ষ্ম ভাজ পড়েছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে ঝুলে আছে। সাদা ইন করা শার্টে লক্ষ্যমাত্রায় ভাজ পড়েছে। জুতো জোড়া খুলে আসেনি। কাঁদায় মাখোমাখো হয়ে গিয়েছে যেখানে পা ফেলেছে। অরুর মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। মেঝে এবং দরজার এই সীমান্ত টুকু সে নিজে মুছে। কোমর বেঁকিয়ে! এখানে এভাবে আসার মানে কী! তন্ময় শুধু সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো না। অরুকে টপকে ভেতরে ঢুকে গেল। শব্দ করে চেঁচাল অরু, ‘ এই, এই আপনি করছেন কী! ‘

তন্ময় ঘরে ঢুকে সম্পুর্ন কক্ষ জুড়ে বিচরণ চালালো কাঁদায় মাখোমাখো জুতো জোড়া পরে৷ তারপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। হুট করে আবার দরজার কাছটায় চলে এলো। অরু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে নিয়েছিল ভেবে লোকটা চলে যাবে! তাকে অবাক করে দিয়ে তন্ময় দরজার সিটকানি লাগিয়ে দিল।
বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো অরুর। রক্ত চলাচলের গতি বেড়ে গেল। নিজের অজান্তেই পেছনে চলে এলো কয়েক-পা। মাথা তুলে তাকাতেই তন্ময়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলল। শিহরণ বয়ে গেল সর্বাঙ্গ জুড়ে। শীতল সেই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। মাথা নত করে ফেললো। কন্ঠনালী কাঁপছে। কথা বললে কি গলার স্বর কেঁপে উঠবে? অরু গলার স্বর সরু রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘ কি সমস্যা আপনার? ‘

এ’কথায় যেন তন্ময়ের মস্তিষ্ক জ্বলে উঠল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা সে মুহুর্তেই অপ্রস্তুত অরুর সামনে চলে এলো। অরু পেছনে হাঁটার সময় টুকু পেল না। শটাং করে ডান গালে চড় খেয়ে বসলো। আচমকা ম্লান থাপ্পড় খেয়ে ভড়কে গেল। কেঁপে উঠল দৃশ্যমান রূপে। গালে হাত চেপে চমকে তাকাল তন্ময়ের দিক। পরপর বাম গালে আরেকটা থাপ্পড় পড়ল। আশ্চর্য! দুটো থাপ্পড় খাওয়া অরুর চোখে তন্ময় নিজের শীতল দৃষ্টি মিলিয়ে বলল, ‘ প্রথম থাপ্পড়টা তুই সেদিন ছাদে প্রাপ্য ছিলি। ‘

একটি বিদঘুটে গন্ধ অরুর মুখে থুবড়ে পড়ল। গন্ধে পেট গুলিয়ে উঠল। সঙ্গে অনুভব করলো তন্ময়ের কন্ঠের স্বর মৃদু কাঁপছে। যেমন কথা মনের গহীন হতে খুঁজে খুঁজে বলছে সে।
তন্ময় মাথাটা দুলিয়ে আরেকটু ঝুকল, ‘দ্বিতীয়টা আমাকে এভোয়েড করার জন্য। আর তৃতীয়’টা…. ওহ্, তৃতীয় থাপ্পড় তো বাকি! এটা কোথায় দিব? পিঠে? বলত তৃতীয় থাপ্পড় তুই কেন প্রাপ্য? ‘

থাপ্পড় গুলো অতটা জোরে লাগেনি। ধীরে লেগেছে। তবুও অরুর ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে মুহুর্তে। চোখের কোণে জল জমেছে। নাক ফুসছে। যেন কেঁদে উঠবে। এভাবে মারার মানে কী? অশ্রুসিক্ত নয়নে অরু মেঝেতে তাকিয়ে। তন্ময় ধীর স্বরে ধমকে উঠলো, ‘ বল তৃতীয় থাপ্পড় কেন খাবি তুই? ‘
‘ আমি চাচ্চুকে ডাকব! ‘
‘ পড়ে! আমাদের কথাবার্তা শেষ হোক, হু? ‘

অরু এই মাতাল’টার সঙ্গে একদম থাকবে না। মাতলামি করার যায়গা পায়না? আজ ওসব খেয়ে এসে এমন করছে! নাহলে তাকে চড় মারা তো দূরের বিষয়, এভাবে কথাবার্তা বলেছে কখনো? মুখের উপর কিছু ধমক মেরেছে এই যা! অরু ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না থামানোর প্রচেষ্টায়। তন্ময়কে ধাক্কা মেরে ছুটে গেল। দরজা খুলতে নিতেই হাতে টান অনুভব করল। তন্ময়ের গভীর স্বর শোনা গেল,
‘আমার কথা শেষ হয়নি অরু! আজ আমাদের কথা হবে, তারপর তোর ছুটি হবে। নে এখানে
দাঁড়া। ‘

অরুর দুরুদুরু বুক কাঁপছে। হাতে যেখানে স্পর্শ করেছে সেখানটা শীতল অনুভব করছে। তন্ময়ের স্পর্শ শীতল। ঠান্ডা বরফের ন্যায় হয়ে আছে হাত দুটো। তন্ময় পুনরায় বলল,’ উত্তর দে। আম ওয়েটিং! ‘
অরু ফুপিয়ে উঠল, ‘ জানি না! ‘
‘ তৃতীয় থাপ্পড় সেদিন আমাকে না বলে চলে আসার জন্য! সেলফোন ওফ রাখার জন্য! আমার কল কাটার জন্য! ‘

তৃতীয় থাপ্পড় অরুর পিঠে পড়েছে। অরু ক্ষিপ্ত কন্ঠে শুধালো, ‘ আপনার সমস্যা কী!’
‘ সমস্যা আমার নাতো। তোর! আর সেই সমস্যার কথাই জানতে চাই৷ তুই আমাকে বলবি! পরিক্ষা শেষ তো এখন। আরামসে বল। আমাদের হাতে সারারাত পড়ে আছে। ‘

কথাগুলো বলে তন্ময় সোজা হলো। অরুর সমান ঝুকে কথা বলে সে হয়রান যেমন! কোমর দু’পাশে দুলিয়ে, গলার টাই খুলে ফেললো। গলার কাছের কিছু বোতাম খুলে দিলো। দু’হাতার হাতার বোতাম খুলে কনুই পর্যন্ত উঠিয়াছে। প্রশস্ত পেশিবহুল হাত শার্টের উপর দিয়ে ফুলে। অরু আঁড়চোখে সেখানে তাকিয়ে আবারো মাথা নত করল। তার আগের তন্ময় ভালো! এই মাতাল তন্ময় মারাত্মক ভয়ংকর। এই তন্ময় অরু একদম চায়না!

তন্ময় অরুর নরম বিছানায় বসল, দু’পা দু’পাশে ছড়িয়ে। নজর বন্দী করল অরুর দিকে। অরুকে দেখছে খুটিয়ে খুটিয়ে। এখনো অরুর নাক ফুসছে। কেঁদে দিবে দিবে ভাব তবে কাঁদছে না। তন্ময় পায়ের সাহায্যে চেয়ার টেনে দিল। যেমন পা ব্যথা হলে আসামীর বসবার সুযোগ ও রয়েছে। অরু বসল না। হঠাৎ দরজায় করাঘাতের শব্দ! শোনা গেল মুফতি বেগমের কন্ঠ, ‘ অরু! ঘুমিয়ে আছিস এখনো? ‘

অরুর চোখজোড়া রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেল। কঠোর হতে বেরিয়ে আসবে চোখ। তন্ময় স্বাভাবিক। উঠে দাঁড়ালো। যেমন দরজা খুলবে। অরু দৌড়ে দরজার সামনে দাঁড়ালো। মুফতি বেগম দেখলে কেমন দেখাবে ব্যাপারটা? কী বলবে সে? দরজা লাগিয়ে তারা কি করছিলো? তন্ময় বাঁধা পেয়ে আবারো ভেতরে চলে গেল। বসল না বরং দাঁড়িয়ে রইলো। মুফতি বেগম আরও দুবার দরজায় করাঘাত করেছে। জবাব না পেয়ে চলে গেলেন। অরু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক তাকাল। বুকটা ধুক করে উঠল। এভাবে তন্ময়কে অরু কখনোই দেখেনি। তাই হয়তো সে এতটা আকর্ষণ অনুভব করছে? নাহলে সবকিছু ভুলে কীভাবে তার মন বারবার কাঁপছে? তন্ময়ের চাহনি পেতেই কেন দুরুদুরু করছে বুকের ভেতর? জানালা দিয়ে আসা দমকা হাওয়া উড়াতে লাগল অরুর ঘনকালো চুল।

তন্ময় এক’পা দু’পা ফেলে অরুর দিক অগ্রসর হলো। কাছাকাছি এসে সকল চুলগুলো একত্রে নিজের বা’হাতে পেঁচিয়ে নিল। এই অভ্যাসটা তার আগেকার। প্রায়সময় সে অরুর চুল হাতে পেঁচিয়ে টেনে দিত৷ বড়ো হয়ে আর করা হয়না। ভালো দেখায় না ভেবে করেনা। তবে আজ শুধু চুল নয় তন্ময়ের ইচ্ছে করছে চুলে মুখ গুঁজতে। কেমন হবে অরুর চুলের ঘ্রাণ! সামনে সবকিছু ঘোলাটে এবং দুটো দেখা তন্ময়ের মুখ অরুর ঘাড়ে চলে গেল। অরুর ঘোর মুহুর্তেই কেটে গেল৷ দুহাত তন্ময়ের বুকে চেপে সরানোর চেষ্টা করলো। সফল হলো না। তন্ময়ের নাক তার ঘাড়ে ছুঁয়েছে। পরপর নরম কিছুর স্পর্শে অরু থরথর করে কেঁপে দেয়ালে লেপ্টে গেল। অস্পষ্ট মৃদু স্বরে চিৎকার করল,
‘ তন্ময় ভাইয়া! আ..আপনি… ‘

অরুর ঘাড়ে অজস্র চুমু খেয়ে চলেছে তন্ময়। এক অদৃশ্য বাঁধা যেন উঠে গিয়েছে সামনে থেকে। ঘাড় থেকে মুখ অরুর কানের কাছে অগ্রসর হচ্ছে। কানের লতিতে ঠোঁট ছুয়েছে দুএকবার। গভীর স্বরে বলল,
‘ কেন করছিস এমন? আমি জানতে চাই। কেন এভোয়েড করছিস আমায়? কি হয়েছে? সব তো ঠিক ছিলো! তাহলে? ‘
কেঁপে উঠল অরু। মুহুর্তেই মনে পড়লো কলির কথা। তাদের বিয়ের কথা! বন্ধ চোখজোড়া খুলল। তন্ময়কে ঠেলে সরাতে চাইল পুনরায়। তন্ময় সরল না। বরং আরও ঘনিষ্ঠ হলো। গভীরভাবে অরুকে নিজের মধ্যে আটকে রাখল। ‘ ভালো লাগা শেষ? ‘ তন্ময়ের এ’প্রশ্নে গড়গড় করে কোণ ঘেঁষে চোখের জল বেয়ে পড়ছে। নাক ফুসছে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো অরু। কান্নার তোড়ে শরীর কাঁপছে। তন্ময় অরুর মুখ বরাবর এলো। করুণ ভাবে কাঁদতে দেখে বিচলিত হলো, ‘ কেন কাঁদছিস! ‘
‘ কাঁদছি কারণ আপনি বাজে। খারাপ লোক! ‘
‘ কোনদিকে? ‘
‘ সবদিকে! ‘
‘ সবটা? সবদিক কীভাবে পরিবর্তন করবো? ‘
তন্ময়কে চিন্তিত দেখাল। অরু ভ্রু দুটো কুঁচকে রেখেছে সামান্য। এমন হাবভাব করছে যেমন সে নিজে অরুর জন্য সব করবে! অরু ভেঙিয়ে
বললো, ‘ আপনার হবু বউয়ের কাছে যান। ‘

তন্ময়কে এবার আরও চিন্তিত দেখাল। ভুরু জোড়ার মাঝখানে ভাজ পড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। সে অরুকে ভালোভাবে দেখে বলল, ‘ তার কাছেই তো আছি। ‘

অরুর মুখ দিয়ে ফসকে বেরোলো, ‘তন্ময় ভাইয়া!’ যেন তন্ময়কে হুশে আনতে চাইছে। রীতিমতো ভয়ে সর্বশক্তি দিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নিল। তোলপাড় শুরু হয়েছে ভেতরে৷ অনুভূতির সাগরে ভেসে সে মরে যাবে। নাহলে জ্ঞান হারাবে। তন্ময় কী মদ খেয়ে ভুলভাল বকছে? নাকি তন্ময় একই অনুভব করে তার মতো? অরুর হৃদয় ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। এইযে তন্ময় শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে। অরু সেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতটা লজ্জা সে তার সারাজীবনে অনুভব করেনি। এভাবে সর্বঙ্গ জুড়ে কম্পন সৃষ্টি হয়নি। হুট করে তন্ময়ের মুখ তার মুখ বরাবর চলে এলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে কানের কাছে মুখ নিল। নিশ্বাস ছেড়ে গভীর স্বরে আবদার করল, ‘ শুধু তন্ময় ডাক। ‘

কথাটা বলে তন্ময় আশাহত চোখে অরুর দিক তাকিয়ে। লজ্জায় অরু ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে।
চোখ পিটপিট করছে। মুখের উপর নাম ডাকতে তার গলায় বিঁধছে। উচ্চারণ করার চেষ্টা করল কয়েকবার। হচ্ছে না! হূট করে তন্ময়ের চোখে চোখ পড়ল। ঘোর লেগে গেল অরুর। হেপনোটাইজের মতো তাকিয়ে রইলো। অস্পষ্ট স্বরে ডাকল ‘ তন্ময়! ‘

মুহুর্তেই তন্ময়ের সরু পাতলা ঠোঁট জোড়া তার ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়! শুধু ছোঁয়াতে থেমে থাকেনা। নিজের পেশিবহুল হাতের সাহায্যে আঁকড়ে ধরে অরুর কোমর। নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে চলে। শ্বাস-প্রশ্বাস এক হয়েছে। ঘনিষ্ঠ হয়েছে স্পর্শ। কাঁপতে থাকা অরুর কপাল কুঁচকে আছে। অদ্ভুত টেস্ট! সিগারেট, মদ সব তার মুখে। নাক কুঁচকে আসছে। হঠাৎ সেভাবেই তন্ময় ঢুলে পড়ে তার শরীরের উপর! মাথা তার কাঁধে গিয়ে পড়েছে। বিড়বিড় করে কিছু কথা বলল তন্ময়। অরু কান খাড়া করে যতটুকু পেরেছে শুনেছে। এবং তাতেই তার বুকের উঠানামা বেড়ে গেল। শক্ত হয়ে গেল শরীর। কথাগুলো প্রতিধ্বনি হচ্ছে বারংবার। কানের কাছে বেজে চলেছে। অরুর পা’জোড়া দুর্বল হয়ে গেল। সে পড়ে যেতে নিয়ে দেয়ালে ধরে নিজেকে সামলাল। কয়েকটি নিশ্বাস ফেলে তন্ময়ের দিক তাকানোর চেষ্টা করল। সে মনে করেছিল, ক্লান্ত ভঙ্গিতে চোখবুঁজে রয়েছে তন্ময়। কিন্তু এখন কয়েকবার ডেকে সে বুঝতে পারলো, নেশায় সেন্সল্যাস হয়ে গিয়েছে৷ তন্ময়কে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল। জুতো জোড়া খুলে দিল। মোজা খুলে জুতোয় ঢুকিয়ে সাইড করে রাখল। বিন্দুবিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। অরু পরনের ওড়না দিয়ে মুছিয়ে দিলো কপালের ঘাম টুকু। নিজ মনে বলল, ‘ সত্যি কী তাই? ‘
___________
মাজার থেকে শাবিহা দুটো পঁয়তল্লিশে ফিরেছে। রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় চিৎপটাং হয়ে পড়ল। সেলফোন হাতে নিল। অয়নের অনেকগুলো কল, মেসেজেস। একটি ভিডিও কল এসেছে। অয়নের সাথে তার কখনো ভিডিও কল হয়নি। আসলে সে খুব লজ্জা পায় ভিডিও কলে কথা বলতে। সরাসরি নিজের মুখশ্রী দেখে কথা বলাটা, লজ্জাজনক প্রায়। কিন্তু আজ শাবিহার অয়নকে এখনই দেখতে ইচ্ছে করছে। শাবিহা ভিডিও কল ব্যাক করল। কল রিসিভ হয়েছে। স্ক্রিনে অয়ন শুয়ে আছে সাদা বেডসিডে। উপরের অংশ উলঙ্গ! চোখে রাজ্যের ঘুম। উষ্কখুষ্ক অবস্থা। শাবিহার বুক কেঁপে উঠল। ইচ্ছে করছে আগ বাড়িয়ে চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে। কপাল থেকে সরিয়ে গুঁছিয়ে দিতে। অয়ন ঘুমন্ত স্বরে বলল, ‘ কোথায় ছিলে? ‘

শাবিহার বুক আরেকবার ধুক করে উঠল। সময় নিয়ে বলল, ‘ মাজারে। ‘
‘ খেয়েছ? ‘
‘ হু। ‘
‘ ঘুমাবে না? ‘
‘ না। ‘
‘ আমার ঘুম ধরছে।’
‘ঘুমাও।’
‘আমাকে দেখেন,আমি ঘুমাই।’
শাবিহা অস্পষ্ট স্বরে, ‘হু’ বলল।

অয়ন সত্যি সত্যি সেভাবে ঘুমিয়ে পড়েছে। শাবিহা কল কাটল না। একমনে দেখে গেল ঘুমন্ত অয়নকে। নিষ্পাপ, পবিত্র দেখাচ্ছে। শাবিহা নিজেও জড়সড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। স্ক্রিন চোখের সামনে রেখে অয়নকে দেখতে বসল খুটিয়ে খুটিয়ে। মনের গহীন থেকে বিড়বিড় করে বলল, ‘ আমরা এক হবো ত অয়ন? ‘

চলবে~
‘Nabila Ishq ‘
_____________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here