প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল।
২৮.
সাতটা বাজতে বারো মিনিট বাকি। অরু তন্ময়কে কল করেছে। কল ধরেছে তন্ময়ের ম্যানেজার সুমন। কন্ঠে মাধুর্য নিয়ে বলেছে,’স্যার মিটিংয়ে আছেন।’
অরু বিরক্ত হলো বটে। মিটিং ফিটিং যত্তসব! মিনমিন করে বলল,’রাখি তাহলে।’
কল রেখে অধৈর্য চোখে তাকিয়ে থাকা মারজিকে চোখ রাঙাল। মারজি কান পেতে বসে। যেন অরু- তন্ময় রোমান্টিক আলাপ-আলোচনা করবে আর তা সে কান পেতে শুনবে। মেয়েটা কি জানেনা ওটা যেকেউ নয়, তন্ময় শাহজাহান! যার মুখে রসকষ নেই। অরু যদি কিছু সুইট টক করে সেটাও হজম হবেনা লোকটার দ্বারা। একটা ধমক দিয়ে কল কেটে দিতো!
মারজি বিরক্ত সুরে বলল,’ভাই কই?’
‘জানি না।’
‘কল কে ধরলো?’
‘আমার নানা।’
‘তোকে নিতে আসবে কখন?’
অরু উদাসীন ভঙ্গিতে বলল,’কি জানি।’
‘কিছুক্ষন পর আবার কল দিবি। এভাবে বসে থাকলে হবে? পটানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে তো! তন্ময় ভাইয়ের পেছনে হাত ধুয়ে ছ্যাচড়া মেয়েরা পড়ে। এমন পুরুষকে পটাতে তোর কোমরে ওড়না বেঁধে নামতে হবে, বুঝলি?’
‘না।’
‘আর এভাবেও তিনি তোর ভাইয়া। ভাইয়াদের ছাইয়া করতে গেলে, একটুখানি কষ্ট হজম করে নিতে হয়।’
‘কীসব বলিস তুই!’
মারজি দুষ্টু হেসে বলল,’লজ্জা পাচ্ছিস?’
‘তোর মাথা।’
মারজি মুখ ভেঙিয়ে উঠে চলে গেল। অরু ফোনের দিক তাকিয়ে রইলো। তন্ময়ের কল ব্যাক এসেছে মিনিট পাঁচেক পর।অরু রিসিভ করে বলল,’আকাশ ভাইয়াকে বলেন আমাকে নিয়ে যেতে!’
‘তুই কল দিয়ে বল গিয়ে!’
ধমক মেরে তন্ময় কল কেটে দিলো। রেগে গিয়েছে নিশ্চয়ই! এটা না বললে কি চলত না? এই মুখ একহাত আগে চলে। অরু নিজের গালে একটা চড় মারল৷ বিরক্ত হয়ে ওভাবে কেন বলতে গেলো? এখন তো রেগে তন্ময় নিতে আসবেই না। মুখশ্রী অন্ধকার করে বসে রইলো। ধীরেসুস্থে নিজেকে গুঁছিয়ে নিয়েছে। কি আর করার, একাই যেতে হবে। অবশ্য এখান থেকে এখানেই।
মারজিকে বিদায় জানিয়ে অরু বেরিয়ে পড়লো। কিছুটা যেতেই তন্ময়ের গাড়ি দেখল। মাথায় দাঁড়িয়ে! হু, এসেছে তাহলে। মুখ ভেঙিয়ে অরু হেঁটে চলেছে। বাম-ডান কোথাও নজর দিচ্ছে না। গাড়ির সামনে দিয়ে যেতেই, তন্ময় ডাকল। অরু সাড়াশব্দ করলো না। আজ সে গাড়িতে উঠবে না। একদমই উঠবে না। ওভাবে কেন ধমকেছে! পুনরায় তন্ময় ধমকানো সুরে কয়েকবার ডেকেছে। ফায়দা হয়নি।
অরু হাঁটছে তার পেছনে ধীরে তন্ময়ের গাড়ি চলছে। এখন আর তন্ময় ডাকছে না। অরু আঁড়চোখে কয়েকবার তাকিয়েছে পেছনে। ডাকছেও না নির্দয় লোক একটা! এতখানি রাস্তা অরু হেঁটেই এলো। বাড়ির সামনে পৌঁছে হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
সুমিতা বেগম তখন সোফায় বসে, নাটক দেখছিলেন। এসময় তার পছন্দের সিরিয়াল চলে। এটা একদম মিস করেন না। তার সঙ্গে সিরিয়াল খানা মুফতি বেগম ও দেখেন। ব্যস্ত দুজনের সামনে দিয়ে অরু চলে যাচ্ছে। অরুকে দেখতেই সুমিতা বেগম বললেন, ‘কিছু খাবি?’
‘না।’
নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে রাখল অরু। কিছুক্ষণ পর পাশের রুমের দরজা খোলার শব্দ এলো। তন্ময় এসেছে। আসুক নাহলে নদীতে ভাসুক!
রাতে অরু তাদের কাজিন মেসেঞ্জার গ্রুপে ঢুকেছে। অলরেডি অয়ন এবং ইব্রাহিম চ্যাট করছে। তাদের আলাপ-আলোচনার মধ্যে অরু কয়েকবার বা’হাত ঢুকিয়েছে। উল্টাপাল্টা বকবক করে শান্তশিষ্ট পরিবেশ নষ্ট করে ফেলেছে। ইব্রাহিম তন্ময়কে মেনশন মেরে বলল, ‘তোর আপদ নিয়ে যা।’
অরু রেগে গ্রুপ থেকে চলে এলো।সকলের কাছে সে বিরক্তিকর বুঝি? মনে অশান্তি নিয়ে শুয়ে পড়লো। নরম তুলতুলে বালিশে মুখ গুঁজে ভাবনায় বিভোর। দুনিয়ার সবকিছু চিন্তাভাবনা করে, তন্ময়কে নিয়ে ভাবতে বসলো। মগজে তন্ময় আসতেই,
একটি ঘটনা মনে পড়লো তার। ঘটনা বেশ পুরনো।
অরু তখন ক্লাস এইট সবে। তার দুরন্তপনায় শাহজাহান বাড়ি হাস্যজ্বল। সে আর দীপ্ত বাড়ির আনাচকানাচে খেলে বেড়াতো। তন্ময় তখন পড়াশোনা করছে। গম্ভীর্য ভাব নেই। শান্ত প্রকৃতির। একদিন কানাঘুঁষা করে প্রসঙ্গ উঠলো, তন্ময় প্রেম করে। তার গার্লফ্রেন্ড আছে। সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড। গার্লফ্রেন্ডের বাবা খাদ্যমন্ত্রী কামরুল। ব্যস, ঝরের বেগে সকলের কানে চলে এলো বিষয়টি। এমনকি অরুর কানেও। বন্ধুবান্ধবদের বাহাবাহা শুনছে,
‘তন্ময় ভাইয়ের জন্য ওইটা পারফেক্ট মেয়ে। এমন হাইয়ার ক্লাস মেয়েই, তন্ময় ভাইয়ের পাশে থাকার যোগ্য। দুজনকে পারফেক্ট মানাবে৷’
বন্ধুবান্ধবদের কথাবার্তা শুনে অরুও উদ্ধিগ্ন হয়ে উঠলো। উত্তেজিত কন্ঠে, রাতে ড্রয়িংরুমে সকলের সামনে বলে ফেললো, ‘খাদ্যমন্ত্রীর সাথেই তন্ময় ভাইয়ের বিয়ে দাও চাচ্চু। আমি ভাবি চাই।’
মোস্তফা সাহেব কেশে উঠলেন। তাদের একেকজনের কাশাকাশির মানে বুঝতে পারলো না অরু। সে চারপাশে তাকিয়ে তন্ময়কে দেখতে পেল।শান্তশিষ্ট তন্ময় রেগেমেগে অস্থির তখন। অরু উত্তেজনায় তন্ময়ের রাগ উপলব্ধি করতে পারল না। আপাতত সে বিবেকহীন মানুষে রুপান্তরিত হয়েছে। তন্ময়ের হাত ধরে বলল,’ভাইয়া খাদ্যমন্ত্রীকেই ভাবি হিসেবে… ‘
সম্পুর্ন বাক্য শেষ হওয়ার পূর্বেই অরুর গালে শক্ত একটা চড় পড়ল। এতটাই জোরে পড়েছে যে সে নড়ে গেল৷ মেরে তন্ময় না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। মাইর খেয়ে অরু বিষম খেয়েছে যেন। এর আগে তন্ময় তাকে কক্ষনো মারেনি। আদরে বাদর বানানো তার তন্ময় ভাইয়া, তাকে মারল? অরু কান্নাকাটি করে অস্থির। তাকে কেউ শান্ত করতে পারছেনা। এমনকি মোস্তফা সাহেবও নন।আনোয়ার সাহেব মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। নরম সুরে বললেন,’আম্মা খাদ্যমন্ত্রী তো পুরুষ। ভাবি কেম্নে করবে তারে।’
আনোয়ার সাহেবের কথা শোনার মতো মনমানসিকতা অরুর নেই। খাদ্যমন্ত্রী তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। এখন শুধু তন্ময়ের চড়ের কথা মনে আছে৷ চড় খেয়ে অরুর রাতে একশো এক ডিগ্রি জ্বর এসে পড়লো। জ্বর কাবু করে ফেলেছে তাকে। মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার ডাকা হয়েছে। অরুকে দেখেশুনে ঔষধ দিয়ে গিয়েছেন। জ্বরে আক্রান্ত অরুকে বেশ রাত করে তন্ময় দেখতে এসেছে। অরু তখন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। তন্ময়কে দেখে দূরে সরে গেল। এক থাপ্পড় খেয়ে এতটাই ভয় পেয়েছে যে তন্ময়কে কাছে আসতে দেখেই একশো হাত দূরে চলে যাচ্ছে।
অস্থির তন্ময় অরুকে ঘন্টাখানেক লাগিয়ে মানিয়েছে, বুঝিয়েছে। অরুর কান্নাকাটি থামাতে সে আদর স্বরুপ কপালে চুমুও খেয়েছে। অরুর কান্নাকাটি থেমেছে। চড়ের কথা ভুলে আবারো একটি চড় খাওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,’বলেন তাহলে আপনি খাদ্যমন্ত্রীকে বিয়ে করবেন?’
তন্ময়ের নাক ফুসছে। সে নিজেকে সামলে রাগী স্বরে বলেছিল, ‘তুই খাদ্যমন্ত্রী কামরুল। আর আমি তোকে বিয়ে করব। ঠিকাছে?’
তখন বিষয়টি বুঝতে পারেনি অরু। শুধু তন্ময়ের রাগী স্বর বুঝেছে এবং কেঁদেছে। তবে এখন,
বালিশে মাথা গুঁজে থাকা অরু শব্দ করে হাসছে। এসব মনে করলে যেমন হাসি পায়, তেমনি সে লজ্জায় হতভম্ব হয়ে পড়ে। অরু আন্দাজ করলো, সে ছোট থেকেই তন্ময়কে জ্বালিয়ে আসছে। এক মিনিট শান্তি দেয়নি লোকটাকে। এতগুলো বছর তাকে সামলানো কম কথা নয়! অরুর আজ সত্যিই তন্ময়ের উপর মায়া হচ্ছে।
________
মায়া টুকু বেশিক্ষণ রইলো না। বৃহস্পতিবার সকাল সকাল অরু সেজেগুজে তৈরি হয়েছে। আজ সে টকটকে লাল কামিজ পরেছে। লাল কামিজের সঙ্গে মিলিয়ে লাল নাগরাজ জুতো পরেছে। লাল চুড়ি দু’হাতে পরেছে। নুপুর ও লাল রঙের পরেছে। তার এই মাথা থেকে পা অবদি লাল সাজার কারণ তন্ময়। তন্ময়ের লাল রঙ একদম পছন্দ নয়। লাল রঙ দেখলেই তন্ময়ের ভুরু দুটোর মাঝখানে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে। আজ সেই ভাজকে তাজ করতে অরুর এই সাজ।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকা অরুকে দেখে, খাবার টেবিলে বসে থাকা সকলেই আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো। সাতসকাল বেলা এমন সেজেগুজে খেতে আসার কারণ কি আদৌও আছে?
আশ্চর্যজনক ভাবে সেসময় তন্ময় গ্লাসে মুখ দিয়েছে। কিছুটা পানি কেবলই মুখে নিয়েছিল। অরুকে দেখে, গলায় পানি নিয়েই কেশে উঠেছে। কাশতে কাশতে কপালের মধ্যস্থান কুঁচকে গিয়েছে।পাশে বসা আকাশ পিঠ থাপড়ে বলল,’ঠিকাছস?’
‘হু।’
অরু হাসিমুখে আনোয়ার সাহেবের পাশে এসে বসেছে। সুমিতা বেগম মাথা দু’পাশে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে নাড়ালেন। মেয়েটার করা কার্যকলাপ আজকাল তার সুবিধের মনে হয়না। কি হয়েছে কে জানে! কীসব উদ্ভট আচরণ করে চলেছে। একদন্ড শান্তিতে থাকেনা। এই মেয়েটার মধ্যে শান্তি বলতে কিচ্ছু নেই।
আজ ব্রেকফাস্ট প্লেটে দিতে কলি সাহায্য করছে৷ জবেদা বেগম না করেছেন। কিন্তু কলি শুনল না। তন্ময়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কেবলই। খাবার প্লেটে উঠিয়ে দিবে৷ তন্ময় হাত দেখিয়ে বলল,’আমি পরোটা নিব না।’
জবেদা বেগম বললেন,’দিস না ওরে। ও সকালে পরোটা খায়না।’
‘তাহলে কি খাবে?’
‘ব্রেড। তুই বোস। যে যার খাবার নিয়ে নিবে।’
‘আমি সাহায্য করি?’
তন্ময়কে মারাত্মক বিরক্ত দেখাল। জবেদা বেগম দ্রুত কলির হাত ধরে সরিয়ে নিলেন। নাহলে দেখা যাবে চেঁচিয়ে উঠেছে। কলি অবুঝের মতো চেয়ারে বসে রইলো। কি হলো? সে উত্তরের আশায় জবেদা বেগমের দিক তাকালেন। জবেদা বেগম বললেন,’খেয়ে উঠ।’
অরু মুখ ভেঙিয়ে খেয়ে চলেছে। চোখ উঠিয়ে তাকাচ্ছে না। চোখ উঠিয়ে তাকাবে কেন? এগুলো দেখতে তার একদম ভালো লাগে না। মেয়েটাকে দেখলেই তার বিরক্ত লাগে। সে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষ। তবে দিন বা দিন তার মন বিষাক্ত হয়ে উঠছে। এই কলি নামের মেয়েকে সে একইভাবে অপছন্দ করে যেমনটা সে সুমনাকে করে। এখন থেকে অরু সেসব মেয়েদের অপছন্দ করবে যারা তন্ময়ের উপর কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে তন্ময় রোজকার মতো সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়েনি। দাঁড়িয়ে রইলো। অরু তার সামনে দিয়ে ঘুরছে ফিরছে। গুনগুন করে গান গাইছে। মোস্তফা সাহেব যেতে নিয়ে ছেলের দিক তাকালেন,’আসবে না?’
‘কি? ওহ্, হ্যাঁ।’
বিকেল দিকে অরু ছাঁদে উঠে এসেছে। তার সঙ্গে দীপ্ত। পরিক্ষা শেষ করে তারা আজাদ পাখি হয়ে গিয়েছে। ঘুরছে-ফিরছে! পড়াশোনার কোনো চিন্তা নেই। দীপ্ত বলল,’আমাদের এসময় ঘুরাফেরা দরকার না?’
‘হু।কোথায় যাওয়া যায়?’
‘শহরের বাইরে? আমার ঘুরতে ইচ্ছে করছে।’
‘তো বল গিয়ে চাচ্চুকে।’
‘আমাকে বাবা বকবে।তুমি বলো না।’
‘আমাকে কি চুমু দিবে?’
‘হু। তুমি তন্ময় ভাইকে বলবে প্লিজ?’
‘অ্যাহ!মানুষ খুঁজে পাস না?’
‘ভাইয়াকে বলেই দেখ তো।’
‘পারবো না। আমি আকাশ ভাইয়াকে বলব।’
‘এটাও করতে পারো। ভাইয়া রাজি হবে মনে হয়।’
দীপ্ত এবং অরু স্বপ্নের ঘোরে, সময় নিয়ে ক্যাচাল করছে। মুফতি বেগমের ডাকে দীপ্তকে চলে যেতে হলো। অরু একাই দাঁড়িয়ে রইলো। ধীরেসুস্থে সূর্য ডুবে গিয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মাগরিবের আজান দিয়েছে। এক মনে নিচে তাকিয়ে অরু। চোখের সামনে দিয়ে একটি রিকশা গিয়েছে মাত্র। রিকশায় একজোড়া কপোত-কপোতী দেখেছে। কি সুন্দর জড়িয়ে বসে দুজন। কানেকানে আলাপ করছে। শব্দ করে হাসছে হয়তো। খুব মধুর দেখালো ব্যাপারটা।
ঠান্ডা শরীর এবং মন নিয়ে অরুর ও ইচ্ছে করছে এভাবে, রিকশায় ঘুরতে। তন্ময়ের সাথে! তন্ময়ের কথা মগজে আসতেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো। আদৌও কখনো কি তন্ময়কে শিকার করাতে পারবে সেদিন রাতের কথাগুলো স্ব-জ্ঞানে? প্রথম প্রথম অরুর নিজের উপর বিশ্বাস ছিল। সে পারবে যেভাবেই হোক! তবে এখন তার কনফিডেন্সে আঁধার ছেয়ে গিয়েছে। তন্ময়ের ধৈর্য্য কোনো মানুষের কাতারে পড়ে না। লোকটার আকাশ সমান ধৈর্য্য। এতো ধৈর্য কোথা থেকে পেয়েছে? অরু এতটা বিরক্ত করে, তবুও রাগ বা জেদের বসে কিছু বলেনা। চুপচাপ শুনে যায়, দেখে যায়। ঠিক কিসের অপেক্ষা করছে? অরুর বিয়ের?
হঠাৎ শব্দ শুনলো পেছন থেকে। ফিরে তাকাল। কলি এসেছে! অরু পুনরায় সামনে ফিরে তাকাল। কলি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার নজর অরুতে সীমাবদ্ধ। অরু হেসে উদাসীন ভঙ্গিতে শুধালো, ‘কিছু বলবে আপু?’
‘অনেক কিছু।’
‘আচ্ছা।’
অরু মনোযোগ দেবার ভঙ্গিতে তাকাল। যেন শুনবে কলির কি বলার আছে। কলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। ভেবেচিন্তে বলল,’তুমি আমার তিন বছরের ছোটো। তোমার বয়স আমি পেরিয়ে এসেছি অরু। তাই তোমাকে বুঝতে আমার কাঠখড় পোহাতে হয়না।’
অরুর হাসির রেখা বড়ো হলো, ‘তাই? কি বুঝলেন আমাকে দেখেশুনে।’
‘এইযে তুমি তন্ময় ভাইয়ের পেছনে পড়ে আছ! আমি বুঝতে পারছি এটা তোমার বয়সের দোষ। এই বয়সে এমন করা স্বাভাবিক। তবে সবাইকে তো আর পছন্দ করা যায়না, তাই না? সে তোমার বড়ো তারউপর ভাইয়া হয়। এমন করতে বিবেকে বাঁধেনা?’
‘না। বাঁধেনা।’
অরুর স্পষ্ট জবাবে কলি থমকে গেল। মুহুর্তেই তার ভদ্রতা বজায় রাখা, ঠোঁটের হাসি টুকু বিলুপ্ত হয়ে গেল। কলির মুখশ্রী দেখে অরুর শব্দ করে হাসতে ইচ্ছে করলো। মনে মনে তন্ময়কে ইচ্ছেমতো বকলো। এতসব মাছি জড়ো করেছে নিজের আশেপাশে যে সেগুলো এখন তাকেও রেহাই দেয়না। অসহ্য!
কলি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,’তুমি সেদিন আমার মায়ের থেকে শুনেছ তো, আমার আর তন্ময় ভাইয়ের বিয়ের বিষয়টা? তারপরও কিভাবে এমন করতে পারছ?’
‘আমাদের বাড়ির কেউ এখনো রাজি হয়নি। যেদিন আমাদের বাড়ির মানুষ এবিষয়ে বলবে, আমি মেনে নিব। তার আগে নয়!’
‘খুব পারসোনাল ভাবে আছে বিষয়টা। খুব শীগ্রই শুনতে পাবে।’
‘আমি অপেক্ষায়।’
কলি ভুরু জোড়া কুঁচকে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। অরু দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ হাসিমুখে থাকলেও কলি চলে যেতেই তার চোখমুখে আঁধার নেমে এলো। বিষন্ন মনে দোলনায় বসে পড়লো। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা যেন শরীরে লাগছে না। কয়েকবার হাঁচি দিলো। শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল তবুও নড়চড় নেই তার।
______________
অয়ন মোরের দোকানে বসে। চা খাচ্ছে এবং কথাবার্তা বলছে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। শাবিহার রিকশা মোরের কাছাকাছি প্রায়। এখান থেকেই সে অয়নকে দেখতে পারছে। হাফপ্যান্ট, টিশার্ট পরে দাঁড়িয়ে। ছেলেদের হাফপ্যান্টে খুব মানায়। এক আলাদা সৌন্দর্য ফোটে উঠে। ভীষণ পুরুষালি দেখায়। অয়নকেও লাগছে। হাত নাড়িয়ে কিছু একটা নিয়ে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলছে ছেলেটা। চায়ের কাপ হাতে নেবার ভঙ্গিটা মারাত্মক। শাবিহা তাকিয়ে রইলো ধ্যান মেরে। কথার ফাঁকে অয়ন তাকিয়ে নজর ফিরিয়ে আবারো তাকাল। চোখাচোখি হয়ে গেল। শাবিহা দ্রুত নজর ঘুরিয়ে নিলো। অয়ন চায়ের কাপ রেখে এগিয়ে আসলো। খুব সাবলীল ভঙ্গিতে পেছন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলো। রিকশা ভাড়া দিয়ে দিলো। শাবিহা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে।
অয়ন একটি সাধারণ জিনিস করেছে। সেটা হলো, শাবিহার রিকশা ভাড়া দিয়েছে। এই সাধারণ বিষয়টি এতটা অসাধারণ কেন লাগছে শাবিহার চোখে? এতটাই অসাধারণ লেগেছে যে তার বুক দুরুদুরু কাঁপছে। রিকশা সামনে থেকে যেতেই অয়ন হেসে বলল, ‘আমি মাত্রই ফিরেছি।’
‘হু।’
মানিব্যাগ পকেটে ভরে অয়ন অন্য পকেটে কিছু একটা খুঁজছে। সেটা পেয়ে শাবিহার দিক এগিয়ে দিলো, ‘তোমার জন্য!’
‘কি?’
‘হাত বাড়াও দেখতে চাইলে।’
শাবিহা চারপাশে তাকিয়ে হাত বাড়ালো। অয়ন একটি লোকেট ছাড়ল। সাদা রঙের খুব সুন্দর একটি লোকেট। জ্বলজ্বল করছে। মধ্যের লাভ শ্যাপ খুলতেই, অয়নের একটা ছোট ছবি দেখল। খুব ছোট ছবি। অয়ন হেসে তাকিয়ে। সে ভার্সিটির কোড ড্রেস পরে আছে। অয়ন বলল,’পছন্দ হয়েছে? আমাকে মনে পড়লেই দেখে নেবে এটা। আর আমি সেইম এমন একটা আমার জন্য চাই তোমার থেকে। আমার সামনের জন্মদিনে। দিবে তো?’
শাবিহা হেসে তাকিয়ে রইলো। জবাব দিলো না। ছেলেটা আসলেই পাগল! প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল।
২৯.
ডিসেম্বরের শুরু। এসময় হাড়কাঁপানো শীত নেমে থাকে। ছাঁদে পা ফেলা দায় হয়ে যায়। প্রকৃতি’তে কুয়াশায় ধকধকানো ধোঁয়া উড়ে বেড়ায়। বাইরে নজর বুলিয়ে এক মিটার দূরের জিনিস দেখতে পাওয়াও কষ্টসাধ্যের বিষয়। সেখানে ছাঁদে বসে থাকার কথা চিন্তা করাটাও মর্মান্তিক প্রায়। অথচ অরু দিব্বি ছাঁদের দোলনায় মাথা ঠেকিয়ে বসে। একমনে চেয়ে আছে দূর আসমানে। আঁধার রাতে চাঁদের চারিপাশের নক্ষত্রগুলো জ্বলজ্বল করছে। দেখাচ্ছে, এক সৌন্দর্যের প্রতীক’কে পাহারা দেওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে, পাহারাদার গুলো নক্ষত্র আর সৌন্দর্যের প্রতীক চাঁদ। এক অপরুপ চিত্র এ’যেন। দূর আসমানের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে অগ্রাহ্য করলো বুকের চিনচিন ব্যথা। দমকা হাওয়া এসে উড়িয়ে এলোমেলো করে দিয়েছে নিকষকালো চুলগুলো। সঙ্গে শরীরের পশম গুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে অনায়েসে। ওড়নার শেষের অংশটুকু স্বাধীনভাবে উড়ছে।
ঠান্ডা হয়ে এসেছে অরুর শরীর। শীতল অনুভব করছে ভেতর বাহির সবখানে। তবে দোলনা থেকে উঠতে পারছেনা। পায়ের ধাপ ফেলে নিচে যে নামবে, তার শক্তি অবশিষ্ট নেই। শীতল তৃষ্ণায় ক্লান্তিতে ধুঁকছে শরীর। কোনো একটি বিষয় মনে দাগ কেটে দিলে, সেটি অগ্রাহ্য করা বেশ কষ্টকর বিষয় হয়ে দাঁড়ায় অরুর জন্য। কিছুতেই পারেনা ভুলতে। এটা একটা বাজে স্বভাব বলা যায়। তিলেতিলে শেষ করে দেয় তার হৃদয়। খুব ক্ষীণ মনের অধিকারী সে। একটু কটূক্তি তাকে বিষন্ন করে তুলতে পারে। তছনছ করে দিতে পারে তার হাস্যজ্বল পৃথিবী।
নিঃস্তব্ধতার মধ্যে দূর হতে ঘনঘন পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। অরু মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারছে। শুনেও ঘুরে তাকাল না। দৃষ্টি তখনো আসমানে নিবদ্ধকৃত। পায়ের শব্দ এসে থেমেছে খুব নিকটে। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়েছে। তবুও আর কোনো প্রতিক্রিয়া শুনতে পারছেনা। না শুনতে পারছে কোনো সাড়াশব্দ বা ডাক। কৌতুহল বসত অরু অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে ঘুরে তাকাল। তন্ময় দাঁড়িয়ে! আঁধার রাতের চাঁদের আলোয় তার বিরক্তিকর মুখশ্রী দৃশ্যমান। ভুরু দু’য়ের মাঝে সূক্ষ্ম ভাজ। অরু পুনরায় মাথা ঘুরিয়ে বসে রইলো। আঁড়চোখে আরও দুবার তাকাল। একইভাবে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। এভাবে তাকিয়ে আছে কেন!খেয়ে ফেলবে নাকি! মিনমিন কন্ঠ অরুর, ‘কি সমস্যা!’
তন্ময়ের জবাব এলো না। তবে এবার সে অরুর সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। পেশিবহুল হাতের সাহায্যে একটানে দোলনা থেকে উঠিয়েছে অরুকে। অপ্রস্তুত অরু থুবড়ে পড়েছে তন্ময়ের বুকে। চিরচেনা সেই সুগন্ধি ঘ্রাণ ভেসে এসেছে নাকে। তন্ময়ের স্বাস্থ্যসম্মত শরীর গরম। উষ্ণ অনুভব করছে। সেই উষ্ণ অনুভবের নেশায় স্বেচ্ছায় পড়ে রইলো তন্ময়ের বাহুতে। উদ্বিগ্নতার সহিত মিশে গেল পুরোপুরি। ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজেই দুরু কেঁপে উঠলো। শিহরণ বয়ে গেল সম্পুর্ন শরীর জুড়ে। উপলব্ধি করতে পেল তন্ময়ের উঠানামা করা বুকের গতি। ধকধকানো শব্দ ও যেন শুনতে পারছে ভেতর হতে।
দমকা বেসামাল হাওয়া শরীর ছুঁয়ে দিতেই, থরথর করে কেঁপে উঠছে তার শরীর।
তন্ময়ের ভুরু জোড়া এবার মাত্রাতিরিক্ত কুঁচকে গিয়েছে। তার পাতলা ঠোঁট জোড়া কাঁপছে ধমক দেবার জন্য। গলায় ধমক আটকে রেখে, সাবলীল ভঙ্গিতে শরীর থেকে নিজের জ্যাকেট খুলে ফেললো। পরপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে অরুর গায়ে পরিয়ে দিলো৷ জ্যাকেটে লেপ্টে থেকেও অরুর কাঁপুনি কমছে না। তন্ময় টেনে নিতে চাইলে, অরু যাচ্ছে না। ঠায় দাঁড়িয়ে একইভাবে। তন্ময় থেকে ঘুরে দাঁড়াল। অভিমানে তার কন্ঠে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, ‘আমি যাবো না।’
‘কেন!’
‘আপনার কি!আপনাকে তো ধরে রাখিনি। যান!’
‘মাইর খেতে ইচ্ছে করছে?’
‘না! আপনি ভাগেন।’
‘অরু!’
অরু ঘুরে তাকাল। তার চোখজোড়া লাল হয়ে গিয়েছে। হিসফিস করছে মুখশ্রী। তন্ময়ের রাগী চেহারায় মুহুর্তে পরিবর্তন দেখাল। অদৃশ্যমান ভাবে নরম হয়ে এলো। এগিয়ে যেতে নিয়ে, মোলায়েম সুরে জিজ্ঞেস করলো,’কি হয়েছে?’
‘আপনি.. ‘
‘হু আমি?’
অরু এতো চেষ্টা করেও বাক্যটি মুখ দিয়ে বের করতে পারছেনা। পুনরায় মুখ খুলল। পারছেনা! তন্ময়কে খুব ধৈর্যবান দেখাল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।অরু অস্পষ্ট স্বরে শুধালো,’আপনি কি.. ওই কলি আপুকে পছন্দ করেন?’
তন্ময় তাজ্জব বনে গেল যেন। বিরক্তির রেশ ধরে বলল, ‘তোর কি মনে হয়?’
‘আপনি বলেন!’
‘তুই এসব অদ্ভুত চিন্তাভাবনা মাথায় আনিস কিভাবে?’
‘আমি এনেছি? ওই কলি আপু বলেছে সামনেই আপনাদের দুজনের বিয়ে! তার মা… মানে আপনার মামী ও বলেছে একই কথা। সিলেট থাকতেই! আপনি সবকিছুর দোষ শুধু আমাকে দেন! কেন! আপনি একটা বিয়ে করেন নাহলে দশটা। আমার কি!’
কোনো জবাব এলো না। না শোনা গেল পায়ের শব্দ। অভিমানী অরু আঁড়চোখে চোখ তুলে তাকালো। তন্ময় কপালে সূক্ষ্ণ ভাজ নিয়ে তাকিয়ে আছে। দৃঢ় তার চাহনি। রাগের মাথায় বকবক করেছে এতক্ষণ। হুশে ফিরে ছোট ঢোক গিলল অরু। গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে। ঠোঁট জোড়া জিব
দ্বারা ভিজিয়ে নিল। দ্রুত পায়ে সামনে অগ্রসর হলো। এখন সে কেটে পড়বে! তন্ময়ের মুখমণ্ডল দেখে সে বুঝে গিয়েছে, এ’বিষয়ে তার মাসুম তন্ময় ভাই কিছুই জানে না। না জানুক, তবুও দোষ এই মাসুম তন্ময়ের।
তন্ময়কে রেখে অরু যেতে পা বাড়ালো। পাশ কেটে যেতে নিলে তন্ময় হাত চেপে ধরে। টেনে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে বলে, ‘তুই কি সিলেট থেকে রাতারাতি এই কথা শুনে চলে এসেছিলি?’
অরু থমকাল। পিটপিট করছে আঁখিদুটি। কোন কথা কোথায় নিয়ে গিয়েছে। তন্ময়ের বিজনেস ম্যান না হয়ে, অ্যাডভোকেট হওয়া উচিৎ ছিল। অরু মিনমিন সুরে বলল,’ছাড়ুন।’
তন্ময় তার হাত পিঠের পেছনে পেঁচিয়ে ধরেছে,’উত্তর দিতে বলেছি!’
ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়েছে অরু। ধমক শুনে কেঁপে উঠেছে খানিক। নাক ফুসছে তার। কম্পিত গলায় বলল,’চড় মারবেন আমাকে?এবার আমি সত্যি সত্যি চাচ্চুকে বিচার দিব আপনার নামে!’
পরপর ঘাড়ে স্পর্শ অনুভব করলো। লম্বা চুলে টান খেল। তন্ময় বা’হাতে পেঁচিয়ে নিয়েছে চুলগুলো,’জবাব দে।’
ভয়ে রীতিমতো জড়সড় হয়ে গিয়েছে অরু। তন্ময়ের ওই দানবীয় হাতের চড় ভীষণ রকমের ব্যথিত এবং লজ্জাজনক। পরমুহূর্তেই আবারো চুলে টান খেল। ব্যথায় আর্তনাদ করলো,’ব্যথা পাই।’
‘উত্তর দে।’
‘আপনার কি আমার উপর একটু মায়া হয়না।’
‘অরু! রাগাস না আমাকে! ‘
কথা ঘোরাতে না পেরে, চুপসে গেল অরু। ভয়ে বুক দুরুদুরু কাঁপছে। তন্ময় এতটা ভয়ংকর হবে জানলে সে, কখনোই এই বিষয় তুলত না। চুপচাপ মুখ বন্ধ করে রাখতো। নিজের দোষে ফেঁসে বোকা বনে গিয়েছে একপ্রকার। নিজেকে ছাড়াতে ছটফট করতে গিয়ে, থেমে গেল হুট করে। দূর থেকে ভেসে আসছে দীপ্তর, ‘লাল লাল লাল লাল, লাললালা ওকে!’
দীপ্ত ছাঁদে আসছে নিশ্চয়ই! অরু পুনরায় ছটফট করতে লাগলো। তন্ময় তাকে ছেড়ে দিলো। অরু হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে এমন ভঙ্গিতে শ্বাস ফেলতে নিয়েছিলো, তবে তন্ময়কে শব্দ করে ছাঁদের দরজা লাগাতে দেখে শ্বাস গলায় আটকে গেল। না শ্বাস ফেলতে পারছে আর নাইবা নিতে পারছে।
তন্ময়কে কাছে আসতে দেখে দোলনার পেছনে চলে গেল। তন্ময় অধৈর্য্য গলায় আদেশ সুরে বলল,’এদিকে আয়।’
‘না। একদম না।’
‘তোকে ধরতে পারলে কিন্তু খেয়ে ফেলব!’
অরুর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। এ ধরনের বাক্য সে এই প্রথম শুনছে তন্ময়ের মুখে। লজ্জায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। সুযোগ পেয়ে মুহুর্তেই তন্ময় তাকে পেছন দিয়ে টেনে ধরল। ছাঁদের রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘আর একবার জিজ্ঞেস করবো। এবার যদি জবাব না দেস, তাহলে তোর খবর আছে!’
এমন অবস্থায় অরু শুধু তন্ময়ের বেসামাল স্পর্শ অনুভব করছে। কম্পন সৃষ্টি করছে ভেতরে। গলা দিয়ে কথা বের হইতে চাইছে না। নজর ঘুরিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,’হ্যাঁ।’
‘আমাকে কেন বলিস নি?’
‘কেন বলবো!’
তন্ময় পুনরায় অরুর হাত বেঁকিয়ে ধরেছে। এবার কিছুটা শক্তি প্রয়োগ করেছে। ব্যথায় অরুর আঁখিদুটি ভিজে উঠেছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সহ্য করে গেল। তন্ময়ের কন্ঠে ক্রোধ স্পষ্ট,’তুই এতবড় কাহিনি ঘটিয়েছিস আমাকে না বলে! আমার থেকে কনফার্ম না হয়ে!’
‘ছাড়ুন!’
দরজায় দ্রিমদ্রিম শব্দ করছে। সঙ্গে ভেসে আসছে দীপ্তর বাচ্চামিতে ভর্তি স্বর। অরু ভেজা নয়নে ছাঁদের দরজার দিক তাকিয়ে। ভুলেও তন্ময়ের দিক তাকাচ্ছে না। চোখে চোখ পড়লে সে ভয়ে জ্ঞান হারাবে। যেভাবে তাকিয়ে আছে যেন অরুকে সত্যি খেয়ে ফেলবে।
পরপর জবেদা বেগমের গলার স্বরও শোনা গেল।
‘এই অরু! কি রে এখনো ছাঁদে কি করছিস?’
অরু মৃদু স্বরে বলল,’ছাড়ুন নাহলে আমি চেঁচাব।’
‘চেঁচিয়ে দেখ তুই!’
‘এক্ষুনি যদি না ছাড়েন, আমি সত্যি চেঁচাব।’
‘গো এহেএড!’
অরু দাঁতে দাঁত চেপে রাখল কিছুক্ষণ। কি ভেবেছে অরু চেঁচানোর সাহস পাবেনা? পাবে! আজ সকলের সামনে এই লোককে অপদস্ত করবে সে। অরু নাক ফুসিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘বড়ো মা…’
মুহুর্তেই অরুর অল্পসংখ্যক খোলা ঠোঁটে তন্ময় নিজের ঠোঁট এগিয়ে নিল। আচমকা আক্রমণে অরু থরথর করে কেঁপে রেলিঙে মিশে গেল। চোখজোড়া শক্ত করে বুঝে গিয়েছে। কাঁপতে থাকা শরীরে স্পষ্ট তন্ময়ের বেসামাল স্পর্শ অনুভব করছে। ছটফট করে সরতে চাইলেও পারছেনা। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে তন্ময় তাকে।
চুপ করানোর ভঙ্গিতে ঠোঁটে ঠোঁট মিলেছে ঠিকই তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। নেশায় হারিয়ে গিয়েছে তন্ময়। অনুভূতির সাগরে ভেসে অরুও ছটফট বন্ধ করে দিয়েছে। শক্ত করে চেপে রেখেছে তন্ময়ের টি-শার্ট।দুজনের নেওয়া ঘনঘন গরম একেকটি নিশ্বাস একত্রে মিলিত হচ্ছে। অরু লজ্জায় কয়েকবার মাথাটা ঘোরানোর চেষ্টা করেছে সফল হয়নি। তন্ময় পুনরায় তাকে নিজের দিক করে নিয়েছে।
এই অনাকাঙ্ক্ষিত চুমুর ভেজা শব্দেও লজ্জায় হতভম্ব হয়ে পড়েছে অরু। সেদিন রাতে এতটা গাঢ় করে চুমু হয়নি তাদের মধ্যে। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে তন্ময় জ্ঞান হারিয়ে বসেছিল। তাই বলা যায়, এই অনুভূতি তার কাছে নতুন।
______________
তন্ময় শান্ত হয়েছে খুব সময় নিয়ে। তবে এখনো ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। তার নেওয়া একেকটি শ্বাসপ্রশ্বাস অরুর ঘাড়ে পড়ছে। অরু খনেখনে কেঁপে উঠছে এখনো। মাথা ঘুরিয়ে রেখেছে। চোখের দৃষ্টি নিচে। ভুলবসতও ফিরে তাকাচ্ছে না। তন্ময় ডান হাতে অরুর দু’গাল চেপে ধরেছে। মুখ নিজের দিক ফিরিয়েছে। তার কন্ঠের স্বর আঁধার রাতের থেকেও গভীর, ‘মুড চেঞ্জ হয়ে গেছে। তাই বেঁচে গেলি। তবে এই ভুল যেনো দ্বিতীয় বার না হয়!কোনো কিছু শুনলে সোজা আমাকে এসে বলবি!আমি জবাব দেব। মনে থাকবে?’
অরু বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দোলালো। আড়ষ্ট চোখে তাকাল। তন্ময় সময় নিয়ে বলল,’তুই ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারী নেই আমার জীবনে!’
অরু স্তব্ধ, বিমুঢ়। হকচকিয়ে গেল সে। পরপর নিজেকে হাওয়ায় ভাসমান অনুভব করলো। অস্পষ্ট স্বরে চিৎকার করে উঠলো। তন্ময় তাকে পাজা-কোলে তুলে নিয়েছে। অরুর ছটফট অগ্রাহ্য করে সামনে অগ্রসর হয়েছে তন্ময়। অরু তখনো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে। কানের কাছটায় কেউ ড্রাম বাজিয়ে তন্ময়ের বলা বাক্যটি বারংবার বাজিয়ে চলেছে। দুরুদুরু বুক কাঁপছে অরু। চোখের কোণ কখন ভিজে উঠেছে অজানা।
কাঁচ ভাঙার শব্দে ঘোর কেটেছে অরুর। সে সামনে তাকাল।তার ছোট্ট চোখ জোড়া বড় আকার ধারণ করেছে। কলির হাতে কফির মগ ছিল হয়তো। সেটা জমিনে পড়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় মুখোমুখি তিনজন! অরু লজ্জায় হতভম্ব হলেও তন্ময়ের কোনো হেলদোল দেখা গেল না। সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলেছে। বাকরুদ্ধ অরু একইভাবে পড়ে রইলো তন্ময়ের বাহুতে। সে এতটাই অবাক হয়েছে যে ছটফট করতে ভুলে গিয়েছে।
অরুর রুমে ঢুকে তন্ময় তাকে বিছানায় ছুড়ে ফেলেছে। নরম তুলতুলে বিছানায় পড়ে রইলো অরু। ঘুরে তাকাল না। উঠে বসলো অবদি না। শুনতে পেল দরজার শব্দ। তন্ময় চলে গেছে। চোখজোড়া খিঁচিয়ে বন্ধ করে রেখেছে। বুকে হাত চেপে ধরেছে। সবকিছু একত্রে মগজে ঢুকছে। তবে তন্ময়ের বলা সেই বাক্যটি অরু কিছুতেই ভুলতে পারছেনা। বারংবার হুংকার তুলছে। কাঁপিয়ে তুলছে বুকের ভেতরটা!
চলবে~
‘Nabila Ishq’
_____________________
চলবে ~
‘Nabila Ishq’
_______________________