প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব -৩০+৩১

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

৩০.
রাতে মোস্তফা সাহেব আর তন্ময়ের তর্ক লেগেছে। বন্ধ দরজার আড়াল হতে বাপ-ছেলের তুমুল কথা কাটাকাটি শোনা যাচ্ছে। তবে ঠিক কি নিয়ে, দুজনের ঝগড়া কেউই বুঝতে পারছেনা। ড্রয়িংরুমে লাইন ধরে বাড়ির একেকজন দাঁড়িয়ে। সকলেই চিন্তিত! আনোয়ার সাহেব দুবার, ভাই ,ভাই বলে ডেকে এসেছেন। তাতে কাজ হলো না কোনো! অপরদিকে জবেদা বেগম কয়েকবার দরজায় করাঘাত করেছেন। স্বামী বা সন্তান কেউই কোনোপ্রকার সাড়াশব্দ করলো না।

অরু সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে! নিচে নামছে না ভয়ে। আজ সে ঘর থেকেই বেরোতে চাচ্ছিল না। চেঁচামেচির শব্দে বেরিয়েছে নেহাত। নাহলে দু তিনদিন তার ঘরে আটকে থাকার প্লানিং ছিলো। এখনো ঠোঁটের গরম আভা যায়নি। ভাড় ভাড় লাগছে! ঝিলিক মেরে জ্বলছে ঠোঁটের মধ্যাহ্ন অংশ। এ’অবস্থায় সে একদমই তন্ময়ের সামনে পড়তে চায়না। ভাবতে না ভাবতেই হুট করে তন্ময়কে আসতে দেখছে। চোখমুখ লাল বর্ন ধারণ করেছে লোকটার! ব্যস্ত ভঙ্গিতে উপরে উঠে আসছে। অরু তাড়াহুড়ো করেও তন্ময়ের চোখের আড়াল হতে পারলো না। তন্ময়ের চোখের সামনে পড়ে গেল। লজ্জায় হতভম্ব হয়ে টানটান ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। তন্ময় যখন তার কাঁধ ঘেঁষে গিয়েছে, অরুর শ্বাস আটকে গেল গলায়। চোখ বুঝে থাকলো শক্ত করে। একই বাড়িতে থাকে তারা। সে কিভাবে এভোয়েড করবে তন্ময়কে? এ’টাতো অসম্ভব! কিন্তু অরু লজ্জায় চোখে চোখ রাখার সাহস টুকু পাচ্ছে না। সামনাসামনি হবে কিভাবে?
____________
অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে অয়ন। মাথা ব্যথায় চোখ মেলে তাকাতে পারছেনা। বিষদায়ক যন্ত্রণা উপলব্ধি করছে! কপালে আঙুল ঘষে চলেছে সমানে। একটা পেইন কিলার খেয়ে নিলে পারফেক্ট হতো। তবে সেটা এখন সম্ভব নয়। পেইন কিলার নিলে আরামদায়ক ঘুম চলে আসবে দু’চোখের পাতায়। আর অয়নের আজ ঘুমানোর কোনো রাস্তা নেই। সারারাত জেগে কাটাতে হবে।
আপাতত একটা গরম গরম কফি লাগবে! রান্নাঘরে পা বাড়ালো। ফ্রিজ থেকে একটা দুধের প্যাকেট বের করে নিয়েছে। নিঃশব্দে চুলায় দুধ বসিয়েছে। মগ, চামিচ গুছিয়ে সেখানে কিছুটা কফি, সামান্য চিনি নিয়ে মিক্সিং করে নিয়েছে। দুধ উথলে ওঠতেই মগে ঢেলে নিল। নেড়েচেড়ে রেডিমেড শর্টকাট পদ্ধতিতে বানানো কফিতে চুমুক মেরে, নিজের রুমের দিক পা বাড়ালো। সামনাসামনি পড়ল লতা বেগমের। তিনি মাত্রই ঘুম ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। টুকটাক শব্দ শুনে হয়তো! হামি দিয়ে, চোখের কোণে বিন্দু ঘুমন্ত জল নিয়ে বললেন,’এখনো ঘুমাসনি?এতরাত করে কফি খাবি? ঘুমাবি কিভাবে?’

‘ঘুমাব না মা। কাল অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে।ঘুমানোর সময় নেই।’
‘মাথা ব্যথা করছে নিশ্চয়ই?আয় মালিশ করে দেই একটু।’
‘না তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।’

অয়ন নিজের রুমে ঢুকে গেল। দরজার সিটকানি লাগিয়ে চেয়ার টেনে টেবিলের সামনে বসলো। সামনেই মোবাইল ফোন স্যাট করে রাখা। বলা যায়, তার চক্ষুদ্বয়ের সামনে মোবাইলের স্ক্রিন। স্ক্রিনে ভেসে আছে শাবিহার ঘুমন্ত মুখমণ্ডল। নিবিড়ভাবে, আবেশে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাঁথা বুক অবদি টেনে নিয়েছে। থুতনি ঝুকে গলায় ঠেকেছে। আঁধারে তার মায়াবী মুখশ্রীর দেখা মেলা বেশ দায় হয়ে পড়েছে। অয়ন আঁড়চোখে কয়েকবার দেখে, অ্যাসাইনমেন্টে মনোযোগ দিলো। কিছুটা এঁকে, কিছুটা লিখে কফিতে চুমুক বসাচ্ছে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে আবার একনজর পুনরায় স্ক্রিনে দিয়েছে। তবে একবার স্ক্রিনে নজর রাখলে ফেরানো কষ্টদায়ক বটে। আনমনে মৃদু হেসে বলল, ‘কথার খেলাফ করেছ কেন শাবিহা! তুমি না বললে রাত জেগে আমায় উষ্ণতা দিবে?’

মৃদুস্বরে হাসলো অয়ন। অধর বেঁকিয়ে চেয়ে রইলো ক্ষীণ নজরে। খুব নেশাগ্রস্ত শোনালো তার কন্ঠের স্বর,’কবে তোমাকে এভাবে নিজের পাশে দেখব? এই দিন আসছে না কেন বলো তো! আমার যে আর তর সইছে না!’

অনুভূতি ব্যক্ত করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। পুনরায় অ্যাসাইনমেন্টে মনোযোগী হবার প্রচেষ্টায় মত্ত হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে এসেছে পাঁচটা পঞ্চান্ন’তে। তার অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হয়েছে সবেই। হাত-পা ভেঙে এসেছে। উঠে একটু এক্সারসাইজ করে নিল৷ ওঠবস করে ফোন হাতে নিল। দুষ্টু সুরে বলল, ‘গুডমর্নিং অয়নের প্রেয়সী।’

অয়নের প্রেয়সীর জবাব নেই। হেসে অয়ন স্ক্রিনে চুমু দিয়ে কল কেটে দিলো। এতক্ষণ যাবত ঘুমে বিভোর শাবিহা হঠাৎ করে চোখ মেলে তাকাল। অসম্ভব লাল হয়ে গিয়েছে চোখজোড়া। চোখের সাদা অংশটুকু লাল শিরায় জমাট বেঁধে গিয়েছে। গাল দুটো ভীষণ ভাবে জ্বলছে। ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে হাসির রেখা ফুটতে চাইছে। সে জেগেই ছিলো সর্বক্ষণ। জেগে ছিলো বললে ভুল হবে। আধঘুমন্ত ছিলো। অস্পষ্ট ঘুমের ঘোরে সে সবই শুনেছে, দেখেছে। লজ্জায় চোখ খোলেনি। এতসব উদ্ভট কান্ডকারখানা করে ছেলেটা যে শাবিহা মুখ তুলে তাকাতে অবদি দ্বিধাবোধ করে। অশান্ত ভাবে ফের চোখ বুঝল। কিছুটা সময় আছে এখনো। ঘুমিয়ে নিবে। নাহলে সকালে চোখ খুলে তাকাতে পারবে না তন্দ্রা কাটিয়ে। তার ঘুমের আবার বেহাল অবস্থা। পর্যাপ্ত ঘুম নাহলে মেজাজ খিটখিটে থাকে। সারাদিন মনমেজাজ তেতো হয়ে রয়। আর সেটা শাবিহা মোটেও চায়না।
_________
শীতকালের সময়টাতে অরু জানালা বন্ধ রাখেনা। এটা একটা তার বাজে স্বভাব বলা চলে। সুমিতা বেগম সন্ধ্যার পরপর জানালা বন্ধ করে দিয়ে যান। তবে অরু পরপর আবার খুলে রাখে। মশার পরোয়া করেনা। এভাবেও এসময়, এয়ারকন্ডিশনার ছাড়া পড়ে না যে! তাই জানালা সর্বক্ষণ খোলা রাখা যায়।

খোলা জানালা দ্বারা সূর্যের কিরণের প্রবেশ ঘটেছে রুমে। ঠিক অরুর মুখশ্রীর উপর পড়ছে লম্বা সরু উজ্জ্বল কিরণের রেখা। চোখজোড়া কুঁচকে অরু ঘুরে গেল। তবু রেহাই নেই এই সূর্যের কিরণ হতে। হাসফাস করে মিনমিন স্বরে অভিযোগ করল। পিটপিট করে আঁখিদুটি খুলে তাকিয়ে রইলো মাথার উপরের সিলিংয়ের পানে। মস্তিষ্ক ফাঁকা। সময় লাগলো মগজধোলাই করে, সবকিছু ধীরেসুস্থে মনে করতে। গতরাতের সেসব মনে পড়তেই চোখ শক্ত করে বুঝে ফেললো।

বিছানা ছাড়ার কোনো লক্ষন দেখা গেল না তার মধ্যে। ঘড়ির কাঁটা সাতটায় ঘুরছে। তন্ময় এখনো বেরোয়নি। সে আটটায় ব্রেকফাস্ট করে, আটটা ত্রিশের মধ্যে বেরোয়। তারমানে তন্ময়ের সামনে পড়তে না চাইলে, দেড় ঘন্টা নিজেকে এই রুমে বন্দী করে রাখতে হবে।

পরপর মগজে আসলো, আজ তো শুক্রবার! শুক্রবার তো ছুটির দিন। তারমানে তন্ময় বাড়িতেই থাকবে। অরু চোখমুখ কুঁচকে মুখে বালিশ গুঁজে আর্তনাদ করে উঠলো। কিভাবে সামনাসামনি হবে! ঠিক এসময়, দরজায় করাঘাতের শব্দ! দীপ্ত উচ্চস্বরে ডেকে চলেছে, ‘আপু! এই আপু!বড়ো মা ডাকছে।’

অরু দাঁতে দাঁত চেপে মরার মতো পড়ে আছে। সাড়াশব্দ করছে না। তবুও দীপ্ত উচ্চস্বরে ডেকে যাচ্ছে। তার থামার নামগন্ধ নেই! একসময় দীপ্তর ডাকাডাকি থেমে গেল। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলবে এর পূর্বেই তন্ময়ের ডাক,’অরু!’

অরু হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো। চোখ দুটো তার বড়বড় হয়ে গেল। শ্বাস ফেলতেও ভয় হচ্ছে। দ্বিতীয় বার তন্ময়ের কন্ঠ ভেসে আসতেই নড়েচড়ে উঠলো। এতো ডাকাডাকির কি আছে? না পেরে অরু জবাব দিলো,’হু।’
‘নিচে আয়।’
‘আ..আচ্ছা।’

দ্রুত পায়ে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুম ঢুকে গেল। তন্ময়ের কন্ঠ কেমন নিত্যদিনের মতো শোনালো। যেনো গতকাল এমন কাহিনি সে করেনি! অথচ এদিকে অরু নিত্যদিনের মতো শান্তশিষ্ট থাকতে পারছেনা। ফ্রেশ হয়ে দরজা খুলে, উঁকি মেরেছে প্রথম। রাস্তা ফাঁকা দেখে দৌড় লাগালো। এক দৌড়ে সিঁড়ির সামনে। নামতে নিয়ে থমকে গেল। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে তন্ময় দাঁড়িয়ে। কথা বলছে ফোনে! দুরুদুরু বুক কাঁপছে অরুর। লজ্জা, সংকোচ তাকে ঘিরে ধরেছে। ওড়নার কোণা মুঠো করে ধরে রেখেছে। নিজেকে স্বাভাবিক করার পর্যাপ্ত চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। মাথা নত করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে, উষ্ঠা খেলো। পড়তে গিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলো। লজ্জায় মাথাকাটা গেল তার। উষ্ঠা খাবার সময় কি আর ছিলো না? আশপাশ কোথাও নজর দিলো না আর। তন্ময়ের দিক তো ভুলেও না। দ্রুত পায়ে, ডাইনিংয়ের সামনে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। প্লেট উল্টিয়ে টেবিলে নজর রাখল। কি নিবে বা খাবে দ্বিধাজড়িত তার পাশের চেয়ার টেনে তন্ময় এসে বসেছে। অরুর ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। এতটা প্রেসারাইজড ফিল সে কখনোই করেনি। আজ তন্ময়ের উপস্থিতি বড্ড জ্বালাচ্ছে তাকে। তিলে তিলে মনে এনে দিচ্ছে আজেবাজে চিন্তাভাবনা।

জবেদা বেগম তন্ময়ের প্লেটে খাবার দিতে নিয়ে বললেন, ‘আজ কলি ফিরে যাবে। তোর কি সময় হবে ওকে নিয়ে যাবার?’
‘না।’

সোজাসাপটা জবাব তার। জবেদা বেগম আঁড়চোখে স্বামীর দিক তাকালেন সাহায্যের জন্য। মোস্তফা সাহেব স্ত্রীর নজর দেখেও না দেখার ভান করে, খাওয়ায় মনোযোগী হলেন। জবেদা বেগম আরেকবার চেষ্টা করলেন, ছেলেকে রাজি করানোর জন্য। ‘কেন? কোনো জরুরি কাজ আছে?’
‘একটা গেট টুগেদারে যেতে হবে।’
‘তোর মামা বলছিল তোকে যেতে!’
‘সময় নেই। এসব উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে বলো তাদের!’

জবেদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মাথা নত করে খেতে থাকা কলি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো শব্দ করে। খাবার ফেলে চলে যাবার জন্য পা বাড়ালো। জবেদা বেগম হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’কিরে উঠলি যে, খাবি না?’
‘খিদে নেই।’

কলি হুড়মুড়িয়ে চলে গেল। জবেদা বেগম প্লেটে খাবার নিয়ে পিছু ছুটেছেন। মোস্তফা সাহেব কিছু বলতে যেয়েও বললেন না।কোণা চোখে ছেলেকে বিরক্ত নজরে দেখে নিলেন। সব ঝামেলার চুড়ান্তে রয়েছে তার এই ছেলেটা! আকাশ উত্তেজিত কন্ঠে শুধালো, ‘তোর ব্যাচমেটদের গেট টুগেদার না?’
‘হু!’
‘ওয়াও! গতবছর আমি গিয়েছিলাম না তোর সাথে! মারাত্মক লেগেছে। একেকজন এতো ডিফারেন্ট অ্যান্ড ফানি। একদম বোর ফিল হইনি। ভীষণ এঞ্জয় করেছি।’
‘এবার আসবি?’
‘না ভাই। আমার অলরেডি ইউ নো… হয়ে আছে।’
‘ওকে!’

অরু এতটাই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে খেয়ে যাচ্ছিলো যে সে মোস্তফা সাহেবের ডাক শুনতে পায়নি। পুনরায় ডেকে উঠতেই ফিরে তাকাল, ‘জি চাচ্চু?’
‘রেজাল্ট কবে বেরোবে জানো কিছু?’
‘মাসের শেষের দিক।’
‘কোন ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাচ্ছ? পাব্লিক ওর প্রাইভেট? নাকি যেটাতে আছ ওটাতেই?’
‘পাব্লিক। আমি ঢাবিতে চান্স পেতে চাই চাচ্চু।’
‘দূর হয়ে যায় তো! এডমিশন টেস্ট দিতে কত পয়েন্ট চেয়েছে?’
‘এসএসসি আর এইচএসসি মিলিয়ে এইট!’
‘এসএসসি’তে তো এ’প্লাস ছিলো তাই না?’
‘জি।’
‘এইচএসসি তে কেমন করবে?’
‘মোটামুটি।’
‘ভর্তি হবার জন্য পড়াশোনা শুরু করে দাও, তাহলে! ওহ্ হ্যা, এবার বিজ্ঞান বিভাগে কতটা আসন রয়েছে জানো!’
‘শুনেছিলাম এক হাজার সাতশো পঁচানব্বই।’
‘মন দিয়ে পড়তে থাকো।’
‘জি।’

ব্রেকফাস্ট শেষ করে অরু সোফায় বসেছে। তার নাক পিটপিট করছে। দু’একবার হাঁচি দিয়ে, টিস্যু নাকে গুঁজে রেখেছে। সামনে দিয়ে দীপ্ত নেচেকুদে বেড়াচ্ছে! এই আসছে আবার যাচ্ছে। অরু দীপ্তর উপরেই কয়েকবার হাঁচি-কাশি ঝাড়তেই সে দৌড়ে পালালো নাকমুখ কুঁচকে।

মোস্তফা সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ করে, তন্ময় অরুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অরু ঘুরেফিরে আঁড়চোখে তাকে দেখে নজর সরিয়ে নিচ্ছে। বা’হাতের টিস্যু খানা পিঠের পেছনে লুকিয়ে রেখেছে। হাঁচি দিতে ইচ্ছে করছে, তবে নিজেকে দমন করে রেখেছে এই লজ্জাজনক কাজ করা হতে। তন্ময় খুব সাবলীল স্বরে জিজ্ঞেস
করলো, ‘গেট টুগেদারে যাবি?’

নাক পিটপিট, হাঁচি-কাশি সব ভুলে বসলো অরু। ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। অবিশ্বাস্য সুরে বলল, ‘কি?’
‘গেলে সন্ধ্যার আগে তৈরি হয়ে থাকিস!’

তন্ময় টেবিল হতে মানিব্যাগ, সেলফোন এবং হাতঘড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। দূরে সিঁড়িতে দাঁড়ানো দীপ্ত দৌড়ে তার পেছনে ছুটেছে। হয়তো কিছু কিনে দিতে বলবে! অরু ধ্যান মেরে তন্ময়ের যাবার পানে তাকিয়ে। সে আসলেই কিছু বুঝতে পারছেনা। তন্ময়ের সঙ্গে গেট টুগেদারে সে কেন যাবে? মানে তাকে হঠাৎ করে কেন নিতে চাচ্ছে? কই আগেতো কখনো যেতে বলেনি!
_______________
বিকেল থেকে অরু বাড়ি জুড়ে বিচরণ করছে। চিন্তায় সে আধপাগল প্রায়। কি করবে? যাবে নাকি না? তন্ময় তাকে জোড় দিয়ে কিছু বলেনি। সাধারণ ভাবে বলেছে! তারমানে না গেলেও চলবে। যেতেই হবে এমন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু মনেমনে অরু যেতে চাচ্ছে। আবার একটু দ্বিধাবোধেও জড়িয়ে রয়েছে। তন্ময় বলেছে সন্ধ্যার আগে তৈরি হয়ে থাকতে। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটায় ঘুরছে! আর কতো? এখন তৈরি হতে না গেলে, তন্ময় তাকে ফেলে চলে যাবে।

অবশেষে রুমের দরজা লাগিয়ে অরু আলমারি খুলে বসেছে। কি পরবে ভাবতে ভাবতে সোনালী রঙের একটা থ্রিপিস বের করে বিছানায় রাখল৷ এটাই পরবে! ফ্রেশ হয়ে এসে কামিজ পরে নিল। ধীরেসুস্থে তৈরি হয়ে গেল৷ নিজেকে পরিপাটি করে আয়নায় দেখল। কপালে ছোট পাথরের টিপ দিতে গিয়েও দিল না। বিছানায় বসে, উঁচু জুতো জোড়া পরতে লাগলো। মিনিট পাঁচেক আগে পাশের রুমের দরজা খোলার শব্দ পেয়েছিল। তন্ময় নিশ্চয়ই রেডি হচ্ছে? অরু জুতো পরে বসে রইলো। তন্ময় ডাকলে তবেই বেরোবে নাহলে নয়। আচ্ছা, তাকে বেরোতে না দেখে যদি তন্ময় চলে যায়? হাজার উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা মাথায় নিয়ে বসে থাকলো। ছয়টা পঁয়তাল্লিশে দরজায় করাঘাতের শব্দ। অরুর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। নিজেকে আরেকবার দেখে নিয়ে দরজা খুলতে এগোল। তার দুরুদুরু বুক কাঁপা কি বন্ধ হবেনা?

তন্ময় ইন করা কালো শার্ট পরেছে, কালো প্যান্টের সঙ্গে। হাতে বড়ো কালো রঙের একটা ঘড়ি পরেছে। আপাতত মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভিং করছে। চিরচেনা সেই সুবাস ভেসে আসছে নাকে। তন্ময়ের এই পারফিউমের ঘ্রাণ অরুর খুব পছন্দের। আঁড়চোখে তন্ময়ের গম্ভীরমুখে দৃষ্টিপাত দিলো। তার চোখজোড়া অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে তন্ময়ের পাতলা ঠোঁটে চলে গেল। গরম মুখ নিয়ে মুহুর্তেই অন্যপাশে ফিরল। ধুকপুক শুরু হয়েছে ভেতরে। নিস্তব্ধ গাড়ির মধ্যে তন্ময়ের পাশে বসে থাকাটাও দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অরু শুনেছে তারা ধানমন্ডি তেত্রিশে যাচ্ছে। মোবারক রেস্টুরেন্টের ছাঁদ বুক করা। সেখানেই গেট টুগেদারের আয়োজন করা হয়েছে। সে ভীষণ নার্ভাস। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তার নাকের ডগায় ও বিন্দু ঘামের দেখা মিলছে। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। তন্ময় অরুর পাশের কাঁচ নামিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে দমকা হাওয়া ছুঁয়ে দিল অরুকে। পর্যাপ্ত শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে, নিজেকে শান্ত করল। আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক তাকাল। মিনমিন সুরে বলল, ‘অনেক মানুষ থাকবে সেখানে?’
‘হু।’
‘আমার যাওয়াটা স্বাভাবিক দেখাবে কি?’
‘গেলে বুঝবি।’

এটা কোনো সুন্দর উত্তর হতে পারে? একদম নয়। ফালতু, ছোটলোকি উত্তর। এতবড় বন্ধুবান্ধবদের গেট টুগেদারে তাকে কেন নিচ্ছে! অরুকে বিষয়টি এতটাই ভাবাচ্ছে যে, তন্ময়ের করা গতকালের কীর্তিকলাপের বিষয় ভুলে বসলো।
__________
রেস্টুরেন্টের পাশে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে গাড়ি পার্ক করে বেরিয়ে এসেছে তন্ময়। পরপর অরুও বেরোলো। খুঁড়ে খুঁড়ে তন্ময়ের পিছু হাঁটছে। চারপাশে নজর বোলাচ্ছে। খুব সুন্দর পরিপাটি পরিবেশ চারিপাশে। অরু মারজির সঙ্গে কমবেশি অনেক রেস্টুরেন্টে গিয়েছে। তবে এটায় কখনো আসা হয়নি। কিন্তু পরেরবার মারজিকে নিয়ে ঠিক আসবে। এই রেস্টুরেন্টের খোলামেলা পরিবেশ তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।

সদরদরজার সামনেই দারোয়ান। তন্ময়ের সেলফোন বেজে চলেছে সমানে। এতক্ষণ যাবত একটা কলও রিসিভ করেনি। এবার রিসিভ করলো। হু,হ্যাঁ করে রেখে দিল। ঘুরে তাকাল। অরু এখনো তার থেকে পাঁচ হাত দূরে। ধীরেসুস্থে হাঁটছে নাকি দ্রুত বুঝতে পারলো না। তবে অরুর মতে সে দ্রুত হাঁটছে। হাঁটছে বললে ভুল হবে! দৌড়াচ্ছে একপ্রকার। তাও তন্ময়ের পাশাপাশি থাকতে পারছেনা। তন্ময়ের কাছাকাছি আসতেই তার কাঁধ পেঁচিয়ে ধরলো তন্ময়। অরু কিছুটা কেঁপে উঠে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। তন্ময় তাকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে নিয়ে বলল, ‘ওরা ফানলাভিং পার্সন। আবোলতাবোল বকে। সেগুলো কানে নেওয়ার প্রয়োজন নেই! খারাপ লাগলে আমাকে জানাবি। বোঝা গেল?’

অরু মাথা দোলাল। ছটফট করে রয়ে গেল তন্ময়ের বাহুতে। এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করছে। উপলব্ধি করছে মানুষের চাহনি। ভীষণ লজ্জাও লাগছে বটে। এভাবে ধরে হাঁটার কি আছে? মানুষজন নিশ্চয়ই ভাববে তারা প্রেমিক-প্রেমিকা। আসলেই কি! তন্ময় তো স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তার জীবনের একমাত্র নারী শুধু অরু! তারমানে দাঁড়ায় তন্ময় তো তার প্রেমিক! ভাবতেই অরুর মন আকাশে উড়তে লাগলো ডানা মেলে। সে কখনো কল্পনা করেছে কি তার এই সুন্দর ভাই, তার প্রেমিক হয়ে যাবে? অরু মিটিমিটি হেসে তাকাল। দেখল তন্ময় তার দিকেই তাকিয়ে। অরুর হাসি গায়েব হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। তন্ময় আগ্রহী স্বরে জিজ্ঞেস করলো,’কি ভাবছিস?’
‘কই! কিছুনা।’
‘মিটিমিটি হাসছিলি কেন?’
‘কোথায় হাসছিলাম!’
‘আমি দেখলাম।’
‘আমি কি হাসতে পারবনা?’
‘না হাসতে পারবিনা। যেখানে সেখানে হাসার প্রয়োজন নেই তো।’

অরু মুখ গোমড়া করে রাখল। তবে মনে মনে সে মিটিমিটি হেসেই চলেছে। আজ সে খুব সুন্দর অনুভব করছে। ভীষণ ভালো লাগছে তার। সাথে একটা বাজে রকমের ইচ্ছে জেগেছে মনে। তন্ময়কে শক্ত করে জরিয়ে ধরতে চাওয়ার ইচ্ছে!
প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

৩১.
ছাঁদে পা রাখতেই দেখতে পাওয়ার যাবে, পা’পাশে সবুজ বোর্ডে, বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘গ্রিন ল্যান্ডে স্বাগতম’। নামটির যথার্থ পরিচয় দিয়েছে। ফ্লোরে সবুজ ঘাসের মেলা। বোঝার উপায় নেই যে এখানে প্লাস্টিকের ঘাসের ব্যবহার হয়েছে। দেয়ালেও সমানতালে ঘাসের ব্যবহার। মধ্যখানে দু’লাইন গেঁথে বড়ো দুটো টেবিল গিয়েছে। আসন দেয়া রয়েছে মোট চল্লিশ জনের। ড্রাম, গিটার এমন নানান রকমের বাদ্যযন্ত্র রয়েছে আশপাশে। গোল কুশন বালিশ গুলোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে অনেকেই। এতগুলো অজানা মানুষ একত্রে দেখে অরু হকচকিয়ে গেল। সেই মানুষ গুলোর নজর তন্ময়ের উপর পড়তেই, একেকজনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সে তন্ময়ের পেছনে চলে এলো। ভয়ে ধকধক করছে ভেতরটা। একপ্রকার গুটিয়ে গিয়েছে সে। এমন হট্টগোল মোটেই আশা করেনি।

বারো, চৌদ্দ জন পুরুষ হবে একত্রে। এবং প্রত্যেকে স্যুট-কোট পরে। একেকজন পুরুষের পাশে সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে। বোঝাই যাচ্ছে তাদের জীবনসঙ্গিনী। তারা দিব্বি তন্ময়কে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ডেকে চলেছে,’এই আমাদের চ্যাম্প চলে আসছে। সাইড, সাইড! যায়গা দেন।’
‘এতবড় তন্ময় এতটুকু যায়গায় আটব ত?’
‘এই ব্যাটা! এতবড় তন্ময় মানে! তোর’টা কি
ছোটো?’
‘এইযে বড়ো তন্ময় চাচা দেখে নেন চোখ খুলে, ঠিক কে আগে অশ্লীলতা শুরু করছে! চোখ খুলে দেখে নেন সবাই! মাহিননা শুরু করছে! আমি আবার সবসময় অশ্লীলতার খেতাবে অংশগ্রহণ করতে চাই না।’
‘এই মাদার’বোর্ড তুই এতবড়ো বলতে কি বুঝাইছস এটা আগে বল।’
‘এতবড় মানে বড়ো! বড়ো ইংলিশে হলো, ‘বিগ’! বিগার বিগ!’
‘শা’লা অশ্লীল! তুই দেখে আসছস বিগ না স্মল। গে একটা!’
‘এই খবরদার! মুখ সামলে কথা বলবি, ছোটো মিয়া!’
‘আহিস দেখাব ছোটো না বড়ো।’
‘একদম খুলে?’

অরু ফ্যালফ্যাল নয়নে একেকজনের কথাবার্তা শুনে যাচ্ছে। ভীতু সে একটি কথার মানেও বুঝে উঠেনি। কি রেখে কী বলছে ভালোভাবে শুনতেই পারছেনা! বুঝবে তো দূরের বিষয়। সে বরং আলগোছে তন্ময়ের শার্টের একটি অংশ চেপে রেখেছে। তার দৃষ্টি ঘুরেফিরে সকলকে দেখছে। একসময় দৃষ্টি গিয়ে থামলো ইব্রাহিমের দিক। ইব্রাহিম একটি গ্লাস হাতে বসে। আপাতত ঠিক অরুর দিক তাকিয়ে মুচকি হেসে চলেছে। গ্লাসের সাথে গ্লাস মেরে উচ্চস্বরে বলল, ‘তোরা ইম্পর্ট্যান্ট গেস্ট মিস করে যাচ্ছিস!’

ইব্রাহিমের আঙুল তোলায় এবার সকলেই তন্ময়ের পেছনে তাকাল মনোযোগ দিয়ে। সুঠাম দেহের তন্ময়ের পেছনে পাতলা, ছোটো গড়নের অরুকে লক্ষ্য করা আসলেই কষ্টসাধ্যের বিষয়। কিছু সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা বয়ে গেল। পরপর পুনরায় হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ! মাহিন অধৈর্য গলায় শুধালো, ‘এটা অরু না?’
‘অরুকে এনেছিস? সিরিয়াসলি! সূর্য কোথা থেকে উঠছে?পূর্ব?’
‘শা’লা অশিক্ষিত সূর্য পূর্ব দিক থেকেই উঠে!’
‘সূর্যমামা আর আমি ভাইরা ভাই! এখন ভাই-ভাই হয়ে তো আর তাকে উল্টো দিক থেকে উঠতে বলতে পারিনা!’
‘ইয়াক!’

অরু এখনো চমকে তাকিয়ে। সকলেই তার নাম জানে।কিভাবে জানে? সে তো এই প্রথম তাদের দেখছে। এর আগে কখনো দেখেনি। তন্ময় বন্ধুবান্ধব বাড়িতে আনেনা খুব একটা। ক্লোজ ফ্রেন্ড ইব্রাহিম হাতেগোনা দু’একবার এসেছে। আর সকলেই তাকে কেমন নাম ধরে, মজার সুরে কথা বলে চলেছে। যেনো বছর বছর ধরে তাদের সম্পর্ক, পরিচয়, চেনাজানা।

তন্ময় মাথা ঘুরিয়ে অরুর দিক তাকাল। এগিয়ে নিয়ে গেল তার বন্ধুবান্ধবদের সামনে। চোখে চোখ রেখে নরম সুরে বলল, ‘দে আর মাই ফ্রেন্ডস।’

অরু ছোটো স্বরে সালাম জানাল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’

‘আলাইকুমস সালাম। আলাইকুমস সালাম।’ জবাব খানা সকলের থেকে ফিরে আসলো। তন্ময় একটি কুশন এগিয়ে দিয়ে বসতে ইশারা করলো অরুকে। অরু বসলো জড়সড় হয়ে। তার পাশেই তন্ময় বসেছে ছুঁই ছুঁই হয়ে।

সর্বদা গম্ভীরমুখের তন্ময়কে এখন আর গম্ভীর লাগছে না। সে মুচকি হেসে তাকিয়ে বন্ধুদের পানে। দু’একবার মাথা দুলিয়েছে। কথা বলছে! এক সুন্দর পরিবেশ। হাসাহাসির ঝড় বসেছে। ঠাট্টার সুরে রিহান বলে, ‘এতবড় তন্ময়ের জন্য অরু ছোটো হয়ে গেল না!’

হাসাহাসির ঝড় নেমে এলো। ইব্রাহিম হাসতে লুটিয়ে পড়েছে। চোখের কোণে তার জল জমেছে। নিজেকে সামলে চোখে কোণ মুছে নিল। মাহিন অতিষ্ঠ সুরে ভেঙাল,’ সেই তন্ময়েরটা নিয়েই ওর যত মাথা ব্যথা! দেখে আসছে যে বড়ো! আর তোর’টা! ওটা যে ছোটো শুহানি জানে? এই শুহানি এটাকে ডাক্তার দেখাস না কেন!’

রিহান সকলের থেকে বেশি দুষ্টু প্রকৃতির। তা তার হাবভাবে বোঝা যাচ্ছে। তার পাশে ফর্সা, লম্বাচওড়া দেখতে মেয়েটি হলো শুহানি। অরু মনোযোগ দিয়ে মেয়েটিকে দেখল।কথাবার্তায় বুঝে নিয়েছে মেয়েটিও তন্ময়ের ফ্রেন্ড সার্কেলের একজন। তুই তুকারি তো আর যে সে লোক করেনা। লক্ষ্য করেছে তন্ময়কেও তুই করেই সম্বোধন করেছে। ইভেন রিহানকেও! শুহানি নাক কুঁচকে বলেছে,’ডাক্তার দেখিয়েছি, সার্জারী করতে হবে!’

রিহান বুকে হাত চেপে রেখেছে, ‘ বেবি! ডার্লিং! সুইটহার্ট হাও ক্যান ইউ সে দিস!’
‘চুপ থাক!’
‘এভাবে বলেনা যান! কষ্ট পাই।’
‘তুই মর।’
‘আমি মরলে কেম্নে হবে জান!’

রসিকতা সকলের মধ্যে বিদ্যমান। মাহিনের বা’পাশের ছেলেটা সৈয়দ। শান্তশিষ্ট ধরনের। তবে এবার মুচকি হেসে অরুকে জিজ্ঞেস করলো,’অরু তো এবার ইন্টার পরিক্ষা দিয়েছ না? তুমি করে বলছি কারণ ভীষণ ছোটো। আমাদের সকলের মাস্টার্স কমপ্লিট বুঝলে? আমরা তোমার সিনিয়রদের ঘরের সিনিয়র। তা এতবড় সিনিয়র বয়ফ্রেন্ড পেয়ে কেমন বোধ করছ?’
‘তারউপর সিনিয়র বয়ফ্রেন্ড কাজিন!
‘ওহো!’

অরু আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক তাকাচ্ছে মাথা নত করে। ঠিক কতপ্রকার লজ্জা সে পাচ্ছে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। রীতিমতো গালে গরম আভাস পেয়ে চলেছে। মাথা তুলে তাকাতে পারছেনা। তন্ময় ঠোঁটে স্মিথ হাসি রেখে আছে। অরু খুব সময় নিয়ে নিচুস্তর স্বরে বলল,’জি। ইন্টার দিয়েছি।’
‘বি কম্ফোর্টেবল অরু! আমরা আমরাই তো।’

সৈয়দের পাশে রুবেল বসে। সে শুধু হেসেছে এবং টুকটাক মতামত দিয়েছে। এবার সেও কথা বলল,
‘এমন সুন্দরী শান্তশিষ্ট পিচ্চি কাজিন আমাদের নেই কেন!তাহলে তো আর মেয়ে খুঁজতে হতোনা! বাচ্চাকাল থেকে পড়িয়ে, শিখিয়ে নিজের মতো বড়ো করে, বিয়ে করে ফেলতাম!’
‘কাজিন গুলো সব বিয়েসাদী করে আঙ্কেল বানিয়ে ফেলেছে!’
‘সব লাক তন্ময় চাচার।’

অরু টানটান হয়ে বসে। ঘনঘন তন্ময়ের দিক তাকাতে ইচ্ছে করছে। কারণ তন্ময়ের হাত তার পিঠে। একটু পরপর বুলিয়ে দিচ্ছে। যেমন শান্ত করছে অরুকে। কিন্তু অরুর তো অস্বস্তি হচ্ছে না। একটু লজ্জা এবং ভয় লাগছে। তেমন ভালোও লাগছে।

ইব্রাহিম শব্দ করে হেসে উঠলো, ‘শান্ত? তাও অরু!অসম্ভব।’

শুহানি হেসে শুধালো, ‘অনেক দুষ্টু নাকি?’
‘দুষ্টু না! দুষ্টুর নানি। তন্ময়কে নাকে দরি লাগিয়ে ঘুরায়। অচেনা মানুষদের সামনে এমন পুতুল সেজে থাকে। কিন্তু বাড়িতে ও একটা জলজ্যান্ত জ্বালানি।’

অরু লজ্জায় মাথা নত করে রেখেছে। মনেমনে ইচ্ছে মতো বকে দিল। পেয়ে নেক একবার সামনে। ইতর, বাটপার একটা। মাহিন ইন্টারেস্ট নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘সত্যি নাকি তন্ময়?’

তন্ময় উচ্চস্বরে করে হেসে উঠলো। হাসির শব্দে অরু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকাল। বন্ধুদের সঙ্গে তাহলে তন্ময় এমন থাকে? কতটা সুন্দর লাগছে তার আইডিয়া আছে লোকটার? অরুর বুক দুরুদুরু করে কেঁপে উঠছে। বুকে অশান্তি অনুভব করছে। এভাবে তার সামনে কেন হাসেনা? এইযে হেসেছে বলে গহব্বরে হারিয়ে গিয়েছে মায়াবী চোখ দুটো। ঠিক কতটা সুন্দর দেখাচ্ছে, তা তো অরু ভালোভাবে দেখতেই পারছেনা।

তন্ময় হেসে বলল,’দুরন্তপনায় ঘেরা। ড্রামা বা মুভিস দেখতে হয়না। সি’জ এনাফ।’

শুহানি হেসে বলল, ‘ড্রামা কুইন আহা! লটারি জিতছস দোস্ত!’

অরু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। শুহানির কথায় পুনরায় লজ্জায় হতভম্ব হয়ে গেল। পরপর বন্ধুদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। নানান রকমের বিষয় নিয়ে কথা বলছে। অরু মনোযোগ দিয়ে শুনছে। একসময় ওয়েটার এসে ড্রিংকস দিয়ে গিয়েছে। সে মেজেন্টা নিয়েছে। ধীরেসুস্থে একটু একটু করে খেয়ে চলেছে। এরমধ্যে শুহানি এবং উপস্থিত কিছু মেয়ের সাথে তার কথাবার্তা হলো! তাদের কথায় অরু বুঝতে পারলো তারা সবাই তাকে চিনে। তন্ময়ের সেলফোন থেকে নাকি ছবি দেখেছে। মজার মজার অনেক ইন্সিডেন্ট শুনেছে। অরু বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। নাহিন দুষ্টু সুরে বলল, ‘তোমাকে মজার একটা বিষয় বলি অরু! তখন আমরা মাস্টার্স প্রথম বর্ষে। তন্ময়কে আমাদের ক্লাস লিডার তন্নি প্রপোজ করে। মাঠে ভরা জনগণ! পাব্লিক প্রপোজ বুঝো ত? পাব্লিক প্রপোজ করে বসে। সেই কি কান্ড! ভাবতেই হাসি চলে আসছে!’

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তার সঙ্গে বাকিরাও যোগদান করেছে। কিন্তু অরু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বাকিটা শোনার জন্য। মাহিন বলল, ‘বাকিটা আমি বলি শোনো। তন্ময় খুব নিট অ্যান্ড ক্লিন! এটা আমরা সকলেই জানতাম। ও আগে থেকে ছোট গার্লফ্রেন্ড বাড়িতে বড়ো করছে, তা তো আর তন্নি বেচারি জানে না! ও তন্ময়ের পেছনে আঠার মতো লেগে পড়ল। কি খাটনি না খেটেছিলাম এই মেয়েকে সরাতে।’

অরু চোখমুখ অন্ধকার করে তন্ময়ের দিক তাকাল। তন্ময় জিজ্ঞেস করলো,’খারাপ লাগছে?’
‘না।’
‘ঠান্ডা লাগছে?’
‘উহু!’
‘ডিসকম্ফোর্ট ফিল করলে জানাবি!’
‘হু।’

নাহিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’হাও কিউট! এই কেয়ারিং তন্ময়কে আমি প্রথম দেখছি!’
‘মি টু!’
‘আমিও!’

অরুর বলতে ইচ্ছে করলো, সেও এই প্রথম দেখছে। এমন কেয়ারিং, হাস্যজ্জ্বল সুন্দর তন্ময় আগে দেখেনি। দেখেনি বললে ভুল হবে। খেয়াল করেনি। মাহিন তন্ময়ের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এই তুই এভাবে তুই তুকারি করছিস কেন অরুকে!’
‘অভ্যাস।’ তন্ময়ের ছোট জবাব। থেমে আবারো বলল, ‘পরিবর্তন করা যাবে বলে মনে হয়না।’
‘জান, টান ডাকিস না? না মানে কোনো নিক-নাম দিস নাই?’

অরু লজ্জায় পুনরায় হতভম্ব হয়ে রইল। তন্ময় আগেই যেই ওয়ার্নিং দিয়েছে তাকে, তার যথাযথ কারণ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে অরুর। বন্ধুদের মস্করার গুলো তন্ময় কি ইজিলি হ্যান্ডেল করছে। যে যা বলছে, সে সেটাই মেনে নিচ্ছে। জবাব দিচ্ছে! অরু চুপচাপ জড়সড় হয়ে সকলের আলাপ-আলোচনা শুনে গেল।
____________
ডিনার শেষ করে সকলে পুনরায় শুয়ে, বসে রয়েছে। মজামাস্তি থামেনি তাদের এক সেকেন্ডের জন্য। কিছুক্ষণ পর রুবেল গান নিয়ে কথা তুলেছে।ব্যস, সকলের রিকোয়েস্ট মেনে রিহান গান গাইল শুহানির জন্য। একটি বাংলা রোমান্টিক গান। অরু সমানে হাতে হাত, ছুঁয়ে তালি দিচ্ছে। লাজুক হেসে মনোযোগ সহকারে শুনছে। কি সুন্দর গেয়েছে! নিশ্চয়ই প্রায়শই গান গায় তারা! গান শেষ হতেই একসময় রূপম বলল, ‘অরু তোমাকে তন্ময় গান শুনিয়েছে ত?’

অরু প্রায়সময় শুনেছে তন্ময় ভালো গান গায়। গিটার বাজাতে পারে। কিন্তু কখনো শোনেনি। অরু মাথা নাড়লো। শোনেনি! মাহিন চেঁচিয়ে উঠলো,’কি বলো! তোমাকে গান শোনায়নি? পৃথিবীতে এমন প্রেমিক আছে নাকি, যে নিজের প্রেমিকাকে গান শোনায় না?’
‘আরে ওদের বিষয়টা তো ভিন্ন অন্যদের থেকে। দে আর কাজিনস!’
‘তাতে কি! কাজিনদের চান্স আরও হাঈ মাম্মা!’
‘এই ব্যাটা চল তাড়াতাড়ি গান গেয়ে শোনা একটা অরুকে! তুমি শুনতে চাও ত অরু?’

চুপসে গেল অরু। সকলের নজর তার উপর। এমনকি তন্ময়ের! সেও তাকিয়ে তার রায় জানার জন্য। লজ্জায় এখান থেকে অরুর লাফিয়ে উঠে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে তন্ময়ের মুখে গানও শুনতে চায়। অবশেষে হালকা মাথা দোলাল। মুহুর্তে রিহান তার হাতের গিটার ছুড়ে মা’রে তন্ময়ের দিক।
ইব্রাহিম উৎসাহ দিল, ‘চল শুরু কর!’

তন্ময় গিটার হাতে মাথা নত করে, গিটারে টুং টুং শব্দ করছে। অরু ধ্যান মে’রে দিয়ে তাকিয়ে। বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ঠিক কতটা এক্সাইটম্যান্ট তার ভেতরে কাজ করছে, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সে কখনো কল্পনা করেনি, তন্ময় তার জন্য গান গাইবে। গম্ভীর তন্ময়কে এভাবে কল্পনা করার সাহস সে জীবনেও পায়নি।

পরিবেশ শান্তশিষ্ট হয়ে গেল মুহুর্তে। কোনো শব্দ নেই। সকলেই নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে। তবে ঠোঁটে মৃদু হাসি! মাহিন আঙুলের সাহায্যে শিঁষ বাজিয়েছে দুবার। ইব্রাহিম মোবাইলের ক্যামেরা ওন করে দিয়েছে। তন্ময়ের ভারী, গভীর কন্ঠের স্বর ধীরে শোনা গেল।

‘চাহে কুছ না কেহনা, ভালে চুপ তু রেহনা
মুঝে হে পাতা, তেরে প্যায়ার কা
খামোশ চেহরা, আখো পে পেহরা
খুদ হে গাওয়া, তেরে প্যায়ার কা,

তেরি ঝুকি নাজার, তেরি হার আদা
মুখে কেহ রাহি হে এ দাস্তা ,
কই শাকস হে যো কে ইন দিনোন
তেরে যেহেন-ও-দিল পে হে ছা গায়া!’

চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’
চলবে~
‘Nabila Ishq’
_____________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here