প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল
৩৬.
ঘড়ির কাঁটা বারোটায়৷ নিরিবিলি ঘরে একা থেকে অরুর মস্তিষ্ক সম্পুর্ন জ্যাম। সে পাশের রুমে তন্ময়কে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছেনা। এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে চলেছে দেহে। দুরুদুরু কাঁপতে থাকা বুকের গতিও নিয়ন্ত্রণে নেই। আজকের অনুভূতি একটু বেশি প্রগাঢ় কী? তন্ময় পাশের রুমে বুঝি তাই? কই তাদের বাড়িতেও তন্ময় আর তার রুম পাশাপাশি। তাহলে? ব্যস্ত পায়ে অরু নিজের ল্যাগেজ খুলল। তার একটি বেশ পারসোনাল ডায়রি আছে। খুব যত্নে সে তা লুকিয়ে রাখে৷ নিজেই খুব একটা ধরে না বা অযথা গুপ্তস্থান থেকে বের করেনা৷ যখন ইচ্ছে হয়, মনের কিছু অনুভূতি লেখা দরকার ঠিক তখনই বের করে। কিন্তু ভুলেও আগের লেখাগুলো’তে চোখ বুলোতে যায়না। তার অবশ্য কারণ রয়েছে। ক্লাস সেভেন থেকে সে এই ডায়েরি লিখছে। এবং উঠতি বয়সে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা সে ডায়েরিতে লিখে রেখেছে। আবেগে কীসব উদ্ভট অনুভূতি লিখেছে তা বুঝদার হয়ে পড়ার ইচ্ছে অথবা অবস্থা একদম অবশিষ্ট নেই তার মাঝে৷ এমন নয় যে সে অনেক বুঝদার বা বড়ো হয়ে গিয়েছে। তবে তখনকার থেকে এখন ভালোই আছে। অরু আজকাল ভাবছে ডায়েরি খানা পুড়িয়ে ফেলবে। এই ডায়েরি কারো হাতে গেলে মানইজ্জত আর থাকবে বলে মনে হয়না। বিশেষ করে বাড়ির ইয়াং জেনারেশনে হাতে, একদম যাওয়া যাবেনা। হট্টগোল পড়ে যাবে। অরু মনে ভয় নিয়েও ডায়েরিতে পুনরায় লিখতে বসলো। এবং তাকে নিয়েই লিখল যাকে নিয়ে সচরাচর সে লিখে থাকে। তার তন্ময় ভাই!
এতরাতে সেলফোন বেজে উঠবে প্রত্যাশা করেনি অরু। স্ক্রিনে মারজির নাম ভেসে উঠেছে। মেয়েটা এতরাত করে কল করলো হঠাৎ? অরু ডায়েরি রেখে উঠে দাঁড়ালো। বিছানার কোণে বসে কল রিসিভ করল৷ ওপাশ হতে মারজির দুষ্টু হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। থেমে থেমে মৃদু স্বরে হাসছে। হাসির শব্দ এতটাই মধুর যে অরুর ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠল। তবুও ধমকের সুরে শুধালো, ‘কী?’
‘হানিমুন।’
‘কী!’
‘দোস্ত একটা গল্প ভেবেছি। গল্পের নাম হানিমুন। প্লট একদমই টপ নচ। তোকে শোনাবো। দেখি, শুনে বলত এই প্লটে একটা হাই বাজাট্যার মুভি করা যাবে কিনা!’
অরুর ভুরু দু’য়ের মাঝ সূক্ষ্ম ভাজ পড়েছে। চিন্তিত সুরে বলল,’সবই ঠিক আছে। কিন্তু হানিমুন নামটা এডাল্ট হয়ে গেল না?’
‘হোক এডাল্ট। তারা যদি এডাল্ট কাজ করতে পারে, আমাদের বলতে সমস্যা কোথায়।’
অরু স্পিচল্যাস বনে গেল। চুপচাপ শুনতে চেষ্টা করলো মারজির হানিমুন গল্প।’গল্পের নায়কের নাম সুলতান। নায়িকার নাম সুলতানা।’
এতটুকু বলতেই মারজিকে থামিয়ে অরু বলল,’নাম দুটোর মধ্যে এতো মিল কেন! ভাইবোন মনে হচ্ছে!’
‘ভাইবোনই তো। তারা চাচাতো ভাইবোন বুঝলি? এখন আমাকে আর রুখবি না। শেষ করতে দে গল্পটা। পরপর লম্বা একটা ঘুম দিব।’
‘আচ্ছা।’
‘তাদের দুজন সম্পুর্ন ভিন্ন দুটো মানুষ। বিবরণ দিতে গেলে বলা যায়, সুলতান হচ্ছে খাবার। আর সুলতানা হচ্ছে মাছি। খাবারে মাছি ভনভন করে তাই না? তেমনি সুলতানের চারিপাশে সুলতানা ভনভন করে৷ একদিন ঘোষণা শোনা গেল, সুলতানকে নির্বাসনে যেতে হবে৷ সুলতানা কিভাবে থাকবে একা? সেও ছুটে গেল সঙ্গে। আশ্চর্যজনক ভাবে নির্বাসনে গিয়ে নির্বাচন করে ফেললো তারা। মানে দুজনের হানিমুন হয়ে গেল। দুজন গেল ফিরে এলো চারজন হয়ে। এটাই কাহিনী! বল কেমন লাগলো? আরে ব্যাটা নারী আর পুরুষ হলো চুম্বক। নির্বাচন না হলে আমি ভাবতাম সুলতানের মধ্যে গন্ডগোল আছে বুঝলি।’
অরুর নাক ফুসছে। তার আর বুঝতে বাকি নেই কিছু! দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে গেল। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,’মারজি তোর মতো অসভ্য মেয়ে আমি আর দুটো দেখিনি! জাহিল। খবরদার আমাকে কল দিবিনা। ফাজিল। ইনহিউম্যান!’
রাগে থরথর করে কেঁপে অরু কল কেটে দিল। এর পূর্বে সে মারজির সয়তানি হাসির ঝংকার শুনতে পেয়েছে। সঙ্গে ফোন সুইচড ওফ ও করল। এই মেয়েটা কতটা বাজে! কীসব চিন্তাভাবনা মাথায় নিয়ে রেখেছে! এরজন্যই তো আন্ডা পায় পরিক্ষায়। পড়াশোনা রেখে এসব ভাবলে কি গোল্ডেন পাবে? রাগ কমে যেতেই অরুর গাল দুটো জ্বলে ওঠে। মুখশ্রী থেকে গরম আভাস পাওয়া যাচ্ছে। লজ্জায় হতভম্ব সে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো।
__________
হুশিয়ার সাহেবের কল এসেছে। মোস্তফা সাহেব চিন্তিত চেহারায় কল রিসিভ করেছেন। এবং অপর পাশ থেকে যা শুনলেন, তা বিশ্বাস করার মতো নয়। তৎক্ষণাৎ চুপসে গেলেন। হাতটা সামান্য কেঁপে উঠলো। হুশিয়ার সাহেব কল কেটে দিয়েছেন খানিকক্ষণ হয়েছে। মোস্তফা সাহেব তখনো একইভাবে দাঁড়িয়ে। জবেদা বেগম চিন্তিত সুরে বললেন, ‘কি হলো?’
মোস্তফা সাহেব জবাব দিতে পারছেন না। তিনি ঠিক কিভাবে বলবেন বুঝতে পারছেন না। তবে বলতে তো হবে৷ এভাবে চুপ করে থাকলে তো চলবে না৷ স্ত্রীর দিক চাহনি নিবদ্ধ করে বললেন,’কলি সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছে।’
জবেদা বেগমের হাতে কাঁচের গ্লাস ছিল। সেটা শব্দ করে মেঝেতে পড়ে গেল। ভেঙেচুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে। সেই শব্দে ড্রয়িংরুমে অনেকে ছুটে এসেছে। এমনকি শাবিহা! সে কথা বলছিল অয়নের সাথে।কি ঘটেছে শুনে স্তব্ধ খেয়ে বসলো। দেখতে পেলো জবেদা বেগম হন্তদন্ত ভঙ্গিতে নিজের রুমে চলে গেলেন। এখনই সিলেটের উদ্দেশ্যে বেরোবেন হয়তো। মোস্তফা সাহেবও ছুটেছেন। শাবিহা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে এলো। অয়ন তখনো সমানে কল দিয়ে চলেছে। হঠাৎ কল কেটেছে তাই হয়তো চিন্তা করছে। সে প্রথমে তাকে কল ব্যকা করে বলল, ‘পড়ে কল করছি।’
‘কিছু হয়েছে?’
‘হ্যাঁ! ফ্যামিলি প্রব্লেম।’
‘আচ্ছা। সমস্যা হলে আমাকে জানাও।’
‘হু।’
কল কেটে সে বারান্দায় চলে এলো। এখন তার তন্ময়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু তন্ময়ের ফোন বন্ধ। সুইচডওফ বলছে। অরুর ফোন ও সুইচড ওফ। এই দুই ব্যক্তি ফোন সুইচড ওফ করে কোন ক্ষেতে কাজ করছে? বিরক্তে শাবিহার মাথাটা ধরে এলো।
_____________
শীতকালে বৃষ্টি সচরাচর হয়না। তবে প্রকৃতির হিসেব আলাদা। এই প্রকৃতি সবসময় ক্যালেন্ডার ফলো করে থাকেনা। যেমন হুট করেই আকাশের গর্জন শোনা যাচ্ছে। দ্রিম দ্রিম বজ্রপাতের শব্দ ভেসে আসছে। অরু দু একবার কেঁপে উঠেছে। ছোট থেকে একা থাকা তার অভ্যাস। এমন বজ্রপাতের শব্দে কখনো ভয় পায়নি। তবে আজ ভিন্ন। এটা তার নিজের বাড়ি নয়। আর সাথে তার পরিবার নেই। মনের মধ্যে খচখচ করছে। এমন সময় ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে কেমন হয়? বেশ বাজে! এমন সেটাই ঘটেছে। প্রখর শব্দে বজ্রপাত হলো এবং সঙ্গে হুট করেই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। চোখ ধোঁয়াশা অন্ধকার। মৃদু স্বরে চিৎকার করেছে অরু। সেলফোন খোঁজার চেষ্টা করলো। পেলো না। পরপর অনুমান করে অন্ধকারে ছুটে গেল দরজার দিক। দরজা খুলে ভয়ার্ত গলায় ডাকল, ‘তন্ময় ভাই!’
তন্ময়ের জবাব সঙ্গে সঙ্গে এলো,’হু। এইযে আমি।’
যেমন সে অরুর সামনেই। অরু হাতড়ে কিছুটা এগোতেই তন্ময়কে ছুঁতে পেল। যা হাতের সামনে এসেছে ধরলো। এবং সেটা তন্ময়ের প্রসস্থ বুক। তন্ময় পুনরায় বলল, ‘হোটেল থেকে কল এসেছে। সমস্যা দেখা দিয়েছে উপরের সেকশনে বজ্রপাতের কারণে। চলে আসবে ইলেকট্রিসিটি কিছুক্ষণের মধ্যে। ভয় লাগছে?’
‘না এখন লাগছে না।’
বলেই অরু চুপ মেরে গেল। খুব লজ্জা লাগছে তার। তন্ময়কে ছেড়ে দিল। ছেড়ে আবার ভয়ও পেতে লাগলো। দেখা যাচ্ছে না। ভয় তো পাবেই। আবছা যে দেখবে তারও উপায় নেই। অরু ধীর স্বরে বলল, ‘লাইট জ্বালান।’
‘সেলফোন কোথায় যেন রেখেছি। দাঁড়া খুঁজে আসি।’
‘না। আমি সাথে যাই চলুন।’
অরু এগোতে চাইল। তবে উপলব্ধি করলো তন্ময় একইভাবে দাঁড়িয়ে। নড়ছে না। কেন? অরুও দাঁড়িয়ে রইলো কাঠকাঠ হয়ে। সে ভয় পাচ্ছে নাকি নার্ভাস ঠিক বুঝতে পারছেনা। কিন্তু কিছু একটা অদ্ভুত অনুভব করছে। খুব অদ্ভুত। উত্তেজনা, ভালোলাগা, ভয়, নার্ভাসনেস সব মিলিয়ে জড়সড় হয়ে পড়েছে। অরু আনমনে তন্ময় থেকে সরে গেল। খুব করে সরে দাঁড়ালো। অন্ধকারের ভয় কেন যেনো হুট করে চলে গেল। এখন অন্য এক ভয় মাথায় চেপেছে। বুকের উঠানামার গতি বেড়েছে। সাথে শ্বাসপ্রশ্বাদের নিয়ম। নিস্তব্ধতা চারপাশে। কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতায় অরুর শ্বাসপ্রশ্বাস নর্মাল হতে লাগলো। এমন সময় সে নিজের সামনে আরেকটি দেহের উপস্থিতি অনুভব করলো। দেহের সাথে দেহের সংঘর্ষ হতেই, অরু মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘তন্ময় ভাই?’
যেমন এই অন্ধকারে সে শিয়র নয়, এটা তন্ময় কিনা। সময় নিয়ে জবাব এলো, ‘তন্ময়।’
খানিক কেঁপে উঠলো অরু। ভীতিকর কদমে পেছনে চলে এলো কয়েক পা। এই গলার স্বর সে চিনতেই পারছে না। একটা মানুষের গলার স্বর কতটা পরিবর্তন হলে, এমনটা হয়? তার সামনে এক ভিন্ন তন্ময় যেমন। তবে অচেনা নয়। সে এই তন্ময়কে দুবার দেখেছে। সেবার তার রুমে মাতাল অবস্থায়। দ্বিতীয় বার ছাঁদে। সে হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করছে কিছু একটা অঘটন ঘটবে ইলেকট্রিসিটি এখনই না আসলে। পিছুপা হয়ে এক মিনিটের স্বস্তি পেয়েছে অরু। তবে এরপর সেই দেহের সংঘর্ষ পুনরায় অনুভব করলো। এবার ঘনিষ্ঠ ভাবে। প্রখর ভাবে। অরু চেঁচিয়ে তন্ময়কে ডাকতে চাইল। কিন্তু পারলো না। কোমরে শক্ত ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলো৷ গলায় দাঁড়ির খোঁচা খেল৷ চুলে টান অনুভব করলো। কানে ঠোঁটের স্পর্শ। অরু নড়েচড়ে উঠলো। তন্ময়কে সরাতে তার বুকে দু’হাত রাখল। তীব্র ভবে অনুভব করতে পেলো তন্ময়ের বুকের উঠানামার গতি। গলা শুকিয়ে গেল অরুর। তন্ময়ের নেওয়া ঘনঘন নিশ্বাস তার ঘাড়ে পড়ছে। পরপর সেখানে নরম ঠোঁটের বিচরণ। অরু মরতে থাকা প্রানীর মতো হাসফাস করতে শুরু করলো। এক অদ্ভুত টান মস্তিষ্ক খালি করে দিয়ে গিয়েছে। বুঝতে চাইছে না আর কোনোকিছু। পুরো পৃথিবী অচেনা এবং অজানা হয়ে গেল৷ সামনে শুধু তন্ময়কে অনুভব করতে পারছে। এমন সে মনের এক কোণায় চাচ্ছে, এই অনুভূতি শেষ না হোক। অরুর কম্পিত হাত তন্ময়ের পেছনে চলে গেল। খুব কাঁপছে তার হাত৷ তাদের এই ঘনিষ্ঠতা ঠিক কতটা মাদকতায় ফেলেছে তাকে তা ভাষায় প্রকাশ্য নয়। তন্ময়ের রুমের দরজা খোলা। বারন্দা থেকে স্পষ্ট ভেসে আসছে বৃষ্টির শব্দ। ঠান্ডা হাওয়া। এই আবহাওয়া যেনো আগুনে কেরাসিন ঢেলে দিয়েছে এমন। উত্তপ্ত তন্ময়ের স্পর্শ গাঢ়তর হয়ে গিয়েছে। অরুর কোমরে ঠোঁট নিতেও সময় লাগলো না তার। তার একেকটি স্পর্শ অধীর আকাঙ্খার, আদূরে। কথায় আছে অনুভূতির রাজ্যে হারালে পুরুষ মানুষের আকুতির দেখা মেলে। ভুল নয়। এইযে অরু যখন চোখজোড়া ঠাটিয়ে বন্ধ করে রেখেছে। ছটফট করে কয়েকবার অনুভূতি থেকে দূরে যাবার চেষ্টা করছে, সে’সময় অস্পষ্ট গভীর স্বরে তন্ময় বলল, ‘নড়ে না জান! প্লিজ!’
থমকানো, বিমুঢ় অরু মুর্তি বনে গেল।
বিশ মিনিট সময় নিয়েছে ইলেকট্রিসিটি আসতে। যখন এসেছে ঘটনা অনেকটাই হাতের বাইরে। তন্ময় হুট করে থেমে গেল। যেমন ইলেকট্রিসিটির সাথে তার মস্তিষ্ক ফিরে এসেছে। সম্পুর্ন শরীর থমকে গেল তার। ভেজা নয়নে চোখ বন্ধ করে থাকা অরুকে দেখে, সে আরও তাজ্জব বনে গেল। চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে আওড়াল, ‘শিট, শিট। শিট!”
পরপর হন্তদন্ত ভঙ্গিতে উঠে গেল। মেঝেতে পড়ে থাকা শার্ট তুলে দৌড়ে ছুটে গেল নিজের রুমে। শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। অরু তখন উঠে বসলো। চোখজোড়া লাল তার। তন্ময়ের দরজায় তাকিয়ে রইলো। এখনো শ্বাসপ্রশ্বাস রুদ্ধ। সময় নিয়ে নিজেও নিজের রুমে চলে এলো। ঠিক কতটা লজ্জায় পড়েছে তা বলার মতো নয়। তার এখন পৃথিবী থেকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
_________
সকাল সকাল অরুর দরজায় করাঘাতের শব্দ। ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে অরু উঠে বসলো। মাথা বিপুল পরিমাণে ব্যথা করছে। খুব চোখে লাগছে রুমের আলো। সে কিছুক্ষণ মাথা ধরে বসে রইলো। অগ্রাহ্য করল দরজার করাঘাত। ধীরে ধীরে গতকাল রাতের সবকিছু পরিষ্কার ভাবে, মাথায় স্যাট হলো। মুখ থুবড়ে পড়লো বিছানায়। অস্পষ্ট মৃদু স্বরে চিৎকার করলো। এই মুখ সে কীভাবে দেখাবে? ঠিক কিভাবে? দরজায় আবারো করাঘাত। এবার তন্ময়ের গলার স্বর ও ভেসে এলো, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আয়৷ ফাস্ট!’
অরু মুখ অন্ধকার করে বসলো। মানুষটার মধ্যে লাজলজ্জা নেই নাকি? এমন একটা ঘটনার পর এমন বুক ফুলিয়ে কিভাবে কথা বলতে আসে?
অরু ফ্রেশ হয়ে বিড়াল ছানার মতো বেরিয়েছে ঘন্টা লাগিয়ে। মাথা এতটাই নত যে মুখ দেখা দ্বায় হয়ে পড়েছে। খেয়াল করলো তন্ময়ের সাথে ম্যানেজার সুমন উপস্থিত। দুজন কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছে। কোথাও যাবে হয়তো। অরু পিছুপিছু মাথা নত করে গেল। পার্কিং লটে গাড়ির সামনে এসেও মাথা নত করে রেখেছে। গাড়িতে উঠে পেছনে বসেছে। মাথাটা ঘুরিয়ে রেখেছে। লজ্জায় হতভম্ব সে এখন তন্ময়ের দিক তাকাতেও পারছেনা। সুমন সাহেব তন্ময়ের সাথে বসে। তিনি ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,’স্যার আর ইউ শিয়র? মানে এটা সাধারণ বিষয় নয়। একা এভাবে.. ঠিক হচ্ছে কী!’
তন্ময়ের জবাব এলো না। অরু ভালোভাবে শুনতেও পেলো না কিছু। সে তখনও নিজের দুনিয়া নিয়ে বড়োই ব্যস্ত। গাড়ি থেমেছে আধঘন্টা পর। তন্ময় বেরোতেই অরু বেরোলো। ছোটছোট পায়ে সামনে অগ্রসর হতে গিয়ে চারপাশে নজর বোলালো। অফিস? বিল্ডিং? এটা কোথায়? অরু কিছুই বুঝতে পারলো না৷ অজানা সে তন্ময়ের ইশারায় চলল। একটি অফিস রুমের মতো। চেয়ারে টুপি পরে একজন বয়স্ক চাচা বসে। দাঁড়িগোফ সাদ ধবধবে। পাশে দু একজন অজানা মানুষও দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে ফুলের মালা এবং আরও হাবিজাবি কতকিছু। কথাবার্তায় বুঝা গেল লোকগুলো সুমন সাহেবের ভাইপো। তাদের মধ্যে কথাবার্তা হলো। কথাবার্তা সেড়ে তন্ময় চেয়ারে গিয়ে বসলো। অরুকে বসতে ইশারা করলো। চেয়ারে বসে অরুর নেমপ্লেটে চোখ গেল। যা টেবিলের কোণায়। বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ‘কাজি অফিস।’
থমকে গেল অরু। বিষ্ময় নিয়ে পাশে তাকাল। তন্ময়ের হেলদোল নেই। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘যা করতে বলা হবে, কর।’
অরুর কোনোকিছু বিশ্বাস হলোনা। সে পাথরের মতো বসে রইলো। লজ্জাসংকোচ ভুলে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে রইলো তন্ময়ের দিক।
_______
মালা পরিহিত অরু গাড়িতে বসে। স্তব্ধ তার চাহনি। তন্ময় স্টেরিংয়ে মাথা দিয়ে রেখেছে। লাগাতার ফোন বাজছে। রিসিভ করছে না। একসময় রিসিভ করলো। শাবিহার কল। রিসিভ করতেই, শাবিহা বলে উঠলো, ‘ভাই বিয়েটা কি করে ফেলেছিস? তোকে বলেছি এবং আবারও বলছি। অরুকে এখনই বিয়েটা করে ফেল৷ যা অবস্থা বাড়ির, মনে হচ্ছে জোরজবরদস্তি কিংবা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে হলেও তোর গলায় কলিকে ঝুলিয়ে দিবে। এই মেয়ে তোর জন্য সুইসাইড এটেম্পট করেছে। বুঝতে পারছিস নানা, নানী কিংবা মা কি চাইবে তোর থেকে?’
অরুর আজ বিষ্ময়ের দিন। সে শুধু ক্লান্ত ভঙ্গিতে শুনে গেল শাবিহার কথাগুলো। কতকিছু হয়ে গেল সে কিছুই জানেনা। ক্লান্ত অরু সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে ফেলল। মানসিক ক্লান্তি সবচেয়ে ভয়ানক ক্লান্তি!
চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক!’
_______________প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল
৩৭.
বিয়ে হল একটি সামাজিক বন্ধন। আবার বলা যায় বৈধ চুক্তি! যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। শুধু দাম্পত্য সম্পর্ক নয় সাথে দুটো পরিবারের বিশেষ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। বিয়ে নিয়ে পরিবারের থাকে হাজারো স্বপ্ন, সখ, আহ্লাদ, ইচ্ছে। ছেলে কিংবা মেয়ের বিয়েতে বাবামা, আত্নীয় স্বজন অনেকেই অনেক কিছু করার স্বপ্ন বুনে থাকেন। তাই অবশ্যই বিয়েটা একান্ত ভাবে সেড়ে ফেলার মতো বিষয় নয়। শাহজাহান পরিবারের মতো সুনামধন্য পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য তো অবশ্যই নয়। তাদের জন্য কাজি অফিসে একান্ত গিয়ে বিয়ে করা আর গলায় ছু*রি তাঁক করা একই বিষয়। ব্যাপারটা সুমন সাহেব বড্ড ভালোভাবে বুঝে গিয়েছেন। এবং বেশ এলোমেলো হয়ে পড়েছেন। প্রেসার বেড়ে গিয়েছে তার। হাসফাস করছে বুক। তন্ময়ের পারমিশন পেয়ে গোসল ও করে নিয়েছে। তবুও দম বন্ধ হয়ে আসা অনুভূতি থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। চিন্তিয় তিনি যেকোনো সময় হার্টএট্যাক করে ফেলতে পারেন। কী জবাব দিবেন সে মোস্তফা সাহেবকে?সেই তো গার্ডিয়ানের সাক্ষর দিয়েছে। সবকিছু স্ব-চোক্ষে হতে দেখেছে। সবকিছুই সে করেছে নিজ দু’হাতে। এগুলো নিশ্চয়ই মোস্তফা সাহেবের কানে পৌঁছে গিয়েছে! নাহলে এমন পাগলের মতো কলের উপর কল কেন করবেন! এইযে দুইশো ছাপ্পান্ন কল ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। কলের নাম্বার দেখেই গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ তার। কপালে হাত চেপে সোফায় বসে পড়লেন শব্দ করে। স্বেচ্ছায় এই কি জ্বালা কাঁধে নিলেন। চাকরি তো যাবে সাথে প্রাণ খানাও। অসহায় দৃষ্টিতে তন্ময়ের দিক তাকালেন। তন্ময় লাঞ্চ করছে ডাইনিংয়ে বসে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে এতবড় তান্ডব করেছে। ছেলেটা কী বুঝতে পারছে সে কী করেছে? কতটা ভয়ানক কাজ করেছে? এদিকে সুমন সাহেব স্পষ্ট পাশের রুম থেকে অরুর অস্পষ্ট কান্নার শব্দ শুনতে পারছেন। মেয়েটা নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে! সেই সকাল থেকে অনবরত কেঁদে চলেছে। পানি পর্যন্ত গলায় দেয়নি। হুট করে কি হয়ে গেল! কোথাকার জল কোথায় এসে গড়ালো। তিনি অসহায় সুরে তন্ময়ের উদ্দেশ্যে বললেন,’স্যার মামণী না মানে..মেয়েটাকে.. মানে ম্যামকে থামাবেন না? সকাল থেকে কিছুই খায়নি! অনবরত কাঁদছে।’
‘সুমন সাহেব!’
‘জি স্যার!’
‘আমার মনে হয় আপনার নিজেকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত।’
‘স্যার আমার চাকরি কী থাকবে?’
তন্ময় টিস্যুতে হাত মুছতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সাবলীল গলায় বলল,’আমার থাকলে আপনার ও থাকবে।’
সুমন সাহেব অন্ধকার মুখে মিনমিন সুরে আওড়ালেন,’আমার চাকরি আর প্রাণ দুটোই গেল বলে!’
‘এক্ষুনি বেরোতে হবে। সঙ্গে আসছেন তো?’
সুমন সাহেব মাথা দোলাল। না যেয়ে উপায় আছে বুঝি? ঝামেলা তো তাকে ঘিরে। সে না গেলে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। সুমন সাহেব নিজের অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন আপাতত। কিন্তু তার মধ্যে এতটুকু সাহস নেই মোস্তফা সাহেবের সামনাসামনি হবার।
তন্ময় অরুর রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কয়েকবার করাঘাত করেছে। কষাঘাতের শব্দে অরুর কান্না থেমেছে। তবে সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তন্ময় পুনরায় করাঘাত করল। গম্ভীর স্বরে
বলল, ‘ল্যাগেজ গুছিয়ে নে৷ এক্ষুনি বেরোবো।’
ভেতর থেকে অরুর বিষন্ন কন্ঠের স্বর শোনা গেল, ‘আমি যাবো না। একদম যাবো না।’
‘দরজা খোল। অরু!’
‘যাবো না।’
‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে আয়। আমি এসে যদি দেখি তুই রেডি!’
কথাটুকু বলে সে ব্যস্ত পায়ে নিজের রুমে ঢুকে গেল। ড্রয়িংরুমে সাধারণ সুমন সাহেব বসে রইলেন মাথা নত করে। মোস্তফা সাহেবের কল পুনরায় আসছে। এটা নিয়ে ছাপ্পান্ন হবে। এই কল কী ধরবেন? ধরে কেঁদেকেটে মাফ চেয়ে নিবেন এখনই?
_____________
গতকাল রাতের ঝুম বৃষ্টির আভাস প্রকৃতেতি এখনো বিদ্যমান। রাস্তাঘাট, গাছপালা সবকিছু ভেজাচ্ছন্ন। সাথে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। শীতল আবহাওয়া। যাবো না বলতে থাকা অরু, শরীরে চাদর পেঁচিয়ে গাড়িতে বসে। তার পাশের জানালার কাঁচ নামানো বিদায়, হাওয়া এসে সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে দিচ্ছে। এতো সুন্দর আবহাওয়া অথচ সে উপভোগ করতে পারছেনা। ভয়ে জড়সড় হয়ে গিয়েছে হৃদয়। হাতপা ঠান্ডা হয়ে আছে। ঠিক কি রেখে কী নিয়ে ভাববে মাথায় আসছে না। মস্তিষ্ক বড্ড ফাঁকা। রাতে সেলফোন বন্ধ করেছে এখনো খোলেনি। বাবা-মা, চাচ্চু, বড়ো মা, ছোট চাচ্চু, চাচী তারা নিশ্চয়ই অরুর উপর নিরাশ হবেন। বকবেন হয়তো মারবেন ও! চিন্তিত অরু তন্ময়কে ভিষণ ভাবে অগ্রাহ্য করলো। তাকাল না অবদি। বাইরে তাকিয়ে রইলো। বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপছে। কপালে হাত ছোঁয়াল। গরমে কপাল পুড়ে যাবার যোগাড়। জ্বর আসছে মনে হয়। অরু নিরুপায় ভঙ্গিতে মাথাটা সিটে হেলান দিয়ে রাখল। তাদের কী মেনে নিবে পরিবার? এর উপর একটি বাজে সিচুয়েশন ঘটেছে। কলি সুইসাইড করেছে। তন্ময়ের জন্য। যেই তন্ময় এখন তার ভাই নয় তার স্বামী! তার জীবনসঙ্গী! কি হবে! কি বলবে!
সিলেটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত সন্ধ্যা ছ’টা। গাড়ি মৌলভীবাজার জেলায় পৌঁছে, খান বাড়ির উদ্দেশ্যে না গিয়ে সোজা মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছুটেছে। তন্ময় দ্রুত পায়ে বেরিয়েছে। পিছু পিছু অরু এবং সুমন সাহেব ও যাচ্ছেন। সুমন কিংবা অরু দুজনের একজনের ও পায়ের গতি নেই। ধীরেসুস্থে এগোচ্ছেন। এদিকে তন্ময় তার পূর্বের রূপে সাচ্ছন্দ্যে হেঁটে অগ্রসর হচ্ছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সে হারিয়ে গেল অরুর চোখের সামনে থেকে। অরুর চোখের সামনের সবকিছু ঝাপসা লাগছে। দেখতে পারছেনা চারিপাশ। যতটা এগোচ্ছে সঙ্গে কেঁপে উঠছে বুকের ভেতর।
মোস্তফা সাহেব ব্যস্ত পায়ে করিডরে হাঁটছেন। দূর থেকেই তার চারিপাশে এক অদ্ভুত ভয়ংকরী আভাস ঘুরঘুর করছে যেন। কাছে ঘেঁষার সাহস পাওয়া মুশকিল। হুশিয়ার সাহেবকে তার থেকে কিছুটা দূরে দেখা যাচ্ছে। চোখমুখ শক্ত। ওহী সাহেব কপালে আঙুল চেপে বসে আছেন। আনোয়ার সাহেব উৎসুক দৃষ্টিতে চারপাশ তাকাচ্ছেন। কারো আসবার কথা যেমন! তাদের এমন করুণ অবস্থার একটাই কারণ হতে পারে। নিশ্চয়ই তারা জেনেছেন অরু তন্ময়ের বিয়ের ব্যাপারটা। তন্ময়কে দেখে মোস্তফা সাহেবের পা থেমে গেল। দৃষ্টি স্থির হলো। তার নেওয়া ঘনঘন রাগী শ্বাসপ্রশ্বাসের দেখা মিলছে, বুকের উঠানামার গতিতে। বাকরুদ্ধ, হতভম্ব হুশিয়ার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে। বৃদ্ধ তার হাতে শক্ত মজবুত লাঠি। তন্ময় সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছে। যেমন কোনো গুরুতর বিষয় ঘটেনি সেভাবে প্রশ্ন করলো,’কি অবস্থা কলির?’
তার বাচনভঙ্গি স্বাভাবিক। অত্যন্ত স্বভাবিক! তন্ময়ের গলার স্বরে পেসেন্ট রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন জয়া বেগম, মোজাহিদ সাহেব। পরপর আরও অনেকেই বেরিয়েছে। লম্বা করিডর মুহুর্তে তাদের পরিবারের একেকটি সদস্যের দ্বারা জ্যাম হয়ে গেল। মোজাহিদ সাহেব অত্যন্ত রেগে। মুখমণ্ডল লাল এবং কঠিন। তিনি তেড়েমেরে এগোলেন। কিছু বলবেন পূর্বেই হুশিয়ার সাহেব বললেন,’এখানে কোনো কথা নয়। বাড়ি ফিরে নেই তারপর।’
গুরুজনের কথায় অবস্থা কিছুক্ষণের জন্য ধামাচাপা দেওয়া গেল। তবে কতক্ষণের জন্য? অরু দুরুদুরু পায়ে এসেছে। তাকে দেখে আনোয়ার সাহেব ছুটে গেলেন। চোখমুখে তার চিন্তার ছাপ। পিছু গেলেন সুমিতা বেগমও। কিন্তু তার মুখে ক্রোধ। চিন্তার ছিটেফোঁটা আপাতত অবশিষ্ট নেই। আনোয়ার সাহেবের পূর্বে মেয়ের কাছে চলে এলেন। স্পষ্ট শব্দে চড় বসিয়ে দিয়েছেন মেয়ের গালে। চড়ের শব্দ এতটাই প্রগাঢ় যে উপস্থিত সকলে শুনতে পেল। আনোয়ার সাহেব তাজ্জব বনে গেলেন। তার পায়ের গতি থেমে গেল মাঝপথে। মেয়েকে গিয়ে ধরতে অবদি পারেননি এখনো। সুমিতা বেগম আবারো হাত তুলবেন যেমন। তন্ময় খুব দ্রুত পায়ে অরুকে নিজের পেছনে টেনে নিয়েছে। অরু ততক্ষণে নিজের গাল ধরে রেখেছে। দুচোখের পাতায় অশ্রু টলটল করছে। ব্যথিত নয়নে মায়ের পানে তাকিয়ে সে। মানছে ভুল করেছে। এরজন্য এতগুলো মানুষের সামনে চড় মারবে বুঝি? সুমিতা বেগম তন্ময়ের দিক তাকালেন। তন্ময়ের চেহারায় কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে খুব দৃঢ় গলায় বলল, ‘এভাবে ওকে মারবেন না চাচী। আমার পছন্দ না। কথাবার্তা যা হবে পড়ে। এখানে সিনক্রিয়েট করবেন না।’
মোস্তফা সাহেব বুক ধরে চেয়ারে বসে পড়েছেন। খু খু শব্দে কেশে উঠলেন। তিনি অবিশ্বাস্য চোখে ছেলের দিক তাকিয়ে। বিশ্বাস করতে পারছেন না যা তিনি শুনেছেন এবং যা তার সামনে ঘটছে।
___________
হাত কাঁ’টার সামান্য চেষ্টা। অতটা গাঢ়তর ভাবে হাতের নলি কা’টতে পারেনি। কিছুটা কেটেছে। মুলত ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। রিস্ক থেকে মুক্ত। কলিকে বাড়িতে নেওয়ার পারমিশন দেওয়া হয়েছে হাসপাতাল থেকে। রাত দশটার মধ্যে খান বাড়িতে পৌঁছেছে সকলের গাড়ি। মেয়েকে মোজাহিদ সাহেব ধরে ভেতরে নিচ্ছেন। সোজা রুমে গিয়ে শুইয়ে দিয়েছেন। স্ত্রীকে মেয়ের পাশে রেখে বেরিয়ে এসেছেন। ইতোমধ্যে সকলে উপস্থিত বৈঠক ঘরে। এমনকি সুমন সাহেব ও। তিনি যথাসম্ভব নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে। এমতাবস্থায় চোখ রাঙিয়ে তার দিক তাকিয়েছেন মোস্তফা সাহেব। সেই চাহনিতে রয়েছে আগুনের ফুলকি। থরথর করে কেঁপে উঠে তিনি ডাকলেন, ‘স্যার!’
মোস্তফা সাহেব বুকে হাত চেপে আছেন। চোখজোড়া কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করলেন। নিজের ত্যাড়া ছেলেকে জিজ্ঞেস করার থেকে উত্তম ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করা। তিনি চোখজোড়া খুলে কোনোরকমে প্রশ্ন করলেন সুমন সাহেবকে,’মাহবুব সাহেব যা বলেছেন তা কী সত্য?’
মাথা নত করে আছেন সুমন সাহেব। ভীত ছোট গলায় জবাব দিলেন, ‘আজ্ঞে জি স্যার!’
মোস্তফা সাহেব হাঁসফাঁস করে উঠলেন। অরু ফ্রিজ থেকে একটি ঠান্ডা পানির বোতল হাতে সোফায় বসেছে। ঢকঢক শব্দে পানি খেয়ে বোতল টি-টেবিলে রাখল। বাবার উদ্দেশ্যে বলল,’বিয়েটা আমি করেছি। সুমন সাহেব নন।’
‘তন্ময়!!’
চেঁচিয়ে উঠলেন মোস্তফা সাহেব। তিনি দাঁড়িয়ে গিয়েছেন রাগে। ভয়ে অরু কেঁপে নিঃশব্দে কেঁদে উঠেছে। সে আনোয়ার সাহেবের পেছনে দাঁড়িয়ে। আনোয়ার সাহেব বিন্দুমাত্র রেগে নন। আসলে সে রাগবেন নাকি হাসবেন বুঝতে পারছেন না। মানে তিনি রাগান্বিত হবার কোনো কারণ দেখছেন না। তন্ময় ভালো ছেলে। ঘরের ছেলে। নিজের মেয়ের জন্য উত্তম পাত্র যা তিনি স্বপ্নেও পাওয়ার কথা ভাবেননি। সে ছেলে স্বেচ্ছায় তার মেয়ে বিয়ে করেছে। এখন থেকে মেয়ে তার সারাজীবন নিজের কাছে থাকবে। আপন হয়ে। এটা তো দুঃখের বিষয় নয়। বরং তার মনে হচ্ছে এরথেকে উত্তম কিছু আর হতেই পারেনা।
হুশিয়ার সাহেব শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলেন। ঠান্ডা মাথা শুধালেন,’এভাবে হুট করে বিয়ে করার মানে কী তন্ময়? পরিবার নেই তোমার? কারো রায় নেবার প্রয়োজন বোধ করলে না! কেন?’
মোজাহিদ সাহেব নিজেকে চুপ রাখতে পারলেন না। চেঁচিয়ে উঠলেন,’আমি তো দেখছি সব দোষ এই মেয়ের। আমি শুনেছি তো! এই মেয়ে ইচ্ছে করে সঙ্গে গিয়েছে তন্ময়ের। ওর মাথা খারাপ করে দিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। আমার মেয়ে কলি এসেই বলেছে, এই মেয়ের সম্পর্কে! দুশ্চরিত্রা! এই মেয়েই আমার মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।’
হতবাক হয়ে পড়েছেন মোস্তফা সাহেব। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছেন মোজাহিদ সাহেবের দিক। তারপর তাকালেন হুশিয়ার সাহেবের দিক৷ তারপর নিজের স্ত্রীর দিক। এসব কথা তিনি মোটেও শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। হুশিয়ার সাহেব শব্দ করে ছেলেকে চুপ থাকতে বললেন। এরমধ্যে যা বলার তা বলে ফেলেছেন মোজাহিদ সাহেব। তন্ময় স্তব্ধ মেরে বসেছিল। এবার উঠে দাঁড়ালো। মোজাহিদ সাহেবের চোখে চোখ রেখে তাকাল। লাল হয়ে চোখের সাদা অংশটুকু। ক্ষিপ্ত মুখশ্রী। মোস্তফা সাহেব ছেলেকে আটকানোর সামান্য প্রচেষ্টা করলেন। পূর্বেই তন্ময় বলে ফেলেছে, ‘আপনি যার সম্পর্কে কথা বলছেন সে আমার স্ত্রী। মুখ সামলে কথা বলবেন।’
আনোয়ার সাহেব নড়ে উঠলেন। হাতের শক্ত মুষ্টিবদ্ধ ঢিল হলো। আটকে রাখা প্রখর শ্বাস ফেললেন। লাল চোখজোড়া কিছুটা শান্ত হলো। কিন্তু রাগে থরথর করে কাঁপতে শরীর এখনো গরম। অরু বাবার হাত চেপে ধরেছে। নিঃশব্দে কান্নায় ভেঙে পড়েছে সে। মোস্তফা সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। শক্ত গলায় বললেন, ‘ভুল আমার হয়েছে। আমাদের পরিবারের বিষয় এখানে তোলা ঠিক হয়নি। ছেলে আমার ভাতিজিও আমার। তাদের নিয়ে কথা বলার অধিকারও আমার। আমরা নিজেরাই হ্যান্ডেল করে নিব, বাবা। আসছি! নাতির বিয়ে খেতে চলে আসবেন। চলো জয়া!’
তিনি একমুহূর্ত দাঁড়াননি। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন। ছেলের উপর যত রাগ ছিলো সব উবে গেল। একরাশ যন্ত্রণা দিয়ে গেল বুকে। নিজের বাড়ির মেয়ে সম্পর্কে এসব কথা তিনি বরখাস্ত করবেনা না। ওহী সাহেব তার ভাই আনোয়ার সাহেবের কাঁধে হাত রাখলেন। অরুকে সহ সদরদরজার দিক এগোলেন। হুশিয়ার সাহেব উদ্ধিগ্ন সুরে মোস্তফা সাহেবকে ডেকে চলেছেন। কাজ হলো না। মোজাহিদ সাহেবও আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। জয়া বেগমও আর আশপাশ তাকালেন না। বাবামায়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলে তিনিও বেরিয়ে পড়লেন।
চলবে~
‘নাবিলা ইষ্ক’
______________