প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল
৪০.
ড্রয়িংরুমে তাড়াহুড়ো পায়ে দৌড়াচ্ছে অরু। একবার সুমিতা বেগমের পেছনে লোকাচ্ছে তো আরেকবার জয়া বেগমের পেছনে, নাহলে মুফতি বেগমের পেছনে। তন্ময় টিশার্ট টাউজার পরে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। খুব ধীরেসুস্থে আসছে। তার ডান হাতে নেইলকাটার। শব্দ করছে কাটার দিয়ে। অরু পুনরায় ভনভন করে উঠলো মাছিদের মতো। হট্টগোলের কারণে আনোয়ার সাহেবও উপস্থিত হলেন। আজ সকলেই বাড়িতে। তাই এই বেসামাল দৃশ্য একপ্রকার সকলের সামনে অনিচ্ছাকৃত ভাবে চলে এসেছে। জয়া বেগম বিচলিত অরুকে শক্ত করে ধরলেন। শুধালেন, ‘হয়েছে কী!’
অরু জবাব দেবার পূর্বেই তার সামনে তন্ময় চলে এসেছে। দৌড়ে আনোয়ার সাহেবের পেছনে চলে গেল অরু!গম্ভীর স্বরে তন্ময় ডাকল, ‘এদিকে আয়।’
‘না!’
আনোয়ার সাহেব হাসছেন বাড়ির বাচ্চাদের বাচ্চামিতে। হেসে কারণ জানতে চাইলেন। ঠিক হয়েছে কী! দীপ্ত শব্দ করে হেসে বলল, ‘চাচ্চু আজ অরু আপুর নখ কাটা হবে।’
অরুর বা’হাতের হাতের নখ সামান্য বড়ো। খুবই সামান্য। সাদা ফকফকে নখ। অরু প্রত্যেকদিন পরিষ্কার করে রাখে। নেইলপালিশ দিলে দেখতে সুন্দর লাগে কি-না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সেই নখের কারণে আজ তন্ময়ের ঘাড় জ্বলছে। আসলে তখন তন্ময়ের বাহুতে অরু কৈ-মাছের মতো ছোটাছুটি করতে গিয়ে ঘাড়ে খোঁচা দিয়ে ফেলেছে। তৎক্ষণাৎ যায়গাটা লালচে হয়ে গেল। তন্ময় তখনই নেইল-কাটার হাতে নিয়েছে। অরুর নখ কাটবে। অরু দিবেনা কাটতে।
আনোয়ার সাহেব সরে যেতেই, তন্ময় এসে হাত চেপে ধরেছে অরুর। তাকে সোফায় বসিয়ে সে পাশে বসল। জয়া বেগম হেসে দুপাশে মাথা দোলালেন। পরপর রান্নাঘরে চলে গেলেন। বাকিরাও আর থাকল না। দীপ্ত সামনে বসে রইলো। টানটান উত্তেজনা নিয়ে গভীর ধ্যানমগ্ন হলো তাদের দেখায়। অরু তখনো চোখমুখ অন্ধকার করে আছে। তন্ময় টানটান করে অরুর আঙুল টেনে ধরেছে। নড়চড় লক্ষ্য করে ধমকে উঠলো, ‘নড়বি না। চুপচাপ বোস।’
অরু ভীষণ ব্যস্ত তন্ময়কে দেখল। নিচুস্তর গলায় মিনমিনে সুরে বলল, ‘ধরাধরি করেছে কেন! এখন সব দোষ আমার নখের!’
তন্ময় যেমন কিছুটা আন্দাজ করে নিয়েছে। সে চোখ তুলে তাকালো। অরু চুপসে গেল। তন্ময় খুব ছোট স্বরে বলল, ‘কামড় দিলে সমস্যা নেই। দাঁত কা’টব না।’
এরপর আর অরু নড়চড় করল না। থমকে বসে থাকলো। তন্ময় আরামসে নখ গুলো কে*টে চলে গেল।
____________
উত্তরায় একটি নতুন কোম্পানি খোলা হয়েছিল পাঁচ মাস পূর্বে। নতুন কোম্পানি! নামডাক তখনো উঠেনি। প্রচন্ডভাবে শেয়ারহোল্ডারের প্রয়োজন ছিলো। অনেককেই ডাকা হলো। অনেক নামকরা বিজনেস ম্যান হাজির হলো। তবে শেয়ারের দাম বেশি। এতো দামে শেয়ার কিনবে না জানালো! দিশেহারা কোম্পানির একেকজন মালিক বাধ্যতামূলক শেয়ারের দাম কমিয়েছেন। অয়ন সেসময় নিজের সর্বোচ্চ টাকা দিয়ে শেয়ার কিনে রেখেছে। আটচল্লিশ লাখ টাকার শেয়ার একাই কিনে, কোম্পানির সবথেকে শেয়ারহোল্ডারের খেতাব অর্জন করে নিল। অনেক বিজনেসম্যান তাকে বাচ্চা, নির্বোধ, মুর্খ বলেছিল! টাকাগুলো নির্ঘাত জলে যাবে বলে বেট লেগেছে একেকজন। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে, নতুন কোম্পানি তখন তেমন সাড়া না পেলেও, দু-মাসের মাথায় সাড়া পেতে লাগলো। জমিনে পড়ে থাকা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পাঁচ মাসের মাথায় কোম্পানির শেয়ারের দাম হুড়মুড়িয়ে বেড়ে গেল। এখন অয়নের আটচল্লিশ লাখ টাকার শেয়ারের দাম উঠেছে, তিন কোটি প্রায়! ব্যাপারটা মাত্রই জেনেছেন অয়নের বাবা সৈকত সাহেব। সেক্রেটারি শারমিন মাত্রই নিউজপেপার দেখিয়েছেন তাকে। নিউজপেপারে বিজনেস রিলেটেড পৃষ্ঠায় ছেলের ছবিসহ হেডলাইন দেখে আহাম্মক হয়ে গেলেন। ছ’মাস পূর্বে অয়ন হিউজ পরিমাণে টাকা নিয়েছে তার থেকে। বলেছে অফিস খুলবে। নিজের! সৈকত সাহেব রেগে যান। ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু ছেলে কথা শুনবে না। ওয়াদা দেয়, সে পাঁচগুণ বাড়িয়ে টাকা ফেরত দিবে। বিশ্বাস করেননি সৈকত সাহেব। তবুও বাধ্য হয়ে চল্লিশ লাখ টাকা দেন ছেলেকে। এদিকে সেক্রেটারী শারমিনের চাহনিতে বিষ্ময় ফুটে! সে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল, ‘স্যার আপনি জানতেন না? তারমানে কী ছোট স্যারের একার চিন্তাভাবনা এগুলো? সে কীভাবে এতো টাকা ইনভেস্ট করার মতো সাহস পেলো? চল্লিশ লাখ টাকা! যা এখন দু কোটি! বিশ্বাস করতে পারছি না এখনো!’
সৈকত সাহেব শুকনো ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দ্বারা ভিজালেন। তিনি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। ব্যস্ত পায়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার আজকের মিটিং গুলো, হোল্ডিং রাখতে বলে বেড়িয়ে পড়লেন। মাঝরাস্তায় ছেলেকে কয়েক কল করলেন। বন্ধ ফোন! বাড়ির সামনাসামনি পৌঁছাতেই অয়নের ফোন থেকে কল ব্যাক এলো। এবং সৈকত সাহেবকে বলতে না দিয়ে সে বলল, ‘বাবা৷ তুমি অফিসে নেই কেন!’
‘তুই কোথায়? অফিসে নেই আমি। বাড়ির সামনে।’
‘তোমার সাথে কথা আছে। আসছি আমি। থাকো।’
সৈকত সাহেব নরম সুরে বলতে চাইলেন ‘আয় বাবা।’ বলতে পারলেন না। ছেলে কল কেটে দিয়েছে। তবুও রাগলেন না। আজ তিনি ছেলেকে নিয়ে গর্ববোধ করছেন। উচ্ছ্বসিত মনে বাড়িতে ঢুকলেন। স্ত্রী নেই! খোঁজ করলেন না স্ত্রীর। সে আরাম করে সোফায় বসে থাকলেন। ছেলের সাথে বিজনেস রিলেটেড কথাবার্তা বলবেন। সেখানে স্ত্রী না থাকলেও চলবে। অয়ন হাওয়ার বেগে এসেছে। পাঁচ মিনিট লাগেনি। তারমানে কতটা সাংঘাতিক মাত্রায় বাইক চালিয়ে এসেছে এই ছেলে, তা বোঝার জন্য আলাদা আর ব্রেইন ব্যবহার করতে হবে না। আরাম ভাব ছেড়ে নড়েচড়ে বসলেন সোজা হয়ে। অয়ন বাবার সামনে বসেছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার সে। অস্থির ভঙ্গিতে কয়েকবার হাত ঘড়িতে চোখ বোলালো। সৈকত সাহেব মুগ্ধ নয়নে ছেলেকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন। আজ তিনি ছেলের ক্ষমতা সম্পর্কে জেনেছেন। এই ছেলেই তার বিজনেস উঁচু করে রাখবে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে মুখ খুললেন। কিছু একটা বলতে চাইলেন, পূর্বেই অয়ন উতলা সুরে বলে উঠল, ‘বাবা আমি একজনকে পছন্দ করি!’
সৈকত সাহেবের প্রসস্থ হাসির রেখা স্তব্ধ খেয়ে গেল। কয়েকবার পাপড়ি ঝাপটালেন। মুখ খুলবেন পূর্বেই অয়ন বলল, ‘আজ তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আমি সেটা হতে দিব না। তুমি এক্ষুনি গিয়ে আমার জন্য তার হাত চাইবে।’
সৈকত সাহেবের থমকে যাওয়া হাসি এবার বিলুপ্ত হওয়ার পথে। তিনি অবিশ্বাস্য নয়নে আবারো মুখ খুলতে চাইলেন, পূর্বেই অয়ন বলে দিলো, ‘আমি শাবিহাকে বিয়ে করতে চাই বাবা।’
‘ত..তুমি.. কী! শাবিহা? কোন শাবিহা!’
‘পাশের বাড়ির।’
সৈকত সাহেব আঁতকে উঠলেন। আর এক সেকেন্ডও বিলম্ব না করে বুক চেপে ধরলেন। তার শ্বাস আটকে এসেছে। এতগুলো আনইনভাইটেড অপ্রত্যাশিত তথ্য হজম করতে পারলেন না।
___________
সময় যেন পানির গতিতে চলে যায়। চোখের পলকে দুপুর গড়িয়ে বিকেলে ঠেকেছে প্রকৃতি। সোনালী আলোয় আলোকিত চারপাশ। শাবিহাকে তৈরি হতে বলে গিয়েছিলেন জবেদা বেগম। সুন্দর করে শাড়ি পরতে বলেছিলেন মুলত। রান্নাঘরের কাজ শেষ করে এসে দেখছেন, মেয়ে তার এখনো ফ্লোরে বসে আছে। ঠিক যেভাবে দেখে গিয়েছেন। ভুরু জোড়া কুঁচকে বললেন, ‘কি রে! তৈরি হচ্ছিস না কেন!’
শাবিহার জবাব নেই। সে একই ভঙ্গিতে বসে। জবেদা বেগম দু’পাশে মাথা নাড়ালেন অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে। জোর গলায় ডাকলেন, ‘অরু, রুবি! কই তোরা!’
অরু আর রুবি একত্রেই রয়েছে। দুজন আড়াল হয়ে আছে৷ কেউই শাবিহাকে তৈরি করতে যেতে চাইছে না। অরু তো কেঁদে নাক লাল কাপ ফেলেছে। রুবি ব্যস্ত পায়ে রুমে হাঁটাচলা করছে। সে জানত না, শাবিহা অয়নের বিষয়টা। সবে জেনেছে। জেনে অবাক হয়েছে ভীষণ। শাবিহাকে ভালোভাবে জানে এবং চেনে। এমন মেয়ে নিজের থেকে ছোট এক ছেলেকে মন দিয়ে বসবে, কেইবা ভাবতে পেরেছিল!
দুএকবার মুখ খুলেছে কিছু বলতে! অবশেষে কিছুই বলতে পারল না। চুপচাপ দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। শাবিহাকে অয়নের সঙ্গে ভেগে যেতে বলত! তবে সেই ডিসিশন কতটাই ভালো হত? সে-তো তেমন তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা জানে না৷ নাক কুঁচকে রুবি বলল,’কান্না ওফ কর। বড়ো মা ডাকছে। চল…’
‘শাবিহা আপু কান্না করছে!’
‘করুক।’
‘আমার তার কান্না সহ্য হচ্ছেনা!’
‘সহ্য না হলে কান আর চোখ বন্ধ করে চল।’
অরু বিষন্ন অনুভব করলো। কেউ তাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে না৷ হুয়াই! এইযে অরু কষ্টে রসমালাই খেতে পারছে না। বাড়ির আনাচকানাচ রসমালাইয়ের ঘ্রাণে ম-ম করছে। অথচ কষ্টের কারণে একটা পিস মুখে পুড়তে পারেনি এখন অবদি। সেই কষ্টে কান্নার মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। জবেদা বেগমের তৃতীয় ডাকে দুজনকে একপ্রকার বাধ্য মেয়েদের মতো যেতে হলো। তাদের ধমকের সুরে আদেশ করলেন জবেদা বেগম, ‘সুন্দর ভাবে তৈরি করে দে মেয়েটাকে। চলে আসবে তো লোকজন। তাড়াতাড়ি কর!’
মাথা দোলাল রুবি। অরু বিক্ষিপ্ত মনে শাবিহার পাশে বসেছে। শাবিহার এঅবস্থা কী দেখছে না বড়ো মা? নাকি সে চোখেই দেখে না। জবেদা বেগমের উপর চরম বিরক্ত অরু! আচ্ছা, সে কী একটা কল দিবে অয়নকে? বলবে কি খুলে সবকিছু? এইযে শাবিহা সকাল থেকে কিচ্ছুটি খেলো না। আড়াল হয়ে কাঁদল। কার জন্য? অবশ্যই অয়নের জন্য! এখন সেই অয়নকে জানাতে হবে না বুঝি? অরু মনে মনে ঠাঁই করে নিল, আজ সে অয়নকে কল করবে। কিছুক্ষণ পরেই করবে। অয়নকে খুব করে বলবে কিছু করতে।
শাবিহা উঠে দাঁড়িয়েছে। চুলগুলো কোনোরকমে হাতে পেঁচিয়ে নিল। পা বাড়ালো ওয়াশরুমের দিক। ফ্রেশ হয়ে এসে বসেছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে। রুবি চিরুনি নিয়ে ধীরে শাবিহার চুল আঁচড়ে দিতে সাহায্য করছে। অরু হাতে পেটিকোট আর ব্লাউজ নিয়ে দাঁড়িয়ে। ব্লাউজ কাজ করা! খুব সুন্দর কারচুপির কাজ। এটা জবেদা বেগমের নিজের শাড়ি। মেয়েকে এটাই পরতে বলেছেন। অরু ব্লাউজ খানা নিজে পরতে নিয়ে থেমে গেল। এমতাবস্থায় রুমের সামনে হাজির হয়েছেন জবেদা বেগম এবং লতা বেগম। লতা বেগম মুলত শাবিহাকে দেখতে এসেছেন। শাড়িটা তিনিই পরিয়ে দিবেন জানালেন। শাবিহা অস্বস্তি অনুভব করলো। লতা বেগমের পানে বেশ করে তাকাল। বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপছে। কাছ থেকে দেখতে পাওয়া অয়নের চেহারার সঙ্গে ভদ্রমহিলার কী মিল! লতা বেগম এসে শাবিহার মুখ উঁচু করে ধরলেন।’দেখি.. দেখি… মাশাল্লাহ। কি মিষ্টি। পাত্রপক্ষ এক দেখায় পাগল হয়ে যাবে নির্ঘাত।’
শাবিহার ভীষণ লজ্জা লাগলো। সে চুপচাপ লতা বেগমের ইশারায় দুলল। শাড়ি পরিয়ে ভালোভাবে তাকে দেখল লতা বেগম। ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে। চোখ ফেরানো দায়। শাবিহার বিচলিত আচরণ দেখে অরু লতা বেগমকে টেনে বিছানায় বসালো। খুব ইনিয়েবিনিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘অয়ন ভাইয়া কই?’
লতা বেগম অশান্ত সুরে বললেন, ‘ছেলেটার যে কি হলো হুট করে! রাত থেকে কেমন করছে! খাচ্ছে না, ঘুমোচ্ছে না! সামনে অনার্সের ফাইনাল। অথচ সে কী যেন নিয়ে মহা ব্যস্ত। ওর সবকিছু আমার মাথার উপর দিয়ে যায় বাবা!’
অরু পিটপিট নয়নে শাবিহার দিক তাকাচ্ছে। দেখল শাবিহা মন দিয়ে শুনছে। দুষ্টু হেসে সে শুধালো, ‘অয়ন ভাইয়াকে বিয়ে দিবেন না আন্টি?’
‘দিব তো। আমার তো একটামাত্র সন্তান। বিয়ে দিয়ে দিলে দুটো হবে৷ ভাবছি বিয়েটা দিয়ে বাড়িতে একটা মেয়ে নিয়ে আসব যত দ্রুত সম্ভব। আমার আর একাএকা পড়ে থাকতে ভালো লাগে না।’
অরু উত্তেজিত হয়ে পড়লো। কন্ঠ তটস্থ করে বলল, ‘হ্যাঁ বিয়েটা দিয়ে দিন। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখুন ভালো মেয়ে আছে। একদম ফুলপরী।’
ভাবুক হয়ে পড়লেন লতা বেগম। ভেবে বসলেন অরু নিজেকে ইঙ্গিত করে বলছে। তিনি বললেন, ‘তোর তো বিয়ে হয়ে গেছে অরু!’
অরু স্তব্ধ, বিমুঢ়! আশ্চর্য! সে কী নিজের কথা বলেছে নাকি! লজ্জায় হতভম্ব অরু চুপসে গেল। লতা বেগম উৎসুকভাবে বললেন, ‘তন্ময় কোথায়?’
‘ভাইয়া ঘরে।’
‘এই ভাইয়া কীসের! ভাইয়া ডাকবি না। তন্ময় বলে ডাকবি। দেখি ডেকে দেখা! এখান থেকে ডেকে
উঠ। ছেলেটা আসুক, কতদিন ধরে দেখিনা।’
‘পারব না।’
রুবি হঠাৎ করে দুষ্টু বনে গিয়েছে। সে হুলস্থুল হয়ে লতা বেগমের সাথী হয়েছে। দুজন মিলে অরুকে হেনস্তা করতে শুরু করলো। বাধ্যতামূলক ডাকতে হবেই হবে, বলে চলেছে! বড়দের সামনে অরু ভীষণ বিষন্ন হয়ে পড়লো। ছোট ছোট পায়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। নরম ছোট সুরে ডাকল, ‘তন্ময় ভাইয়া!’
সঙ্গে সঙ্গে রুবি অরুর মাথায় গাট্টি দিয়ে বসল। ভারী গম্ভীর স্বরে বলল,’তন্ময় হবে।’
‘আমি..আমি পারবো না।’
‘পারবি। পারবি.. ট্রায় কর!’
অরু মিনমিন ধীর সুরে বলল,’আমাকে ছেড়ে দাও রুবি আপু!’,
‘আগে ডাক তারপর ছেড়ে দিব।’
অরু কখনোই তন্ময়কে নাম ধরে ডাকেনি। বড়দের সে সর্বদাই সম্মান করে। তন্ময় তার বড়ো। বড়দের নিশ্চয়ই সে নাম ধরে ডাকবে না৷ আকাশ হলে ফাজলামো করে হলেও নাম ধরে ডাকা যেতো। কিন্তু তন্ময়! অরু এই লোককে কখনোই, নাম ধরে ডাকতে পারবে না। তার দ্বারা অসম্ভব। তবে অসম্ভব কে সম্ভব করাই রুবির কাজ। সে ইচ্ছেমতো অরুকে জ্বালালো। অবশেষে অরু চেঁচিয়ে উঠলো,’তন্ময়!’
আশ্চর্যজনকভাবে তন্ময় তখন সিঁড়ির মাথায়। সবেই নামতে নিচ্ছিল নিচে। মোস্তফা সাহেব ডেকেছেন। অরুর গলা ফাটানো ডাক শুধু সে নয়, পাশে উপস্থিত ওহী সাহেবও শুনলেন। তন্ময়ের পা জোড়া অপ্রস্তুত ভাবে সামনে চলে গেল। স্লিপ খেয়ে রেলিঙ ধরলো। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো সে! অরু পরপরই তন্ময়কে লক্ষ্য করল। আতঙ্ক মনে পরপর উচ্চ গলায়, ‘ভাইয়া!’ বলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রুবির গাট্টা ও পড়ল তার মাথায়!
___________
সময় পাঁচটা পঞ্চান্ন। পিতাপুত্র একত্রে সদরদরজার সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে। যেমন তাদের থেকে কেউ টাকা পাওনা। এক্ষুনি পরিশোধ করতে হবে যেন। নাহলে গলা কে*টে নিবে। মোস্তফা সাহেব তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, ‘আজকাল প্রতিশ্রুতি দিলেই হয়না, রাখতেও জানতে হয়। আর সবাই তা পারেনা।’
তন্ময়ের জবাব এলো না। মোস্তফা সাহেব তাতে আরও বিরক্ত হলেন। খিটখিটে মেজাজে বললেন,
‘বুকের পাঠা থাকতে হয়।’
তন্ময় মাথা ঘুরে তাকাল।খুব স্বাভাবিক স্বরে শুধালো, ‘কিছু বললে!’
মোস্তফা সাহেব ছেলেকে চোখ রাঙালেন। গম্ভীরতা বজায় রেখে পূর্বের ন্যায় দাঁড়ালেন৷ ওহী সাহেব এবং আনোয়ার সাহেব ও পাশেই আছেন। অতিথির আগমনে কোনো ত্রুটি রাখবেন না৷ একপর্যায়ে দূর থেকে একটি গাড়ি দেখা গেল। মোস্তফা সাহেব সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। গাড়ি কাছাকাছি আসতেই হুট করে ওপর পাশ থেকে আরেকটি গাড়ি চলে এলো। দুটো গাড়ি একত্রে মোস্তফা সাহেবের সামনে থামলো। একটি কালো রঙের গাড়ি আরেকটি সাদা।
___________
চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল
৪১.
অবিবাহিত জোয়ান মেয়ে ঘরে থাকলে, তার জন্য সম্বন্ধ আসা স্বাভাবিক।বিয়ের প্রস্তাব আসবেই। তবে একই দিনে, একইসাথে, একই সময় দুটো পরিবারের আগমন ঘটবে পাত্রপক্ষ হিসেবে এটা নেহাতি মস্করা! এইযে দুটো পরিবার তার চোখের সামনে রয়েছে। মোস্তফা সাহেব সোফায় টানটান হয়ে বসে আছেন৷ উত্তেজনায় বিবেকহীন হয়ে পড়েছেন। একমাত্র ছেলে সহ প্রানপ্রিয় ভাইদের পানে ঘনঘন তাকাচ্ছেন। চোখেচোখে কথা বলছেন নতুন কপোত-কপোতীদের মতো।
সামনের সোফায় স্যুট-কোটে অয়ন বসে আছে। গলায় টাই বাঁধা। হালকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গাল, থুতনি জুড়ে। চুলগুলো পেছনে জেল দিয়ে স্যাট করা। নিত্যদিনের মতো কপালে পড়ে নয়। ফর্সা বাম হাতে হাতঘড়ি ঝুলে আছে। লম্বাচওড়ায় সে পাশে বসা তার বাবাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে বছর আগেই৷ আজ আর তাকে বাচ্চা অয়ন লাগছে না। বরং গম্ভীর এবং গোপনীয়তা বুকপকেটে লুকিয়ে রাখে তেমন পুরুষ মানুষ লাগছে। অয়নের পাশে বসা সৈকত সাহেব মুড়ামুড়ি করছেন। স্ত্রী তার সামনেই দাঁড়িয়ে টিফিনবাক্স হাতে। বারংবার চোখাচোখি করতে চাচ্ছে। হয়তো জিজ্ঞেস করতে চাইবে, এভাবে আসার কারণ! কিন্তু সৈকত সাহেবের কাছে আপাতত কোনো প্রশ্নের জবাব নেই। আর না আছে চোখাচোখি করার মতো সাহস। ঘরে গিয়ে কী জবাব দিবেন স্ত্রীকে সেটাও ভাববার বিষয়! ছেলে, স্ত্রী তো তাকে মধ্যখানে ফেলে গিলে ফেলবে।
অপরদিকে মোস্তফা সাহেবের বন্ধু আশরাফুল সাহেব নিরুদ্দেশের সাগরে বহমান। তিনি পরম যত্নে হেসে চলেছেন। নিজের সামনে বসা অজানা গেস্ট নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। নিজের বড়ো ছেলে মুবিনের প্রশংসা সমানে করছেন। ছেলে কতদূর পর্যন্ত পড়েছে! ডিগ্রি কোন সাবজেক্ট নিয়ে করেছে! কোন খেলায় পুরষ্কার পেয়েছে! হেসে দুলে নিজেদের সম্পত্তির বর্ননাও করলেন। সুইজারল্যান্ডে তাদের অবস্থা কেমন! সেখানকার বিজনেস কতদূর এগিয়েছে এসব!
অন্যদিকে সৈকত সাহেব কবুতরের ন্যায় বসে। কোনো গুনগান ছেলের হয়ে করলেন না! তার সুদর্শন ছেলে একাই সেখানে সটান মেরে বসে, সকলের আঁড়চোখ গুলো কেঁড়ে নিয়েছে অনিচ্ছায়!
তিনি চুপচাপ বসে আছেন। আঁড়চোখে মোস্তফা সাহেবের দিক তাকাচ্ছেন। মোস্তফা সাহেব আগে থেকে তাদের আসার কারণ না জানলে, বুঝতেই পারতেন না এরা তার মেয়ের হাত চাইতে এসেছে! এতটুকু ছেলে আর মুখের অবস্থা দেখ! বুকের পাটা দেখ! আরে এই বয়সে মোস্তফা সাহেব ছোট প্যান্ট পড়ে, পকেটে ধুলাবালি ঢুকিয়ে ঘুরেছেন। বাবার ভয়ে, প্যান্ট ভিজিয়ে রাস্তায় দৌড়েছেন। পিতামাতার মাইরের ভয়ে দাদা-দাদীর পেছনে লুকিয়ে ফিরেছেন। আর আজকালকার জেনারেশনে ছেলেপেলে ভয় পাবে কী! এরা ভয় পাইয়ে মেরে ফেলবে বাবা-মা!
_________
মাস খানেক পূর্বের কথা। মোস্তফা সাহেব বাগানে বসে ছিলেন। আবহাওয়া ঠান্ডা। খুব আরাম করে বসে চা পান করছিলেন। মনমেজাজ বড্ড ভালো। তার আগেই ভালো প্রফিট করেছে কোম্পানি। ছেলে বিজনেসে পুনরায় হাত দিয়েছে, প্রফিট তো করবেই! অত্যন্ত খুশি মনেই পরিবেশ উপভোগ করছিলেন। তখনই উপস্থিত হলো তার ছেলে। তন্ময় কফির মগ হাতে এসেছে। বাবার পাশে বসেছে। দুজনের মধ্যে নিরবতা। একজন আরেকজনের দিক শুধুই আঁড়চোখে দেখছে। সরাসরি নয়! আর নাইবা সেধে কথা বলছে আগ বাড়িয়ে! একসময় মোস্তফা সাহেব গম্ভীরমুখে শুধালেন, হয়েছে কী! তন্ময় খুব সাবলীল গলায় বলেছিল, ‘তোমার বুকের ব্যথাটা আছে এখন?’
মোস্তফা সাহেবের মুখের গম্ভীরতা বেড়ে গেল হাজার গুনে। তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেললেন ছেলে তার বুকের ব্যথাটা নির্ঘাত বাড়াতে এসেছে। মৃদু ভয়ে তিনি আর প্রশ্ন করলেন না। নিঃশব্দে অতিবাহিত করলেন কিছু সময়। তন্ময় জবাব না পেয়ে আর কথা বাড়াচ্ছে না। চুপচাপ কফিতে চুমুক বসাচ্ছে। অধৈর্য মোস্তফা সাহেব একসময় তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলেন, ‘বুকের ব্যথা ট্যথা নেই। বুড়ো হয়নি বুঝলে। এখনো তরতাজা মজবুত আছি। এসব দু’টাকার কথা আমার বুকের ব্যথা বাড়ানোর ক্ষমতা রাখেনা।’
পরপরই তন্ময় স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠেছিল,’শাবিহা একটা ছেলেকে ভালোবাসে। ছেলেটা ওর বয়সে ছোট হয়। বছর খানেকের প্রেম তাদের। সম্পর্ক গভীর। ছেলেটা পাশের বাড়ির অয়ন!’
নিস্তব্ধতা চারপাশে। টু-শব্দ শোনা গেল না। মোস্তফা সাহেব স্তব্ধ, বিমুঢ়। চাহনি শুন্যে পরিনত হয়েছে। অস্পষ্ট স্বরে ‘কী!’ বলে উঠেছিলেন। অবাস্তবিক, অমানবিক ছেলে পুনরায় কথাগুলো বলে দিল নির্বিকার ভঙ্গিতে। মোস্তফা সাহেব শক্ত করে বুকটা ধরে রেখেছেন। একটামাত্র ছেলে প্রেমে পড়েছে বলে তার দুনিয়া উথাল-পাতাল করে দিল। এখন মেয়েটা কী তার ছোট্ট জীবনে ঝড় তুলবে?
_____________
মুবিনকে অয়ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। দেখল বলা যায়না। চোখ রাঙিয়ে দেখল বলতে হয়! মাথা থেকে পা অবদি দেখেছে। ঠিক কোথায় সাহস সঞ্চয় করে তার রমনীকে বিয়ে করতে আসছে, সেটাই মুলত দেখতে চাচ্ছে! অয়নের এমন চোখ রাঙানো অনেকক্ষণ যাবত দেখেও না দেখবার ভান করে যাচ্ছে মুবিন। কিন্তু আপাতত আর পারছে না। সেও তাকাল। তার থেকেও লম্বাচওড়া এবং বয়সে ছোটো ছেলেটাকে দেখে নিল। মুবিন উচ্চতা নিয়ে বড্ড ডিপ্রেশনে থাকে। নিজের থেকে লম্বাচওড়া পুরুষ সামনে দাঁড়ালে তার ইগোতে লাগে। আজ লাগতে লাগতে ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। এই পরিবারের সব পুরুষ লম্বাচওড়া। এতটা লম্বা হবার কারণ কী! কি খায় এঁরা!
ড্রয়িংরুমে থমথমে পরিবেশ। এতক্ষণ যাবত একতরফা কথা বলেছেন আশরাফুল সাহেব। একপর্যায়ে তার কথা ফুরিয়ে গেল। তিনিই থামলেন। কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে সেটার আঁচ করতে পারলেন। ওহী সাহেব কথা এগোনোর সুরে নতুনভাবে আলাপ-আলোচনা শুরু করলেন। পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলো। আশরাফুল সাহেব বিনয়ী সুরে বললেন, ‘কই শাবিহা? দেখি একটু ওঁকে! কতো ছোট দেখে গিয়েছিলাম।’
অয়নের মুখশ্রী আরও গম্ভীর হলো। সে হাতের কনুই দ্বারা বাবাকে গুঁতো দিল। চোখের ইশারায় কথা বলতে বলল। সৈকত সাহেব হালকা কাশলেন। তবে এমতাবস্থায় কথা বাড়ানোর মতো বিবেক পেলেন না। ছেলেটাকে কতো করে বোঝালেন, পাত্রপক্ষ শাবিহাকে দেখে যাক। তারপর নাহয় তারা গিয়ে প্রস্তাব রাখবে। দেখে গেলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না! কিন্তু কে শুনে কার কথা! ছেলের মতে শাবিহাকে সেই পাত্রপক্ষ হিসেবে দেখবে। অন্যকেউ নয়! অবশ্য সৈকত সাহেব রাজি হোননি প্রথমে। ছেলে থেকে ছেলের বউয়ের বয়স বেশি, ব্যাপারটা ঠিক তার মানাচ্ছে না! একটুখানি ছেলে তার! এতটুকু ছেলে এখনই বিয়ে করবে, আবার মেয়ে বয়সে বড়ো! এটা কোন বাবামা মেনে নিবে? কিন্তু তিনি মানতে বাধ্য হলেন। প্রথমে ছেলে লোভ দেখাল। এইযে অয়ন তার বিজনেস সামলানোর দায়িত্ব নিবে বলল। শেয়ারের প্রফিট দিয়ে নতুন প্রজেক্ট শুরু করার ওয়াদা করলো। চিটাগং আধা বিল্ডিংয়ের কাজে হাত দেবার, প্রতিশ্রুতি ও দিয়েছে! এসব বড়সড় লোভে পড়ে তিনি নড়েচড়ে গিয়েছিলেন কিছুটা ঠিকই, তবুও মানেননি। পরক্ষণেই ছেলে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করলো। সৈকত সাহেব ছেলের একতরফা প্রেমের কাহিনি শুনে, বড়ো কষ্ট অনুভব করলেন। এবং ভাবলেন বয়স একটি সংখ্যা মাত্র। ছেলের সুখ বড়ো সুখ।আর শাবিহা তাদের সামনে বড়ো হয়েছে। মেয়েটা কেমন তারা ভালোভাবে জানেন। বয়সের ডিফারেন্স অতটা বোঝার মতো নয়। কিন্তু এখন সমস্যা অন্য যায়গায়। মোস্তফা শাহজাহান কী আদোও মেয়ে দিতে রাজি হবেন?
মোস্তফা সাহেব হাসলেন। ভেতর থেকে ঠেলে বের করা হাসি টুকু ঠোঁটে লেপ্টে রাখলেন। তিনি মাথা দুলিয়ে স্ত্রীকে মেয়ে আনার ইশারা করবেন প্রায়! অয়ন হুট করে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে গিয়ে আবারো বসে পড়লো। পরিপাটি করে বসে মোস্তফা সাহেবের দিক তাকাল। দৃষ্টি প্রখর তার। তবে কন্ঠ নরম।
‘আমাদের কিছু কথা ছিলো।’
মোস্তফা সাহেব কাঠকাঠ গলায় বললেন, ‘পড়ে। এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়।’
লতা বেগম আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না আর। ছেলেকে বকতে বকতে সামনে অগ্রসর হলেন। এখনই কান ধরে বাদরটাকে ঘরে নিবেন। মানইজ্জত এই ছেলে আর রাখবে না মনে হচ্ছে। অয়ন দাঁড়ালো। কান ধরার পূর্বেই মায়ের হাত ধরলো। বিরক্ত সুরে বলল, ‘এটা কান ধরার যায়গা না মা। পাত্রী দেখতে এসে ছেলের কান ধরলে মানইজ্জত কই রইলো? দেখি বসো৷’
‘পাত্রি! এই অয়নের বাবা! হচ্ছে কী!’
মোস্তফা সাহেবকে আশ্চর্যের সীমানায় পৌঁছে দিতে অয়ন বলল, ‘আমি শাবিহাকে ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই।’
শাবিহা দীপ্তর কথাবার্তা শুনে দৌড়ে এসেছে। শাড়ি পরিহিত তার হঠাৎ আগমনে সকলের নজর ঘুরেছে। অপ্রস্তুত শাবিহা চমকে অয়নের দিক তাকিয়ে। শক্তপোক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। শাবিহাকে এমন সাজগোজে দেখে মুখশ্রী গম্ভীর হলো। কপাল কুঁচকে গেল। এমন সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে এলে ত, সাথেসাথে বিয়ে হয়ে যেতো। অয়নের ইচ্ছে করছে টি-টেবিল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে। কই অয়নের জন্য তো এভাবে সাজগোজ করেনি। অয়ন চোখ ফিরিয়ে রাখল। শাবিহার পানে তাকাল না। ইতোমধ্যে আশরাফুল সাহেব দাঁড়িয়ে পড়েছেন। কন্ঠে ভদ্রতা নেই আপাতত, ‘এগুলো কীসব হচ্ছে মোস্তফা?’
মুবিনের চোখমুখ উজ্জ্বল। সে উতলা চোখে শাবিহাকে দেখছে। আঁড়চোখে বাবাকে টেনে সোফায় বসালো। নিজেও পাশে বসে ফিসফিস করে বলল,’সিনক্রিয়েট করো না। মেয়ে আমার খুব পছন্দ হয়েছে বাবা!’
আশরাফুল সাহেব রাগ নিয়ন্ত্রণ করলেন। অপেক্ষায় রইলেন ব্যাখার৷ মোস্তফা সাহেবের ব্যাখ্যার পূর্বে অয়ন পুনরায় বলল, ‘আমাদের গভীর সম্পর্ক! সাগরের থেকেও গভীর। এই সম্পর্কে বিয়ে মাস্ট। নাহলে পাপ লাগবে।’
স্তব্ধ আশরাফুল সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন। ছিঃ ছিঃ করতে বেড়িয়ে গেলেন। বাধ্যতামূলক ছেলে স্ত্রী টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। যাওয়ার পূর্বে মোস্তফা সাহেবকে কথা শোনাতে ভুললেন না। সৈকত সাহেব ছেলের সামনে দাঁড়ালেন। তার এই ছেলেটা এখন নিশ্চিত মাইর খাবে। ভয়ে তিনি ছেলের সামনে দাঁড়ালেন। নিজে ছেলেকে একটা চড় দেন না। সেই ছেলেকে চোখের সামনে অন্যকেউ মারলে তিনি সহ্য করতে পারবেন না৷ একদম নয়! তিনি ছেলের হয়ে মাফ চাইলেন। বিয়ের প্রস্তাব রাখলেন। দুজনের প্রেমের বিষয়টি খোলাখুলি বললেন। ওহী সাহেব বোঝার সুরে বললেন, ‘ভাইয়ের মনমেজাজ খারাপ। আমরা একদিন ডেট ফিক্সড করে কথা বলবো।’
সৈকত সাহেব রাজি হলেন। অয়ন হুড়মুড়িয়ে বেড়িয়ে গেল৷ লতা বেগম ছেলের পিছু ছুটলেন। যতক্ষণ না ছেলের কান টেনে লাল করবেন, তার শান্তি নেই। সৈকত সাহেব যাবার আগে আরেকবার মাফ চাইলেন। তারা যেতেই মোস্তফা সাহেব দ্রুত পায়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। পেছনে জবেদা বেগম ছুটলেন। শাবিহা সিঁড়ির মাথায় বসে পড়েছে। অঝোরে কান্না করছে। অরু, রুবি তাকে দুপাশ হতে ধরে রেখেছে।
__________
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বজ্রপাত তুমুল। বাতাস ছেড়েছে হয়তো। বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে বেলকনি থেকে।
ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে দুটো পঁয়তল্লিশে। শাহজাহান বাড়ি নিস্তব্ধতায় ঘেরা। ঘন্টা খানেক আগেই সকলে ঘুমোতে গিয়েছে। সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়তো। অরু বিছানায় গড়াগড়ি করছে। পরপর উঠে বসলো। বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে বেরোল। তার ঘুম না আসার মুল কারণ রসমালাই। রসমালাই খাওয়ার জন্য হৃদয় ব্যকুল হয়ে আছে। যেহেতু পরিস্থিতি কিছুটা মিটমাট হয়েছে এখন রসমালাই খাওয়া যায়। বিড়াল ছানার মতো অন্ধকারে হাতড়ে এসেছে পাকঘরে। ফ্রিজ খুলেছে। কিন্তু রসমালাই নেই! শেষ! অরু ফ্রিজ উলটপালট করে রসমালাই খুঁজল।কোথাও নেই! আশ্চর্য! সে তো সন্ধ্যায় দেখল ফ্রিজ ভর্তি রসমালাই। কষ্টে অরুর চোখ ভিজে উঠার উপক্রম। সবাই জানে তার রসমালাই পছন্দ। অথচ কেউ তারজন্য একটা পিস রাখল না। দুঃখে কষ্টে ফ্রিজ আটকে ঘুরতেই মুখ চেপে ধরলো।এখনই চিৎকার করতে যাচ্ছিল। তন্ময় সামনে দাঁড়িয়ে। ঘুমন্ত মুখমণ্ডল। ছোট চোখ জোড়া লাল ঘুমের অভাবে। উষ্কখুষ্ক চুলে অবস্থা। তার হাতে খালি পানির বোতল। সে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল নিতে এসেছে নিশ্চয়ই। অরু বুকে থু থু ছিটিয়ে শ্বাস ফেললো। ফ্রিজের সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। তন্ময় অরুকে ভালোভাবে দেখে নিল। ভোঁতা মুখ দেখে জিগ্যেস করলো, ‘কি হয়েছে?’
তন্ময়ের কন্ঠ ভাঙা এবং গভীর। তার ঘুমন্ত স্বর এই নিস্তব্ধ আঁধারে কাঁটা গায়ে নুনের ছিটে যেমন। অরু হাসফাস করে সরে উঠল। ইনিয়েবিনিয়ে বলল, ‘কিছুনা।’
‘খিদে পেয়েছে?’
অরু বিড়বিড় করে ভেঙাল, ‘খিদে পেয়েছে! অ্যাহ! খিদে পেলে যেমন রান্না করে খাওয়াবে!’
তন্ময় প্রশ্ন করলো, ‘কি খেতে ইচ্ছে করছে?’
অরু পাপড়ি ঝাপটাল। খুব মিনমিন করে অভিমানী সুরে বলল, ‘রসমালাই।’
তন্ময় ফুলহাতা খানা কনুই পর্যন্ত তুলে, রান্নাঘরের বাতি জ্বালালো। শব্দহীন ভঙ্গিতে সেলফোন বের করে ইউটিউব ঢুকলো। রসমালাই বানানোর রেসিপি ফলো করে, একটি ভিডিও ছেড়েছে। উপকরণ গুলো নোট করে নিয়েছে। সেগুলো খুঁজে সামনে রাখছে। দুধ বের করে বসিয়ে দিল চুলায়। অরু বিষ্ময়ের চুড়ান্তে। সে মোটেও এমন রিয়েকশন তন্ময় থেকে আশা করেনি। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে। ভীতিকর কদমে তন্ময়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কি করছেন!’
‘রসমালাই বানাবো।’
‘আপনি রসমালাই বানাতে জানেন?’
‘না। রেসিপি ফলো করবো।’
‘দরকার নেই। চলুন!’
তন্ময় শুনল না। আনাড়ি হাতে রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অরু নিজ মনে তাকিয়ে রইলো। তন্ময়ের হাতের আঙুল গুলো লম্বা। নিমিষেই সবকিছু আঙুলের ফাঁকে নিয়ে ফেলছে। শক্তপোক্ত গম্ভীর মুখশ্রী তার। যেমন পৃথিবীর কোনো কিছুর ধার সে ধারে না। অথচ সেই ধার না ধারা মানুষটা অরুর এক কথায়, রসমালাই বানাতে ব্যস্ত। তাও এই বৃষ্টির নামের মাঝরাতে। এতো ভালোলাগা সে কই রাখবে? খুশিতে অরু মুখমণ্ডল জ্বলজ্বল করছে। কিছুটা উঁচু হয়ে হুট করে ব্যস্ত শেফ তন্ময়ের গালে চুমু খেয়ে বসলো। তন্ময়ের ব্যস্ত হাত জোড়া থেমে গেল। স্তব্ধ হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পরপর আবারো কাজে ব্যস্ত হলো। প্রতিক্রিয়া দেখাল না কোনো। অরু সাহস পেলো। খিলখিলিয়ে হেসে অপরপ্রান্তে চলে এলো। হাস্যজ্বল চেহারা দেখিয়ে বলল,’আমাকে বলুন কি করতে হবে। আমিও সাহায্য করব।’
‘ভিনেগার দে।’
অরু এগিয়ে দিল। আকাশ সমান আগ্রহ নিয়ে তন্ময়ের রসমালাই বানানো দেখছে। সঙ্গে এটাসেটা এগিয়ে দিচ্ছে। একসময় জিজ্ঞেস করলো, ‘অয়ন ভাইয়াকে কি মেনে নিবে চাচ্চু?’
‘দেখা যাক।’
‘আজ তো সে রাজার ন্যায় এসেছে তাই না? কতটা সুদর্শন লাগছিল দেখেছিলেন? বেশ বড়ো বড়ো ভাব রেখেছে চারপাশে। মনেই হয়নি সে অনার্সের স্টুডেন্ট। শাবিহা আপু ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিলো ভাইয়ার দিক।’
‘ওহ।’
‘আপনার কি তাকে শাবিহা আপুর জন্য উত্তম মনে হলো?’
‘ছোটো এখনো ও।’
‘কোথায় ছোটো! আচ্ছা আজ আপনি তাদের ব্যাপারে কিছু কেন বললেন না!’
‘প্রয়োজন পড়লো না।’
‘চাচ্চু আপনার কথা শুনবে! বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই বুঝবে।’
তন্ময় একটা ইম্পর্ট্যান্ট পার্টে আছে। মনোযোগ সব সেখানে। অরুর কথায় ধ্যান দিল না। অরু মুখ বন্ধ করে ফেললো। এক নজরে তন্ময়কে দেখছে। আরেকটা চুমু কি দিবে তন্ময়ের বাম গালে? না থাক! অরুর ভীষণ লজ্জা লাগে। সে খুব আবেশে তন্ময়ের চারপাশে ঘুরঘুর করছে।
রসমালাই হতে ঘন্টা খানেক সময় লাগলো। ঝটপট বানানো। তন্ময় সুন্দর ভাবে সার্ভ করেছে। অরু তক্ষুনি খেল না। রসমালাইয়ের প্লেট ধরে নিজের রুমে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তন্ময়কে ভুলে গেল। এখনো বৃষ্টি হচ্ছে! প্রবল বৃষ্টি। বেলকনি সামনে দাঁড়ালো রসমালাইয়ের প্লেট সহ। একটি ছবি তুললো। তারপর গপ করে একটা মুখে পুড়ে ফেললো। মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেল। মজাদার! প্রথম ট্রায়ালে এতটা দুর্দান্ত বানাবে অরু ভাবতেই পারেনি। চার পাঁচটা মুখে দিয়ে ঘুরে তাকাল। তন্ময় এসেছে। অরু কিছুটা অবাক হলো বটে। সচরাচর তন্ময় তার রুমে আসেনা। হাতেগোনা কয়েকবার এসেছে। অরু পুনরায় খাওয়ায় মনোযোগী হলো। খেতে নিয়ে বৃষ্টি দেখছে। তন্ময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সম্পুর্ন প্লেট খালি করে তবেই অরু তন্ময়ের অস্তিত্ব খেয়াল করলো। আঁড়চোখে তন্ময়কে দেখে নিয়ে বৃষ্টির দিক তাকাল। বুকটা ধুক করে উঠলো হুট করে। অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করছে সে। বৃষ্টির সেই রাতের অনুভূতি তাকে পুনরায় ঝেঁকে ধরেছে। অরু থরথর করে কেঁপে উঠলো। সে তো এখন বৃষ্টিকেই ভয় পাচ্ছে। তন্ময়কে ঝুকতে দেখে অরু চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। তন্ময়ের কন্ঠের স্বর অস্পষ্ট গভীর, ‘বৃষ্টি হচ্ছে অরু। আজ ইলেকট্রিসিটি গেলে মন্দ হয়না, তাই না?’
_________________
চলবে ~
‘