প্রেয়সী পর্ব ২+৩

প্রেয়সী

২|
ঠান্ডা বরফের মতো হাতদুটো পেছন হতে, আলতো করে জড়িয়ে সামনে রাখা আমার হাত দুটো মুঠোবন্দি করে ফেলল। মুহুর্তে আমার শরীরে কাঁপন শুরু হয়ে গেলো। হয়তো এই হাত দুটো আমায় ছাঁদ থেকে ঠেলে ফেলে দেবে, আর নয়তো কাঁপতে কাঁপতে আমি নিজেই ছাঁদ হতে পড়ে যাবো। এবার তার মুখটা আমার ঘাড়ের উপরে রাখলেন। তার ছোট চাপদাড়ির খোঁচা খেয়ে নিশ্চিত হলাম, এটা তন্ময় ভাই ছাড়া আর কেউ না। আমি রীতিমতো আরও কাঁপতে শুরু করেছি। ভয় হচ্ছে, এবার বুঝি পড়েই যাবো। তন্ময় ভাইও হয়তো বুঝে ফেলেছেন, এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে ছাঁদ হতে পড়ে আমার দফারফা হয়ে যাবে। আগের সেই হালকা ভাব ছেড়ে এবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর তার রক্তহিম করা অথচ শান্ত কণ্ঠ স্বর আমার কানে বেজে উঠলো,
— ‘ আজকাল খুব সাহস হয়েছে, তাইনা ? জিদ দেখাচ্ছিস, তাও কার সাথে। আমি? তন্ময়ের সাথে জেদ। হু? ‘
আমি নড়তেও পারছি না। আর উনার কথার জবাব দেবার
মতো সাহসও আমার মাঝে অবশিষ্ট নেই। ভয়ে আমার কান্না এসে যাবে যেকোনো মুহুর্তে। প্রবল বাতাসে চুলগুলো, তার মুখে ছড়িয়ে যাচ্ছে। গায়ে জোড়ের অভাব নেই, এক হাত দিয়ে আমার দুহাত সহ কোমড় শক্ত করে ধরে আছেন, অন্য হাত দিয়ে আমার লম্বা চুলগুলো নিজের হাতে পেঁচিয়ে নিলেন। এতো শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরায় চুলে প্রচুর ব্যাথা পাচ্ছি, কিন্তু একটু টু শব্দ করারও সাহস পাচ্ছিনা। তন্ময় ভাই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
–‘ সকালে খেতে আসিসনি কেন? দুপুরে আমি যাবার পরে, আর রাতে আমি আসার আগেই, খেয়ে নিয়েছিস। যেনো, আমার সামনে পড়তে নাহয়, তাইতো? তখন তো আরও মানুষ থাকতো, আর এখন তো একা। এতো ভয় পাস, এখন যদি ছাঁদ থেকে ফেলে
দেই তো? ‘
কান্নায় আর ভয়ে আমার গলা আঁটকে আসছে তবুও সাহস করে বললাম,
— ‘ ভয় পাইনা আমি আপনাকে। ‘
আমার এই কথায় যেনো সে আরও রেগে গেলেন। চুল আরও কিছুটা শক্ত করে টেনে ধরলেন।
— ‘ ভয় পাসনা? ‘
— ‘ নাহ। ‘
— ‘ আচ্ছা? ‘
ওই অবস্থায়ই আমাকে ঘুরিয়ে তার দিকে ফেরালেন। তারপর হাতের বাঁধনটা হালকা করে আমার মাথাটা কিছুটা নিচের দিকে ঠেলে দিলেন। ভয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
— ‘ কি ফেলে দেই এবার? ‘
আমি চোখ মুখ খিঁচে চুপ করে রইলাম। আমাকে চুপ থাকতে দেখে, আমার মাথাটা আরও একটু নিচের দিকে হেলে দিলেন।
— ‘ প্লিজ। ফেলে দিবেন না আমায়। ‘
— ‘ তাহলে বল,ভয় পাস আমায়? ‘
–‘ হ্যাঁ অনেক। অনেক ভয় পাই। ‘
— ‘ ইয়াহ! দ্যাটস লাইক অ্যা গুড গার্ল। ‘
পপরপরই কোনো কথা না বলেই, আমায় জোড়ে রেলিঙ হতে টেনে নামালেন। এমন ভাবে নামিয়েছেন যে হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যাথা
পেয়েছি। উনি এক প্রকার আমায়, ছাঁদে ছুড়ে ফেলে চলে গেলেন। ব্যাথায় নড়তেও পারছিনা। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়, আমি কেঁদে ফেললাম। এই সয়তান আমার জীবন’টা শেষ করে দিচ্ছে।
পরপরই খেয়াল করলাম, আমার সেলফোন ভেঙে গেছে। এবার আমি শব্দ করে কেঁদে ফেললাম। আমার ফোন? এখন কি হবে। বাড়ির থেকে এভাবেই ফোন দিতে চায়না। যাও, জোরপূর্বক নিয়েছিলাম সেটাও ভেঙে দিলো। এখন? ভাবতেই আমার কান্না বাড়তে লাগলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম গ্লাস একদম ডেস্ট্রোয় হয়েছে। নির্ঘাত যাবার সময় এটার উপর পা ফেলেছিলো।
চোখের পানি পুঁছেও লাভ হচ্ছেনা। সেই আবারও গাল ভিজে যাচ্ছে। একটা সহয়তান আর কতটা সহয়তান হতে পারে। ইয়া আল্লাহ।
ব্যাথায় নড়াতে না পারা পা নিয়ে, আমি রুমে পৌঁছালাম যুদ্ধ করে। দরজা আঁটকে বিছানায় বসলাম। পা’জামা হাঁটু অবদি তুললাম। হাঁটু অনেকটা নিয়ে ছুঁলে আছে। কিছুটা রক্তের দাগও পা-জামায় বোঝা যাচ্ছে। হেঁচকি তুলতে তুলতে আমি নিজেই, স্যেভলনের সাহায্যে যায়গাটা পরিষ্কার করে, ব্লাড মেডিসিন তুলোয় নিয়ে ক্ষত’তে চেপে নিলাম। তারপর একটা পট্টি লাগিয়ে দিলাম।
আমি সকালে একদম ঠিক অনুভব করেছি। এই সয়তানের নাম নিলে, জীবনেও আমার দিন ভালো কাঁটবেনা। একদম না।

দোতলা বাড়িটা একদম শান্ত। ভোরের সূর্যে কিছুটা ঝলমলে রূপান্তরিত হয়েছে আশপাশ। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, সবুজ-শ্যামল, শান্ত, ছায়াঘেরা, মনোরম এক পরিবেশ। দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ, টইটুম্বুর খাল-বিলে নয়নাভিরাম শাপলা পদ্ম! পাখিদের কোলাহলের মনোরম এক দৃশ্য। সকাল সকাল এই দৃশ্য অনুভব করার অনুভূতি-ই আলাদা। বাক্যে প্রকাশ করার মতো না।
আসলে, আমাদের বাড়ি তারপর বাড়ির চারপাশ খুবই সৌখিনতায় ঘেরা। খুবই সাজানো-গোছানো। আশপাশে ভুলেও কোথাও আবর্জনা পাওয়া যাবেনা। বাড়ির ভেতর তো দূরের বিষয়, বাহিরেও তেমন অগোছালো থাকেনা। নিট অ্যান্ড ক্লিন যাকে বলা হয়। এতটা পরিপাটি রাখার বড় কারণ হচ্ছে তন্ময় ভাই। বাড়ির সকলেই তার অসুখের ব্যাপারে অগ্যত যেটা হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। উনি আবর্জনা ঘরে কেন বাড়ির আশপাশেও দেখতে রাজিনা। যার কারণে বড় মা, ছোট চাচী ঘুম থেকে উঠতে’ই, আগে আশপাশ সহ পুরো বাড়ি পরিষ্কার করে ফেলেন। কারণ বাড়ির শেহজাদা সাতটা’য় ঘুম থেকে উঠেন এবং আটটায় বাড়িতে ব্রেকফাস্ট করেন। আমি এখনই জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, বড় মা বাগান পরিষ্কার করছেন। ছোট চাচী সিঁড়ির ঝাড়ু শেষ করে, আপাতত ঝাড়ু হাতে কথা বলছেন বড় মা’র সাথে ৷ আর আমার মা ডাস্টার দিয়ে দোতলা ধরে নিচ তোলার সিঁড়ি সহ পুছে ফেলেছেন। আমি রুমে চলে এলাম। পা’টা এখনও ব্যাথা করছে। চিনচিন করছে হাঁটতে নিলেই। ধ্যান দিলেই ব্যাথা বাড়বে। আমি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কলেজের ড্রেস সহ ব্যাগ সবকিছু গুঁছিয়ে বিছানায় রাখলাম। এখনও সময় আছে তাই পড়তে বসে পরলাম। আমার এখনও শেষ ক্লাসের পড়া কমপ্লিট হয়নি। কিন্তু বেশিকিছুক্ষন পড়তে পারলামনা। কারণ সুমনা এসেছে। বড় মামার মেয়ে এটা। আমরা একই বয়সের এবং একই কলেজে পড়ছি। ইথি নিশ্চয়ই জেনে গেছে তন্ময় ভাই এসেছে। তাই দ্রুত কলেজ ড্রেসে হাজির। এ আবার তন্ময় ভাইয়ের দেওয়ানী। তন্ময় ভাই বলতেই পাগল। আমি বইটা বন্ধ করে ফেললাম। সুমনা এসে ব্যাগ’টা বিছানায় ফেলেই দরজা থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। এবং ফিসফিস আওয়াজে প্রশ্ন করলো,
–‘ তন্ময় ভাই আসছে জানাস নাই কেন? ‘
আমি এক্সকিউজ দিয়ে দিলাম।
–‘ ফোন ভেঙে গেছে। ‘
–‘ আল্লাহ, কিভাবে? ‘
–‘ এভাবেই। ‘
সুমনা সন্দেহ দৃষ্টিতে আমার দিক কিছুক্ষণ তাকালো। তারপর হঠাৎ আয়নার সামনে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করলো।
–‘ আমাকে ঠিক দেখাচ্ছে তো? আজ দু’বেনী করেছি। আমাকে নাকি প্রচন্ড সুট করে। কেমন লাগছে? ‘
আমি কিছুটা হাসলাম। সুমনা এমনিতেও দেখতে মাশাল্লাহ। লম্বা তার হাঈট, গায়ের রঙ ফরসা, লম্বা ঘন ব্রাউন রঙের চুল। কিন্তু, আজ একটু বেশিই সুন্দর ভাবে, সেজেগুজে এসেছে। কারণ একটাই। তন্ময় ভাই বাড়িতে। আমি টেবিল গোছাতে গোছাতে বললাম,
–‘ মাশাল্লাহ। ‘
সে খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো। কাজল আরেকটু ঘনো করে লাগালো। তারপর বেরোতে বেরোতে বলল,
–‘ উঁকিঝুঁকি দিয়ে আসি। ‘
গেলো তাহলে মেয়েটা। উফ। এমন সুন্দর সুন্দর মেয়েরা এই খারুস’কে কেনো পছন্দ করে? পাশের বাড়ির কুলসুম এবং তার বড় বোনও তন্ময় ভাইর কথা জিজ্ঞেস করবে। আবার আমার ক্লাসের সাথীরা কয়েকটা পাগল করবে এভাবে,
–‘ তন্ময় ভাইয়ের নাম্বার’টা দে না। প্লিজ। ‘
তো এমন অনেক। এগুলো ভেবে লাভ নেই। আসলে তারা তো আর সয়তানটার আসল চেহারা দেখেনি। দেখলে নির্ঘাত এরে দ্বিতীয় বার দেখার ইচ্ছা রাখতো না। আর আমি তা গ্যারান্টি দিতে রাজি। হুহ।

কলেজের জন্য তৈরি হয়ে, খেতে গিয়ে আমি দীপ্তর সাথে বসলাম। প্রথমেই নজরে আসলো, ওর ঝাকড়া চুল। হাত নিজ ইশারায় ওর চুল আওলে দিলো। দীপ্ত ঘুমন্ত চোখে চশমা’টা আরেকটু ঠেলে নিয়ে বলল,
–‘ এইবারের টেস্টে আমি রকিবুলের থেকে পাঁচ পয়েন্ট এগিয়ে গনিতে। ‘
আমি উৎসাহ দিলাম,
–‘ সাব্বাশ। এই না হলো আমার ভাই। ‘
–‘ ইংলিশে ক্লাসে সবচেয়ে হাইস্কোর আমার। ‘
–‘ ব্রিলিয়ান্ট। ‘
ছেলেটা এতো মেধাবী। বলার বাহিরে। ক্লাসে টপ না করতে পারলে, ও পাগল হয়ে যায় প্রায়। এভাবে সবচেয়ে সুইটেস্ট৷
রবিন ভাই ভেঙলেন দীপ্তকে ,
–‘ গুম্বজ, আর কতো পড়বি? পড়তে পড়তে চোখ খেয়ে
ফেলছিস একদম। ‘
–‘ হিংসা হচ্ছে? ফেল্টুস! ‘
রবিন ভাই হচ্ছেন দীপ্তর বড় ভাই। দীপ্তরা তিন ভাইবোন। ছোট দীপ্ত, তারপর রুবি আপু এবং তাদের দুজনের বড় রবিন ভাই। এইগুলা হলো ছোট চাচ্চুর সম্পদ। এদের মধ্যে ব্রিলিয়ান্ট দীপ্ত, বাকি দুই ভাইবোনই পড়ালেখায় কাঁচা।
আমার সামনে বসে সুমনা। এবং ওর পাশে তন্ময় ভাই। একদম শক্ত চেহরা নিয়ে খাচ্ছেন। মনে হচ্ছে কাউকে সামনে পেলে, দু’চারটে কোপ, তার গলায় অনায়াসে দিবেন।
সুমনা কথা বলার চেষ্টা করছে,
–‘ তন্ময় ভাই, কতদিন থাকবে এবার? ‘
–‘ দেখি। ‘
ব্যস। সে তার মুখ বন্ধ করে ফেলেছে। সুমনা আমার দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অসহায় চোখে। বেচারি। পছন্দ করেছে এমন কাউকে, যে রীতিমতো এক পাথর। তাতে আমার কি। হু, আমি ভাই ঝটপট খেয়ে উঠতে যাবো, তার আগেই সুমনা বলল,
–‘ তন্ময় ভাই চলো না, আমাদের দিয়ে আসবে। কলেজের সামনে কিছু ছেলেরা, আমাকে ডিস্টার্ব করে। ‘
আমি তাড়া লাগালাম,
–‘ দেরি হচ্ছে সুমনা। ‘
সহয়তান’টার জবাব এলো,
— ‘ যাও, ব্যাগ নিয়ে আসো। ‘
হু। ঢং। সুমনা লাফাতে লাফাতে ব্যাগ আনতে চলে যাচ্ছে। আমি আব্বুর কাছে গেলাম। সে আমাকে দেখেই গালে হাত ছোঁয়ালেন,
–‘ কি হয়েছে? মুখটা এমন ফোলা কেন? ‘
–‘ এভাবেই। ‘
আমি বড় হয়েছি। নাহলে এখনই আব্বুকে জড়িয়ে বলতাম,
–‘ এই সয়তান তন্ময় আমাকে হেনস্তা করে আব্বু। এটার একটা রফাদফা করে দাও, তাহলে আমি একদম শান্তিতে থাকবো। ‘
অথচ আমি জানি, এটা বললে যদি পরে তন্ময় ভাই জানেন। তাহলে আমার অবস্থা করুণ হয়ে যাবে। করুণের থেকেও করুণ

তন্ময় ভাইর সাথে বেরোলে, নজর থাকবে সকলের আমাদের দিকে। আমি আরও মাথা নিচু করে সাইড হয়ে হাঁটতে লাগলাম। আশপাশ পরিচিত অপরিচিত অনেকেই কথা বলছেন, আবার ডাকছেন,
–‘ তন্ময় ভাই কখন এলেন? কি অবস্থা তন্ময়. আররে, তন্ময় ভাই একটা জরুরি ম্যাটার ছিলো? তন্ময় ভাই সময় আছে?’
সে বেশ হাত উঠিয়ে দেখাচ্ছে ‘ পরে ‘। ভাব দেখলে গা পিত্তি একদম জ্বলে শেষ। উহরে, রাজা বাদশাহ আসছেন।
এদিকে সুমনা বেচারি বারবার তন্ময় ভাইকে প্রশ্ন করছে। আর হাসছে। আবার অনেকটা ভাইর সাথে চেপে আছে। আমার হাসি পেলো। ভাইয়া যেই নিট অ্যান্ড ক্লিন টাইপ মানুষ। কখন না আবার এর উপর চেঁচিয়ে উঠে। হি হি। চেঁচালেই তো ভালো হবে। সুমনাও দেখুক এর আসল রুপ। তন্ময় ভাই হঠাৎ থামলেন। তারপর পেছনে ফিরেই ধমক দিলেন,
–‘ সামনে হাঁট।। ‘
আমি দ্রুত তাদের সামনে গিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কি শয়তান। রাস্তার মাঝেও শুরু। তুই জাহান্নামে মরবিরে। তুর কপালে বিয়ে নাই। তুই সিঙ্গেল মরবি। হু।
কলেজের সামনে সেই ছেলেগুলো আবারও দাঁড়িয়ে ছিলো। সুমনা বেশ ভয় পাওয়ার ভান করে, ভাইকে দেখিয়ে দিলো। এভাবে এই মেয়ে দুই-তিন ছেলে অনায়াসে মেরে ফেলতে পারে। আর ওর যেই মুখ। একদম শুদ্ধ ভাষায় গালাগাল করে খেয়ে দিবে।
ভাই তাদের দিক তাকাতেই, ছেলে দুটো দৌঁড়।
আমি যেতে নিলে তন্ময় ভাই প্রশ্ন করেন,
–‘ তোর ফোন ওফ কেন? ‘
মন তো চাচ্ছিলো এর সাথে, আজ রফাদফা হয়েই যাক। অথচ আমি কিছুই বলতে পারবো না। যেখানে বাড়ির বড়রা একে সম্মান করে। সেখানে আমি কিভাবে খারাপ ব্যবহার করতে পারি?
–‘ কাল রাত্রে ছাঁদে ভেঙে গেছে। ‘
আমি বলেই গেইটে ঢুকে গেলাম। আমার মাথাটা এখনও ঝিলিক মেরে উঠে। কি শক্তি দিয়েই না চুল ধরেছিল। আর আমার উচ্চতা ভীতি কে কি নির্মম ভাবেই না অপমান করেছিল। একদিন তুইও শাস্তি পাবি দেখিস, শয়তানের বাচ্চা।
প্রেয়সী

৩|
আমি কি আমার জীবনের স্বাধীনতা পাবো? সেই ভাগ্য কি হবে। কি পাপ করেছিলাম। এতো শাসন আমাকেই কেনো পেতে হবে। আর সকলের মতো, আমি কেন ঘুরতে যেতে পারিনা। কেন পারিনা? অভাগীর মতো দেখে যাচ্ছি, বান্ধবীরা রেস্টুরেন্ট যাচ্ছে। অথচ আমি যেতে পারছিনা। অসহায় চোখে তাদের চলে যাওয়া দেখে, আমিও বাড়ির উদ্দেশ্যে চললাম। এই অভাগী জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে আর কি লাভ। জীবন উপভোগ করতে না পারলে, এই জীবন রেখে আর কি হবে। একদিন এই শাসনের জীবন ভাঙবে, আমি মরলে।
ছোট থেকে ঘুরাঘুরি কাকে বলে জানিইনা। নানু বাড়ি ছাড়া আর কোথাও ঘুরা হয়নি। স্কুল জীবনে একবারও পিকনিক অ্যাটেন্ড করতে পারিনি। স্কুলের হেডমাস্টার দ্বারা ও বাড়িতে রিকোয়েস্ট করিয়েছি, আমাকে যেতে দেওয়ার জন্য। আফসোস কাজ হয়নি। হবে কিভাবে? বাড়িতে আছে তো এক জঙ্গল। যার নিজের জঙ্গল ছেড়ে, আমারটা পছন্দের। আররে, তোর কপালে সুখ নেই শাহজাহান তন্ময়। তুই আমার অভিশাপে ভস্ম হয়ে যাবি। টুকরো টুকরো করে ভস্ম হবি।
ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম পিকনিক আগামী শনিবার। এবার যেতে না দিলে, শাহজাহান পরিবারের একদিন নাহয় আমার একদিন। দেখে নিবো।

দরজা বরাবর আসতেই শুনছি, বড় মা ফোনে বলছেন,
–‘ অরু এসেছে। এইতো এখানেই। হ্যাঁ, আব্বা কখন আসবি? দুপুরে ঘরে খাবিতো? আচ্ছা, আয় তাহলে। ‘
আমি ক্লান্ত চোখে তাকালাম। এতো অস্বস্তি জঙলটার কি নিয়ে? আমি বাড়িতে না আসলে তুর কি? আসবো না বাড়ি। কলেজ থেকে ঘুরতে যাবো, ডেটিং করবো, যা ইচ্ছে করবো। বাটপার। নিজের বেলায় ষোলো আনা। দিন-রাত আলপনা করে, বাড়িতে এসে হুজুর। এহ। জানি না মনে হয় উনার ব্যাপারে। কয়েকদিন পরপর হেডলাইন বেরিয়ে আসে,
–‘ তন্ময় ভাই এর সাথে প্রেম করছে। তন্ময় ভাইকে ওই মেয়ের সাথে দেখেছি। ‘
নিজের হেডলাইনের চিন্তা না করে, আমাকে নিয়ে পরে থাকে। থাক থাক। আমিও দেখি কতদিন জ্বালাতে পারিস।
দরজায় জুতো খুলে জুতো র‍্যাগে রেখে, স্লিপার পরে ভেতরে প্রবেশ করলাম। মা,চাচীরা ছাড়া আর কেউ নেই বাড়ি। সবাই হাজির হবে আর মাত্র ঘন্টার মাঝে। দুটো বিশ এ দুপুরের খাবার। এই সময়ের মাঝে সবাইকে উপস্তিত হতে হবে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখলাম, ছোট চাচী রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। নিশ্চয়ই আবারও লেগেছে চাচার সাথে। ছোট চাচী বেশ ইমোশনাল। একটুতেই কেঁদে দেন। ঠিক আমার মতো। কষ্ট নিতে পারেন না।
আমাকে খেয়াল করতেই, সে চোখ মুছে ফেললেন। হাসার চেষ্টা করে বললেন,
–‘ কিরে, কখন এলি। ‘
আমি ব্যাগটা সিঁড়ি তে ফেলে, তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
–‘ থাক, হাসার অভিনয় করতে হচ্ছেনা। এবার বলে ফেলো, হয়েছে কি? ‘
চাচী’র চোখ আবারও ভিজে উঠছে। আমি হালকা হেসে চোখের পানি মুছে দিলাম। সে হালকা আওয়াজে বলল,
–‘ তুর চাচা, আজও বলল সে নাকি আরেকটা বিয়ে করে ফেলবে। ‘
হা হা হা। এই কথাটা ঝগড়া লাগলেই চাচা বলেন। সেটা প্রতিবার বিশ্বাস করা আমার নিরীহ চাচী। সে একদম অবুঝ। চাচা যে তাকে কতটা ভালবাসেন তা সে কখনোই বুঝতে পারেননি। আসলে চাচা শক্ত মনের। মনের কথা মনে রাখতে পছন্দ করেন। কিন্তু বাড়ির আমরা জানি, সে চাচী ‘কে কতটা ভালবাসেন, স্নেহ করেন।
–‘ সে বললেন আর তুমি সত্যি ভেবে নিলে? সে বলে রাগে। রাগ কমে আসলে দেখবে, তোমার পছন্দের রসমালাই এনে ফ্রিজ জ্যাম করে রেখেছেন। ‘
সে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর চোখ মুছে ফেললেন।
–‘ কথা তো সত্য। আমি যাই মেলা কাজ। ‘
আমি হাসলাম। ব্যস। রাগ, অভিমান, কান্না শেষ তার। একদম নিস্পাপ বাচ্চাদের মতো। উনার যে তিন ছেলেমেয়ে আছে, তা তার ব্যাবহারে একদম বুঝা অসম্ভব।
রুমে প্রবেশ করতেই মনে পড়লো, মোবাইল নেই আমার। মোবাইলহীন এতিম আমি। মনে হচ্ছে জীবনে বড় কিছু নেই। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সব৷ ব্যাগ গুঁছিয়ে রেখে আমি বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে পরলাম। বড় এক মিশন রয়েছে আমার। পিকনিক যাবার মিশন। পিকনিক যেতে হলে আগে কাকে ধরবো? আব্বা? না। সে উজবুকের কথায় ডিসিশন নেন। উজবুক না বললে সেও না বলে দিবেন। বড় মা? না। সেও তার ছেলের কথায় গলে যান। আর মা তো আরও আগে না। তাহলে? অপশন আছে, বড় আব্বু আর রবিন ভাই। ইয়েস।

একটা উনত্রিশ। আমার গোসল শেষ। একটু ছাঁদ ভ্রমণ করা যাক। ছাঁদে উঠেই আমার চোখে চড়কগাছ। তন্ময় ভাই দাঁড়িয়ে শর্টস পরে। মনে হচ্ছে গোসল সেরে এসেছে। ফোনে কথা বলছে। আমি উল্টো পথে আসার আগেই সে দেখে ফেলেছে। আমার মনে পরে গেলো তার নিষ্ঠুরতম আচরণ। এর সাথে একা থাকা যাবেনা। আমি দ্রুত ফিরতে গিয়ে, খেলাম দরজার সাথে টাক। তন্ময় ভাই আগেই হালকা স্বরে চেঁচালেন,
–‘ ওয়াচআউট ইডিয়ট। ‘
আমিতো ততক্ষণে চিতকার এক দিয়ে, কপাল ধরে বসে পড়েছি।
পা দুটো আর কপাল কিছুক্ষণের জন্য একদম অবসে পরিনত হলো। চোখ ধাঁ ধা করছে। কি মারাত্মক ব্যাথা’টাই না পেলাম। সে এসে আমার কপাল থেকে হাত সরালেন,
–‘ দেখি। ‘
একপ্রকার মাথা উঁচু করে, কপাল ঘষে দিলেন৷
–‘ এতটা গাঁধি একজন কিভাবে হয়? ‘
আমি গাঁধি? আবার উহ, দরদও দেখাচ্ছে। উজবুক একটা। নিজে চুল টেনে, হাঁটু আমার ছুঁলে দিয়ে, এখন মায়া দেখাচ্ছে। আমি তার হাত সরালাম। নিজে’ই উঠে দাঁড়ালাম। সে বলল,
–‘ একটা আইস কিউব ঘষে দে কপালে। যা। ‘
না চাইতেও নিচুস্বরে বললাম,
–‘ জ্বি। ‘
আমি অনেকগুলো সিঁড়ি গিয়ে, আবারও পিঁছু ফিরলাম। তন্ময় ভাই তাকিয়ে। এবার ভ্রু উঁচু করলেন? আমি দ্রুত নেমে গেলাম। শেষ কপালটা আমার।

নিচে নামতেই দেখলাম রুবি আপু টিভি দেখছেন। চাচীরা ডাইনিং সাজাচ্ছেন। চাচ্চুরা আলাপে বিভোর। দীপ্ত হাতে ড্রয়িং বুক নিয়ে বসে। আমিও সোফায় বসলাম। শক্ত চোখে আশেপাশে নজর বোলাচ্ছি। এখন তন্ময় ভাই নেই। এখনই সবাইকে রাজি করানোর, সুহানা পাল। আমি উঠে চাচ্চুদের পাশে বসলাম। ব্যস তাদের নজর আমার দিক।
–‘ কলেজ থেকে আগামী শনিবার পিকনিক। আমি যেতে চাচ্ছি। ‘ কেউ কিছু বলার আগেই, আমি প্রায় রিকোয়েস্ট করতে লাগলাম,
–‘ প্লিজ। আমি যাবো। আমি একবারও যেতে পারিনি। আমি এবার যাবো। প্লিজ, যেতে দাও। প্লিজ। ‘
বড় চাচ্চু অবাক কন্ঠে বললেন,
–‘ এভাবে বলছো কেন অরু? অবশ্যই যাবে। ‘
–‘ বলছ তো? পরে কথা খিলাফ করবে না তো? ‘
–‘ আররে অমান্য কেন করবো? ‘
–‘ ছুঁয়ে প্রমিজ করো। ‘
বড় চাচ্চু প্রমিজ করার আগেই, উজবুক হাজির। এসেই প্রশ্ন করছে,
–‘ কিসের প্রমিজ? ‘
চাচ্চু হাসতে হাসতে বলছেন,
–‘ অরুর কলেজ পিকনিক আগামী শনিবার। ও যেতে চাচ্ছে। কিন্তু দেখ, কিভাবে রিকোয়েস্ট… ‘
চাচ্চু আর বলতে পারলেন না। উজবুক ঘ্যানঘ্যান শুরু করলো,
–‘ এবার উত্তরের পাহাড়ি এলাকায় নিচ্ছে। সাথে বি সেকশনের ছেলেরা সহ যাচ্ছে। প্রাইভেসি নেই। যাবার প্রয়োজন নেই। ‘
আমি দ্রুত বললাম,
–‘ গার্ড নিচ্ছে কলেজ থেকে। ‘
চাচ্চুও সহমত হলেন,
–‘ হ্যাঁ, ওরা গার্ড রাখে। আর কলেজের প্রিন্সিপাল আমার পরিচিত। আমি পারসোনালি দেখে রাখতে বলবো। ‘
তন্ময় ভাইয়ের শক্ত কন্ঠ,
–‘ কিসের গার্ড। এতগুলো স্টুডেন্টদের কি সেফটি দিবে? আর ও যেই গাঁধি। এক পা আগাতে দশবার হোঁচট খায়, ওরে কিভাবে পাঠাতে চাচ্ছো? সাথে উটকো ছেলেরা যাচ্ছে, এখানে কিসের গ্যারান্টি? যাবার প্রয়োজন নেই। ‘
আমার চোখ ভিজে আসছে। আমি টলমল চোখ নিয়ে চাচ্চু – আব্বুর দিক তাকালাম। বড় চাচ্চু স্বর তুললেন,
–‘ মেয়েটা যেতে চাচ্ছে। তো যাবে। একা না ছাড়তে চাইলে, আমি রবিনকে পাঠাবো সাথে। দুদিন এর ট্রিপ। ঘুরে আসুক। ‘
আমি সহমত হলাম,
–‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ। রবিন ভাই গেলে…
উজবুকের থমথমে কন্ঠ,
–‘ ও যাবেনা। ‘
ব্যস। আব্বু নিজেও উজবুকের সাথে সহমত,
–‘ আমি ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো। তন্ময় যেহেতু চাচ্ছে না, তাহলে অবশ্যই কারণ আছে। আমি নিয়ে যাবো, হু? ‘
আমার কান্না পাচ্ছে। সবাই যাচ্ছে৷ স্যমনাও যাচ্ছে। ও তো প্রতিবার গিতেছে। আমিই একমাত্র অভাগী। কথা না বাড়িয়ে আমি সিঁড়ির দিক চললাম। পেছন থেকে বড় চাচ্চুর আওয়াজ,
–‘ কি হচ্ছে তন্ময়? ও যেতে চাচ্ছে, যাবে। ‘
তন্ময় ভাই জবাব দিচ্ছেন না। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। কি শয়তান এটা। তুই পস্তাবি দেখিস। উজবুক।

দুপুরে খেলাম না। রাতেও না খেয়ে। এবার সত্যিই খিদে পাচ্ছে। তাতে কি? খাবো না। উজবুক খাক সব। আমি স্বাস নিচ্ছি এতেও ওর সমস্যা। আমি মরলে ওর সমস্যা সমাধান হবে। এর মাঝে বড় মা আসলেন। আমি আঁড়চোখে তাকিয়ে, বিছানায় বসেই রইলাম। সে প্লেট আমার পাশে রাখলেন,
–‘ বাবাহ। মেয়ের দেখি রাগ। ‘
বলতে বলতে গাল টেনে দিলেন। আমি দ্রুত তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
–‘ বড় মা। আমি যাবো। প্লিজ। ‘
–‘ আচ্ছা। যাবি। ‘
–‘ তুমি পরে কথা ঘোরাবে। ‘
বড় মা আত্নবিশ্বাস নিয়ে বললেন,
–‘ যাবি। আমি বলছি৷ ‘
–‘ ছুঁয়ে প্রমিজ করো। ‘
বড় মা করলেন প্রমিজ।
–‘ অরুকে ছুঁয়ে বলছি। অরু এবার পিকনিক যাবে। ‘
ওরে, আমার খুশি কে দেখে। বড় মা নিজেই খাইয়ে দিলেন।

কিন্তু, খুশি বেশিক্ষণ টিকলো না। কারণ উজবুক গাড়ি করে দিয়ে আসবে, আবার নিয়ে আসবে। তো এখানে পিকনিনে যাওয়াটা কিভাবে হলো? যাবারই কি দরকার?

চলবে
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here