পড়ন্ত বিকেলে বিচ্ছেদ পর্ব ৩

❄️পড়ন্ত বিকালের বিচ্ছেদ❄️
তৃতীয় পর্ব
মিহি

–তোমাদের নির্বুদ্ধিতা দেখে আমি হতবাক।মর্গ থেকে লাশ কিভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে?

–স্যরি স্যার।

–লাশের ছবি দেখাও।

–এই যে স্যার।

ইন্সপেক্টর রাজিব রহস্যের হাতে লাশটার বেশকিছু ছবি ধরিয়ে দিল।ছবি দেখে রহস্য বেশ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল রাজিবের দিকে।

–কি হলো স্যার?

–এই ছবিতে সাদা ছাড়া কোন লাশ তো আমি দেখতে পারছি না।

–এটা কি করে হতে পারে??স্যার, এখানেই তো সব ছবি ছিল।

–কিছু তো একটা গণ্ডগোল আছে।এক কাজ করো,স্কেচ বানিয়ে নাও লাশটার।স্কেচ-আর্টিস্ট ডাকো।

–ওকে স্যার।

অদ্ভুত সব চিন্তায় মাথা ক্রমাগত হ্যাং হয়ে আসছে রহস্যের।এখন অবধি লাশের মুখটাও দেখতে পারেনি সে?লাশের এভাবে মর্গ থেকে উধাও হয়ে যাওয়া,ছবির ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যাওয়া-এসবের মধ্যে কোন যোগসূত্র নেই তো?

সায়ন বইটা বেশ ভালোভাবে রপ্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তনয়ার লাশটা মর্গ থেকে সরিয়েও ফেলেছে,এমনকি তনয়ার ছবিগুলোও। এখন রহস্য নামক ছেলেটা কখনোই জানতে পারবেনা তনয়ার পরিচয় । সকলের মন থেকে তনয়ার মুখ মুছে দেয়াও হয়ে গেছে । কেউ চাইলেও আর তনয়ার চেহারা মনে করো পারবে না । অদ্ভুত এক প্রশান্তি পাচ্ছে সায়ন । রহস্য কখনোই জানতে পারবেনা এই তনয়াই সে যে এক সময় তার প্রেমিকা ছিল । অলৌকিক শক্তির উত্তরাধিকার এখন শুধু তার হাতে কিন্তু রহস্য কোন না কোন ভাবে এই শক্তির সাথে জড়িয়ে আছে নয়তো তনয়া রহস্যের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়াত না কিন্তু তনয়া রহস্যকে ছেড়েছিল কেন? যাদের সাথে এই অলৌকিক শক্তির সম্পর্ক রয়েছে,সবাইকে তো সে নিজের সান্নিধ্যে রেখেছিল,রহস্য ব্যতীত। বেশ বড়সড় একটা জট পাকায় সায়নের মাথায়। তবে কি তনয়া সত্যিই রহস্যকে ভালোবাসত?রহস্যের প্রতি একটা চাপা ক্রোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে সায়নের। রহস্যকে শেষ করে দেওয়ার জন্য হাতদুটো নিশপিশ করতে থাকে।নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে সায়ন।চোখদুটো ক্রমাগত রক্তলাল হতে থাকে।

নীল মলাটের ডায়েরিটা আবারো হাতে নিয়েছে রহস্য। সারাদিনের ঝামেলায় অদ্ভুত এক বিরক্তি সৃষ্টি হয়েছে মনে। স্কেচ রেডি করতে বলেছিল রাজিবকে অথচ সে নাকি তনয়ার চেহারাই মনে করতে পারছেনা। এসব কখনোই স্বাভাবিক নয় । অস্বাভাবিকতার সহস্র পেঁচানো সুতোয় পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে এই বিষয়গুলো । ডায়েরিটা খুলতেই পরিচিত একটা গন্ধ পায় রহস্য । রজনীগন্ধার সুবাস । তনয়া রজনীগন্ধা ভালোবাসত খুব । প্রতিদিন রহস্য নিয়ে যেত একটা করে রজনীগন্ধা তার জন্য । যেদিন শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল,সেদিনও রহস্যের হাতে তনয়ার জন্য আনা একতোড়া রজনীগন্ধা ছিল কিন্তু দেওয়ার মতো অধিকারটা আর হয়ে ওঠেনি। নীল মলাটের ডায়েরিটায় চোখ দিল রহস্য ।
“প্রথম অনুভূতিগুলোকে কি নাম দেওয়া যায় আমার জানা নেই,হয়তো সেটা ভালোবাসা না । হতে পারে ভালোলাগা কিংবা মায়া তবে আমি যা জানি তা হলো আমি মারাত্মকভাবে তোমার ঐ ভাললাগা কিংবা মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। সবসময় পাশে চাইতাম তোমায় । স্ত্রী হিসেবে নয়,বন্ধু হিসেবে পাশে থাকতে চাইতাম। তোমার রাগ,অভিমান, ভালোবাসা, কষ্ট পাওয়া,কান্না -হাসি সবকিছুতে তোমার হাতে হাত রেখে পাশে থাকার সেই বাসনা বুঝি আমার জেদ হয়ে গেল।সত্যি বলতে,আমি আসার আগেও তোমার জীবনে একজন ছিল আমি জানতাম । জেনেও বেহায়ার মতো চাইতাম তুমি আমাকে ভালোবাসো । স্বামী হিসেবে এটা চাওয়া আমার কাছে অস্বাভাবিক নয় কিন্তু হয়তো তুমি মেনে নিতে পারছিলে না সবকিছু এত সহজে । তাই হয়তো সবসময় দূরে থাকতে । একটা সময় একে অপরকে বুঝতে শিখলাম তবে বোঝাপড়ার সময়টা ক্ষণিকের ছিল । অল্প সময়ের ব্যবধানে জানতে পারলাম তোমার বিয়ের পরের আরেক সম্পর্কের কথা । ভাবতাম কমতি বুঝি আমার মধ্যেই কিন্তু যেদিন বুঝলাম …….”কলিংবেলের শব্দে ডায়েরি থেকে নজর সরাল রহস্য।ঘড়ির দিকে তাকাল রহস্য।সাড়ে ন’টা বাজে।এই সময়ে কে নক করছে?আশেপাশে তো কোন বাড়িও নেই যে প্রয়োজন ছাড়া এসে নক করবে।ডায়েরিটা বন্ধ করে রিভলবার লোড করে দরজার কাছে গেল রহস্য । লুকিং গ্লাসে তাকাল রহস্য। তার বয়সী একজন ভদ্রলোক বাইরে দাঁড়িয়ে । রিভলবার সাইডে রেখে দরজা খুলল রহস্য । বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বেশ সঙ্কোচের সাথেই ভেতরে আসার অনুমতি চাইল । রহস্যের সামনাসামনি বসল লোকটা । কিছু বলার জন্য উশখুশ করছেন তিনি । বারদুয়েক কেশে মুখ খুললেন তিনি । “আমি সায়ন!তনয়ার বর।”লোকটার কথা শোনামাত্র বেশ আশ্চর্য হলো রহস্য । পুলিশ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে জেনেও সে এত সাহস নিয়ে রহস্যের বাড়িতে কি করে আসতে পারে?

–আপনি এখানে কেন এসেছেন সেটা বলুন।

–এসেছি একটা বিশেষ প্রয়োজনে।

–বলে ফেলুন।তারপর রাজিব এসে আপনাকে নিয়ে যাবে।

–আমার স্ত্রী তনয়া আপনার প্রাক্তন প্রেমিকা।বিয়ের বেশ কয়েক মাস পর আমি জানতে পারি সেটা।ভেবেছিলাম আপনাকে ভুলে আমার সাথে সংসার করতে পারবে তনয়া কিন্তু নাহ!!আমি ভুল ছিলাম।তনয়া যেমন আমায় ভালবাসেনি,তেমনই আপনাকেও কখনো ভালবাসেনি।জানিনা কি ব্যর্থতা৷ ছিল আমার!

–ব্যক্তিগত কথা বাদ দিয়ে কেস এর কথায় আসেন।

–তনয়ার খুন আমি করিনি।প্লিজ বিলিভ করুন।তনয়ার খুনের সাথে আমি কোনভাবেই জড়িত না।

–তাহলে আপনি পালিয়ে বেরাচ্ছেন কেন?কারন কি?

–আমার পালিয়ে বেড়ানোর কারণটা তনয়া।ওর মৃত্যুর পেছনে লুকিয়ে থাকা রহস্য।প্রতিমুহূর্তে তাড়া করে বেড়াচ্ছে ওর মৃত্যুর রহস্য।

–যা বলবেন স্পষ্ট করে।এসব হেঁয়ালি করবেন না।আমি পুলিশ স্টেশনে কল করছি।যা বলার আছে,পুলিশ স্টেশনে গিয়ে বলবেন।

–স্যার প্লিজ কয়েকটা মিনিট আমার কথা শুনুন
আমি এখানে এসেছিলাম আপনাকে মারার জন্য।

–এখনো যে ঐ ইরাদা নেই আপনার কেমনে বুঝবো??

–স্যার প্লিজ!!আমি তনয়ার লাশ সরিয়েছি।তনয়া র লাশ মর্গে থাকলে ওর শক্তিকে অন্য কেউ ব্যবহার করে সবকিছু তছনছ করে দিবে।

–কিসের শক্তি?

–তনয়ার কাছে অলৌকিক শক্তি ছিল।সেই শক্তি প্রাপ্তির নেশাতেই ও ঐ শক্তির সাথে জড়িত সমস্ত পুরুষের সাথে সম্পর্ক করেছে।

–আপনার এসব মনগড়া কাহিনি কি আমার আদৌ বিশ্বাস হওয়া দরকার?

–রহস্য সাহেব।শক্তির প্রমাণ চান??আপনি যেই নীল ডায়েরিটা পড়ছিলেন,সেটা এখন আপনার টেবিলে নেই। যে কালো রঙের সিম্পল ডিজাইনের কফি মগটাতে আপনি ব্ল্যাক কফি খান,সেটা ভেঙে পড়ে আছে রান্নাঘরে। কিছুক্ষণ আগেই ভেঙেছে,আমার আসার মুহূর্তে কিন্তু আপনার কানে শব্দ যায়নি।

রহস্য টেবিলের দিকে তাকাল।সত্যিই ডায়েরিটা নেই সেখানে।সামনে তাকাতেই দেখল সায়নও নেই সামনে।অথচ একসেকেন্ড আগেও সায়ন সামনেই বসে ছিল।চোখের পলকে কেউ কিভাবে উধাও হয়ে যেতে পারে?আশেপাশে তাকাল রহস্য।সামনে তাকাতেই দেখল সায়ন আবার নিজের জায়গায় বসে আছে।

–ব্ল্যাক ম্যাজিক ইউজ করছো নাকি টেকনোলজি?

–অলৌকিকতা বিশ্বাস করলে বলতে পারি।

সাইডে থাকা রিভলবারটা সায়নের কপাল বরাবর ধরল রহস্য।সায়ন হেসে উঠলো।সায়নের এই হাসির কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।সায়ন এখনো হেসে যাচ্ছে।অদ্ভুত এক রকমের হাসি তার।সায়নের হাসির সাথে সাথে পেঁচার সেই বিদঘুটে ডাকটা কানে আসলো রহস্যের।মাথাটা চিন চিন করতে শুরু করল,চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো।রিভলবার হাত থেকে পড়ে গেল রহস্যের।সায়নের হাসির মাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে । ধীরে ধীরে রহস্যের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল সে । সায়ন এগোতেই শব্দ তীব্র হতে লাগল । দুহাতে কান চেপে ধরে নিচে বসে পড়ল রহস্য । চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে । কোনোভাবেই চোখদুটো আর খোলা রাখতে পারল না রহস্য । ফ্লোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

চলবে……
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।আগামী পর্বে সকল রহস্যের সমাধান হবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here