বড্ড ভালোবাসি পর্ব ৪৪+৪৫+৪৬

গল্প :- বড্ড ভালোবাসি
পর্ব :- ৪৪
Writer :- Labiba Islam Roja
:
:
:
আকাশে আজ হাজারও তারার আনাগোনা আর তার মধ্যে একটা ইয়া বড় চাঁদ উঠেছে।চাদের আলোয় চারপাশটা আলোকিত হয়ে গেছে।চাঁদে মাঝে মাঝে মেঘের আনাগোনা চলছে।মনের মধ্যেও আজ হাজারো মেঘ জমে আছে।একদিকে যেমন প্রাপ্তি তেমনি অন্যদিকে প্রিয়জনদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট।বিয়ে মানেই একটা মেয়ের পুরনো পরিবেশকে ভুলে নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়াও।যাদের দুদিন আগে চিনতামও না তাদের সাথে কি মানিয়ে নিতে পারবো?এখানে তো আমার হাজারটা ভুল ঢাকার জন্য ভাইয়া আছে কিন্তু ওখানে তো নিজের বলতে কেউ নেই তাহলে আমার ভুলগুলো কে ডাকবে। আব্বু আম্মু ভাইয়া কাউকে কখনও ছেড়ে থাকিনি আজকে রাতের পরেই তো বদলে যাবে সব।তখন ওদের ছাড়া থাকবো কিভাবে আমি।আকাশের দিকে তাকিয়ে একমনে কথাগুলো ভেবে চলেছি আমি।হঠাৎ মাথায় কোমল হাতের স্পর্শে ঘুরে তাকালাম আমি আব্বু আর আম্মু একপাশে অন্যপাশে ভাইয়া আর ভাবি।আব্বু আদর মাখানো কন্ঠে বললেন….
.
কি হয়েছে আমার প্রিন্সেসের আজ এত চুপচাপ কেন?মা আবার বকেছে বুঝি।এখনও ঘুমাসনি কেনো?এত রাত জাগলে তো কাল শরীর খারাপ করবে রে মা।চল ঘুমাবি এখন।
.
আমি আর কথা বলতে পারছিনা এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এখন আর নিজেকে আটকাতে পারছিনা আব্বুকে জরিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরেছি আমি।সাথে সবাই আমাকে জড়িয়ে কাঁদছে কিন্তু নিঃশব্দে।যাতে আমি টের না পাই।নিজের চোখ মুছে কান্না জড়িত গলায় ভাইয়া বলছে…..
.
এত কাঁদছিস কেন তুই?তোকে বিয়ে দিচ্ছি একেবারে কাউকে দান করছি না।কয়দিন পর পর চলে আসবি।তাই এত কান্না করিস না আর তোর সাথে সাথে আমাদেরকেও কাঁদাস না আমি আর কাঁদতে পারবো না তখন কেঁদে ছিলাম বলে চোখ ভার হয়ে আছে সো এখন কাঁদতে পারছিনা কষ্ট হচ্ছে কান্না থামা।
.
আমি কান্না জড়িত চোখে ভাইয়ার দিকে তাকালাম যার চোখে অশ্রুতে টলমল করছে সে এতক্ষণ ধরে এত শক্ত হয়ে আমায় কথাগুলো বলছে কি করে।নিজেই কেঁদে ভাসাচ্ছে অথচ আমাকে মানা করছে।বুঝতে পারছি আমার কান্না ভাইয়ার সহ্য হচ্ছে না।হবেই বা কি করে ছোট থেকে কাঁদতে দেয়নি আমায় যখন যা চেয়েছি তাই এনে দিয়েছে।যাতে কোনেকিছুর জন্য কাঁদতে না হয় আমায়।পাশ থেকে ভাবি বললেন….
.
অনেক রাত হয়েছে এবার কান্নাকাটি বাদ দিয়ে চলো সবাই ঘুমাবো।কান্নার জন্য কালকে কনে বিদায়ে সময় অঢেল টাইম পাবে তাই এবার চুপ করো আর রুমে চলো তারপর সবাই যার যার রুমে চলে গেলাম।
.
বিছানায় উপুত হয়ে শুয়ে আছি আমি জানালা দিয়ে সকালের সোনালি রোদ এসে আমার গায়ে পরেছে।প্রকৃতিতেও কেমন শীতলতা বিরাজ করছে আজ।ব্যালকোনি দিয়ে বাতাস আসছে তাই হয়তো।ঘড়িতে কটা বাজে তার হুশ নেই আমার।অলসতার কারণে ফোনকেও ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে না কটা বাজে।তবুও অলস হাতে ফোনটাকে হাতে নিয়ে চমকে উঠলাম আমি।বেলা বারোটা অথচ আজকে কেউ এখনও রুমে এলো না।আমার ঘুম নিয়ে আব্বু ভাইয়ার তেমন সমস্যা নেই কিম্তু আম্মু এতক্ষণে তো বাড়ি মাথায় নেওয়ার কথা তাহলে আজ এত চুপ কেন?পরক্ষেই আবার মনে পরলো আজ আমার বিয়ে।অনেক জলপনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন।যাকে নিয়ে না চাইতোও কল্পনার রাজ্যে উকিঁ দিয়েছি আমি।যাকে ভাবতে ভাবতে আমার সময় কেটে যেতো কিন্তু তাকে নিয়ে ভাবনারা আমার শেষ হতোনা।আজ একজনকে যেমন নিজের করে সারাজীবনের মতো পাবো তেমনি তাকে পাওয়ার জন্য অনেকে ছেড়ে দূরে চলে যাবো কথাগুলো মনে হতেই অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার।
.
পার্লারের লোকেরা এসে সাজিয়ে দিয়ে গেছে আমায়।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার দেখে নিলাম নিজেকে।তিশা আনলিমিটেড কথা বলেই যাচ্ছে বলেই যাচ্ছে কিন্তু তার থামার কোনো নামই নেই।ওর শেষের কথাটা শুনে কেঁপে উঠলাম আমি।
.
দোস্ত আজ তোমাকে একা পেয়ে দেখ রিহান ভাইয়া কি করে?
.
কি করবে মানে!একা পেয়ে তোরা কোথায় থাকবি। আমার কথা শুনেই রসগোল্লারর মতো বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তকায়ে তিশা খিল খিল করে হেসে উঠলো আমি হ্যাবলার মতো ওর দিকে তাকিয়ে হাসির কারণ খুঁজতে লাগলাম কিন্তু পাচ্ছি না।
.
তুই কি দয়ালু রে দোস্ত তোর মতো যদি সবাই হতো তাহলে আমাদের মতে ফ্রেন্ডদের কষ্ট করে বাসর ঘরের সামনে আড়ি পাততে হতো না।
.
এতক্ষণে বুঝলাম ও বাসর ঘরের কথা বলছে আর আমি ভাবলাম অন্যকিছু।ওর খুশী যেন ধরছেই না।ওর এই হাসিগুলো আমার ঠিক সহ্য হচ্ছে না।তাই ওর পাশে বসে বললাম খুব বাসর করতে ইচ্ছা করছে তাই নারে।
.
ও মাথা নারিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে হ্যাঁ বললো।ওর কথাশুনে মোবাইল হাতে নিলাম আমি।আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে তিশা হয়তো কি করবো সেটা ভাবতে ব্যস্ত।
.
কিরে ফোন দিয়ে কি করবি?রিহান ভাইয়ার সাথে কথা বলবি(ভ্রু নাচিয়ে)
,
ওর খুশীতে এক বালতি পানি ঢেলে বললাম না রিহানকে নয় যে তোর বাসর করার শখ মিটাতে পারবে তাকে।আমার কথায় মুহূর্তেই তিশার মুখের সব হাসি মিলিয়ে মলিন হয়ে গেলো।
.
দয়া কর দোস্ত ওই বান্দরকে এখানে ডাকিস না।এখন এসব কথা শুনলে না জানি কি কি করবে।দেখ (গলা দেখিয়ে)এখনও বাদরের খামচার দাগ মিটেনি।
.
ওকে দিলাম না কল তোকে তো আমি বাদরের কাছে এভাবে পাঠাতে পারিনা বলেই হেসে উঠলাম আমি।
.
.
স্টেজে বরের বেশে বসে আছে রিহান।এখন শুধু রোজ আসার অপেক্ষা।একটু পর দেখলাম তিশা আর আপু রোজকে নিয়ে নিচে নামছে।নতুন বউয়ের মতো গুটিগুটি পায়ে নিচে আসছে রোজ।ওকে দেখে চোখ আটকে গেল।আরেকটু হলে হার্টফল করতো।চোখের সামনে কি দেখছি এটা মানুষ না পরী।।গোলাপি লেহেঙ্গা ম্যাচিং জুয়েলারি হাত ভর্তি চুড়ি ঠোঁটে ডিপ লিপস্টিক চোখে কাজল এতে যেন অপ্সরী লাগছে।অপলক চোখে দেখছি রোজকে।চোখের পাতা নড়ছে না।রোজকে আমার পাশে বসানো হলো।আবিরের গোতায় হুশ ফিরলো আমার।
.
কিরে এবার একটু আমাদের দিকে তাকা ভাই।বউকে আর কত দেখবি দেখ এখানে তোর বউ ছাড়াও আমরা আর অনেক সুন্দরী রূপসী মেয়েও আছে ওদেরও একটু দেখ।
.
আমার এত সুন্দরী রূপসী দেখার প্রয়োজন নেই আমার যাকে দেখা দরকার সেই অপ্সরীকে দেখলেই হলো।এসব ময়দা সুন্দরীদের তুই দেখ।
.
রিহানের কথাগুলো কানে আসতেই লজ্জা রাঙা মুখ করে মাথা নিচু করে বসে আছি।আড়চোখে উনার দিকে একবার তাকালাম আমি।এখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি।তাই আবারও চোখ সরিয়ে নিলাম।খয়েরি শেরওয়ানীর সাথে গোলাপি পাগড়ী।হাতের ভাঁজে বিশাল উরনা জরিয়ে ডান পাশে ফেলে রেখেছেন উনি।
.
ওটা হবে না বস এখানে বান্দরনীকে দেখতে পাচ্ছিস না।ও গেলে তবে একটু চান্স নিয়ে দেখা যেতো।কথাটা শুনেই চোখ বড় বড় করে তাকালো তিশা।ব্যস ভাইয়া মুখে আঙ্গুল দিয়ে বসে আছে।
.
একটু পর কাজীকে নিয়ে স্টেজে আসলেন আব্বুসহ অনেকেই।যখন আমাকে কবুল বলতে বলা হচ্ছিলো মুখ থেকে যেন কথা বের হতেই চাচ্ছে না।কেউ যেন গলা চেপে ধরে কথা আটকে দিয়েছে।চোখ থেকে টুপটাপ পানি পরছে।এদিকে সবাই আস্তে আস্তে করে বলছে কবুল বলার জন্য কিন্তু পারছিনা।ভেতরটা দুমরে মোচরে শেষ হয়ে যাচ্ছে।এই একটা শব্দই সবার কাছ থেকে দূরের করে দেবে আমায়।এই বুঝি বাবার প্রিন্সেস নামটা ঘুচে যাবে।ভাইয়ার কাছে সেই অবাধ্য আবদারগুলো হারিয়ে যাবে দূর অজানায়।আম্মুর অকারণে বকা শোনা সেই ভাইয়া আর আমার হাসাহাসি সব যেন হারিয়ে যাবে নিমিষেই।
.
আবারও কানে আসলো তিশার কথা এই রোজ কবুল বলনা।কাঁদিস না বলে দে প্লিজ।
.
পাশ থেকে আম্মুও বলে উঠলো সোনা মা এভাবে কাঁদে না বলে দেনা।।
.
অতপর অস্পষ্ট সুরেই বলে দিলাম সেই কাঙ্কিত কথাটি।বিয়ে সম্পন্ন হলে খেতে চলে গেলো সবাই।এদিক ওদিক সবার ছবি তোলা হাসি তামসার কি বাহার।কিন্তু এতকিছুর মাঝে আমার মাথায় হাজারো কথা ঘোরপাক খাচ্ছে।কিছুই ভালো লাগছেনা আমার।মাথাটা কেমন করছে।আমি এদিক ওদিক নিজের আপনজনদের দেখছি কত শত ভালোবাসায় গড়া এই সম্পর্কগুলো। এদের ছেড়ে আমি যাবো কিভাবে থাকবো কিভাবে।
.
অবশেষে বেজে গেলো বিদায়ের ঘন্টা।গাড়ির কাছে যেতেই বুক ফেঁটে কান্না আসলো আমার।আজ নিজের বাড়িটাকে বড্ড আপন মনে হচ্ছে।বাড়ির আনাচে কানাচে কতশত স্মৃতি লুকিয়ে আছে।বাবার আদর ভাইয়ার ভালোবাসা আম্মুর বকুনি সবকিছুই যেন আজ ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে।এই বুঝি আব্বুর কাছে সব আবদার শেষ হয়ে গেলো আমার।মামনি ডাকটা বুঝি ঘুচে গেলো আমার জীবন থেকে।এসব ভেবেই আব্বু আর আম্মুকে জরিয়ে অঝর ধারায় কেঁদে চলেছি আমি।রিহান একহাতে আমায় ধরে আব্বুর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলো।এই ছেলেটাকে এখন আমার খুন করতে ইচ্ছা করছে আমার আব্বু আম্মুকে জরিয়ে একটু কাঁদতে দিলো না। ভাইয়া কোথায় গেলো চারদিক তাকিয়ে খুঁজচ্ছি আমি কিন্তু কোথাও নেই।হাঁটতে পারছিনা রিহান ধরে ধরে গাড়ির সামনে নিয়ে গেলো আমায়।গাড়িতে উঠতে যাবো তখনই গাড়ির সামনে চোখ গেলো আমার।ভাইয়া ওখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।রিহানকে ছাড়িয়ে ভাইয়ার কাছে গিয়ে গলা জরিয়ে ধরলাম আমি।ভাইয়াও শক্ত করে জরিয়ে আছে আমায়।একমাএ ভাইয়াই ছিলো আমার খেলার সাথী।কত জ্ববলিয়েছি।সবাই যখন গভীর ঘুমে তখন ভাইয়াকে ঘুম থেকে তুলে বেরিয়ে গেছি আইসক্রিম খেতে।কখনো এতটুকু বিরক্তি দেখিনি মুখে।আজ যেন চিরকালের মতো ভাইয়ার কাছে সব অবাধ্য আবদার শেষ হয়ে যাচ্ছে আমার।আর কখনও গভীর রাতে চাইলেও আইসক্রিম খাওয়াবে কে আমায়।হাপিয়ে গেলে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরবে কে।কথাগুলো ভাবছি আর কাঁদছি ভাইয়াও কেঁদে চলেছে।।ইসস! মেয়েদের ভালোবাসা কত কষ্টের।কি নির্মম দুনিয়ার রীতি।একজনকে আপন করে পাওয়ার জন্য হাজারজনকে পর করে পাড়ি দিতে হয় অজানা রাজ্যে।কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে গেছে আমার।আবারও রিহান বাধা আমার সামনে ভাইয়ার কাছ থেকে ছাড়িয়ে কোলে তুলে গাড়িতে বসিয়ে দিলো আমায়।আমি এখনও কেঁদে চলেছি।আমাকে বসিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেও এসে বসলেন আমার পাশে।আমার মাথা উনার বুকের সাথে চেপে ধরে আছেন উনি।চোখের পানিতে উনার শেরওয়ানী ভিজে একাকার।টিস্যুর বক্স এগিয়ে দিয়ে পরম যত্নে আমার চোখ মুছে দিয়ে পানি খাওয়ালেন উনি।।উনি বার বার থামতে বলছেন কিন্তু চোখের পানি তো কারো কথা শুনবে না সে তো ভেসেই যাচ্ছে আপন গতিতে।উনি করুন কন্ঠে বললেন…..
.
এই রোজ এবার থামো জানো আজ নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।আমার জন্য সবাইকে ছাড়তে হলো তোমায় তেমার বাবার রাজ্য খালি করে আমার রাজ্যের রাণী বানাবো বলে নিয়ে যাচ্ছি।তোমাকে ভালো রাখতে কতটা সক্ষম জানিনা তবে ভালোবাসার অভাব থাকবে না।ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখবো তোমায়।এভাবে বাচ্চাদের মতো আর কেদো না প্লিজ।কষ্ট হচ্ছে তো খুব। তোমার চোখের প্রতিটি পানির ফোঁটা আমার কলিজায় তীরের মতো বিধছে।তোমাকে বলছিনা এত চিন্তা করবে না।আমি আছি তো তোমার পাশে কি পারবো না তোমায় ভালো রাখতে।মুখে হাসি ফুটাতে।
.
আমি উনাকে জড়িয়ে ধরে মৃদু সুরে বললাম হুম।উনি আমাকে আরো শক্ত করে কোমড় জরিয়ে উনার কাছে নিয়ে গেলেন।
..
.
চলবে…………..
..
গল্প :- বড্ড ভালোবাসি
পর্ব :- ৪৫
Writer :- Labiba Islam Roja
:
:
:
-: দেখতে দেখতে ভাবির বাসায় পৌছে গেলাম আমি।যার নাম এখন ভাবির বাড়ি বা রিহানের বাড়ি নয়।এখন নাম হয়েছে শ্বশুর বাড়ি।দুধ মিষ্টি খাইয়ে মিষ্টি হেসে আমাদের বরণ করলেন রিহানের মা।আন্টির পাশে তিশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলাম আমি।আবার ওর পাশ ঘেষে আবির ভাইয়াকে দেখে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হলো।আমাদের এখানে আমার ফ্রেন্ড আর এখানে আবির ভাইয়ার উডবি ওয়াইফ হিসাবে এসেছে।বাহ দোস্ত তো আমার থেকেও একধাপ এগিয়ে।আমাকে দেখে চোখ টিপে মিষ্টি একটা হাসি দিলো তিশা জবাবে আমিও একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলাম ওকে।
.
বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে আছি আমি আর আমার ঘা ঘেষে বসে আছে তিশা।সামনে রিহানের এক ঝাঁক বন্ধু।কিন্তু রিহানকে কোথাও দেখতে পাচ্ছিনা।আমাকে এখানে অস্বস্তির মধ্যে রেখে কোথায় যে গেলো কে জানে।।তারা অনেক কথা বলছে যার কিছু বুঝতে পারছি আর কিছু পারছিনা।মাথাটা ব্যাথা করছে এদের কোনো কিছুই আমার ভালো লাগছে না।এখন যদি ঘুমাতে পারতাম তাহলে হয়তো ভালো হতো।কিন্তু এটা তো আমার বাড়ি না যে যখন যা ইচ্ছা তাই করব এর নাম যে শ্বশুর বাড়ি এখানে কিছু করার আগে দশবার ভাবতে হবে আমাকে।এদিকে পেটেও ইদু্ঁর দৌড়াচ্ছে।সেই কোন সকালে দুই লোকমা ভাত আম্মু জোর করে খাইয়ে দিয়েছিল সারাদিনে আর দানা পানিও পেটে পড়েনি।হঠাৎ লিনা আপু বলল এই যে রোজ ওই দেখ তোমার বর মশাই নিচে নামছেন।আপুর কথায় সামনে চোখ তুলে তাকালাম আমি।হোয়াইট টি-শার্ট পরে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে নিচে নামছেন উনি।উনার চোখে চোখ পরতেই চোখ সরিয়ে নিলাম আমি।
.
রাতুল ভাইয়ার ঘাড়ে হাত দিয়ে সোফার হাতলে বসলেন উনি।রিহান আসার সাথে সাথে কোথা থেকে আবির ভাইয়াও এসে হাজির।বসেই সবার উদ্দেশ্যে বললেন….বাচ্চারা আমার বাসর নিয়ে কার কি প্ল্যান আছে ফটাফট বলে দাও।
.
তখনই আসিফ ভাইয়া বললেন….দোস্ত আজ তোমার বাসর রাত সেখানে আমরা একটু আরটু মজা করবো না তা তো হতে পারেনা।হুম অনেক প্ল্যান আছে কিন্তু তোকে বলা যাবেনা।তোকে বলে দিলেই তো সব শেষ।
.
আমাকে না বললেও কিছু হবে না।তোরা আমার বন্ধু তোরা এ নিয়ে মজা করবি না তা কি হতে পারে।করতেই পারিস তাতে আমার কোনো আপওি নেই।
.
তুই আপওি করলেও কেউ শুনছে না।তবে এটা জেনে যা আমরা তোকে আজকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছি না।তোর মনে আছে আমার বাসরে কি কি করেছিলিস এই সবকয়টাকে নিয়েে।এবার আমার চান্স এসেছে শোধ নেওয়ার।আজকে টের পাবা দোস্ত জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।কিরে আবির তুই আছিস তো আমাদের সাথে।
.
না দোস্ত আমি এসব কাজে নাই।রোজ আমার বোনের মতো ওর সাথে আমি কি করে এমন করতে পারি।তাছাড়া দুদিন পর আমিও বাসর করবো তাই আমি কারো সাথে লাগতে চাইনা ভাই।আমি এসবে নাই আমাকে ছাড়।
.
ভাইয়ার কথায় হেসে উঠলো সবাই।তখনই আবারও রিহান বলে উঠলেন…..তোরা কি জানিস তোদের সব প্ল্যান মাঠে মারা গেলো।
.
সবাই জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উনার দিকে।উনি বললেন….কারণ আজ আমার বাসর হচ্ছে না।সো সব প্ল্যানের কবর দিয়ে যে যার মতো ঘুমিয়ে পরো।আর কেউ আবার এটা ভেবো না আমি মিথ্যা বলছি।
.
ভাই আমাদের ঘুম পাড়িয়ে কোনো ডিস্টার্ব ছাড়া বাসর করে বোকা বানাবি তাই তো।
.
না দোস্ত আমি এসব কিছুই করবো না।আমি আমার বাচ্চা বউয়ের কথা চিন্তা করে এই ডিসিশন নিয়েছি।আজকে এত দখল গেছে তার উপর কেঁদে কেটে একদম ক্লান্ত হয়ে গেছে ও তাই আজ আর বাসর করবো না।ওর একটু রেস্ট নেওয়া উচিৎ ওকে গাইজ তোমরা ঘুমালে ঘুমাও নাহলে আড্ডা দাও।আর তিশা আমার বউকে খাইয়ে ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব তোমার।ওকে আমার ঘুম পাচ্ছে গুড নাইট বলে হাই তুলতে তুলতে উপরে চলে গেলেন উনি।
.
উনার কথাগুলো ঠিক বিশ্বাস করতে পারলাম না আমি।উনি যাওয়ার পর সবাই মুখ গোমরা করে উনাকে এককগাধা গালাগাল দিয়ে যে যার মতো গিয়ে শুয়ে পরলো।একটু পর আন্টি এসে খাইয়ে দিচ্ছেন আমায় আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি উনার দিকে।শুনেছি শাশুড়ি খুব একটা ভালো হয়না।কিন্তু উনাকে দেখে ধারনাটা পাল্টে গেলো আমার।
.
শোন মা তুমি শুধু আমার বউমা নও আমার মেয়েও।আমার এক মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়েছি আমি এখন তার জায়গায় তোমাকে পেয়েছি।এখন থেকে রাহার মতো তুমিও আমাদের আরেক মেয়ে।আর আমি জানি সারাদিন ধরে কিছুই খাওনি তুমি।মুখ দেখেই তা স্পষ্ট এবার থেকে কোনো অনিয়ম করবে না কিন্তু বুঝেছো।
.
আমি ছলছল চোখে তাকিয়ে আছি…..আন্টি আপনি
.
একদম চুপ করো।একবার আন্টি ডেকেছো মেনে নিলাম কিন্তু এরপর থেকে আর আন্টি নয় মা শুনতে চাই।কি বললাম তোমায় আমার মেয়ে তুমি।আর মেয়েরা মাকে আন্টি বলে ডাকলে কেমন লাগে বলতো।
.
উনাকে যত দেখছি ততো অবাক হচ্ছি আমি।কি করে আমাদের সম্পর্কটাকে সহজ করে দিলেন উনি।আম্মু আপনি খাবেন না?
.
এইতো আমার লক্ষ্মী মেয়ে বলেই কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালেন উনি।উনাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলাম আমি।
.
বাসর ঘরে বসে আছি আমি।রিহান তখন বন্ধুদের বোকা বানানোর জন্য ওসব বলেছে আর সবাই সেটা বিশ্বাস করে এতক্ষণে খেয়ে ঘুমিয়েও পরেছে।কথাটা শুনেই বুঝতে পারলাম আমার বরের ব্যাপক বুদ্ধি আছে আর তার সাথে কেউ পারবেনা।তিশা আর আবির ভাইয়া আমাকে সবটা খুলে বললো।এরপর আমাকে এখানে রেখে ওরা চলে গেলো।পুরো ঘরটা গোলাপ আর রজনীগন্ধা বেলী দিয়ে সাজানো।ফুলের সুবাসে পুরো ঘরটা মম করছে।মনটা খারাপ থাকলেও এখন এরকম একটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশে মন খারাপ করে থাকাই যায় না।এই ঘরে আরো এসেছি কিন্তু আজকের মতো অনুভূতি কখনো হয়নি।বুকের ভিতরে ধুক ধুক করছে।কেমন যেন অন্যরকম একটা ফিলিংস হচ্ছে আজ।হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলাম আমি।দরজার দিকে তাকাতেই দেখলাম রিহান ঘরে ডুকেছে পরনে মেরুন রঙের পাঞ্জাবী।উনাকে দেখে হার্টবিট দ্রুত চলছে আমার।আবার কিছুটা ভয়ও করছে তাই গুটিশুটি মেরে বসে আছি।
.
উনি বিছানার কাছে আসতেই বিছানা থেকে নেমে উনাকে সালাম করলাম আমি। আমার হাত ধরে থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুললেন উনি।ইসস আমার বউটাকে তো আজ অন্যরকম রূপে দেখছি বলেই কপালে চুমো দিয়ে বললেন….তোমায় #বড্ড_ভালোবাসি রোজ #বড্ড_ভালোবাসি♥….আমিও উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম আমিও #বড্ড_ভালোবাসি♥ আপনাকে।
.
আচ্ছা শুনেছি বাসর রাতে দু রাকাত নফল নাময পড়তে হয় চলো পড়ে নিই।
.
হুম চলুন।তারপরে দুজনে নামায পড়ে নিলাম।
.
নামায শেষে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে রোজ।রিহান কাছে এসেই রোজের কাধে নাক ডুবিয়ে দিলো।রিহানের ভালোবাসার স্পর্শে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো রোজ।আচমকাই রিহান রোজকে কোলে তুলে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো….আজ ভালোবাসার রাত রোজ।অনেক ভালোবাসা দিবো তোমায়।।
.
উনার কথায় লাজুক উনার বুকে মুখ লুকালাম আমি।চুপচাপ উনার বুকে মুখ গুজে পড়ে আছি। গোলাপের পাপড়ি দেওয়া বিছানায় শুইয়ে দিলো রোজকে।দুজনেই হারিয়ে গেলো ভালোবাসার গভীর সমুদ্রে।আজ ওদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো।শুরু হলো জীবনের নতুন এক অধ্যায়।
.
.
ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো রোজের।আবছা অন্ধকার দেখা যাচ্ছে রুমে।আজ নিজের সাথে মিশে আছে অন্য একজন।চোখ তুলে উনার দিকে তাকালাম আমি।ঘুমের মধ্যে কি নিষ্পাপ লাগছে উনাকে।একদম বাচ্চাদের মতো করে ঘুমিয়ে আছেন।কথাটা ভেবেই মুচকি হেসে উনার কপালে চুমো একেঁ দিলাম আমি।উনি কিছুটা নড়ে আবারও আমাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।আস্তে করে উনার হাত সরিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে নীল শাড়ি পড়ে ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে আছি আমি।চারিদিকে ঝাপসা অন্ধকার আর আমার চোখে রঙিন স্বপ্নের আলো।উনার সাথে কাটানো কতশত স্মৃতি আজ ভীড় করেছে মনের আঙিনায়।উনার সাথে সেই প্রথম দেখা হওয়া ঝগড়া চড় থাপ্পড় ভুল বোঝাবুঝি উনার সাথে কাটানো মুহূর্ত খুনসুটি।এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে এত সময় পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনিআমি।হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর যেতেই দেখলাম সকাল নয়টা বাজে আমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছি।তাই দেরি না করে রুমে গেলাম আমি।উনি এখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন।আমাকে ঘুম কাতুরে বলেন এখন নিজেই এত ঘুম ঘুমাচ্ছেন অদ্ভুদ।উনার কানের কাছে গিয়ে আস্তে করে বললাম…..
.
এই যে শুনছেন অনেকবেলা হয়ে গেছে সকাল নয়টা বাজে উঠুন।উনি আমাকে একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন।এখন আমাকে একদম ডিস্টার্ব করবে না রোজ আমি এখন ঘুমাবো বলেই আমাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন উনি।
.
আরে আমি আপনাকে ঘুম থেকে উঠাতে চাইছি আর আপনি আমাকে ঘুম পাড়াচ্ছেন।
.
জাস্ট টেন মিনিটস আমাকে এভাবে ঘুমাতে দাও প্লিজ।রোজ আর কিছু বললো না রিহানের বুকে মাথা রেখেই শুয়ে পড়লো।কিছুক্ষণ পর আবারও ঘড়ির টাইম দেখে চমকে উঠলো রোজ দশটা বাজে।কখন ঘুমালাম বাসার সবাই কি ভাববে।এবার রিহানকে না ডেকেই ওকে ছাড়িয়ে নিচে চলে গেলো রোজ।
.
.
চলবে…..
.গল্প :- বড্ড ভালোবাসি
পর্ব :- ৪৬
Writer :- Labiba Islam Roja
:
:
:
-: ড্রয়িংরুমে এসেই দেখলাম এখানে গল্পের হাট বসেছে।সবাই যে যার মতো রিহানকে বকাবকি করেই যাচ্ছে।এদিকে কেউ কেউ কালকে রাতের বোকা বানানো ছেড়ে আজকের এত বেলা পর্যন্ত ঘুম নিয়ে পরেছেন।এ নিয়ে কি হাসাহাসি।আমি বসে বসে উনাদের কথা শুনছি।রিহানের মা এসে আমার হাতে এককাপ কফি ধরিয়ে উনার ছেলের রুমে পাঠালেন তাকে ডেকে তোলার জন্য।আমি তো ডেকে ডেকে হাঁপিয়ে গেছি সেটা হয়তো উনি জানেন না।তাই আবারও শাশুড়ির কথায় বাধ্য মেয়ের মতো উনার রুমে পা বাড়ালাম আমি।উনাকে শত শত ডাক দেওয়ার পরও উনার ঘুম ভাঙ্গলো না।উল্টো আমায় বলছে রোজ ইচ্ছে তুমিও ঘুমাও আমকেও ঘুমাতে দাও প্লিজ এই ভালো ঘুমটা নষ্ট করো না।তাই আবারও উনাকে ঘুম থেকে তুলতে ব্যর্থ হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে বসলাম আমি।আমি আসতেই তিশা কোথা থেকে মনে হলো উড়ে এলো।ওকে দেখে খুব খুশী মনে হচ্ছে।কিন্তু কেন সেটা বুঝতে পারছিনা।
.
রোজ কালকের রাত কেমন কাটলো হুম!! সবটা ডিটেলসে বল আমায়।
.
কেন তোকে বলতে যাবো কেন আমি?অন্যের বাসর সম্পর্কে না জেনে নিজেরটা সেরে নে না।
.
পেছন থেকে আবির ভাইয়া বলে উঠলো…ঠিকই বলেছো রোজ….তিশা ডার্লিং অন্যের খবর নিয়ে কি হবে।আমার সাথে চলো ক্লাইম্যাক্স দেখতে পাবে।
.
আবির ভাইয়ার কথা শুনে বড় বড় ঢোক গিলে পিছন ফিরে তাকালাম তিশা আর আমি।ভাইয়া আমাদের পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে মুখে শয়তানি হাসি নিয়ে।
.
আপনার সাথে কেন যাবো?আমি আমার বেস্টুর কাছে জানতে চাইছি সেখানে আপনি কথা বলছেন কেন?আপনাকে বলেছি কথা বলতে?
.
না বলোনি!!তুমি বলবে আর আমি শুনবো তা তো কোনো কথা নয়।তাছাড়া আমাকে কি বউ পাগলা পেয়েছো বউয়ের কথায় উঠবো আর বসবো।ওহহ সরি!!তুমি তো আমার বউই নও উডবি বউ।শুধু বউ হলে ভেবে দেখতাম।
.
ধুর এখানে আসাই আমার ভুল হয়েছে বলেই গাল ফুলিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো তিশা।এর এমন বিহেভ দেখে হাসতে লাগলো সবাই।
.
.
দুপুর বারোটার দিকে ঘুম ভাঙ্গলো উনার।উঠেই তাড়াহুড়ো করে শাওয়ার নিয়ে রিসেপসনের কাজে লেগে পরলেন উনি।।উনাকে এখন আস্ত চিবিয়ে খেতে ইচ্ছা করছে আমার।শয়তান ছেলেটার জন্য সবার সামনে কি লজ্জাটাই না পেতে হলো কিভাবে হাসাহাসি করছিলো এ নিয়ে ছিঃ এ ছেলের লাজ-লজ্জা বলে কিছু নাই।একটু পর পার্লারের লোক এসে সাজাতে শুরু করলো আমায়।গায়ে আবারো চকলেট কালারের ভারী লেহেঙ্গা জড়িয়ে দিলো আমার।যার ভারে নুয়ে নুয়ে পরছি আমি।স্টেজের দিকে নিয়ে গেল তিশা সেখানে আগে থেকেই রিহান ছিলো।চকলেট রঙের পাঞ্জাবী গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি অপরূপ লাগছে।আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে কাছে আসলেন উনি হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।আমিও উনার হাত ধরে স্টেজে উঠে বসলাম।ফটোগ্রাফাররা এসে ভীড় জমিয়েছে আমাদের সামনে।নানান পোঁজের ছবি তুলতে ব্যস্ত ওরা।সাথে আবির তিশার দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া তো লেগেই আছে।স্টেজের সামনে আম্মুকে দেখে সেখানে দৌড়ে গেলাম আমি।আম্মু আব্বু ভাইয়া ভাবীসহ সবাই এসেছেন।আম্মুকে জড়িয়ে কেঁদে অস্থির আমি।ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কয়েকটা চকলেটের বক্স ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ভাইয়ার দিকে।
.
এখন তো আর তোর জন্য চকলেট নিয়ে আসতে পারবোনা তাই একসাথে দিয়ে গেলাম।এগুলো শেষ হওয়ার আগেই আবার এসে দিয়ে যাবো আমি ঠিক আছে।
.
ভাইয়াকে জড়িয়ে কাঁদছি আমি।আজকের দিনেও ভাইয়া নিজের দায়িত্ব থেকে পিছায়নি।এখানেও চকলেট নিয়ে এসেছে।ভাইয়া এমন একটা শব্দ যার সাথে কোনোকিছুর সাথে তুলনা হয়না।যতই ঝগড়া মারামারি হউক না কেন “ভাইয়া” শব্দটাই যে ভালোবাসার ফুলঝুরি।
.
ড্রিম লাইটের আলো জ্বলে উঠলো রোজ আর রিহানকে ঘিরে।সবাই যে যার ডান্স পার্টনার নিয়ে স্টেজে উঠলো।রোজের ভারী লেহেঙ্গা নিয়ে উঠতে প্রবলেম হচ্ছে দেখে রিহান সবার সামনে ওকে কোলে তুলে নিলো।রোজ তো লজ্জায় মরে যাচ্ছে সবার সামনে।রোজ রিহানের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো….
.
কি করছেন নামান আমাকে সবাই কিভাবে দেখছে আমি যেতে পারবো।
.
দেখলে দেখুক!!আমি তো অন্য কারো বউকে নিয়ে যাচ্ছি না আমার বউকে কোলে তুলে নিয়ে যাচ্ছি এতে প্রবলেম কোথায়।স্টেজে পৌছেই রিহান রোজকে নামিয়ে দিলো।রোজ লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে আছে এটা দেখে রিহান একটানে কোমড় জড়িয়ে রোজকে কাছে নিয়ে এলো।এদিকে মিউজিক অন হয়ে গেছে…
.
♪তু আতা হ্যা সিনেমে……😍😍
♪যাব যাব সাসে ভারতি হু….😱😱
🎻তেরে দিলকি গালিও সে…..😘😘
♪ম্যা হার রোজ গুজারতি হু…..😗😗
🎸হাওয়া কে জ্যাসে চালতা হ্যা তু…..🐸🐸
♪ম্যা রেত জ্যাসি উরতি হু…….😲😲
♪কন তুঝে ইউ পেয়ার কারেগা……❤❤
🎶জ্যাস ম্যা… কারতি হু….💑💑
.
ডান্স শেষে সবাই করতালি দিতে থাকে।রোজ রিহানকে সরিয়ে রিহানের মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো।আর রিহান রোজের লজ্জায় চলে যাওয়া দেখে মুচকি হাসলো।
.
.
অনুষ্ঠান শেষে রোজ রুমে এসেই ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরলো।সারাদিনের দখলে এখন বড্ড ঘুম পাচ্ছে ওর।কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পরলো রোজ।রিহান রুমে এসে দেখলো তার ঘুমকুমারী ঘুমিয়ে পরেছে।কিছুক্ষণ ওর পাশে বসে ওয়াশরুমে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে এসে রোজের সামনে শুয়ে কিছুক্ষণ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো তারপর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ওকে বুকে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।
.
মাঝরাতে পায়ে ঠান্ডা কিছুর ছোয়ায় ঘুম ভাঙ্গলো রোজের।পাশে রিহানকে দেখতে না পেয়ে ধরফড়িয়ে উঠলো সে।পরক্ষণেই বুঝতে পারলো রিহান ওর পায়ের কাছে বসে আছে।
.
উফ রোজ এত নড়ছো কেন?তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে তাহলে এখন উঠলে কেন?
.
আপনি কি করছেন আমার পায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?হাত সরান বলছি।
.
হুম এবার ঠিক আছে।দেখতো কেমন হয়েছে।
.
পায়েল!
.
হুম!!এটা কালকে তোমার গিফট হিসাবে তোমাকে দেওয়ার জন্য এনেছিলাম কিন্তু কালকে ভুলে গিয়েছিলাম তাই আজকে পরিয়ে দিলাম।
.
তাই বলে পায়ে হাত দেবেন।আমাকে দিলেই তো আমি পরতে পারতাম।
.
আমার অনেকদিনেরর ইচ্ছা আমার বউকে নিজ হাতে পায়েল পরাবো।আর আজকে সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দেবো তা কি হয়।এতদিন বউ ছিলো না বলে পরাতে পারিনি এখন বউ আছে পরিয়ে দিলাম।
.
ঠিক আছে আপনি এখানে দাঁড়ান বলে বিছানা থেকে নেমে উনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম আমি।
.
এটা কি রোজ?বারবার পায়ে হাত দাও কেন?মুখ দিয়ে সালাম দিলেই তো হয়।আর শোন কালকে সালাম করতে না করিনি কারণ এটা নিয়ম আজকে বলছি আর কখনও পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবে না
মুখ দিয়ে দেবে।এসব আমার ভালো লাগেনা রোজ।তোমার জায়গা পায়ে নয় রোজ আমার বুকে(বুকে টেনে নিয়ে)
.
জ্বী হুকুম মহারাজ!!কিছুক্ষণ পর চলুন না চাঁদ দেখে আসি।
.
ওকে চলো বলেই ব্যালকোনিতে গিয়ে দাড়ালাম দুজনে।রিহান পেছন থেকে কোমড় জড়িয়ে চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলেন।শীতল কন্ঠে বলে উঠলেন….জানো রোজ এখানে এতগুলো লাল গোলাপের গাছ কেন?আমি মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি উনার দিকে।আমাকে ছেড়ে গাছগুলো কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন উনি।তোমার জন্য রেড রোজ শুধু তোমার জন্য।যখন তোমার নাম জানতে পারলাম তখনই এই গাছগুলোকে এনে রোপন করেছিলাম ….কারণ এগুলো থাকলে এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলবো না আমি।এর সুবাসে যাতে ঘুমের মধ্যেও তোমায় অনুভব করতে পারি।আর তাই হলো এর সুবাসে ঘুমের মধ্যে তোমায় অনুভব করতে পারতাম।
.
আচ্ছা চাঁদ দেখা হলো তোমার?
.
হুম আপনি দেখবেন না?
.
আমার কথায় হাসলেন উনি।আমি তো আমার চাঁদকে দেখতেই ব্যস্ত তাই আকাশের চাঁদটাকে দেখার সময় পাইনি।এই চাঁদকে দেখেই পাগল হয়ে যাচ্ছি আর ওই চাঁদকে দেখবো না।নেশা ভরা কন্ঠে বললেন এখন আমার চাঁদের সাথে পাগলামি করবো আমি।লজ্জায় উনার বুকে মুখ লুকালাম আমি।আমাকে কোলে তুলে রুমে প্রবেশ করলেন উনি।আমাকে বেডে শুইয়ে নিজের সমস্ত ভার ছেড়ে দিলেন আমার উপর।দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।
.
কি হলো ছাড়ুন।
.
উহুম ছাড়বো না বলে আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন আমায়।
.
আগে যাও একটু ভালো ছিলাম কিন্তু কথা বলে সেটাও নষ্ট করলাম।কেন যে বলতে গিয়েছিলাম কে জানে?এখন উনার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মরো।
.
পরদিন সকাল থেকেই যে যার মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো।উনি আর বাবা ব্রেকফাস্ট করে অফিসে চলে গেলেন।আমি আর মা একা একা বাসায় আছি।মা রান্না করছেন।যেহেতু রান্নার “র” জানিনা সেহেতু মায়ের পাশে দাঁড়ালাম আমি।আমাকে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিলেন উনি।জবাবে আমিও একটা দিলাম।উনার কাছ থেকে কিছু রান্না শিখছি আমি।এভাবেই কেটে যাচ্ছে আমাদের দিনগুলি।আগামীকাল তিশার গায়ে হলুদ।আমার তো নাগিন ডান্স দিতে ইচ্ছা করছে।।এ নিয়ে তিশা অনেকবার কল দিয়েছে আজকে যাওয়ার জন্য কিন্তু স্বামী মহাদোয় আমাকে নিয়ে যাবেন কিনা সিওর জানিনা আমি।সন্ধ্যার পর অফিস থেকে বাসায় ফিরলেন উনি।উনার জন্য কফি নিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম আমি।এসেই ফ্রেশ হয়ে ল্যাবটপ নিয়ে বসে পড়েছেন উনি।উনাকে কফি দিয়ে সোফায় গাল ফুলিয়ে বসে আছি আমি।উনি একবার আড়চোখে আমাকে দেখে আবারও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন উনি।এবার উনার সামনে গিয়ে দাড়ালাম আমি কিন্তু তাতেও উনার কোনো হুশ নেই।আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে কাজ করে চলেছেন উনি।এখন আর রাগকে দমিয়ে রাখতে না পেরে ল্যাবটপটাকে বন্ধ করে উনার গলা জড়িয়ে উনার সামনে বসলাম আমি।আমার কান্ডে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন উনি।
.
কি হয়েছে আজ আমার বউয়ের!! এত ভালোবাসা দেখাচ্ছ যে স্বামীর প্রতি।এমনিতে তো ধারে কাছেও পাওয়া যায় না।সারাক্ষণ মায়ের সাথে থাকো তাহলে আজ কি হলো হুমম।
.
অনেককিছু হয়েছে!!আমি এতক্ষণ ধরে আপনার সাথে কথা বলার চেষ্টা কররছি আর আপনি আমাকে ফেলে কাজ করছিলেন?আমার থেকে আপনার কাজ বড় হলো।
.
কি যে বলো তুমি!!বউয়ের থেকে বড় কাজ!! কিছুতেই নয়।এবার বলো কি বলবে।
.
কেন আপনি জানেন না আমি কি বলতে পারি।
.
হুম সেটা অবশ্য জানি!!ভালোবাসি বলবে তো আর বলতে হবে না আমি জানি।।
.
ধুর আর বলবোই না!! মন খারাপ করে চলে যেতে নিলেই হাত ধরে বিছানায় বসালেন উনি।গাল চেপে এত রাগ করছো কেন তুমি।আমি তো মজা করছিলাম।তিশার বিয়েতে যাবে তো।আমরা আগামীকাল যাবো না বিয়েরদিন এটেন্ড করবো।
.
যদি পুরো বিয়েতেই মজা করতে নাই পারি তাহলে আর বিয়ের দিন আমি যাবো না।তিশার বিয়ে গায়ে হলুদ নিয়ে কত স্বপ্ন ছিলো আমার।কত মজা হৈ হুল্লোড় করবো।এগুলোই যখন করতে পারবোনা তাই আর যাবোনা।
.
রাগ করলে বুঝি?আমি মাথা নাড়িয়ে না জানালাম।ছলছল চোখে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে।ছাদে গিয়ে বসে আছি আমি।আজ ওই বাড়ীর কথা খুব বেশি মনে পরছে আমার।আজকে যদি ওখানে থাকতাম তাহলে বেস্টুর বিয়েতে যেতে কেউ নিষেধ করতো না আমায়।না করলেও এ নিয়ে এতক্ষণে কেঁদে কেটে বাড়ী মাথায় নিতাম।কিন্তু এখানে তো উনাদের ইচ্ছাই সব আমার ইচ্ছার কোনো দামই নেই।। কালকে আমার বেস্টুর গায়ে হলুদ আর আমি থাকবেনা ব্যাপারটায় বেশ হাসি পাচ্ছে আমার।এটাও হওয়ার ছিলো কখনও ভাবতেই পারিনি রিহান আমাকে নিয়ে যাবেনা।এটাও ঠিক আমার ভাবনার উপর অন্যদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে না।
.
অনেক্ষণ ছাদে বসে আছি এবার রুমে গেলাম।রুমে একপাশে একটা লাগিজ দেখতে পেলাম।উনি কি কোথাও যাচ্ছেন রাগের বশে তখন জিজ্ঞেসও করা হয়নি।কিন্তু উনি কোথায়।একটু পর উনি রুমে প্রবেশ করলেন….
.
তুমি কোথায় ছিলে কতক্ষণ ধরে তোমাকে খুঁজচ্ছি কিন্তু কোথাও পেলাম না।
.
ছাদে গিয়েছিলাম কেন কি হয়েছে?আর লাগিজ আপনি কোথাও যাচ্ছেন নাকি?
.
হুম তবে শুধু আমি নয় আমরা যাচ্ছি।
.
আমরা মানে!!কোথায়….?
.
আমার বন্ধু আবির আর তোমার বান্ধবী তিশার বিয়েতে এটেন্ড করতে আগামীকাল সকালে আমরা ওখানে যাচ্ছি।দেখ তোমার কি কি লাগবে প্যাক করে নাও টাইম নেই সকাল সকাল যেতে হবে নাহলে একটা মারও মাটিতে পরবে না।এমনি আবির ক্ষেপে আছে।
.
আপনি না তখন?
.
মজা করেছিলাম তুমি কি বলো সেটা দেখার জন্য কিন্তু তুমি তো কিছু না বলে রাগে অভিমানে রুম থেকেই চলে গেলে।আমাকে এতটা খারাপ মনে করো না রোজ।তেমার ইচ্ছা অনিচ্ছার দাম আছে আমার কাছে।কখনও তোমার উপর আমার কোনো সিদ্ধান্ত চাপাবো না আমি।এই ভরসাটা রাখো প্লিজ!!
.
উনাকে জড়িয়ে অঝরে কাঁদতে লাগলাম আমি।আমি কিনা কি ভাবছিলাম।সরি আর কখনও এমন হবেনা। মুচকি হেসে নিজ হাতে চোখ মুছে দিলেন উনি।তোমাকে না বলেছি কাঁদবেনা।একটা কথাও কি শুনবে না আমার।কান্না বন্ধ নাহলে নিয়ে যাবো না কিন্তু।উনার কথায় মৃদু হাসলাম আমি।
.
.
চলবে…………….
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here