বন্ধ দরজা পর্ব ২৪

#বন্ধ_দরজা
পর্ব-২৪
লেখা-মিম
দুইঘন্টা আগে সুহায়লাকে খাবার আর মেডিসিন খাইয়ে দিয়েছে তানভীর। কিছুক্ষন বাদেই মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। ওই দুই ঘন্টা সে কিছুক্ষন রুমে পায়চারি করেছে, সুহায়লার পাশে বসে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো, কিছুক্ষন ফ্লোরে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে ছিলো। বিশ মিনিট হলো সুহায়লার পিছনে এসে শুয়েছে তানভীর। সুহায়লাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ওর পিঠে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদছে তানভীর। কাঁদতে কাঁদতে সুহায়লার জামার পিঠের অংশ ভিজিয়ে দিচ্ছে। এতদিন ওর কান্না পায়নি। আজ দুপুরের পর থেকে অকারনে তার কান্না পাচ্ছে। অকারনে বললে ভুল হবে। কারনটা হচ্ছে সুহায়লা এবং তানভীরের অতীত। তানভীর কান্না করা ছেড়ে দিয়েছে প্রায় আঠারো বছর। আসলে এত বছরে যত কষ্টই হোক চোখে কখনো পানি আসেনি। আজ আঠারো বছর পর চেখ থেকে অাপনা আপনিই পানি ঝড়ছে। সুহায়লা ঘুমের মধ্যেই টের পাচ্ছে পিঠটা কেমন যেনো স্যাতঁস্যাতে লাগছে। ঘুমটা ভেঙে গেলো ওর। বুঝতে পারছে তানভীর ওকে জড়িয়ে ধরে আছে। কিন্তু পিঠ ভিজলো কিভাবে? তানভীর কি আবারও কাঁদছে? পাশ ফিরতে চাইলেও পারলো না সুহায়লা। ও পাশ থেকেই বললো,
-” তানভীর আমাকে একটা ছাড়ো, ওদিকে ঘুরে শোবো।”
তানভীর আরো শক্ত করে চেপে ধরলো তাকে।
-” কথা আছে তোমার সাথে। আমাকে একটু পাশ ফিরতে দাও। এরপর আবার জড়িয়ে ধরো।
সুহালার কথা শুনে ওকে ছাড়লো তানভীর। ওর দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুলো সুহায়লা। তানভীর আবার ওকে জড়িয়ে ধরলো।সুহায়লার গলায় মুখ গুজে রেখেছে তানভীর।
-” সেই সন্ধ্যা থেকে কাঁদছো। কি হয়েছে যে এত কান্নাকাটি করছো?”
-” কত বদলে গেছো তুমি! তোমিার বদলে যাওয়া একদম মেনে নিতে পারছি না।”
-” এভাবে কাঁদার কি আছে এখানে? কেঁদো না প্লিজ।”
-” তুমি জানো দুপুরে কি পরিমান ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম? মনে হয়েছে আল্লাহ তোমার কবুল করে ফেলেছে। ফিরে এসে তোমাকে আর আমি দেখতে পাবো না, কথা বলতে পারবো না। সত্যিই আমাকেফেলে চলে যাবে তুমি।”
-” তানভীর আমি এখনও মরিনি। বেঁচে আছি। তাহলে তুমি কাঁদছোকেনো?”
-“ভয় করছে খুব।”
-” কিসের ভয়?”
-” যদি তুমি চলে যাও। যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি।”
সুহায়লা কোনো উত্তর দিচ্ছে না। কি উত্তর দিবে খুঁজে পাচ্ছে না। তানভীরের কান্না দেখে কষ্ট পাচ্ছে বেশ। ওকে কখনো কাঁদতে দেখেনি সুহায়লা । তানভীর কাঁদতে পারে এটা অজানা ছিলো তার।
-” সুহা আমার কেউ নেই। তোমার তো সবাই আছে। তুমি আমাকে ভুলে থাকতে পারবে। কিন্তু আমি? আমার তো তুমি ছাড়া কেউনেই। তুমি চলে গেলে আমি কি নিয়ে থাকবো? ”
-” তুমি তো এতদিন আমাকে ছাড়াই ছিলে। সংসার শুধুমাত্র আমি একা করেছি। তুমি মন থেকে আমাকে কখনোই টানো নি। এখনকেনো এসব বলছো ?”
-” ভুল করে ফেলেছি।”
-“………..”
-” এই সুহা তুমি না আমাকে ভালোবাসো? তাহলে কেনো চলে যেতে চাচ্ছো”
-” কখনো কখনো প্রয়োজনে ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়াটাই ভালো। ভালোবাসাটা অক্ষুন্ন থাকে। তিক্ততা বাড়ে না। সম্পর্কটা চিরতরে নষ্ট হয়ে যায় না। কাছে থাকলেই যে ভালোবাসা বাড়বে এমনকোনো কথা নেই। দূরে থেকেও ভালোবাসা যায়। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা তানভীর। আমার কতটুকু জুড়ে তুমি আছো তা তুমি কল্পনা করতে পারবে না। এতগুলো দিন আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে। ভালোবাসি বলেই করেছি । আমার ভাগ্যে ছিলো না তোমার সংসার করা। ভাগ্যের বিপরীতে তো আমরা ছুটতে পারবো না। এখন আমি চাচ্ছিনা তোমার সাথে এক ছাদের নিচে বাস করতে। তোমার সাথে থাকতে গেলে তিক্ততা আরো বাড়বে। আমি চাইনা সম্পর্কটা চিরতরে নষ্ট হয়ে যাক।”
-” ভাগ্যে ছিলো না মানে? ভাগ্যে কেনো থাকবে না? তুমি আমাকে ভালোবাসো আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি চাচ্ছি সংসারটা টিকিয়ে রাখতে। তাহলে কেনো তোমার মনে হচ্ছে ভাগ্যে নেই।”
-” আসলেই ভাগ্যেনেই। আর নয়তো তোমাকে যখন ভালোবেসে ঘর করতে চেয়েছি তখন তো তুমি পািয়ে বেড়িয়েছো। আর আজ যখন তুমি চাচ্ছো সংসার করতে তখন তিক্ততা এতটাই বেড়ে গেছে যে ভালোবাসা সত্ত্বেও তোমার সাথে এক ছাদের নিচে বাস করার নূন্যতম ইচ্ছাটুকু আমার নেই। মন থেকে টানছে না ব্যাপারটা।”
-” আমি কি করবো বলো? কি করলে তোমার ইচ্ছা হবে আমার সাথে সংসার করার?
-” কিছুই না। তোমাকে যখন ভালোবেসেছি তখন তোমার মাঝে এমন কিছু ছিলো না যেটা দেখে ভালোবাসা জন্মাবে। অকারনে ভালোবেসেছি তোমাকে। শত অপমান পাওয়ার পরও তোমার সংসারে থাকতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু এখন আর সেটা হয়না। তুমি কিছু করলে আমার আবার সংসার করার ইচ্ছা জাগবে এটা তোমার ভুল ধারনা। ঠান্ডা মাথায় কথা বুঝার চেষ্টা করো। সেপারেশনে চলে যাওয়াটাই বেটার হবে। কাউকে অহেতুক কষ্ট পেতে হবে না।”
-” তুমি বুঝতে পারছো আমি যে একা হয়ে যাবো?”
-” একাথাকতে বলেছে কে? বিয়ে করে নিও তোমারর স্ট্যাটাসের সাথে ম্যাচ হয় এমন মেয়েকে।”
-” অন্য কাউকে চাই না আমি। আমার তোমাকে প্রয়োজন কেউ আমাকে তোমার মতো করে ভালোবাসবে না।”
-” সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে তানভীর। তোমার সাথে আমার কোনোদিক দিয়েই ম্যাচ হয় না। আমাদের রিলেশনটা পুরাই একটা মিসম্যাচ।
-” কে বললো এসব তোমাকে? তুমি জানো ফাহিম সবসময়ই বলে আমাদের দুজনকেখুব মানায়।তুমি আমার জন্য একদম পারফেক্ট একটা মেয়ে। আমারওএক্স্যাক্টলি সেটাই মনে হয়।”
-” তুমি বোধহয় ভুলে গেছো তানভীর। আমি যে কোনোদিক দিয়েই তোমার যোগ্য না সেটা তুমিই আমাকে প্রতিমূহূর্তে মনে করিয়ে দিয়েছো।”
-” পুরোনো কথা ঘাটাঘাটি করো কেনো? ওগুলো বাদ দিতে পারো না? আমি কি তখন বুঝে এসব করেছি নাকি? ”
-” তুমি দশ বছরের বাচ্চা। কিছু বুঝো না তুমি।”
-” শোনো এসব ঝেড়ে ফেলে দাও। তুমি সবদিক দিয়ে আমার যোগ্য। বরং আমিই তোমার যোগ্য না।”
-” তানভীর আমাকে কনভিন্স করার জন্য এতটাও বাটার লাগানোর প্রয়োজন নেই। কনভিন্স হলে আমি এমনিতেই হবো। তোমাকে করতে হবে না।”
-” অফকোর্স আমাকে করতে হবে। তোমাকে বুঝাতে তো হবে আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর নয়তো তুমি কি আমার সাথে থাকবা নাকি?”
-” যখন তোমার সাথে থেকেছি তখন কি আমাকে তুমি বাটার লাগাতে? কখনো তো লাগাওনি। তবুওতো থেকেছি। ”
– ” সমস্যা কি তোমার? পিছন পিছন ঘুরছি ভালো লাগে না নাকি? সেপারেশনে যাওয়ার এত শখ কেনো হচ্ছে? ভালো লাগে না আমাকে? বেশি বুড়া মনে হয় আমাকে?”
-” বুড়া মনে হতে যাবে কেনো?”
-” তাহলে ছাড়াছাড়ির কি আছে? রাহাতকে ভালো লেগেছে? ওকে বিয়ে করবা তুমি? এজন্য আমাকেডিভোর্স দিতে চাচ্ছো?”
সুহায়লার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে তানভীরের কথায়। হাসি চেপে রেখেছে। এমন সিরিয়াস মোমেন্টে হাসাহাসি করাটা খুবই বিশ্রি দেখাবে।
-” ফের কোনো বড়লোককে বিয়ে করার ইচ্ছা আমার নেই।”
-” তারমানে তুমি সত্যিই বিয়ে করবে। মিডেল ক্লাস কাউকে বিয়ে করতে চাচ্ছো। ওহহো….. আমার তো মাথা থেকে কথাটা সরেই গিয়েছিলো। এখন মনে পড়লো। তোমাকে একটা ছেলে ভালোবাসে। নামটা যেনো কি খেয়াল আসছে না। ঐ যে তোমার তেরো বছর বয়স থেকে ছেলেটা তোমাকে ভালোবাসে?”
-” কে? আসিফের কথা বলছো?”
-” হুম আসিফ। শুনেছি ও নাকি এখনও তোমাকে ভালোবাসে?”
-” কার কাছে শুনেছো?
-” সাবা বলেছিলো ছয় সাত মাস আগে। তুমি কি তাহলে আসিফকে বিয়ে করবে?”
-” কিসব পাগল ছাগলের মতো কথা বলছো? ওকে কেনো বিয়ে করতে যাবো? ওকে বিয়ে করার হলে তো আরও আগেই করতে পারতাম।”
-” তাহলে আমাকে ছাড়তে চাচ্ছো কেনো? আমি কি তোমাকে ভালোবাসি না? আমি কি তোমাকে কম যত্নে রাখবো?”
– ” তানভীর এসব কথাবাদ দাও। যখন সেপারেট হবো তখন এসব নিয়ে ক্যাচম্যাচ করো। এখন ঘুমাও প্লিজ।”
-” আমি টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছি আর তোমার কাছে ক্যাচম্যাচ মনে হচ্ছে? আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে তুমি? কষ্ট হবে না তোমার?”
-” হবে। তবে এতটাও না। শুরু থেকেই তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছো। অভ্যাস হয়ে গেছে আমার। তাই তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গেলেও আমার তেমন কষ্ট হবে না ।”
-” আমার তো অনেক কষ্ট হবে। আমি তোমার ভালোবাসায় অভ্যস্ত। তুমি ছাড়া থাকা ইমপসিবল। তুমি একতরফা তোমার কথাই ভাবছো। আমার কথা ভাবছো না।”
-” আমি দুজনের কথাই ভাবছি। তুমি ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করো।”
-” আমার কোনো বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই। দূরেই যেহেতু চলে যাবে তাহলে এত ভালোবাসা দেখানোর প্রয়োজন কি ছিলো আমাকে? একটা অমানুষকে ভালোবেসে মানুষ বানানোর প্রয়োজন কি ছিলো? আমি অমানুষ ছিলাম, অমানুষই থাকতাম। কেনো এসেছিলে আমাকে বদলাতে? একা থাকতে অভ্যস্ত ছিলাম। শুধু শুধু আমাকে তোমার নেশা ধরিয়েছো কেনো? আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়ে এখন নিজে দূরে সরে যোতে চাচ্ছো? তাহলে আমাকে ভালোবাসতে শিখানোর মানে টা কি? আমি মরে যেতাম তখন। কি দরকার ছিলো আমার এত সেবা যত্নকরে সুস্থ করার।”
-” তুমি কিভাবে ভাবতে পারলে তুমি মরে যাবে আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো? তুমি জানো গোমাকে ওভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে আমার কি পরিমান কষ্ট হয়েছিলো?”
-” ভালোই তো আমি মরে যাবো সেটা সহ্য হয় না। বিছানায় পড়ে থাকবো সেটা সহ্য হয় না। আর আমাকে ফেলে চলে যাবে তখন সহ্য হবে ঠিকই তাই না? এটা কেমন যুক্তি দেখাচ্ছো?”
-” আমাদের তর্ক যে সারারাতেও শেষ হবে না তুমি জানো? রাত হয়েছে অনেক ঘুমাও। ”
-” না আমার সাথে কথা বলো।”
-” আমার মাথা ব্যাথা করছে। প্লিজ….”
-” ওহ সরি সরি। আমর মাথায়ই ছিলো না তুমি যে অসুস্থ। তুমিঘুমাও।”
-” তুমি ঘুমাবে না?”
এখন ঘুম আসতে দেরি হয় । তুমি তো এখন আমার উপর হাত পা ফেলে শোও না। কেমন যেনো খালি খালি লাগে। ঘুম আসতে চায়না।”
সুহায়লা তানভীরকে কোনো উত্তর দিলো না। চোখ বন্ধকরে রইলো। মনের মধ্যে খচখচ করছে সুহায়লার। খারাপ লাগছে তানভীরের জন্য। মানুষটা এভাবে পরিবর্তন হয়ে যাবে কখনো ভাবেনি সুহায়লা। ব্যাপারটা হজম করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। খুব বেশি দোটানায় ভুগছে সে। এমন একটা পরিস্থিতিতে ঝুলে আছে ওকে ছাড়া থাকাও সম্ভবনা ওকে নিয়ে বেঁচে থাকাও সম্ভব না। সুহায়লা টের পাচ্ছে তানভীর ওর হাত টেনে নিজের বুকে চেপে ধরে রেখেছে। ছাড়িয়ে আনতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু আনছে না। কিছু একটা ওকে আটকাচ্ছে। হতে পারে সেটা ওর ভালোবাসা। আবার কোনো এককারনে রাখতেও মন সায় দিচ্ছে না। হতে পারে সেটা তার অভিমান।
(চলবে)
.
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here