#বন্ধ_দরজা
পর্ব-২৭
লেখা-মিম
আসাদের চেম্বারে দাঁড়িয়ে আছে ফাহিম। সুহায়ালার কপালের স্টিচ টা ছিঁড়ে গেছে। সুতাগুলো কাঁটছে আসাদ। তানভীর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে ব্যাথাটা ও নিজে পাচ্ছে।
-” আসাদ, একটু আস্তে কাঁট স্টিচগুলো। আমার বউ ব্যাথা পাচ্ছে।”
-” ব্যাথা পাবে কিভাবে? ও এখনও সেন্সলেস।”
-” সেন্সলেস হোক তাতে কি হয়েছে। ও ঠিকই ব্যাথা পাচ্ছে। তুই আস্তে আস্তে কাঁট।”
-” এখন এত দরদ উথলে উঠছে কেনো তোর? মেয়েটা ইনজুরড ছিলো। তুই কিভাবে পারলি ওকে ধাক্কা দিতে?”
-” শুধু ধাক্কা না। তানভীর ওকে গলা চেপেও ধরেছিলো।”
-” ও অমানুষ হয়ে গেছে ফাহিম।”
-” আমি কি ইচ্ছা করে করেছি নাকি? রাগ উঠে গিয়েছিলো প্রচুর। কন্ট্রোল করতে পারিনি। ও যে সিক সেটা মাইন্ড থেকে একদম স্লিপ হয়ে গিয়েছিলো।”
-” মাইন্ড থেকে স্লিপ হয়ে গিয়েছিলো মানে কি? ওর কপালে এত বড় ব্যান্ডেজ কি তোর চোখে পড়ে নি?”
-” ফাহিম, মেয়েটাকে ওর কাছে রাখা রিস্ক হয়ে যাবে। এক কাজ কর। ওকে ওর বাবার বাসায় রেখে আয়। সুস্থ হলে ফিরে আসবে।”
-” রিস্ক মানে? ও বাবার বাসায় কেনো যাবে? ও গেলে আর ফিরবে না।”
-” আমিও সেটাই চাই। ও না আসলেই ঠিক হবে। কি আছে তোর কাছে? কি দিয়েছিস ওকে আজ পর্যন্ত? যা তা আচরন করেছিস। তোর কারনে রাহাত এসব করার সুযোগ পাচ্ছে। তুই জানিস রাহাতের ঘটনা ম্যাক্সিমাম মানুষই জানে। সেদিন পার্টিতে গিয়ে আম্মু আর আমার ওয়াইফ এসব গসিপ শুনে এসেছে। তুইতোর বউয়ের সাথে কি করিস না করিস সেসবকথাও সেখানে বলাবলি হচ্ছিলো। ”
-” হুম নিশাতও আমাকে বলেছে। দুই মহিলা নাকি ফোন করে ওর কাছে জানতে চেয়েছে ঘটনা কতটুক সত্য।”
-” মেয়েটাকে নিয়ে রীতিমতো তামাশা চলছে। মহিলাগুলো পারেও বটে। তুই জানিস তানিশা সেদিন পার্টি থেকে এসে আমাকে বলছে তোমার বন্ধু একটা জানোয়ার। মেয়েটার উচিত ওকে ছেড়ে দিয়ে রাহাতকে বিয়ে করে ফেলা তাহলেই তোমার বন্ধুর মুখে স্যান্ডেলের বাড়ি পড়বে।”
-” নিশাতও এক্স্যাক্টলি এই কথাটাই আমাকে বলেছে।”
-” তোদের বউরা জানোয়ার। সবকয়টা অসভ্য।”
-” আশ্চর্য! তুই ওদের বকছিস কেনো?”
-” ওরা চায়না আমার সংসারটা টিকুক। কেনো চায়না? আমি আমার বউকে বেশি ভালোবাসি এটা ওদের দেখে হিংসা হয় তাই না?”
-” কি যে ভালোবাসিস সেটার নমুনা তো চোখের সামনেই আছে।”
-” দেখ আমাকে এসব বলবি না। আই রিয়েলি লাভ হার।”
-” খারাপ ব্যবহার করলি তুই মারলি তুই,ব্যাথা পেলো সুহায়লা, আর কাঁদছিস কি না তুই? এই ন্যাকাকান্না অফ করতো। আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে।”
-” এই, তুই একটু আস্তে ড্রেসিং করনা। ওর কষ্ট হবে তো।”
-” আর কত আস্তে করবো?”
-” ও ব্যাথা পাচ্ছে তো।”
আসাদ ফাহিম দুজনই তানভীরের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের চোখে বিরক্তি আর খারাপ লাগা দুটো একসাথে প্রকাশ পাচ্ছে।
-” এটা তোর কেমন ভালোবাসা তানভীর? ওর জন্য এত কষ্ট হয় তাহলে মেরেছিস কেনো?”
-” ও বলেছে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আসিফকে বিয়ে করবে।”
-” এটা আবার কে?”
-” ওকে ভালোবাসে আরও সাত বছর আগে থেকে। শয়তানটা এখনও আমার বউকে ভালোবাসে।”
-” সেই সাত বছর আগে থেকে! তুই কি গাধা? ও ঐ ছেলেকে বিয়ে করার হলে তো সেই তখনই করতে পারতো। তোর এত টর্চার সহ্য করেছে তবুও তো ঐ ছেলের কাছে যায়নি।”
-” তখন তো সেসব মাথায় আসেনি। হুট করে কথাটা শুনে রাগ আর কন্ট্রোল করতে পারিনি। মাথাটা সেই কখন থেকেই হ্যাং হয়ে ছিলো এই মেয়েকে নিয়ে। এরপর এই কথা বলে ও আরও আগুনের মধ্যে ঘি ঢেলে দিলো।”
-” হ্যাং ছিলো কেনো? কিছু হয়েছে ওর সাথে?”
-” তুই কখনো সুহার সাথে ওর ফ্যামিলির বন্ডিং নোটিস করেছিস?”
-” হ্যাঁ করেছি। খুব ভালো বন্ডিং।”
-” প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভালো বন্ডিং ওদের মাঝে।”
-” কি আশ্চর্য! ভাই বোনদের মধ্যে বন্ডিং ভালো থাকবে না?”
-” থাকুক ভালো কথা। এজন্য আমাকে বাদ দিয়ে কেনো?”
-” কিকরেছে ও?”
-” আজ রাতে ডিনারে গিয়েছিলাম ওদের নিয়ে। সাবার হাজবেন্ডও ছিলো ওদের সাথে। ওরা চারজনে মিলে সে কি ফুর্তি। একেকজন হাসতে হাসতে না পারে ফ্লোরে গড়াগড়ি খায়। কই ওরা তো কখনো আমার সাথে এত হাসাহাসি করে না। আর সুহা….. ও তো এত হাসাহাসি দুষ্টামি আমার সাথে করে না কখনো। নিজেরা নিজেরা তো ঠিকই করে। পুরোপুরি একা মনে হচ্ছিলো নিজেকে। আমাকে এভাবে দূরে সরিয়ে রাখার মানে কি? আমার কষ্টহয় না?”
-” তোকে কি ওরা অন্য টেবিলে বসিেছে?”
-” না এক টেবিলেই বসে ছিলাম।”
-” তাহলে দূরে সরালো কিভাবে? তুই যদি এক টেবিলে থাকা সত্ত্বেও ওদের সাথে সেভাবে না মিশতে পারিস তাহলে সেখানে ওদের কি দোষ? ওরা কি এখন তোর জন্য নিজেরা নিজেরা একটু মজাও করতে পারবে না?”
-” আমি কি না করেছি করতে পারবে না? কিন্তু আমাকে ফেলে কেনো?”
-” ফের একই কথা বলছিস। ওরা কি এখন তোকে বলবে আসেন তানভীর ভাই আমরা হাসাহাসি করি? তোর ওদের সাথে মজা করতেইচ্ছে হচ্ছিলো তো তুই নিজে থেকে করিস নি কেনো?”
-” চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি।”
-” কেনো?”
-” জানিনা।”
-” তুই ওদের সাথে মিশতে পারিসনি সেটা তোর সমস্যা ,ওদের না। তাছাড়া বরাবরই ওরা জেনেছে তুই গম্ভীর প্রকৃতির। নিজেকে কখনোই ওদের সামনে মেলে ধরিস নি। তাই হতে পারে তুই চুপচাপ বসে ছিলি সেটা ওরা স্বাভাবিক মনে করেছে। আর তুই যে বললি সুহালা তোর সাথে কখনো সেভাবে মিশেনি। তোর কথার উত্তরটা এখন দেই। সুহায়লা বরাবরই তোর সাথে দুষ্টামি করতে চেয়েছে। বরং তুই ওকে কখনো পাত্তা দিসনি। এখন ও কি তোর পিছন পিছন ঘুরতেই থাকবে ? কম তো আর ও তোর পিছনে ঘুরে নি। তুই কয়দিন ঘুরেছিস ওরপিছনে? পাঁচ ছয়দিনেই অতিষ্ঠ হয়ে রক্তারক্তি কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছিস। তুই বলতে পারবি শ্বশুড়বাড়িতে গত বিশ মাসে কয়বার পা দিয়েছিস? তোকে একশবার দাওয়াত করেও তো উনারা নিতে পারেনি ঐ বাড়িতে। সাদমান তোকে প্রতি সপ্তাহে ফোন করতো দুই তিনবার। তুই কয়বেলা ওকে ফোন করেছিস? সাবার বিেতে তুই যাস নি। ইমরানের সাথে তোর প্রথম ইন্ট্রোডিউস হয়েছে তুই এক্সিডেন্ট করার পর। তুইও ঐ বাড়ির জামাই, ইমরানও ঐ বাড়ির জামাই। তোর বাসায় তো কোনো দাওয়াত ছাড়াই চলে এসেছে তোকে দেখার জন্য। আর তোকে এতবার দাওয়াত দেয়ার পরও তুই যাসনি। পার্থক্যটা বুঝতে পারছিস? এখন তুই বল ওদের দোষটা কোথায়? তুই চুপচাপ ধাঁচের সেজন্যই হয়তো তোকে নিয়ে এত মাতামাতি করেনি। ওরা ওদের তো ছিলো তোকে তোর মতো থাকতে দিয়েছে। সামান্য একটা ব্যাপারকে তুই টেনেটুনে কত বড় বানালি?”
-” তুই জানিস ও আগের মতোকরে আমার সাথে কথা বলে না। এখন সুহায়লাকে অন্য কারো সাথে বেশি মিশতে দেখলে আমার মনে হয় ও আমার কাছ থেকে একশ হাত দূরে সরে গেছে। ভয় লাগে অনেক।”
-” দূরত্বটা তুইই বাড়িয়েছিস। আর আজকে যা করেছিস এরপর দূরত্ব আরো বাড়বে। সুহায়লা তো তখন শুধু আগুনে ঘি ঢেলেছে আর তুই ঘি , কেরোসিন দুটোই ঢেলেছিস।”
-” এখন তাহলে কি হবে?”
-” কি আবার হবে? চলে যাওয়ার নাম নিলে আবার পিটিয়ে বেহুঁশ বানিয়ে ফেলে রাখবি। তাহলেই তো হলো। তোর বউ ঘরেও থাকবে, তোর সাথেতর্কেও জড়াবে না।”
-” আচ্ছা আসাদ, কতক্ষন হয়ে গেলো ওর জ্ঞান এখনও ফিরছে না কেনো?”
-” একটু সময় লাগবে। আজকে রাতটা চাইলে তুই এখানে রাখতে পারিস আবার বাসায়ও নিয়ে যেতে পারিস। নতুন করে স্টিচ করে দিয়েছি। এবার আরো দুটো স্টিচ এক্সট্রা দিতে হয়েছে। ঘা শুকাতে একটু সময় লাগবে। মেডিসিন দিয়ে দিয়েছি। নিয়মমতো খাওয়াবি। সকালে একবার আর সন্ধ্যায় একবার ব্যান্ডেজ খুলে ড্রেসিং করবি। তিনদিন পর নিয়ে আসিস। সেলাই কেঁটে দিবো। আর প্লিজ, রাগটা কন্ট্রোল কর। মেয়েটাকে আর কত পিষবি? তোর অত্যাচারে এই মেয়ে একদিন মরে যাবে।”
-” এটা একটা মিসটেক ছিলো। আর কখনো হবে না।”
-” তোকে একটা কথা বলি। আমার মতে ,কিছুদিন তোরা সেপারেট থাক। ওকে ওর বাবার বাসায় পাঠিয়ে দে।”
-” কেনো?”
-” তুই মেন্টালি মোটেই স্ট্যাবল না। কখন কি করে ফেলবি তারঠিক নেই। তাছাড়া সুহায়লারও একটা ব্রেক প্রয়োজন। অনেক সময় দূরত্ব সম্পর্ককে মজবুত করে।”
-” অলরেডি দূরত্ব চলছে। আর কত দূরে যাবো?”
-” দেখ আমার সাজেস্ট করার দরকার ছিলো, করেছি। এখন তুই মানবি কি না সেটা তুই ভালো জানিস।”
-” তুই কি ওকে আজরাতটা হসপিটাল থাকবি নাকি বাসায় নিয়ে যাবি?”
-” বাসায় যাবো।”
-” তাহলে আমি তোকে বাসায় ড্রপ করে দেই। কাল সকালে নিশাতকে পাঠিয়ে দিবো।তুই একা সব ম্যানেজ করতে পারবি না। আর রাতে কোনো প্রবলেম হলে আমাকে বা আসাদকে ফোন দিস।”
– চল তাহলে বের হই।”
-” হুম চল।”
তানভীরকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ফাহিম নিজের বাসায় চলে গেলো। তানভীর সুহায়লার হাত ধরে ওর পাশে বসে অপেক্ষা করছে কখন ওর জ্ঞান ফিরবে। অপেক্ষার প্রহরগুলো খুব বাজে হয়। সহজে কাঁটতে চায় না। তানভীরের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছে নিজের উপর। এমনটা সে নাও করলে পারতো। আসাদের কথাগুলো অযৌক্তিক ছিলো না। সুহায়লাকে সে একপ্রকার বেঁধে রেখেছে এখানে। এতে ওর মনে তিক্ততা বাড়ছে। কমছে না। তারউপর আজ যা ঘটেছে তা ছিলো খুবই অযৌক্তিক। এটার জন্য যে তাকে যথেষ্ট ভুগতে হবে সেটা সে ভালোই আন্দাজ করতে পারছে। সুহায়লা চলে যাওয়ার পরই সে ভালোবাসার টানটা বুঝতে পেরেছিলো। হতে পারে খানিকটা দূরে গেলে সুহায়লাও সেই পুরোনো টান টা অনুভব করতে পারবে। তাছাড়া সুহায়লা তো আর অন্য শহরে থাকে না। এই শহরেই থাকবে। ওর বাবার বাসা তো খুব বেশি দূরেও না। যখন খুব বেশি খারাপ লাগবে তখন ছুটে চলে যাবে ওর কাছে। কিছু সময় কাটিয়ে আসবে ওর সাথে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে।সুহায়লা সুস্থ হলেইওকে পাঠিয়ে দিবে ওর বাসায়।
সুহায়লা আস্তে আস্তে নড়াচড়া করছে। জ্ঞান ফিরছে ওর। তানভীর খুব উদগ্রীব হয়ে সুহায়লাকে ডাকছে,
-” সুহায়লা, শুনছো? তাকাও আমার দিকে।”
চোখ মেলতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। তবুও একটু একটু করে চোখ মেলে তাকাচ্ছে সুহায়লা।
(চলবে)
.
.