বন্ধ দরজা ৯
রিসিপশন পার্টি শেষ করে বাপের বাড়ি যাচ্ছে সুহায়লা। সাথে তানভীরও আছে। মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে আছে। পিছনের সিটে বসে আছে ওরা দুজন। সামনের সিটে নিশাত আর ফাহিম বসে আছে। ফাহিম কার ড্রাইভ করছে। সুহায়লার বাবার বাড়ির আত্মীয়রা আরো একঘন্টা আগেই রওয়ানা হয়েছে। নতুন জামাইকে বরন তো করতে হবে। তানভীরের মুখ দেখে সুহায়লার তুমুল হাসি পাচ্ছে। বহু কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে সে। তানভীরের খানিকটা কাছে এসে বসলো সুহায়লা।
-” পাখিটা এমন গাল ফুলিয়ে বসে আছে কেনো?”
তানভীর চোখ গরম করে সুহায়লার দিকে তাকালো। সুহায়লা এবার হেসেই দিলো। সামনে বসে ফাহিম আর নিশাতও হাসছে। তানভীরের রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছে।
কিন্তু কাউকে কিছু বলছে না।
-” পাখিটা কি জানে সে গাল ফুলিয়ে বসে থাকলে তাকে পুরোপুরি ভুতুম পেঁচার মতো দেখা যায়।”
-” কাকে ভুতুম পেঁচা বলছো তুমি?”
-” আমার পাখিটা কে।”
-” আমি দেখতে তোমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। বুঝে শুনে কথা বলো আমার সাথে। আর পাখি পাখি করছো কেনো? আমার নাম কি পাখি নাকি? আমার নাম তানভীর। শুনেছো?”
-” হ্যাঁ আমার পাখিটা।”
-” এই তুমি কি? হ্যাঁ? দেখতে পাচ্ছো না তোমার এই পাখি ডাকটা আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। তবু বারবার এক কথা বলছো কেনো? ”
-” সুহায়লা আপনাকে আদর করে পাখিডাকছে ভাইয়া। এটাও বুঝেন না?”
-” এসব পাখি টাখি ডাক কেমন ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত মনে হয়। এগুলো আমার পছন্দ না।”
-” ওহ্ পাখি ডাকটা তোমার পছন্দ হয়নি? তাহলে কি ডাকবো? জানু ডাকি?”
-” এই সমস্ত মিডেল ক্লাস কথাবার্তা তুমি তোমার কাছেই রাখো। আমাকে এসব শোনাতে আসবে না।”
-” তাহলে ও তোকে কি ডাকবে রে তানভীর? সুইটহার্ট, হানি, বেবি এসব বলবে?”
-” শুরু করেছিস কি তোরা? সবাই মিলে কিন্তু আমাকে তোরা মেন্টালি প্রেশার দিচ্ছিস ।”
-” তোমাকে একটু আদর করে ডাকলাম। আর তুমি কিনা বলছো তোমাকে মেন্টালি প্রেশার দিচ্ছি? আমার আদরটাকে তুমি মেন্টালি প্রেশার মনে করো?”
-” এই শোনো, তোমার এই মুখের আদরের আমার কোনো দরকার নেই। আদর দেখাতে ইচ্ছে হলে আসো, আমার কোলে এসে বসো। এরপর যতখুশি আদর দেখাও। তোমার ঐ শুকনা আদর আমার পছন্দ হচ্ছে না।”
তানভীরের কথা শুনে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সুহায়লা। নিশাত ফাহিমও চুপ। তানভীরের কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরে যেতে চাচ্ছিলো সে। ঠিক সে সময় সুহায়লার কাঁধে ধরে আবার কাছে টেনে আনলো তানভীর। দু হাতে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে সুহায়লাকে।
-” কি? হুমমম? এখন দূরে যাচ্ছো কেনো? খুব তো আদর দেখাতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তোমার। আসো এখন আদর দাও। ”
-” তানভীর, সামনে দুজন মানুষ বসে আছে।”
-” তো কি সমস্যা? আমি তোমার হাজবেন্ড। তুমি আমার কাছে আসবে এটা অন্য কেউ দেখলে সমস্যা কোথায়? তাছাড়া ফাহিম তো আর দূরের কেউ না। তুমি জানো ফাহিম আমাদের বন্ধুদের সামনেই নিশাতের হাতে, কপালে কিস করে। শুধু ফাহিম না, অন্যান্য বন্ধুরাও তাই করে। তাহলে তুমি কেনো এমন সংকোচ করছো?”
-” …………………”
-” আসল কথা হচ্ছে তুমি আমাদের সোসাইটি থেকে বিলং করো না। আমাদের কাছে এসব খুবই নরমাল ব্যাপার। অনেকটা ডাল ভাতের মতো। তোমাদের সোসাইটিতে এসব চলে না। তাই তোমার এই অবস্থা। শোনো মেয়ে, এসব বাদ দাও। তুমি এখন থেকে আমার কথামতোই চলবে। যখন যেভাবে বলবো সেভাবেই চলতে হবে। নাও এখন আমার ঠোঁটে চুমু দাও।”
সুহায়লা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে তানভীরের মুখের দিকে। লজ্জায় জমে যাচ্ছে সে। কেমন মানুষ উনি? এভাবে কিভাবে জ্বলজ্যান্ত দুটো লোকের সামনে তানভীর এমন আবদার ধরছে? খালি ঘর হলে এতক্ষনে সুহায়লা হয়তো লাজ লজ্জা ধামাচাপা দিয়ে তানভীরের আবদার মিটাতো। কিন্তু মানুষের সামনে কিভাবে সম্ভব? তানভীর আবার বলতে শুরু করলো,
-” কি? শখ মিটে গেছে আদর করার?”
-” তানভীর থাম তো। মেয়েটাকে এমন জোর করছিস কেনো?”
-” ওর উপর জোর খাটানোর অধিকার আছে তাই খাটাচ্ছি।”
-” যা করার বাসা যেয়েও তো করতে পারবি। এখন আপাতত বাদ দে। মেয়েটা এরকম পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত না। ওর দিকটাও তো তোকে বুঝতে হবে।”
সুহায়লা দেখলো কথা বলতে বলতে গাড়ি তার বাসার সামনে এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে কলিজায় পানি ফিরে এসেছে ওর। যাক, এখনই গাড়ি থেকে নামা যাবে। তানভীর আর জোর করতে পারবে না। ফাহিমকে সুহায়লা বললো,
-” ভাইয়া, ভাইয়া রাখেন। এটাই আমাদের বাসা। ঐ যে সাদি আর সাবা দাঁড়িয়ে আছে।”
গাড়ি থামানো মাত্রই তানভীরের দুহাতের দেয়াল থেকে এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেমে পড়লো সুহায়লা। এতক্ষন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো ওর লজ্জা আর চিন্তায়। এখন মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে পাথর নেমেছে। ওদের দুজনকে বরন করে ঘরে এনেছে সুহায়লার নানী। আধাঘন্টার মতো ড্রইংরুমে বসে ছিলো ওরা। সাবা আর সুহায়লার কাজিনরা তানভীরের সাথে দুষ্টামি করছে খুব। কিন্তু তানভীর নিজের মতো করে চুপচাপ বসে ছিলো। তেমন একটা কথা সে বলেনি। যতসব কথা সব ফাহিমই বলেছে। দোতলার শেষ মাথার রুমটাতে থাকতে দেয়া হয়েছে তানভীর আর সুহায়লাকে। এর পাশের রুমেই ফাহিম নিশাতের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শেষের রুমটা থেকে স্পষ্ট চাঁদ দেখা যায়। খাটের উপর অর্ধেকটা জুড়ে চাঁদের আলোর দখলে থাকে। সুহায়লার কাঁঠালচাপা ভীষনসপছন্দ। সাদি নিজ হাতে আজ ঘরটাকে সাজিয়েছে কাঁঠালচাপা দিয়ে। সচরাচর এ রুমটাতে থাকা হয়না সুহায়লাদের বাড়ির কারো। নিচের তলাতেই সবাই থাকে। উপরের চারটা রুম খালিই পড়ে থাকে। কখনো মেহমান আসলে উপর তলায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়। কখনো যদি সুহায়লা বা সাবার জোছনায় গা ভিজিয়ে ঘুমুতে ইচ্ছে হয় তাহলে দুবোন মিলে এসে পড়ে এই ঘরটাতে। আজ তানভীরের সাথে এ রুমটাতে থাকবে সে। ঘরে ঢুকার সাথে সাথে কাঁঠালচাপার মিষ্টি সুবাস নাকে এসে লাগলো সুহায়লার। সাবা আর এক চাচাতো বোন ওদের দুজনকে রুমের কাছে দিয়েই আবার ফিরে গেলো। জানালার পাশে সুহায়লা চলে এলো চাঁদ দেখতে। ভরা পূর্নিমা আজ। অসম্ভব ভালো লাগছে তার।ইশশ! তানভীর যদি ওর সাথে স্বাভাবিক থাকতো তাহলে রাতটা হতো অন্যরকম। একদম স্বপ্নের মতো। কিন্তু সে তো……. কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তানভীরের স্পর্শ অনুভব করলো সুহায়লা। দুহাতে তার কোমড় চেপে ধরেছে শক্ত করে তানভীর। তানভীরের বুকের সাথে পিঠ লেপ্টে আছে সুহায়লার। কানের কাছে ফিসফিস করে তানভীর বললো ,
-” তখন ওভাবে পালিয়ে আসলে কেনো?”
সুহায়লা তানভীরের দিকে ঘুরে গলা পেঁচিয়ে ধরলো তার। চোখে চোখ রেখে বললো,
-” পালিয়েএসেছি? কখন?”
-” তখন যে বললাম ঠোঁটে চুমু খেতে। বাসার সামনে আসা মাত্রই তো তুমি রীতিমতো পালিয়ে গেলে।”
-” তো আর কি করবো? তোমার বন্ধু, বন্ধুর বউ সামনে বসে আছে আর তুমি কিনা উল্টাপাল্টা আবদার ধরছো। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো না?”
-” এতটাও ভালো মানুষ সাজার প্রয়োজন নেই সুহায়লা। তোমরা প্রয়োজনে কতটা নির্লজ্জ হতে পারে সেটা আমি ভালোই জানি।”
তানভীরের কথাটা কাঁটার মতো বিঁধলো সুহায়লার গায়ে। তানভীরের গলা ছেড়েদিয়ে বললো,
-” তুমি আমাকে এতটা খারাপ কেনো ভাবো তানভীর? আমার মাঝে কি খারাপ কিছু দেখেছো?
-” তোমরা সবকয়টা একই ধাঁচের। নতুন করে দেখা বা জানার কিছুই নেই।।”
-” আমি তো সেরকম না তানভীর। একটাবার তুমি আমাকে তোমার বউ হিসেবে কাছে টেনেই দেখো।”
-” শোনো সুহায়লা, বারবার তোমাকে এক কথা আমি বলতে পারবো না। তোমার সাথে আমার যে কথা হয়েছে সেটাই ফাইনাল। তোমার টাকার খোড়াক আমি মিটাবো আমার শরীরের খোড়াক তুমি মিটাবে। এবার আমিযখন যেখানে যেভাবে আবদার ধরবো সেভাবেই তোমাকে পূরন করতে হবে। কোনো ধরনের এক্সকিউজ আমি শুনতে চাই না।”
-” তুমি বুঝতে পারছো কি বলছো? পবিত্র একটা সম্পর্ককে তুমি কোথা থেকে কোথায় নামিয়ে নিয়ে আসছো? তুমি যেটা বলছো সেটা হচ্ছে পতিতাবৃত্তি। এখন তুমি কি বলছো আমি আমার নিজের হাজবেন্ডের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কটাকে পতিতাবৃত্তির নাম দিবো?”
-” তুমি কি নাম দিবে সেটা তোমার মাথাব্যাথা। আমার না। আর সম্পর্কের পবিত্রতার বানী তোমার মতোমেয়েদের মুখে মানায় না”
-” কেনো মানায় না? কি করেছি আমি? খোঁজনিয়ে দেখো তো আমার নামে কোনো অপবিত্র সম্পর্কে আমি আজ পর্যন্ত জড়িয়েছি কি না??”
-” এত কথা বলে লাভ নেই। তুমি কি আমার ইচ্ছামতো চলবে নাকিচলবে না সেটা বলো।”
-” না চললে কি হবে?”
-” কি আবার হবে? তুমি যদি আমার খোড়াক না মিটাতে পারো তাহলে অন্য কাউকে নাইট পার্টনার করতে হবে খোড়াক মিটানোর জন্য।”
-” কিহ্?”
-” হুম। টাকা ছিটালে তোমার মতো মেয়েদের অভাবপড়ে না।”
-” তোমার মেন্টালিটি এত চিপ কেনো? ছিঃ!”
-” তোমার চেয়ে ভালো আছি আমি। এট লিস্ট মনে যা আসে তা মুখেও থাকে। তোমাদের মতো মনে একটা মুখে আরেকটা না।”
-” তোমার কাছে কি মনে হচ্ছে না তুমি অযথাই আমাদের ম্যারিড লাইফটা কমপ্লিকেটেড করছো?”
-” বারবার এক কথা ভুলে যাও কেনো? যা হয়েছে সেটা শুধু একটা ডিল। বিয়ে না।”
-” তুমি….”
-” আর কোনো কথা না। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। এসব মেকআপ টেকআপ আমার অসহ্য লাগছে। এসব হাবিজাবি নিয়ে তোমাকে কাছে টানতে পারবো না”
-” কথাটা শু…….”
-” তোমার কথা শুনে তো আর আমার চাহিদা মিটবে না। তুমি কি ফ্রেশ হয়ে আসবে নাকি আমি অন্য কারো সন্ধানে বের হবো?”
সুহায়লা আর কথা বাড়ালো না। লাগেজ থেকে কাপড় বের করে চলে যাচ্ছে ওয়াশরুমে। গতরাতের মতো আজওতৈরী হতে হবে তাকে তানভীরের জন্য। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছে সুহায়লা। শাওয়ারের পানিতে চোখের পানিগুলো ধামাচাপা পড়ছে এভাবে আর কতদিন চোখের পানিগুলো শাওয়ারের পানির নিচে ধামাচাপা পড়বে, কতদিন ওয়াশরুমের দেয়ালগুলো ওর চাপা কান্নার সাক্ষী হবে সে কথা জানা নেই সুহায়লার।
(চলবে)
.
.
.
১ম পর্বের লিংক: https://www.facebook.com/new.love.story.com.bd/posts/387990565374737?__tn__=K-R
৮ম পর্বের লিংক : https://www.facebook.com/new.love.story.com.bd/posts/389818158525311?__tn__=K-R
১০ ম পর্বের লিংক : https://www.facebook.com/new.love.story.com.bd/posts/390348198472307?__tn__=K-R