বন্ধ দরজা পর্ব ১০

বন্ধ দরজা ১০

খুব ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে রুম থেকে বের হতে যাচ্ছিলো সুহায়লা। ঠিক সেই সময় নিশাতের মুখোমুখি হয়ে গেলো সে।
-” কি ব্যাপার আপু? এত সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়লে যে?”
-” আমি তো নামাজ পড়তে ভোরে উঠি। এরপর আবার ঘুমিয়ে যাই। আজ আর ঘুমুতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তোমাদের বাড়িটা একটুঘুরে দেখতে ইচ্ছে হলো। তাই বেরিয়ে এলাম।’
-” ওহ্। চলো তাহলে তোমাকে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাই। ”
বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে সুহায়লা। নিচের তলায় ড্রইং ডাইনিং সহ মোট ছয়টা রুম। আর উপর তলাতে চারটা। নিচের রুম গুলোর তুলনায় উপরের গুলো একটু বেশি বড়। পুরো বাড়িতে আলাদা করে বারান্দা শুধু একটা রুমেই আছে। সেটা হচ্ছে উপরতলার পুর্ব দিকের রুমটাতে। বাড়িটা অনেকটা স্কুলের মতো দেখতে। একসাড়া লম্বা বারান্দা। পাশাপাশি সবকয়টা রুম। এই বারান্দার উপর দিয়েই সব ঘরে আসাযাওয়া করা হয়। বাড়িটাতে আধুনিকতার ছোঁয়া নেই বললেই চলে। সব কয়টা ঘরের দরজা জানালা কাঠের তৈরী।দরজাগুলো তে হালকা নকশা করা। আজকাল এমন দরজা জানালা ওয়ালা ঘর দেখা যায় না। অনেক পুরোনো বাড়ি কিনা। তাই হয়তো বাড়ির নকশাটা এমন। কিন্তু মন্দ লাগছে না নিশাতের। বেশ লাগছে তার এ বাড়িটাতে ঘুরে বেড়াতে। মনে হচ্ছে কত বছর পর ভিন্ন কিছু দেখছে সে। পুরো বাড়ি ঘুরা শেষে ছাদে আসলো নিশাত। এসেই তার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। পুরো ছাদ জুড়েই ফুলের গাছ। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটা তাকে টানছে সেটা হচ্ছে ছাদের একপাশে বড় একটা বালতিতে পাঁচ ছয়টা পদ্মফুল মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফুলের উপর হালকা হাত বুলাতে বুলাতে নিশাত বললো,
-” কত্ত বছর পর পদ্ম দেখছি। ছয় বছর আগে একবারগ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন শেষবারের দেখেছিলাম। এরপর আর গ্রামে যাওয়া হয়নি তাই আর পদ্মের দেখাও পাইনি।”
-” তোমার পছন্দ?”
-“ভীষন।”
-” তুলে দিবো একটা?”
-” না না। ওখানেই বেশি ভালো লাগছে।”
ছাদের উপর থেকে বাড়ির আশপাশে চোখ বুলাচ্ছে নিশাত। সত্যিই বাড়িটাতে অনেকগুলো গাছ আছে। তাও আবার বিশাল সাইজের। কিন্তু তানভীর জঙ্গল কেনো বললো সেটা একদমই মাথায় আসছে না নিশাতের। সবমিলিয়ে কত্ত সুন্দর বাড়িটা। এমন বাড়ির দেখা আজকাল মিলে নাকি? হতে পারে পুরোনো। কিন্তু সুন্দর তো। যেকারো মন ভালো হয়ে যাবে এখানে আসলে। তানভীরটা আসলেই একটা অন্ধ। না সুহায়লার ভালো দিকগুলো তার নজরে পড়ছে না সুহায়লার এত সুন্দর বাড়িটা তার নজরে পড়েছে। ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশাত। হঠাৎ তার নজরে পড়লো সুহায়লার ডান হাতের কব্জিতে কালসিটে দাগ বসে আছে।
-” হাতে ব্যাথা পেয়েছো কিভাবে সুহায়লা?”
-” ব্যাথা পাইনি। তানভীর গতরাতে হাত শক্ত করে চেপে ধরেছিলো। তাই এমন দাগ বসেগেছে।”
-” তাই বলেএত শক্ত করে ধরবে? তুমি কিছু বলোনি?”
-” আপু ও আমার হাত শক্ত করে ধরাতে যতটা না ব্যাথা পেয়েছি তারচেয়ে বেশি কষ্ট পাই ওর কথায়। কিসব বলে আমাকে। শুনলেই গা ঘিনঘিন করে।”
-” ঐ কথাগুলো আবার বলেছে?”
-” হুম গতরাতে আবার বলেছে।”
-” আবার কেনো?”
-” কথার সূত্রপাত হয়েছে আমি কেনো ওকে গতরাতে গাড়িতে চুমু খাইনি? আমি ওকে বলেছিলাম যে গাড়িতে দুজন লোক বসা ছিলো তাদের সামনে কিভাবে?”
-” পরে?”
-” ও বলে এতটাও ধোয়া তুলসি পাতা সাজার প্রয়োজন নেই। আমার মতো মেয়েরা কতটা নির্লজ্জ হতে পারে এসব তার জানা আছে। সে যখন যেভাবে বলবে সেভাবেই তার আবদার মিটাতে হবে। বিনিময়ে সে আমাকে টাকা দিবে। আমি যদি না মিটাই তাহলে অন্য মেয়ের কাছে যাবে।”
-” অন্য মেয়ের কাছে যাবে বলেছে?”
-” হুম।”
-” কি বলো?
আমার জানামতে তানভীর ভাইয়ের এসব মেয়ে মানুষের বাজে নেশা নেই। এমনকি বিভিন্ন পার্টিতে কত মেয়েরা আসে। শর্ট জামা কাপড় পড়ে আসে। গায়ে পড়ে তানভীর ভাইয়ের সাথে কথা বলতে চায়।তবু কখনোই দেখিনি ভাইয়া ঐসব মেয়েদের দিকে নজর দিয়েছে। বরাবরই এসব মেয়েদের এড়িয়ে যেতে দেখেছি।”
-” কি জানি আপু….. ও কেনো সেকথা আমাকে বলেছে সেটা ও ভালো জানে।”
-” ভাইয়া যে কেনো এমন করে! বিশ বছর আগের ঘটনাকে ধরে রেখে শুধু শুধু নিজের লাইফটাকে কমপ্লিকেটেড করার কোনো মানে হয়না। উনার মা তো উনাকে রেখে দিব্যি ভালো আছেন। তাহলে উনি কেনো নিজের জীবনটা এমন বিষিয়ে তুলছেন?”
-” এই কথা এখন ওকে কে বুঝাবে? খুব কষ্ট লাগে জানো ওর মুখে যখন ঐসমস্ত বাজে কথাশুনি।”
-” তোমাকে কিছু কথা বলি। দশ বছর আগে তমার সাথে যখন ফাহিমের ব্রেকআপ হয় এরপর ওর অবস্থা খুব ভয়ানক হয়ে গিয়েছিলো। বলতে পারো সে ৮০% পাগল হয়েগিয়েছিলো। আমার বাবা আর আমার শ্বশুড় অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু ছিলেন। তখন আমি এস.এস.সি. এক্সাম দিয়েছি। তখন ফাহিমকে আমি ভাইয়া ডাকতাম।আমার বড় ভাইয়ের সমবয়সি ছিলো ফাহিম। বলতে পারো অনেকটা বন্ধুর মতো ছিলো ওরা। ফাহিমের নিয়মিত আসা যাওয়া ছিলো আমাদের বাসায়। এস.এস.সি. এক্সাম শেষে তো কোনো কাজ নেই। তো আম্মু একদিন বলছে চল ফাহিমদের বাসায় যাই।শুনেছি ও নাকি অসুস্থ। ওকে দেখেও আসলাম তোর আন্টির সাথে একটু গল্পও করে আসলাম। আমি আর আম্মু জানতাম ফাহিম অসুস্থ কিন্তু ওর কি হয়েছে সেটা আমি বা আম্মু কেউই জানতাম না। আব্বু আর ভাইয়া সব জানতো কিন্তু বাসায় কিছুই বলেনি। ওদের বাসায় পা দেয়া মাত্রই দেখি পুরো ড্রইং রুম, ডাইনিং রুম জুড়ে শুধু কাঁচ আর কাঁচ। দোতলায় ফাহিমের রুম ছিলো। ওর দরজা বাহির থেকে লক রাখা ছিলো। ও ভেতর থেকে কন্টিনিউ দরজা ধাক্কাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে আমি তমার কাছে যাবো। ড্রইংরুমের সোফায় বসে আমার শ্বাশুড়ি কাঁদছে আর আমার দেবরের হাত ব্যান্ডেজ করছে। আম্মুকে দেখা মাত্রই আমার শ্বাশুড়ি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। পরে উনি বসে বসে সব বললো। ফাহিম এসব ভাঙচুর করেছে। ওর ভাই ওকে থামাতে গিয়ে হাত কেটেছে। তমার সাথে কি সমস্যা হয়েছে সব বললো। সব শুনে আম্মু ফাহিমের সাথে গেলো দেখা করতে। আমিও পিছন পিছন গেলাম। যেয়ে দেখি বেচারা ফ্লোরে শুয়ে কাঁদছে। চোখ গর্তে ঢুকে গিয়েছে।মুখ শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। আম্মু ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর ওকে বুঝাচ্ছে। ও শোয়া থেকে উঠে বসলো। আম্মুকে বললো, আন্টি আপনি কি আমার তমাকে এনে দিতে পারবেন? বিশ্বাস করো ঐ মূহূর্তে কেনো জানি না ফাহিমের জন্য এত কষ্ট হচ্ছিলো। ওর প্রতি তখন থেকেই একধরনের টান অনুভব করি। এরপর ওকে অনেকদিন ট্রিটমেন্টকরানোর পর কিছুটা স্বাভাবিক হলো। এরপরও ঠিককরে কারো সাথে তেমন একটা মিশতো না। অনেকটা ঘরকুনে হয়ে গিয়েছিলো। আমার ভাই আর তানভীর ভাই ছাড়া কারো সাথে তেমন একটা মিশতো না। ওকে যত দেখতাম তত ইচ্ছে হতো ওকে কাছে টানি। নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসি। ওর মুখের হাসি আবার ফিরিয়ে আনি। হুট করে একদিন আমারএইচ.এস.সি. এক্সামের পর আমার ভাই এসে আমাকে বলছে,-” তোকে যদি ফাহিমের সাথে বিয়ে দেইতাহলে কি তোর কোনো আপত্তি আছে?”
মনে হচ্ছিলো আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছি। এত্তখুশি লাগছিলো কি বলবো? আমিও একলাফে রাজি হয়ে গেলাম। এরপর ভাইয়া অাব্বুকে বলে ফ।াহিমের সাথে বিয়ের এরেন্জ করায়। প্রথমে আকদ হয়েছিলো। কথা ছিলো গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর অনুষ্ঠান করে আমাকে নিয়ে আসবে। বিয়ের ছয়মাস পর্যন্ত বাবার বাড়িতেই ছিলাম। ফাহিম ছয়মাসে মাত্র তিনবার আমাদের বাড়িতে এসেছিলো। ও ঠিকমতো আমার সাথে তখন মিশতে চাইতো না।”
-” কি বলো? ফাহিম ভাইয়াও তানভীরের মতো ছিলো?
– ” নাহ্। ফাহিম কখনোই আমাকে কোনো বাজে কথা বলেনি। ও যথেষ্ট সম্মান করতো আমাকে। কিন্তু সমস্যাটা ছিলো ও আমার সাথে কথা বলতে চাইতো না। দেখা করতে চাইতো না। আর ফিজিক্যালি এটাচড হওয়া তো অনেক দূরের কথা। এরপর আমার এক কাজিন আমাকে বললো এভাবে আর দূরে থাকিস না। শ্বশুড়বাড়ি চলে যা। হাজবেন্ডের পিছনে জোঁকের মতো লেগে থাক। এভাবে দূরে থাকলে কখনোই তোদের মাঝে ভালো একটা সম্পর্ক বিল্ড আপ হবে না। এরপর সেদিনই বাবাকে বলে একমাস পরই অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করালাম। যেদিন ওদের বাড়িতে পা রেখেছি সেদিন থেকেই ওর পিছনে লেগে গেলাম। জোর করে ওর কাছে যেতাম। ওর খুঁটিনাটি সমস্ত কিছুর খেয়াল রাখতেশুরু করলাম। প্রতি ঘন্টায় ওকে ফোনকরতাম। ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতাম। ও অনেক চেষ্টা করতো আমার কাছ থেকেদূরে থাকার কিন্তু ওকে আমি আঁকড়ে রাখতাম। ঐ বাড়িতে যাওয়ার চার মাসের মাথায় আমি কনসিভ করি। প্রেগনেন্সির দুইমাসের মাথায় প্রচন্ড জ্বর আসে আমার। আমি যে প্রেগনেন্ট সেটা আমি জানতাম না। তখন পর্যন্ত আমি টেস্ট করাইনি। শরীর হালকা পাতলা খারাপ লাগতো কিন্তু কাউকে কিছু বলিনি। আর ফাহিম তো এসবের কিছুই জানতো না। ওর তো আমার দিকে তেমন খেয়ালই ছিলো না। জ্বরের সময় এন্টিবায়োটিকের কারনে মিসক্যারেজ হয়ে যায়। আমারকন্ডিশন আরো খারাপের দিকে মোড় নেয়। যেদিন ডক্টর বলে যে আমি প্রেগনেন্ট ছিলাম কিন্তু মিসক্যারেজ হয়ে গেছে সেদিন ফাহিমের কান্না দেখে কে? বেচারা আমার পাশে বসে আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। ওরকান্না দেখে আমি পুরোপুরি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ও বলছিলো,
-” আই এ্যাম সরি নিশু। আমার উচিত ছিলো তোমার দিকে খেয়াল রাখা। আমি রাখিনি। আমি খুব খারাপ হাজবেন্ড। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। আমাকে ছেড়ে চলে যেওনা প্লিজ। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবোনা। তমা চলে গেছে, এখন যদি তুমিও চলে যাও তাহলে আমি মরে যাবো। প্লিজ আমার হাত তুমি ছেড়ে দিও না।”
ঐ প্রথম ফাহিমের চোখে আমাকে হারানোর ভয় দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার প্রতি ওর ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমি অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেছি। আমার মতে তুমিও তানভীরকে কাছে টেনে নিলেই ভালো হবে। মায়া ব্যাপারটা খুব খারাপ। সহজে মায়াজাল কাটানো যায় না। চেষ্টা করো তানভীর ভাইকে মায়াজালে আটকানোর। ভাইয়ার প্রতিটা বিষয় খেয়াল দিবে। ঘন্টায় ঘন্টায় উনার খোঁজ নিবে।মাঝে মাঝে ছোটখাটো পাগলামি করবে। যত্ন নেয়ার চেষ্টা করবে সবসময়। দেখবে ভাইয়াও একটা পর্যায়ে তোমার প্রতি উইক হয়ে যাবে।”
-” তোমার কি মনে হয়? ও কি আমার প্রতি উইক হবে?”
-” হবে। দিনশেষে সে একটা পুরুষ ানুষ। কতক্ষন দূরে ঠেলে রাখবে তোমাকে?”
-” হুম।”
-” অনেকক্ষন হয়েছে। ফাহিম বোধহয় উঠে গেছে। চলো নিচে যাই।”
-” হুম চলো।”
নিচে নামতে নামতে সুহায়লা ভাবছে নিশাতের কথায় যুক্তি আছে। ঠিকই তো, তানভীর একটা পুরুষ মানুষ। জীবনে ভালোবাসার অনুভুতিটা কেমন সেটা সেএখনো জানে না। অনুভুতিটা তার মাঝে জাগাতে হবে। কতক্ষন দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে তানভীর ওকে? সুহায়লা তার ওয়াইফ। পূর্ন অধিকার আছে তানভীরের সমস্ত কিছুর উপর ওর। আজ থেকে সেও নিশাতের মতো তানভীরের পিছনে জোঁকের মতো লেগে থাকবে। তানভীর হাজার কিছু বললেও কানে তুলবে না। আর কেঁদে বুক ভাসাবে না।
(চলবে)

.
.
.
১ম পর্বের লিংক: https://www.facebook.com/new.love.story.com.bd/posts/387990565374737?__tn__=K-R
৯ ম পর্বের লিংক : https://www.facebook.com/new.love.story.com.bd/posts/390347535139040?__tn__=K-R
১১ তম পর্বের লিংক : https://www.facebook.com/new.love.story.com.bd/posts/390348905138903?__tn__=K-R

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here