#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
১৮.
হালকা হালকা হাওয়া বইছে চারপাশে। সেই বাতাসের মৃদু শো শো শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। মুগ্ধ হয়ে আদ্রিয়ানের গান শুনতে শুনতে কখন যে আদ্রিয়ানের কাঁধে মাথা দিয়ে ফেলেছে বুঝতে পারেনি অনিমা। আদ্রিয়ান টের পেলেও কিছু বলল না। কারণ ব্যাপারটা ওর মন্দ লাগেনি। গান বন্ধ হওয়ার পরেও অল্প কিছুক্ষণ অনিমা একটা ঘোরে ছিল। যখন টের পেল আদ্রিয়ান থেমে গেছে অনিমা চোখ খুলে তাকাল আদ্রিয়ানের কাঁধে মাথা এলিয়ে রেখেই তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। মাথা তুলতে মোটেও ইচ্ছা করছেনা ওর। তাই লজ্জা সংকোচ সব ভুলে আদ্রিয়ানের চোখে চোখ পরার পরেও মাথা না সরিয়ে বলল,
” আপনার ভয়েজে ম্যাজিক আছে জানেন। শুনলেই মন ফুরফুরে হয়ে যায়। এই জন্যেই সবাই আপনাকে এতো ভালোবাসে।”
আদ্রিয়ান ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে বলল,
” সবাই?”
” হ্যাঁ সবাই।”
” তারমানে তুমিও ভালোবাসো।”
” হ্যাঁ বাসিতো।”
কথাটা বলে সাথেসাথে জিবে কামড় দিয়ে আদ্রিয়ানের কাধ থেকে মাথা সরিয়ে ফেলল। ও তো ওতোকিছু ভেবে চিন্তে বলেনি। মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। এখন তাকাতেও লজ্জা করছে আদ্রিয়ানের দিকে। আর আদ্রিয়ান ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। ব্যাপারটায় খুব মজা পেয়েছে ও। তাই একটু খোঁচা মেরেই বলল,
” সিরিয়াসলি? ইউ লাভ মি?”
অনিমা এবার আরও লজ্জা পাচ্ছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেড় হওয়াটাও এখন মুসকিল হয়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট করেই বলল,
‘ না আ-আসলে অামিও আপনার একজন ভক্ত। তাই আপনার সব ভক্তরা আপনাকে যেভাবে ভালোবাসে সেভাবেই..”
আর কিছুই বলতে পারলনা কারণ গলার স্বর আটকে আসছে। চরম একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পরে গেছে ও। আদ্রিয়ান একটু গলা ঝেড়ে বলল,
” সবাই যেরকম ভালোবাসে, তুমিও কী সেরকমই ভালোবাসো নাকি..”
আদ্রিয়ান অার বলতে না দিয়ে অনিমা উঠে চলে যেতে নিলো। কিন্তু ও যাওয়ার আগেই আদ্রিয়ান হাত ধরে ফেলল। অনিমা স্বাভাবিকের চেয়ে খানিকটা জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আদ্রিয়ান নিজের সেই বিখ্যাত আড়াআড়ি স্টাইলে ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
” মায়াবিনী, তুমি জানো তোমার এই লজ্জামাখা মুখেও কতটা মায়া থাকে। উফ! ঘায়েল করা মায়া। এতো মায়া নিয়ে বেঁচে আছো কীকরে বলোতো? তোমাকে যদি কোন মায়া সম্রাজ্যে সম্রাজ্ঞীও ঘোষণা করে দেই সেটাও কম পরে যাবে।”
আদ্রিয়ান এরকম কথায় অনিমার লজ্জার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে পুরো। যাওয়ার জন্য হাত ছাড়াতে চাইলে আদ্রিয়ান আরো শক্ত করে হাত ধরে বলল,
” যাচ্ছো কোথায়?”
অনিমা পেছনে না তাকিয়েই বলল,
” নিচে।”
” কোথাও যেতে হবেনা চুপচাপ বসো।”
অনিমা অসহায় দৃষ্টিতে একবার আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ওর পাশে বস পরল। কারণ অনিমা এটা ভালোভাবে জানে আদ্রিয়ান যখন একবার বলে দিয়েছে বসতে তখন ওকে বসতেই হবে সেটা যেকোন কিছুর মূল্যেই। ছেলেটা এমনই একটু জেদি টাইপ। এমনিতে জোর খাটায় না, কিন্তু যখন খাটায় ভালোভাবেই খাটায়। আদ্রিয়ান ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
” তোমাকে নিয়ে কোথাও এখনও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। সবসময় বাড়ি টু ভার্সিটি। ভার্সিটি টু বাড়ি। বোর হচ্ছো নিশ্চয়ই? যাবে কোথাও?”
অনিমা অবাক হয়ে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। অবাক কন্ঠেই বলল,
” আমি?”
আদ্রিয়ান আশেপাশে কাউকে খোঁজার ভান করে বলল,
” এখানে আর কেউ আছে?”
” না মানে। আপনি আমায় নিয়ে বেড় হলে সবাই তো দেখে ফেলবে। নিউসও করে ফেলতে পারে।”
আদ্রিয়ান কথাটায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
” চিন্তা করোনা। কেউ চিনবেনা আমাকে।”
” আপনাকে চিনবেনা? সেটাও হয়?”
” হয় বেবি। জাস্ট একটু টেকনিক ইউস করতে হয়। যেটা ইউস করে আমি এর আগেও অনেক জায়গায় গেছি দরকারি কাজে। কালকে তো ভার্সিটি অফ আছে না? কালকেই দেখতে পাবে।”
অনিমা কিছু না বলে চুপ করে রইল। এই ছেলের এতো রহস্য এতো হেয়ালি বোঝার ক্ষমতা ওর নেই। তাই চুপ থাকাটাই আপাতত শ্রেয়। কিছুক্ষণ আড় চোখে আদ্রিয়ানকে দেখে হঠাৎ কিছু একটা ভেবে অনিমা বলল,
” আচ্ছা আপনিতো এতো বড় একজন সেলিব্রিটি, গার্লফ্রেন্ড আছে নিশ্চয়ই?”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
” এটা কোথায় লেখা আছে যে সেলিব্রিটিদের গার্লফ্রেন্ড থাকতেই হবে।”
অনিমা হেসে দিয়ে বলল,
” না তা লেখা নেই কোথাও। কিন্তু ভালোলাগার বা ভালোবাসার কেউ নিশ্চয়ই আছে?”
অাদ্রিয়ান হালকা একটু হেসে বলল,
” হ্যাঁ তা আছে। প্রথম দেখা থেকেই আমার ক্রাশ। আর নাও আই থিংক আই নিড হার ব্যাডলি। ভালোবাসাও বলতে পারো।”
অনিমা চমকে উঠল। সাথেসাথে বুক ভার হয়ে উঠল ওর। এটা কী বলল আদ্রিয়ান? অন্যকাউকে ভালোবাসে সে? অনিমা একটা ঢোক গিলে বলল,
” কিছুক্ষণ আগের গানটা কী তার জন্যেই ছিল?”
” অবশ্যই। ওসব কথা আমি তাকে ছাড়া অন্যকাউকে ডেডিকেট করার কথা ভাবতেও পারিনা। আমার অস্তিত্বের সবকিছুতেই ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে ও। ওকে ছাড়া থাকার কথা এখন আর চিন্তাও করতে পারিনা আমি।”
অনিমার গলাটা ধরে আসছে এবার। আদ্রিয়ানও কাউকে এভাবে ভালোবাসে? কিন্তু এতোদিনতো সেরকম কিছু বোঝেনি। বরং আদ্রিয়ানের ব্যবহারে তো ও অন্যকিছু ভেবে ফেলেছিল। অনিমা কাঁপা কন্ঠে বলল,
” কে সে? ইন্ডাস্ট্রির কেউ?”
” সে..”
আদ্রিয়ান আর কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিয়ানের ফোন বেজে উঠল। হঠাৎ এমন করে ফোন বেজে ওঠায় অবাক হয়ে গেল আদ্রিয়ান। এইসময় পার্সোনাল নাম্বারে কে কল দেবে। ফোনটা বের করে স্ক্রিনে তাকিয়ে অনিমার দিকে তাকাল। অনিমাও দেখতে পেলো যে স্ক্রিনে স্মৃতি নামটা ভেসে উঠছে। আদ্রিয়ান অনিমাকে বসতে বলে আদ্রিয়ান উঠে একটু দূরে গিয়ে রেলিং এর কাছে গিয়ে ফোন রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করল। অনিমা তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। হেসে হেসেই কথা বলছে। এমন মনে হচ্ছে কলটা পেয়ে খুব খুশিই হয়েছে। বেশ অনেকটা সময় কেটে গেলেও আদ্রিয়ান কথা বলেই যাচ্ছে। ওর কী খেয়াল নেই অনিমা একা বসে আছে ওখানে। আদ্রিয়ানকে এতো রাতে একটা মেয়ে কেন ফোন করল? তাও এতো কী কথা বলছে? এটাই হয়তো আদ্রিয়ানের সেই প্রেমিকা। আর তাহলে তো এতক্ষণ কথা বলাটাও স্বাভাবিক। ভালোবাসার মানুষটার সাথে কথা বলতে তো সবারই ভালো লাগে। আদ্রিয়ানেরও লাগছে হয়ত। কিন্তু ওর এমন কেন লাগছে? নিশ্বাস ভারী হচ্ছে কেন? ও কী আদ্রিয়ানের প্রতি দূর্বল হয়ে পরেছে? হয়ত পরছে। ওও তো ভেবে নিয়েছিল যে আদ্রিয়ানও ওর প্রতি দূর্বল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে এসব আকাশ-কুসুম ভাবনা ছিল। কোথায় ও আর কোথায় আদ্রিয়ান। ওর মত মেয়েকে আদ্রিয়ান ভালোবাসবেই বা কেন? বাড়িতে থাকতে দিয়েছে, সহানুভূতি দেখিয়ে ভালো করে কথা বলছে, হয়ত একসাথে থাকছে বলে মায়াও পরে গেছে। কিন্তু তারমানেতো এটা না যে আদ্রিয়ানের মনে এরকম কোন অনুভূতি থাকবে। এসব ভেবে আবারও আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখল ও এখনও কথা বলছে। এখানে আর থাকতে ভালো লাগছে না অনিমার। তাই উঠে নিচে এসে নিজের রুমে ঢুকে দরজাটা ভেতর দিয়ে বন্ধ করে দিল। তারপর ড্রয়ার খুলে একটা স্লিপিং পিল খেয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পরল। চোখ দিয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরল। সেটা দ্রুত মুছে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগল। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও গেল।
_____________
রাত সাড়ে তিনটা বাজে। রিকে মেজাজে আজ ভীষণ খারাপ। চৌধুরী বাড়িতে আজ ছোটখাটো একটা টর্নেডো হচ্ছে। রিক নিজের রুমের সবকিছু ভেঙ্গে ফেলে দিচ্ছে। এতো রাতে এরকম ভাঙচুর এর আওয়াজে পেয়ে সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। রঞ্জিত চৌধুরী, মিসেস চৌধুরী, স্নিগ্ধা সবাই উঠে চলে এলে, সার্ভেন্টগুলোও আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখছে। কিন্তু রিকের কাছে যাওয়ার সাহস কেউ পাচ্ছেনা। ইতিমধ্যে কবির শেখকে ফোন করা হয়ে গেছে। কেউ থামাতে পারবেনা তাই আস্তে আস্তে চলে গেল সবাই স্নিগ্ধা বাদে। আজ স্নিগ্ধাও সাহস পাচ্ছেনা রিকের ধারেকাছে যেতে। তবুও অনেক সাহস নিয়ে ভেতরে গিয়ে বলল,
” রিক দা এমন কেন করছ। শান্ত হও প্লি..”
স্নিগ্ধা কথাটা শেষ করার আগেই রিক একটা শো পিচ নিয়ে স্নিগ্ধার পায়ের কাছে ভাঙল। স্নিগ্ধা ভয়ে লাফিয়ে উঠল। রিক গিয়ে স্নিগ্ধার হাত ধরে কাছে নিয়ে এসে হাত মুচড়ে ধরে বলল,
” তোকে বলেছিলাম যে বেশিদিন থাকিস না তোদের বাড়িতে কিন্তু তুই শুনলিনা। তুই থাকলে আজ ঐ মেয়েটা পালাতো না। নিজের বাড়িতে কদিন কম থাকলে মরে যেতি?”
স্নিগ্ধার ভীষণ লাগছে, রাগও হচ্ছে। ইচ্ছে করছে রিককে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু এখন সে খুব বেশিই রেগে আছে তাই আগুনে ঘি ঢালা যাবেনা। তাই ঠোঁট চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। রিক স্নিগ্ধার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল স্নিগ্ধার চোখে কোণে জল জমেছে। চোখ মুখ কুচকে আছে ব্যাথায়। রিক ঝাড়া দিয়ে স্নিগ্ধাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
” যা এখান থেকে।”
স্নিগ্ধা ভাঙা গলায় বলল,
” প্লিজ একটু..”
” যেতে বলেছি আমি তোকে।”
রিকের ধমক খেয়ে স্নিগ্ধা আর কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে চলে গেল ওখান থেকে। রিক বিছানায় বসে দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরল। কিছুই ভালো লাগছেনা ওর। এই মুহূর্তে অনিমার জন্য ওর কষ্টের চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে। ওই মেয়েটাকে এখন হাতের কাছে পেলে কী করত সেটা ও নিজেও ভাবতে পারছেনা। হঠাৎ কেউ বলে উঠল,
” বাবাই আসবো।”
রিক সেদিকে না তাকিয়েই দুহাতে মুখ চেপে ধরে রেখে বলল,
” এতো রাতে এখানে কেন এসছো?”
কবির শেখ ভেতরে এসে রুমের চারপাশে চোখ বুলিয়ে রিকের পাশে গিয়ে বসে বলল,
” আবার ভাঙচুর করেছ?”
রিক নিজের চুল টেনে ধরে বলল,
” মামা প্লিজ চলে যাও। আমি চাইনা তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে।”
” সেটা করে যদি তোমার মাথা ঠান্ডা হয়, তাহলে করো।”
” মামা প্লিজ।”
” বাবাই, শান্ত হও।”
রিক এবার মাথা তুলে কবির শেখের দিকে তাকিয়ে তাঁর দুইহাত ধরে বলল,
” মামা প্লিজ ওকে এনে দেওনা। যেখান থেকে পারো, যেভাবে পারো এনে দাও। ড্যাড ওকে লুকিয়ে রেখেছে না? আচ্ছা ফাইন। তোমরা যা বলবে আমি তাই করব। পার্টি জয়েন করতে হবে তো? করব, ইভেন ড্যাড যা যা করতে বলবে তাই করব। বলোনা ও কোথায়?”
” তোমার কী মনে হয় আমি জানলে এভাবে বসে থাকতাম।”
রিক একটা হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। এখন ওর অবস্থা ঠিক সেরকমই হয়েছে যেরকম কোন নেশাখোর ব্যাক্তি হঠাৎ নেশার বস্তু না পেলে হয়। আর এরকম অবস্থায় মানুষদের দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেওয়া যায়। সেটা কবির শেখ জানেন। আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাইছেন উনি।
_____________
মুখে রোদের তীব্র আলো এসে পরার পরেই সকালে ঘুম থেকে উঠে পরল। চোখে ঘুম আছে এখনও। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে দেখে বেশ বেলা হয়ে গেছে। রাতে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে তাই সকালে উঠতে এতো দেরী। আস্তে আস্তে উঠে ও একেবারে ফ্রেশ হয়ে বেড় হল। নিচে গিয়ে দেখে আদ্রিয়ান সোফায় বসে জুস খেতে খেতে টিভি দেখছে। অনিমা দুটো শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিল। আদ্রিয়ানের প্রতি আর নিজেকে দূর্বল হতে দেবেনা। যেখানে লোকটা অন্যকাউকে ভালোবাসে যেখানে ও কেন কাবাবে হাড্ডি হবে? ও নিচে গিয়ে সোজা কিচেনে চলে গেল। আদ্রিয়ান একপলক অনিমার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিল। কিছুক্ষণ পর অনিমা এক কাপ চা নিয়ে এসে টি-টেবিল থেকে নিউসপেপারটা হাতে নিল। আদ্রিয়ান গম্ভীর মুখে বসে আছে। অনিমার দিকে আর তাকায় নি। অনিমা ভ্রু কুচকে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। কাল কিছু না বলে রুমে চলে এল আর আদ্রিয়ান কিছুই জানতে চাইল না? ভালোই হয়েছে। আদ্রিয়ান ওর সাথে যত কম কথা বলবে ওর জন্যে ততোটাই ভালো। একটা শ্বাস ফেলে চলে যেতে নিলে আদ্রিয়ান বলে উঠল,
” যদি বাইরে ঘুরতে যেতে চাও তো রেডি হয়ে এসো। ফাস্ট।”
অনিমা কিছু না বলে ওপরে চলে গেল।
রুমে অনিমা সারারুমে পায়চারী করতে করতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে যে। আদ্রিয়ান বেশি কথা বলল না কেন? কোন কারণে রেগে আছে ওর ওপর? কিন্তু রাগবে কেন? ও কী করেছে? আচ্ছা আজ তো আদ্রিয়ানের ওকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল? ও এত দেরী করল বলেই কী আদ্রিয়ানের রাগ? আচ্ছা ও এতো রিঅ্যাক্ট করছে কেন? আদ্রিয়ান অন্যকাউকে ভালোবাসে সেটাতো আদ্রিয়ানের দোষ না। তাই ওর উচিৎ আদ্রিয়ানের সাথে নরমাল হয়েই বলা। ওর মনে যেটুকুই অনুভূতি ছিল সেটা মনেই চাঁপা থাক। না, তাই এখন রেডি হয়ে নেওয়াই ভালো। ও রেডি হয়ে আবার নিচে গেল। গিয়ে দেখে আদ্রিয়ান ফোনে কথা বলছে। তাই ও ফিরে আসতে নিলেই শোনে,
” আরে বলছিতো আসব।”
ওপাশ থেকে কিছু বলল যার উত্তরে আদ্রিয়ান বলল,
” হ্যাঁ আজকেই আর এক্ষুনি বেড় হচ্ছি।”
ওপাশ থেকে আবার কিছু বলল। অাদ্রিয়ান বলল,
” শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।”
বলে হেসে দিলো। অনিমার এবার বিরক্ত লাগছে। ভালোবাসে ভালো কথা। বাসুক! যতখুশি বাসুক। এভাবে বলার কী আছে? আদ্রিয়ান হাসি থামিয়ে বলল,
” নো নেক্টস লাই..”
এটুকু বলতেই আদ্রিয়ানের চোখ অনিমার ওপর পরতেই ও থেমে গেল। ‘এসে কথা বলছি’ বলে ফোনটা রেখে দিল। তারপর অনিমাকে আগা গোড়া একবার স্কান করল। অনিমা ঘুরতে যাওয়ার কথা বলবে তার আগেই আদ্রিয়ান বলল,
” সরি আজ যেতে পারবনা। আমায় একটু বেড়োতে হবে। কাজ পরে গেছে।”
বলে আদ্রিয়ান টি-টেবিল থেকে ওয়ালেট বেড় করে পকেটে নিয়ে যেতে নিলেই অভ্র এসে বলল,
” স্যার আমি যাবোনা?”
” না, তুমি থাকো। আমি আজ একাই যাবো।”
অনিমা দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। এতো কষ্ট করে সেজে গুজে রেডি হয়ে এলো। আর লোকটা এভাবে চলে গেল। নাই যদি নেবে তাহলে রেডি হতে বলল কেন? সোজাসাপ্টা অপমান করল এককথায়। কাজ আছে? হুহ! কী কাজ সেটাতো জানাই আছে। নিশ্চয়ই ডেটিং এ যাচ্ছে। অনিমা রাগে গজগজ করতে করতে পার্স থেকে ফোনটা বেড় করে তীব্রকে ফোন করে বলল বেড় হতে আর অরু আর স্নেহাকেও ডেকে নিতে। রেডি যখন হয়েছে ঘুরেই আসবে। তীব্র কেন জিজ্ঞেস করায় এক ধমক দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। অনিমা বেড়োতে নিলেই অভ্র বলল,
” ম্যাম আমি ড্রপ করে দিয়ে আসব?”
অনি ভ্রু কুচকে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমি অপনার বস, টিচার, কোচ বা এইটাইপ কিছু লাগি?”
” না তো।”
অনিমা এবার উঁচু গলায় বলল,
” তাহলে সারাদিন ম্যাম ম্যাম করেন কেন?”
অভ্র মুখ ছোট করে বলল,
” তাহলে কী বলব?”
” নাম ধরে ডাকবেন। অ নি মা। বাংলা বোঝেন নিশ্চয়ই?”
অভ্র অবাক হয়ে বলল,
” নাম ধরে? আপনাকে। বেসম্ভব?”
অনিমা চোখ ছোট করে বলল,
” অসম্ভব শুনেছি, বেসম্ভব কী ভাই?”
অভ্র একটা বোকা হাসি দিয়ে বলল,
” অসম্ভবের ওপরে যেটা হয় সেটাই বেসম্ভব।”
” বেসম্ভব অব্ আই মিন অসম্ভব কেন?”
” পাপ হবে পাপ। তারওপর স্যার আমার গর্দান নিয়ে নেবে। না আসলে স্যার কে স্যার ডাকিতো তাই।”
অনিমা অভ্রর দিকে হতাশভাবে একবার তাকিয়ে বেড়িয়ে গেল। অভ্র চেয়েও যেতে পারল না অনিমার সাথে। ওর কপালটাই এমন। এতদিন আদ্রিয়ান অন্যের রাগ অভ্রর ওপর ঝাড়তো। এখন অনিমাও তাই করা শুরু করে দিয়েছে। যেমন মিয়া তার তেমন বিবি। এসব ভেবে মুচকি হাসল অভ্র।
কফিশপে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে অনিমা, অরুমিতা, তীব্র, স্নেহা রাস্তার সাইড দিয়ে হাটতে হাটতে এগোচ্ছে। অরুমিতা ওদের সাথে স্বাভাবিক থাকলেও মন ভালো নেই ওর। আশিস কাল ফোন দিয়েছিল। নম্বর কোথায় পেল জানেনা, কোনভাবে জোগাড় করেছে হয়ত। অরুমিতা যদিও কয়েকটা কথা শুনিয়ে কেটে দিয়েছে। কিন্তু কী চায় এই ছেলে। তিনবছরে তো ভুলেই গেছিল ওকে তাহলে আবার কেন? তীব্র আর স্নেহা বরাবরের মতই টম এন্ড জেরির মত ঝগড়া করছে। একজায়গায় ভীর দেখে তীব্র বলল,
” ওখানে কী হয়েছে বলতো?”
ওরা কৌতূহল নিয়ে একটু এগিয়ে দেখল আদ্রিয়ান আর একটা মেয়ে একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা একজন সঙ্গীতশিল্পী, স্মৃতি। দেখতে বেশ ভালোই। দুজনেই লোকেদের সাথে সেলফি তুলছে, অটোগ্রাফ দিচ্ছে। একটু দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালেও দেখে প্রথমে যে কেউ কাপলই ভাববে। ফাঁকে ফাঁকে দুজনেই দুজনের সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। বাহ! এই তাহলে তার সেই ইমপর্টেন্ট কাজ। অরু বলল,
” আদ্রিয়ান ভাই না?”
স্নেহা বলল,
” সাথেতো স্মৃতি ম্যামও আছেন।”
অনিমা শক্ত কন্ঠে বলল,
” তীব্র আমাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দিবি?”
তীব্র হেসে বলল,
” আরে আদ্রিয়ান ভাইতো আছেই এখানে। চল ওনার সাথে..”
অনিমা চেঁচিয়ে বলল,
” আমি তোকে বলেছি। পারলে পৌঁছে দে নয়তো আমি একাই পারব।”
বলে অনিমা উল্টো হাটা দিল। তীব্র ওরা বোকা বনে গেল পুরো। এরপর অনিমা পেছনে দৌড় লাগালো। অনিমা খুব জোরে হাটছে। রাগটা যেন রাস্তার ওপর দেখাচ্ছে। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে ওর। যদি অন্যকাউকে এতোই ভালোবাসে তাহলে ওর এতো কাছে কেন এসছিল? এতো হৃদয়গ্রাসী বাক্য বলে বলে বারবার ওকে আহত কেন করেছিল? কীসের জন্যে? কীসের টানে? কী প্রয়োজন ছিল এসবের?
#চলবে…