#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৬৮.
ব্যালকনিতে রেলিং এর ওপর দু-হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা। ঠিক তার পাশ ঘেঁষেই রিক দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টি-ই আকাশের দিকে স্হির। বেশ কিছুক্ষণ পর রিক গিয়ে স্নিগ্ধাকে পেছন থেকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
” থ্যাংকিউ।”
কিন্তু স্নিগ্ধা কিছু বলছে না। ও এখনো স্হির চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরেও স্নিগ্ধাকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে রিক ভ্রু কুঁচকে বলল,
” কী হয়েছে? এভাবে চুপ করে আছো কেন?”
স্নিগ্ধা আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই নিজের পেটে হাত রেখে বলল,
” আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি।”
রিক স্নিগ্ধার কাঁধে মাথা রেখে বলল,
” হুম, জানিতো। এন্ড এইজন্যই তো আজ আমি এতো খুশি।”
স্নিগ্ধা আবার কিছুক্ষণ নিরব রইল। এরপর ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে রিকের দিকে ঘুরলো।
এরপর রিকের চোখে চোখ রেখে বলল,
” তোমার অতীত, অতীতের ভালোবাসা সবকিছু জেনেশুনে সবটা মেনেই আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। কখনও কিছু দাবি করিনি। তুমি নিজে থেকে যা দিয়েছো, যতখানি দিয়েছো ততটা নিয়েই খুশি ছিলাম আমি। কিন্তু আজ আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি। তুমি নিজেও জানোনা না চাইতেও আজ কতটা খুশী দিয়েছো তুমি আমাকে। আজ নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে।”
রিক স্নিগ্ধার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
” কাঁদার কী আছে এতে?”
” জানিনা, আজ খুব কান্না পাচ্ছে।”
” কিন্তু তাতো হবেনা ম্যাডাম। আমার আপনার কান্না একদমই ভালো লাগেনা। তাই আমার সামনে মোটেও কাঁদা যাবেনা। সবসময় হাসি হাসি মুখে থাকতে হবে বুঝলেন?”
” এতোটা ভালো আবার কবে থেকে বেসে ফেললে?”
রিক একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
” ভালোবাসি? সেটা কখন বললাম?”
স্নিগ্ধা ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলল,
” তারমানে বাসোনা?”
রিক মাথা দুলিয়ে বলল,
” না, একদম না।”
স্নিগ্ধা কঠিন রাগ নিয়ে তাকালো রিকের দিকে। এরপর ঝাড়া দিয়ে রিকের হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল রুমে। এদিক ওদিক না তাকিয়েই সোজা শুয়ে পড়ল স্নিগ্ধা। রিক বুঝতে পারল বউ তাঁর ভীষণ রাগ করেছে। রাগ করারই কথা। ইচ্ছে করেই তো ক্ষেপালো মেয়েটাকে। ধীরপায়ে বিছানায় গিয়ে স্নিগ্ধার পাশে শুয়ে স্নিগ্ধাকে জড়িয়ে ধরল। স্নিগ্ধা সাথে সাথেই ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে রিকের কাছ থেকে। রিক আবার জড়িয়ে ধরল ওকে, স্নিগ্ধা আবার একই কাজ করল। কিন্তু রিকতো ছাড়ার পাত্র নয়। যতবার স্নিগ্ধা সরিয়ে দিয়েছে রিক ততবার একই কাজ করেছে। একপর্যায়ে রিকের সাথে পেরে উঠতে ব্যর্থ হয়ে স্নিগ্ধা নিজেই থেমে গেল। এই ছেলে মহা বজ্জাত, মানিয়েই ছাড়বে।
_________
দেখতে দেখতে প্রায় দুটো মাস কেটে গেছে। নিয়মমতো জাবিন ছুটিতে বাড়ি এসেছে। এবার বেশ লম্বা ছুটিতেই এসেছে। অভ্র এতোদিন জাবিনের আসার অপেক্ষাতেই ছিল। এই দুই মাস ভেতরে ভেতরে ভীষণ ছটফট করেছিল ও। প্রথমত ও নিজেও জাবিনকে ভালোবাসে আর দ্বিতীয়ত সেদিন আদ্রিয়ান ঠিক যেভাবে ওকে হুমকি দিয়েছিল ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। কিন্তু জাবিন যে এতো সহজে সবকিছু ভুলে সবটা মেনে নেবেনা সেটা অভ্র খুব ভালো করেই জানতো। ছাদে পাশাপাশি এখন দাঁড়িয়ে আছে অভ্র আর জাবিন। জাবিন প্রচন্ড জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে যাচ্ছে ওর। কিছুক্ষণ আগেই অভ্র জাবিনকে সব সত্যি খুলে বলে দিয়েছে। সবটা শুনে জাবিনের সত্যি ভীষণ রাগ হচ্ছে। একটা বছর ধরে ও গুমরে গুমরে কষ্ট পাচ্ছে, এতো চোখের জল ফেলেছে সবটাই এই বোকা ছেলেটার জন্যে। নিজে নিজেই সব কল্পনা জল্পনা করে বুঝে নিয়েছে। কে বলেছিল একে এতো বুঝতে? নিজে নিজে এতো বেশি পাকামো করতে? শুধু শুধুই এতোদিন এতো কষ্ট পেয়েছে। না, এই ছেলেকে এভাবে মোটেই ছেড়ে দেওয়া যাবেনা। ওকে যেমন কষ্ট দিয়েছে এখন অভ্রকেও ওর পেছনে কিছুদিন ঘুরতে হবে। তবেই তো হবে ইটের বদলে পাটকেল। অভ্র জাবিনের চোখ-মুখ দেখেই বুঝে গেছে যে এই মেয়ে আজ ভয়ংকর রেগে গেছে। ওর কপালে কী আছে কে জানে? একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,
” জাবিন তুমি__”
অভ্র কথাটা শেষ করার আগেই জাবিন রাগী কন্ঠে বলল,
” আপনি, আপনি করে বলার কথা ছিল না?”
অভ্র আবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল জাবিনের দিকে। ওর বোঝা হয়ে গেছে এই মেয়ে এখন ওর জালেই ওকে ফাঁসিয়ে ছাড়বে। কেন যে তখন ওসব করেছিল কে জানে! মুখে এক মুচকি হাসি ফুটিয়ে অভ্র বলল,
” আচ্ছা আমার কথা__”
জাবিন এবারেও অভ্রকে কোনকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,
” কিছু শোনার নেই। আর শুনুন আপনার প্রতি আমার যেই ফিলিংস ছিল সেটা তখন ছিল। বুঝতেই পারছেন আবেগে পড়ে গেছিলাম আরকি। বাট কয়েকদিন দূরে থাকার পরেই সেটা কেটে গেছে। স্পেশালি কলেজে আমার ক্রাশবয় আসার পর থেকে। এন্ড আমার মনে হয় ইদানিং সেও আমায় পছন্দ করে। আমার জন্যে ওরকম ছেলেই পার্ফেক্ট।”
অভ্র অবাক হয়ে বলল,
” ক্রাশবয় মানে?”
জাবিন একটু দাম্ভিক স্বরে বলল,
” সেসব জেনে আপনার কোন লাভ নেই। মাইন্ড ইউর ওউন বিজনেস।”
কথাটা বলে আর দাঁড়ালোনা অভ্রর দিকে তাকিয়ে মুচকি এক হাসি দিয়ে চলে গেল। অভ্র বোকার মত তাকিয়ে রইল জাবিনের দিকে। ‘ক্রাশ বয়’ মানে কী? ওকে বোকা বানাচ্ছেনা তো? ভাই-বোন দুটোই চরম শেয়ানা। কখন কী করে বসে কেউ জানেনা।
_________
আজ আদ্রিয়ানের ফিরতে তেমন রাত হয়নি। আটটার মধ্যে চলে এসেছে। মাথাটা নাকি হালকা ধরেছে আজ। এসে ফ্রেশ হয়েই অনিমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছে। সাথে সেই পরিচিতি বায়না, মাথাটা টিপে দাও। অনিমাও বাধ্য মেয়ের মতো তাই করছে। অনিমা আদ্রিয়ানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
” স্নিগ্ধার ছ-মাস চলছে। আর মাত্র তিনটে মাস এরপর বাড়িতে ছোট্ট বাবু আসবে। গুলুমুলু একটা বাচ্চা। ভাবলেই খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।”
আদ্রিয়ান অনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” গত আড়াইমাস যাবত দিন-রাত আমার কানের কাছে বাবু আসছে। বাবু কতো কিউট হয়। এরপর দেয়ালে বাচ্চাদের এসব ছবি এনে টানিয়ে রেখে। বাচ্চাদের সবরকম ভালো দিক এসব বলে, করে কোন লাভ হবেনা, জানপাখি। আমারও বাচ্চা ভীষণ পছন্দ। তোমার চেয়ে আমার বাচ্চার শখ কম নেই। কিন্তু ফাইনাল এক্সামের আগে এসব বলে কোন লাভ নেই। আমি গলছি না।”
অনিমা মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। এই আড়াইমাসে কম চেষ্টা করেনি আদ্রিয়ানকে মানানোর। সরাসরি বললে ধমক দেবে তাই কত টালবাহানাই না করেছে। কিন্তু ফলাফল শুন্য। এই ছেলে নিজের সিদ্ধান্তে অটল। আদ্রিয়ান বলল,
” বিকেলে ফ্রুট জুস খেয়েছিলে তো?”
অনিমা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। আদ্রিয়ান আবার বলল,
” সত্য বলছো তো? আমি কিন্তু জিজ্ঞেস করব। নতুন এসেছে বাড়িতে কী জেনো নাম? হ্যাঁ, রুণাকে।”
” দিয়ে গেছিল ও, খেয়েছি।”
নিচু কন্ঠে বলল অনিমা। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অনিমা মুখ গোমড়া করে বলল,
” আশেপাশের আন্টিরা মাঝেমাঝেই ইনডিরেক্টলি কথা শোনায়। স্নিগ্ধা বিয়ের ছ-মাসের মাথাতেই মা হতে চলেছে আমি কেন এখনো হতে পারিনি। কেনো এখনো বাচ্চা নিয়ে ভাবছি না। মামনীর কাছে এসেও বলে এসব। যদিও মামনী পাল্টা উত্তর দিয়ে দেয়। কিন্তু__”
আদ্রিয়ান এবার বুঝলো অনিমার কেন মন খারাপ হয়েছে। আদ্রিয়ান এবার উঠে বসে বলল,
” দেখ, তুমি খুব ভালো করেই জানো যে আমি লোকের কথায় কান দেইনা। আর দেবই বা কেন? কারোটা খাই নাকি পরি? আর তাছাড়াও একজন দম্পতি বিয়ের কতবছর পর বাচ্চা নেবে, ক’টা বাচ্চা নেবে এটা সম্পূর্ণ সেই দম্পতির নিজস্ব ইচ্ছে। তাদের নিজস্ব সুযোগ সুবিধা, ইচ্ছে, সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবে। এটা নিয়ে বাইরের কেউ যদি নাক গলায় বা অনধিকারচর্চা করতে চায় তাহলে তাঁরা একপ্রকার শেমলেসদের তালিকাতে পড়ে। আর তাদের মত শেমলেসদের নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমাদের আছে না-কি?”
অনিমা চুপ করে রইল। ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে আদ্রিয়ানের কথায় ও সন্তুষ্ট হয়নি। মুখ গোমড়া করেই উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়ল অনিমা। আদ্রিয়ান একটু এগিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখতেই অনিমা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
” ছাড়ুন আমাকে। আপনি আপনার নিজের ইচ্ছে নিয়েই থাকুন। আমার ইচ্ছেরতো কোন দামই নেই আপনার কাছে। আমার কাছেও আসবেন না আপনি। একদম না।”
আদ্রিয়ান অবাক হয়ে গেল। সচরাচর ও ভালোভাবে বোঝালে অনিমা সবসময় বুঝে যায়। মেনেও নেয়। আজই প্রথম আদ্রিয়ান বোঝানোর পরেও অনিমা উল্টো আরও বেশি রেগে গেল। অনিমার এরকম ব্যবহারের সাথে আদ্রিয়ান পরিচিত না। সমস্যা টা কোথায়?
#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৬৯.
সন্ধ্যা সাত’টা বাজে। আবরার মেনশনের ছাদে অনিমা, স্নিগ্ধা, নাহিদ, তনয়া, অভ্র আর জাবিন বসে আছে। রিক এখনো হসপিটালে আছে। আদ্রিয়ান বাড়িতে ফেরেনি এখনো। আদিব আর আশিসও হয়তো আদ্রিয়ানের সাথেই আছে। ওরা এমনিই কফি আর স্ন্যাকস খেতে খেতে গল্প করছে। হঠাৎ করেই জাবিনের ফোনটা বেজে উঠল। জাবিন ফোনটা হাতে তুলে একবার চারপাশে তাকিয়ে ইতস্তত করে উঠে অনেকটা দূরে চলে গেল কথা বলার জন্যে। অভ্র ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। কে এমন ফোন করল যে আড়ালে গিয়ে কথা বলতে হচ্ছে? ওর সেই ক্রাশবয় নয়তো? যবে থেকে ছুটিতে এসছে সারাক্ষণ সেই ক্রাশ বয়ের নামই জপে যাচ্ছে। সবসময়ই বেশ বিরক্ত হয় এসব ব্যাপারে ও। একবার জাবিনকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল ছেলেটা কে। কিন্তু জাবিন ওর সেই চিরচেনা উত্তর দিয়েছিল ‘ দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস’। অভ্রর গা রাগে কাঁপছিল একপ্রকার। ওর রাগী রূপের সাথে সবাই তেমন পরিচিত না। আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোন মিশনের ক্ষেত্রেই ওর এইরকম রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে সাধারণত।
কিছুক্ষণ পর জাবিন এসে বসল। ওর মুখে লাজুক হাসি ঝুলে আছে। সেই হাসি দেখে অভ্রর ভ্রু কুঁচকে গেলো। আবার কী হল? জাবিনকে এভাবে হাসতে দেখে অনিমা একটু কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” কী ব্যাপার? এতো লজ্জা পাচ্ছো কেন?”
জাবিন চোখ তুলে অনিমার দিকে তাকিয়ে নিজের লাজুক হাসিটা আরেকটু প্রসারিত করে বলল,
” ইউ নো হোয়াট ভাবী? আমার যেই ক্রাশ বয়ের কথা বলেছিলাম না?”
অনিমা মাথা ঝাঁকালো। জাবিন চারপাশে চোখ বুলিয়ে লাজুক কন্ঠে বলল,
” ও আজ আমাকে প্রপোজ করেছে।”
সবাই অবাক হয়ে তাকাল জাবিনের দিকে। অভ্রর চোখ কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। স্নিগ্ধা অবাক হয়ে বলল,
” বাবাহ! তা তুমি কী বললে।”
জাবিন যেন এবার লজ্জায় মাটিতে মিশেই যাবে এরকম অবস্থা। ঝট করেই উঠে পড়ল ওখান থেকে। মুখে লাজুক হাসি ধরে রেখে দ্রুতপদে চলে গেল ওখান থেকে। সবাই হেসে দিল শুধু অভ্র বাদে। ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে যাচ্ছে একপ্রকার। কী হচ্ছে এসব? ঐ ছেলেই বা কী? এরমধ্যে প্রপোজও করে দিল? তনয়া বলল,
” যাক তাহলে ক-দিন পর আরও একটা বিয়ের অনুষ্ঠান চলবে কী বলো?”
সবাই সম্মতি দিল তনয়ার কথায়। অভ্র মুখ গোমড়া করে বসে আছে। নাহিদ বলল,
” বাট দুঃখ একটাই। তখন কিছু মানুষ আড়াল থেকে দেখবে আর গান গাইবে, “বন্ধু যখন ক্রাশবয় লইয়া আমার চোখের সামনে দিয়া রঙ্গ কইরা হাঁইট্টা যায়। ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়!”
সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো নাহিদের এরকম রসিকতায়। কিন্তু অভ্র ঐ মুহূর্তে নিজেকে বড্ড বেশি অসহায় বোধ করল। ভেতরে ভেতরে হঠাৎই প্রচন্ড খারাপ লাগা এসে জেঁকে ধরল। কিছুক্ষণ পর সবাই আড্ডায় মশগুল হয়ে উঠল। কিন্তু বেশ অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরেই অনিমা খেয়াল করল ওর ভালো লাগছে না এখন আর আড্ডা। শুরুতে ভালো লাগলেও এখন বড্ড বেশি বিরক্ত লাগছে এদের বকবক। তাই একপর্যায়ে বিরক্তি লুকোতে ব্যর্থ হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হনহনে পায়ে নিজের রুমে চলে গেল অনিমা। বাকি সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নাহিদ চোখ সরু করে একবার তাকাল অনিমার যাওয়ার দিকে। পরে আবার কিছু একটা ভেবে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।
________
গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আশিস। এতো বছরের বন্ধুত্বে আদ্রিয়ান এই প্রথম ওর গায়ে হাত তুলল। তাও পরপর তিনটে থাপ্পড় মেরেছে আদ্রিয়ান ওর গালে। আদ্রিয়ানের অফিসে অভ্র, আশিস, আদিব বসে ছিল। নাহিদ আসেনি অন্যকাজে ব্যস্ত তাই। আদ্রিয়ান আসার পর আশিসকে মুখ অন্ধকার করে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়েছিল । কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। কারণ ও আশিসকে আগেই বলে দিয়েছে কোন সমস্যা হলে ওকে নিজে থেকে জানাতে। আর আজ আশিস তাই করেছে। কারণ তিনদিন আগেই অয়ন অরুমিতাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে নিজের পরিবার দিয়ে। ওনারা বলেছেন একটু সময় নেবেন ভেবে দেখতে।’হ্যাঁ’ বলে দেওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। এরকম প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ নেই। এটা শুনে আশিস অরুমিতার সাথে কথা বলেছিল। কিন্তু অরুমিতা সোজা বলে দিয়েছে ওর বাবা-মা যেই সিদ্ধান্ত নেবে ও সেটাই শুনবে। অন্তত ওর মতো এক প্রতারকের কাছে ও ফিরে যাবেনা। আশিস বুঝে যায় ওর পক্ষে অরুমিতাকে মানানো সম্ভব হবেনা। তাই বাধ্য হয়েই আজ আদ্রিয়ানের কাছে ওর এই কঠিন স্বীকারোক্তি করে। সবটা শুনে আদ্রিয়ান যতটা না অবাক হয়েছে তার চেয়ে বেশি রেগে গেছিল আশিসের ওপর। তাই পরপর তিনটে থাপ্পড় মেরে দিয়েছে আশিসকে। তবুও রাগ কমছে না। আদিব আর অভ্র মুখ ছোট করে বসে আছে। এখন চুপ থাকাটাই ভালো। আশিস এখনো মাথা নিচু করে রেখেছে। আদ্রিয়ান শক্ত কন্ঠে বলল,
” একবারও লজ্জা করলোনা এরকম কাজ করেও আবার আমার সামনে এসে সেসব কথা বলতে?”
আশিস ইতস্তত করে বলল,
” আদ্রিয়ান তুই ..”
আদ্রিয়ান ধমক দিয়ে বলল,
” একদম চুপ! কথা বলার কোন মুখ আছে তোর? অনুতাপবোধ দেখাচ্ছিস? তুই অনুতপ্ত হচ্ছিস, কষ্ট পাচ্ছিস তাতেই তোর সাত খুন মাপ হয়ে গেল তাইনা? তোর কোন ধারণা আছে তুই কী করেছিস? আর তুই ভাবছিস আমি তোর হয়ে অরুমিতার সাথে কথা বলব? সিরিয়াসলি? তুই এমন বিহেভ করছিস যেনো ওর একটা প্রিয় খেলনা ভেঙ্গে ফেলেছিস। কয়েকদিন কেঁদেকেটে সরি বলবি আর সব ঠিক হয়ে যাবে। এতো সহজ সবকিছু?”
আশিস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলার মত মুখ নেই ওর। আদিব কিছু বলতে নিয়েও বলল না। এখন যা বলার আদ্রিয়ানই বলুক। আদ্রিয়ান আবার বলল,
” অরুমিতা যেটা চাইবে সেটাই হবে। এ বিষয়ে আমি ওকে জোর তো করবই না বরং সাজেস্ট করব যদি সম্ভব হয় তাহলে যেন অয়ন স্যারকেই বিয়ে করে। কারণ হি মাচ, মাচ, মাচ বেটার দেন ইউ।”
আশিস হালকা কম্পিত কন্ঠে বলে ওঠে,
” আদ্রিয়ান আমার কথাটা__”
” তোর কোন কথা শুনতে এই মুহূর্তে আমি প্রস্তুত নই। এটাই ভালো হবে আমার সামনে থেকে চলে যা। ভবিষ্যতে আমার সামনে না আসলেই ভালো হবে।”
অভ্র আর আদিব প্রায় চমকে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। আশিসও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ানের দৃষ্টি স্বাভাবিক। আশিস অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কিছু বলতে নেবে তার আগেই আদ্রিয়ান বলে উঠল,
” গেট লস্ট।”
আশিসের চোখে মুখে এখনো অবাক হওয়ার ছাপ স্পষ্ট। আদ্রিয়ান এবার আগের বারের চেয়েও উঁচু আওয়াজে বলল,
” আই সেইড, গেট লস্ট। আমি নিজের ওপর বেশিক্ষণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারব না।”
আশিস বুঝলো এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আদ্রিয়ান সত্যিই ভুলভাল কিছু করে ফেলতে পারে। তাই মাথা নিচু করেই বেরিয়ে চলে এলো ওখান থেকে। এখন আপাতত কিছুই করা নেই ওর। ও যা করেছে তাঁর শাস্তিতো ওকে পেতেই হতো। হয়তো ভয়ানক শাস্তি।
_________
সময় নিজের গতি অনুসারে বয়ে চলেছে। বদলে গেছে অনেক কিছুই। রিক আর স্নিগ্ধার একটা ছেলে হয়েছে। এখন ওর চারমাস বয়স। দেখতে রিকের মতো হলেও ওর স্নিগ্ধতা একদম স্নিগ্ধার মতো। রিক নিজের ছেলের নাম রেখেছে স্নিগ্ধ। আর অপরদিকে আশিস আর আদ্রিয়ানের সামনে আসেনি। আদ্রিয়ান চায়না এখন আশিস ওর সামনে আসুক। তবে কোথায় আছে কী করছে খোঁজখবর ঠিকই রাখে। আর অরুমিতাও ওর বাবা-মায়ের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়েছে। ও আগে পড়াশোনা শেষ করে জব করতে চায়। তারপর বিয়ের কথা ভাববে। এতোমাসে অভ্রর অবস্থা করুণ। জাবিনের সাথে ঠিকভাবে যোগাযোগ হচ্ছেনা। একবার ছুটিতে এসেছিল। দেখেই বোঝা গেছে এই মেয়ে নতুন করে প্রেম করছে। অভ্রর নিজেকে এখন বড্ড অসহায় লাগছে। কষ্ট আর রাগ দুটোই হয় ওর। নিজের বোকামির জন্যে নিজের ওপরেও কম রাগ নেই ওর। সবমিলিয়ে কয়েকমাস যাবত ভীষণ অস্বস্তি আর যন্ত্রণাতে কাটছে ছেলেটার। এদিকে রঞ্জিত চৌধুরী দুই মাস আগেই ছাড়া পেয়ে গেছেন। আর ছাড়া পেতেই কবির শেখের মতো উনিও উধাও হয়ে গেছেন কোথাও। আদ্রিয়ান সবদিক দিয়েই সতর্ক থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। আর হাসান কোতয়াল, রিক, অভ্রকে সহ নিজেদের প্লান অনুযায়ী এগিয়ে নিচ্ছে। অনিমার ফাইনাল পরীক্ষা আরো আগেই শেষ হয়ে গেছে তাই ওর আপাতত বাড়ি থেকে বের হওয়া একপ্রকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে আদ্রিয়ান। কারণ ও জানে প্রথম আঘাত অনিমার ওপর আসার সম্ভাবনাই বেশি।
রাত একটা বাজে। বিছানায় চোখ বন্ধ করে একপ্রকার মরার মতো পড়ে আছে অনিমা। মাথায় কাছেই গম্ভীর আর চিন্তিত মুখ করে থুতনিতে দুই হাত রেখে বসে আছে আদ্রিয়ান। নাহিদ খুব ধীরে যত্ন সহকারে একটা ইনজেকশন পুশ করে দিল অনিমাকে। এরপর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
” সকালের আগে আর উঠবেনা।”
আদ্রিয়ান গম্ভীর স্বরে বলল,
” তুই আসার পর থেকে আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি রিপোর্টগুলো কী বলছে?”
নাহিদ চুপ মেরে গেল। সেদিনের পরও অনিমা ওরকম ব্যবহার করতো তবে ভীষণ কম। তবে তিন-চারমাস আগে থেকেই অনিমার অল্পতে বিরক্ত হওয়া বা রেগে যাওয়ার সমস্যাটা বাড়তে থাকে। প্রথম দেড় মাস সেটা খুব বেশি অস্বাভাবিক মনে না হলেও এরপর থেকেই মাত্রাটা বাড়তে থাকে। একদিন আদ্রিয়ান একটু লেট করে বাড়ি ফেরে। কিন্তু অনিমা সেদিন ওকে বলেছিল তাড়াতাড়ি আসতে, একসাথে খাবে। কিন্তু আদ্রিয়ানের শো এর সময় দু-ঘন্টা পিছিয়ে যাওয়াতে আসতে দেরী হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে রুমে এসে দেখে যে অনিমা উল্টো ঘুরে শুয়ে আছে। আদ্রিয়ান বুঝতে পেরেছিল যে বউ তার রাগ করেছে। তাই ফ্রেশ না হয়েই অনিমা পাশে গিয়ে বসে কপালে চুমু দিতে গেলেই অনিমা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দেয় ওকে। আদ্রিয়ান অবাক হয়ে যায়। তবুও কিছু না বলে উঠে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে অনিমাকে টেনে তোলে আদ্রিয়ান। কারণ ও জানে অনিমা খায়নি। টি-টেবিলে রাখা খাবারের ট্রেটা থেকে প্লেট নিয়ে অনিমার দিকে এগিয়ে দিতেই ও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় সব খাবারগুলো। আদ্রিয়ান বেশ রেগে যায় এই ঘটনায়। অনিমাকে চড় মারার জন্যে হাত তুলেও হাত নামিয়ে নেয়। অনিমা এর জন্যে আরও রাগ করে শুয়ে পড়ে। ঐ মুহূর্তে আদ্রিয়ানেরও প্রচন্ড রাগ লাগছিল। ওর কথা না রেখে দেরী করে ফেরার জন্যে অনিমা এরকম ব্যবহার করবে সেটা আশা করেনি ও। তাই কথা না বাড়িয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে। পরেরদিন সকালে যা হয় তাতে আদ্রিয়ান আরও অবাক হয়। ঘুম ভাঙতেই খেয়াল করে অনিমা ওকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আদ্রিয়ান কিছু বলার আগেই অনিমা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, প্লিজ ক্ষমা করে দিন আমাকে। কাল রাতে আমার কী হয়েছিল নিজেই জানিনা। খুব রাগ লাগছিল আপনার ওপর। আমি জানি আমি ঠিক করিনি। আমার জন্যে কাল রাতে খেতেও পারেন নি আপনি। থাপ্পড় কেন মারলেন না আমাকে? সেদিনই আদ্রিয়ানে সন্দেহ করা শুরু করে ব্যাপারটা। এরপর থেকেই ও গভীরভাবে লক্ষ্য করতে থাকে অনিমার সব গতিবিধি। খেয়াল করে যে পরিবর্তিতে ওর এই রাগ বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের ওপরেও পড়ছে। নাহিদ আবরার মেনশনে থাকেনা আর রিক ডক্টর। দিনের বেশিরভাগ সময় ওর বাইরেই কাটে। তাই ওরা তেমন লক্ষ্য করেনি ব্যাপারটা। অস্বাভাবিকতার আভাস পেয়েই নাহিদকে ডেকেছিল ও। হ্যাঁ নাহিদই শুরুতে অনিমার ট্রিটমেন্ট করেছিল। ওর এতো তাড়াতাড়ি দেশে আসার কারণটাও অনিমা-ই ছিল। আর ওর নিরব চিকিৎসায় অনিমা সুস্থ হয়েও গিয়েছিল। কিন্তু আবার অনিমার অবস্থার অবনতি দেখে অনিমার কিছু টেস্ট করায় নাহিদ। অনিমার আজান্তেই হয়েছে সেটা। রুটিন চেকাপের নাম করে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। কিন্তু আজ রিপোর্টে ও যা দেখলো তাতে নাহিদ চমকাতে বাধ্য হয়েছে। আদ্রিয়ান আবার বলল,
” কী হলো বল?”
নাহিদ একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
” রিপোর্টে আমি যা পেয়েছি সেটা খুব ভয়াবহ। ওর শরীরে আবার সেই ড্রাগস দেওয়া হয়েছিল। তাও হিউজ পরিমাণে।”
আদ্রিয়ান চমকালো। ড্রাগস! কিন্তু কে দেবে? ওর বাড়িতে এসে অনিমাকে ড্রাগস দেবে তাও নিয়মিত। কীভাবে সম্ভব? নাহিদ বলল,
” আর তার চেয়েও অবাক করা বিষয় হচ্ছে আনুমানিক চারমাস আগে সেটা দেওয়া বন্ধও হয়ে গেছে। আর গতবারের তুলনায় এবার তার মূল এফেক্ট অনেক দেরীতে পড়েছে। যার মানে একটাই এবার ইনজেক্ট করা হয়নি খাওয়ানো হয়েছে।”
আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে ভাবল। রুনা! ঐ মেয়েটাই এসেছিল নতুন এ বাড়িতে। আগের কাজের মেয়েটার স্বামী অসুস্থ থাকায় ননদ রুনাকে এনে রেখে দিয়ে গেছিল। আর সেই-তো চারমাস আগে ফিরে গেছে। আর অনিমাকে একটা খাবারই নিয়মিত দেওয়া হতো। ফ্রুট জুস। তাহলে সেটাতেই! কিন্তু রুনা এমন কেনো করল? নিজের বোকামির জন্যে নিজেই নিজেকে মনে মনে বকলো আদ্রিয়ান। আরেকটু সতর্ক থাকা উচিত ছিল। ভাবনার মাঝে নাহিদ বলল,
” যতো দিন যাবে অবস্থা ততো খারাপ হবে। যদি এখনই ট্রিটমেন্ট শুরু না হয় তো ভয়াবহ কিছু হতে পারে।”
আদ্রিয়ান অস্হির হয়ে বলল,
” হ্যাঁ তো ট্রিটমেন্ট শুরু কর। টাকা যতো লাগে লাগবে।”
নাহিদ গম্ভীর স্বরে বলল,
” সমস্যাটা অন্য জায়গায়।”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
” কী?”
” শী ইজ প্রেগনেন্ট।”
#চলবে…