#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৭৫.
আবরার মেনশনে আজ সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। রাইমা, জাবিন, স্নিগ্ধা কখন থেকে রেডি হচ্ছে। আদিবা আর স্নিগ্ধ খেলছে। রাইমা আজ সকাল সকালই আদিবের সাথে চলে এসছে। রিক, অভ্র, আদিব, আশিস তিনজনই ছুটি নিয়ে নিয়েছে। আজ ওরাও ভীষণ ব্যস্ত। হ্যাঁ আশিস এখন আবার ওদের সাথে আগের মতো মিশে গেছে। আদ্রিয়ানের ওরকম বিপদের দিনে নিজেকে দূরে রাখতে পারেনি ও। দৌড়ে চলে এসেছিল। এসে বলেছিল, ‘দেখ ভাই তোর সমস্যাগুলো কেটে যাক আমি আবার চলে যাব। দরকারে দেশ ছেড়ে চলে যাব। জীবনেও আসব না। কিন্তু এখন তুই যতই বলিস আমি নড়ছি না মানে নড়ছিনা।’ আদ্রিয়ান তখন খুব শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে। যেতে দেয়নি ওকে কোথাও। অরুমিতা, তীব্র স্নেহারও কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে আসার কথা। দুপুরের পর থেকেই মিসেস রিমা আর মিসেস লিমা রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। মিসেস রিমা বললেন,
” লিমা, সুজির হালুয়াটা তুই কর। তোর হাতের সুজির হালুয়া মেয়েটা বেশ ভালোবাসে খেতে।”
মিসেস লিমা হাসি মুখে বললেন,
” সেটা আর বলতে? আজ সবকিছু ওর পছন্দমতোই হবে বাড়িতে। আজ অনেকদিন পর বাড়িতে একটু স্বস্তি এসেছে। সবাই কত খুশী। শুধু আফসোস একটাই রিকের বাবাটা যদি একবার এসব ছেড়ে ভালো হয়ে যেতো তাহলে হয়তো এভাবে জেলে পঁচতে হতো না। আর ভাইয়া? এভাবে পাগলাগারদে থেকে কষ্ট পেতে হতোনা। আদ্রিয়ান তো কম সুযোগ দেয়নি কিন্তু ওনারা শোধরালেন না।”
মিসেস রিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
” পাপ বাপকেও ছাড়েনা। ফুলের মতো একটা মেয়েকে কতটা কষ্ট পেতে হলো ভাইয়ার জন্যে।এখন দেখ নিজেই পাগল হয়ে পাগলাগারদে আছে।”
লিমা মলিন মুখে রান্নায় মনোযোগ দিলেন। নিজের স্বামী আর ভাইয়ের কাজের জন্যে এখনো ভীষণ লজ্জা পান উনি। জেলে যাওয়ার ছ-মাসের মাথায় কবির শেখ নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আসলে নিজের এরকম হার আর জেলের ওরকম জীবন মেনে নিতে পারছিলেন না উনি। তাই আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। যার কারণে ওনাকে পাগলাগারদে পাঠানো হয়। এখন উনি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। আর রঞ্জিত চৌধুরী এখনো জেলে নিজের শাস্তি ভোগ করছেন।
ছাদ সাজানো শেষ করে রিক, অভ্র, আদিব, আশিস রিল্যাক্স করে বসল। স্নিগ্ধা, জাবিন, রাইমা রেডি হয়ে স্নিগ্ধ আর আদিবাকে নিয়ে ওপরে চলে এসেছে ছাদে। এরমধ্যে অরুমিতা, তীব্র, স্নেহাও চলে এসেছে। ওরা আসতেই অরুমিতা আর আশিসের চোখাচোখি হয়ে গেল। অরুমিতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল। আশিস অপেক্ষা করছে সেই সময় আর মুহূর্তের। অপেক্ষাই তো এখন একমাত্র পথ ওর কাছে। একে একে বাড়ির সবাই হাজির এখন শুধু আদ্রিয়ানের আসার অপেক্ষা।
আদ্রিয়ান শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে দেখে তার মেয়েটা উঠে পড়েছে। খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে পা দুলিয়ে খেলছে আর মুখ দিয়ে আওয়াজ করছে। আদ্রিয়ান হাসলো। মিষ্টি এখন হাঁটতে পারে গুটিগুটি পায়ে, দু-একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। ভাগ্যিস ও তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে। নইলে ঠিক নামার চেষ্টা করতো। আদ্রিয়ান গিয়ে মিষ্টিকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
” আমার মিষ্টিপাখি উঠে গেছে? আমিতো দেখিইনি। খিদে পেয়ছে মা?”
মিষ্টি আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে আদ্রিয়ানের হালকা খোচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে দিল। আদ্রিয়ান হেসে মেয়ের নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলল,
” একদম মায়ের মতো দুষ্ট হয়ে যাচ্ছো দিন দিন।”
মিষ্টি কী বুঝলো কে জানে হেসে হেসে ডানে-বায়ে মাথা নাড়িয়ে আদ্রিয়ানের চুলগুলো নাড়তে লাগল। আদ্রিয়ান মেয়ের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসল। এটা অনিমারও খুব পছন্দের কাজ আদ্রিয়ানের মাথার চুল এলোমেলো করে দেওয়া, গালের খোঁচা দাড়িতে হাত বুলানো। আর ওদের মেয়েটা দুজনের মিক্সড কম্বিনেশন বলা যায়। দেখতে আদ্রিয়ানের মতো হয়েছে। তবে চোখদুটো অনেকটা অনিমার মতো বড় তবে চোখের লেন্স আদ্রিয়ানের মতোই বাদামী, অনিমার মতোই বা গালে একটি তিল আর গলার নিচে দুটো তিল আছে। স্বভাব কতটা কার সাথে মেলে সেটা বড় হলে বোঝা যাবে। টি-টেবিলে ঠান্ডা হতে রাখা খাবারটা নিয়ে খুব যত্ন করে মেয়েকে খাইয়ে দিল আদ্রিয়ান। এরপর জামা পড়িয়ে রেডি করে দিয়ে নিজেও রেডি হয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ছাদে উঠতেই অরুমিতা এগিয়ে এসে মিষ্টিকে কোলে তুলে নিল। আদ্রিয়ান গেল সবকিছু ঠিক আছে কি-না দেখার জন্যে। চারপাশে তাকিয়ে দেখল সবকিছুই চমৎকার করে সাজানো হয়েছে। অবাক হলোনা ও। এদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে ও চিরকালই নিশ্চিত থাকতে পারে। জীবনের সব প্রাপ্তির মধ্যে অমূল্য প্রাপ্তি হলো এই বন্ধুগুলো। যারা সবসময় সবরকম পরিস্থিতিতে ওর পাশে ছিল, আছে আর ও জানে চিরকাল থাকবে। অরুমিতা মিষ্টির দুগালে দুটো চুমু খেয়ে বলল,
” আমার মা-টা কেমন আছে হুম?”
মিষ্টি হাসল। মেয়েটা বেশ অন্যরকম। অন্য বাচ্চাদের মতো কথায় কথায় কেঁদে দেয়না। হাসিটাই যেনো ওর বৈশিষ্ট্য। তবে ওকে কাঁদায় একমাত্র স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধর সাথে বেশিক্ষণ থাকলেই ও কেঁদে দেয়। কারণ স্নিগ্ধ সবসময়ই ওর গাল টেনে দেয়, চিমটি দেয়, ভেংচি কাটে যা মিষ্টির মোটেও পছন্দ নয়। মিষ্টিকে দেখেই স্নিগ্ধ দৌড়ে এলো। এসে ওকে নিতে চাইলেই মিষ্টি মুখ কুঁচকে হালকা আওয়াজ করে অরুমিতার গলা জড়িয়ে ধরল। যাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ও স্নিগ্ধর ধারেকাছেও যেতে নারাজ। স্নিগ্ধ নাক ফুলিয়ে চোখ উল্টে তাকিয়ে রাগে ফোঁসার মতো করে মিষ্টির হাতে চিমটি বসিয়ে দিল। মিষ্টি সাথে সাথেই চিৎকার করে কেঁদে দিল। তিন-চারজন মিলেও থামাতে পারছে না। সে কী কান্না! স্নিগ্ধা রেগে স্নিগ্ধর হাত ধরে এনে বলল,
” বেশি ফাজিল হয়ে যাচ্ছো তুমি দিন দিন স্নিগ্ধ। আসতে না আসতেই মেয়েটাকে কাঁদিয়ে দিলে। একটা চড় মারব।”
বাকিরা কিছুই বলছেনা। কারণ এরকম প্রায়ই হয়। স্নিগ্ধ সেই একই ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কোলে নিলে আথেনা কেনো? পতা মেয়ে একতা।”
বলে দৌড়ে চলে যেতে নিয়েও ফিরে এসে আবার মিষ্টিকে যেখানে চিমটি দিয়েছিল সেখানে একটা পাপ্পি দিয়ে দৌড়ে চলে গেল ওখান থেকে। সবাই হেসে ফেলল স্নিগ্ধর এমন কান্ডে সাথে স্নিগ্ধাও। কিন্তু মিষ্টির কান্না আরও বেড়ে গেল। আদ্রিয়ান এসে কোলে নেওয়ার পরই সেই বিখ্যাত কান্না থামানো গেল। তারপর আদিবার কাছে দিয়ে দিল খেলার জন্যে।
অরুমিতা এদিকে ওদিক তাকিয়ে দেখল আশিস ছাদের এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। অরুমিতা গুটিগুটি এগিয়ে গিয়ে আশিসের পাশে দাঁড়ালো। আশিস ঘাড় ফিরিয়ে একবার অরুমিতাকে দেখে আবার সামনের দিকে তাকাল। সেদিন আদ্রিয়ানের কথা শুনে অনেক ভেবেছিল অরুমিতা। ঠিকই তো আশিস অনুতপ্ত, কতবার ক্ষমা চেয়েছে, নিজেকে পাল্টেছে, শাস্তিও ভোগ করছে। ওকে অন্তত একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। তাই ওর বাবাকে বলে অয়নকে মানা করে দেয়। অয়নও আর এগোয় নি। কারণ অরুমিতার ইচ্ছা বা মতামতকে সে যথেষ্ট সম্মান করতো। আশিস যখন আবার অরুমিতার কাছে একটা সুযোগের আশায় এসেছিল তখন ও বলেছিল ওর সময় প্রয়োজন। সময় হলে ও নিজেই বলবে। সেই সময়ের অপেক্ষায় আজও বসে আছে আশিস। কবে আসবে সেই সময়? কবে ওর অপেক্ষার অবসান ঘটবে। দুজনেই অনেকটা সময় থাকার পর আশিস বলল,
” কিছু ভেবেছো?”
” কী ব্যপারে?”
” সত্যিই কী আরেকটা সুযোগ দেওয়া যায় না?”
অরুমিতা কিছু বলল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও অরুমিতার উত্তর না পেয়ে চলে যেতে নিলে অরুমিতা বলে উঠল,
” সুযোগ দেব বলেই তো অয়ন স্যারকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।”
আশিস ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরে বলল,
” তাহলে এতোদিন __”
অরুমিতা আশিসের চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ করেই হেসে দিয়ে বলল,
” এটা আপনার পরীক্ষা ছিল মিস্টার। যে আমার ফিরে আসার অনিশ্চয়তা দেখে আপনি পাল্টি মারেন না-কি সত্যি বদলে গেছেন।”
আশিস চোখ ছোট ছোট করে তাকাল অরুমিতার দিকে। ওর বুঝতে বাকি রয়নি অরুমিতা কী বোঝাতে চাইছে। ও অবাক হয়নি খুব একটা। ওর বিশ্বাস ছিল অরুমিতা ফিরবে। আর গত কয়েকদিনের আচরণে সেটা বেশ বুঝতে পেরেছিল। তারপর হাত ভাঁজ করে বলল,
” তো কী বুঝলেন ম্যাম?”
অরুমিতা গা দুলিয়ে হালকা হাসল। এরপর এগিয়ে এসে বলল,
” বুঝলাম যে আমার ফ্লার্টি বয় এখন গুড বয় হয়ে গেছে। কিন্তু! এরপর যদি ওসব ডানে-বায়ে চোখ যায় না, তাহলে চোখ তুলে ফেলব একদম।”
আশিস হালকা হেসে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল,
” যথা আজ্ঞা!”
দুজনেই দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।
ফোন আসতেই আদ্রিয়ান দেখল নাহিদের কল। মুখে হাসি ফুটলো ওর। সবাইকে ইশারা করে বোঝালো ওরা আসছে। সবাই রেডি হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাহিদ চলে এলো। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি ছাদের দরজার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তনয়া আর হাসান কোতয়াল অনিমার হাত ধরে নিয়ে এলো ভেতরে। অনিমা আসার সাথে সাথেই ওরা সবাই যার যার হাতের বেলুন ফাটিয়ে ‘সারপ্রাইজ’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। অনিমা প্রথমে চমকে উঠলেও আশে পাশে সবাইকে দেখে স্বস্তি পেলো। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। এতো সুন্দর আয়োজন কী ওর জন্যে? কিন্তু কেনো? অনিমা চারপাশ দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। আদ্রিয়ানের দিকে চোখ পড়তেই দেখল আদ্রিয়ান ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ানের কোলে মিষ্টি। জাবিন স্নিগ্ধা ওরা এগিয়ে এসে বলল,
” আজ প্রায় দেড় বছর পর তুমি কম্প্লিটলি সুস্হ স্বাভাবিক হয়ে আমাদের মধ্যে এসেছো। কনগ্রাচুলেশনস!”
অনিমা মুচকি হাসল। একে একে বাড়ির সবাই ওকে জড়িয়ে ধরল। অনিমা স্নিগ্ধ আর আদিবাকে আদর করে ধীর পায়ে আদ্রিয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আদ্রিয়ানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মিষ্টির দিকে তাকালো। কাঁপাকাঁপা হাতে ওকে ছুঁতে গিয়েও থেমে গেল। আদ্রিয়ান নিজেই এগিয়ে দিল মিষ্টিকে। অনিমা একমুহূর্ত দেরী নাহ করে নিজের মেয়েকে কোলে তুলে নিল। সারামুখে কয়েকটা চুমু দিলো। মায়ের স্পর্শ পেয়ে মিষ্টির হাসি যেনো থামছেই না। আদো আওয়াজে ‘মা’ ডেকে অনিমার গলা জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ গুজে দিল মিষ্টি। অনিমার হৃদয় যেনো ঠান্ডা হয়ে গেল। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল ও। এই দেড় বছর মিষ্টিকে ঠিককরে ধরতে পারেনি ও, আদর করতে পারেনি, কাছে রাখতে পারেনি। কান্নাজড়িতো চোখে আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই আদ্রিয়ান মিষ্টিকে সহ দুহাতে আগলে নিলো অনিমাকে। মাথায় আলতো করে চুমু দিয়ে বলল,
” কাঁদবেনা একদম।”
সকলেই কম বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েছে। এই দেড় বছরে ওদের একেকটা কষ্টের মুহুর্তের সাক্ষী ছিল ওরা। দেখেছে কতটা লড়াই করেছে ওরা দু-জন। বিশেষ করে আদ্রিয়ান।
সকলে যখন বলছিল অনিমাকে মেন্টাল হসপিটালে পাঠানোর জন্যে, তৈরী হয়ে গেছিল। তখন আদ্রিয়ান এর চোখে যেই অসহায়ত্ত্বের ছাপ ছিল তা যে কারো মন নাড়িয়ে দিতো। ও এতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। তখন ওর অনিমার সেদিন ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলা কথাগুলো মনে পড়ল, ‘ আপনাকে ভুলে যেতে পারবনা আমি। আপনি প্লিজ কোনদিন আমায় ছেড়ে দেবেন না। যাই হয়ে যাক না কেন। পরিস্থিতি যতই বদলাক না কেন। প্রয়োজনে আপনি আমায় জোর করে আটকে রাখবেন, নিজের অধিকারে আটকে রাখবেন। নিজের বুকে আগলে রাখবেন কিন্তু আমায় ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাববেনও না। আর না আমায় ছাড়তে দেবেন। কথা দিন?’ সেদিনতো ও অনিমাকে কথা দিয়েছিল প্রয়োজনে সমস্ত দুনিয়ার সাথে লড়বে কিন্তু অনিমাকে ছাড়বে না, বুকে আগলে রাখবে। নিজের কথার খেলাপ কীকরে করবে? সেদিন আদ্রিয়ান সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বলেছিল,
” আমার বউকে আমি কোথাও ছাড়ছিনা। ও আমার কাছে থাকবে। তোমাদের যদি ওর সাথে একই বাড়িতে থাকতে ইনসিকিউর ফিল হয় বলতে পারো আমি আমার বউ-বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু অনি কোথাও যাবেনা। আর কেউ যদি এসব কথা আমার সামনে উচ্চারণ কর আমি একমুহূর্ত এই বাড়িতে দাঁড়াবো না।”
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো আদ্রিয়ানের দিকে। কেউ এটা চায়না যে ওরা তিনজন বাড়ি ছেড়ে চলে যাক। বাড়িটা যে প্রাণহীন হয়ে যাবে। তাই কেউ আর কিচ্ছু বলার সাহস পায়নি। আদ্রিয়ান অনিমার সবরকম ট্রিটমেন্ট এর ব্যবস্থা করেছিল। ঐ মুহূর্তে অনিমা যেহেতু খুব এগ্রেসিভ ছিল তাই আদ্রিয়ান অনিমাকে নিজের রুমেই রাখতো। বের হলে বাইরে দিয়ে লক করে দিতে হতো। সময়গুলো সহজ ছিলোনা একদমই। খুব কষ্ট হতো আদ্রিয়ানের সবদিক সামলাতে। শেষমেশ নিজের ক্যারিয়ারেও কিছুটা কম্প্রমাইজ করতে হয়েছে ওকে। মিডিয়াতেও ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়েছিল। রকস্টার আদ্রিয়ান আবরার জুহায়েরের স্ত্রী মানসিক ভারসাম্যহীন। এ নিয়ে আদ্রিয়ানের বাইরেও অনেক কিছু ফেস করতে হয়েছে।
বাইরেটা সামলানো, বাড়ি ফিরে অনিমা আর নিজের বাচ্চার দেখাশোনা সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল ও। দিনশেষে সব সামলে যখন আদ্রিয়ান নিচে খেতে নামতো ওকে এক ক্লান্ত সৈনিকের মতো লাগতো। যে ক্রমাগত লড়েই চলেছে। মিসেস রিমার বুক ফেটে কান্না আসতো নিজের একমাত্র ছেলের এমন মুখখানা দেখে। কিন্তু অনিমাও তো ওনার মেয়েই। ওনারতো গর্বও হয় নিজের ছেলের জন্যে। একজন প্রকৃত স্বামী হয়ে উঠতে পেরেছে তার ছেলে। তবে কষ্টও তো পাচ্ছে তবে কারোই কিছুই করার ছিলোনা সবাই শুধু অসহায় দৃষ্টিতে দেখছিল সবটা। মিষ্টিকে অনিমার কাছে তেমন নেওয়া যেতো না। আদ্রিয়ান না থাকলে স্নিগ্ধাই রাখতো মিষ্টিকে। তবে অনিমা খুব শান্ত থাকলে ফিডিং করাতো ওকে দিয়ে। কারণ অনিমার কাছে বড়দের থাকাও রিস্কি ছিল আর মিষ্টিতো বাচ্চা। এরমধ্যেও অনিমা বেশ কয়েকবার আঘাত করেছিল আদ্রিয়ানকে। বেশিরভাগই কেউ জানতেও পারতোনা আদ্রিয়ান লুকিয়ে রাখতো। তবুও অনেক ক্ষত বাকিদের চোখে পড়ে যেতো। মাঝেমাঝেই প্রচন্ড ভায়োলেন্ট হয়ে যেতো ও। মাঝেমাঝে নাহিদকে বাধ্য হয়ে শক দিতে হতো। একবার আদ্রিয়ান অনিমাকে খাইয়ে ওয়াশরুমে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে অনিমা ভাঙচুর করছে। আদ্রিয়ান এগিয়ে এসে ওকে বাঁধা দিলে অনিমা ভাঙা প্লেটের টুকরো দিয়ে আদ্রিয়ানের হাতে আঘাত করে বসেছিল। আদ্রিয়ানের হাত বেশ অনেকটাই কেটে রক্ত পড়ছিল। কিন্তু আদ্রিয়ান থামেনি অনিমার হাত থেকে অনেক কষ্টে বেশ কয়েকবার আঘাত পেয়েও প্লেটের অংশটা সরিয়ে নিজের সাথে জাপটে ধরে নাহিদকে কল করেছিল। এরপর অনিমাকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল নিজের সাথে। কিন্তু অনিমা আদ্রিয়ানের শক্তির সাথে পেরে ওঠেনি তাই জোরে কামড়ে ধরেছিল আদ্রিয়ানকে খামছি তো আছেই। দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করে নেয় ও। সেদিনও শক দিতে হয়েছিল অনিমাকে। শক দেওয়ার পর যখন অনিমা নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। তখন আদ্রিয়ান অনিমাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে দিয়েছিল। পারছিল না ও আর এসব নিতে। একটা কথাই বলছিল,
” তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাও, জানপাখি। প্লিজ তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাও। আমি পারছি না আর। ক্লান্ত আমি, ভীষণ ক্লান্ত।”
আদ্রিয়ানের কান্না দেখে নাহিদও ঠিক থাকতে পারেনি। আর দাঁড়ায়নি সেদিন ওখানে। অনেকেই অনেক কথা বলতো। অনেকে এটাও বলতো এমন পাগল বউ ঘরে রেখে দিয়েছে কেন? ছেড়ে দিলেই পারে। অনেকেতো নিজের মেয়ের জন্যে প্রস্তাবও এনেছিল। কিন্তু আদ্রিয়ান শুনতোও না এসব কথা। মাঝেমাঝে কঠোর ভাষায় কথা শুনিয়ে দিতো। মানিক আবরার আর রিমাও এদের এক বাক্যে ফিরিয়ে দিতেন। একটা বিষাক্ত সময় ছিল সেটা ওদের সবার জন্যে। রিকেরও প্রচন্ড কষ্ট হতো অনিমার অবস্থা দেখে। একসময় তো ভালোবাসতো মেয়েটাকে। এখনো কী বাসেনা?এটা ঠিক এখন ওর মনের অনেকটা জায়গা স্নিগ্ধা দখল করে নিয়েছে। কিন্তু প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা কেউ ভুলতে পারে? তবে আদ্রিয়ানের ভালোবাসা দেখে বারবার স্তব্ধ হতো। আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতো যাতে অনিমা ঠিক হয়ে যায় নইলে যে ঐ ছেলেটাকে বাঁচানো যাবেনা।
একবছরের তিক্ত সময়ের পর আল্লাহর রহমত, আদ্রিয়ানের ধৈর্য্য আর ত্যাগ, নাহিদের প্রচেষ্টা, আর সকলের দোয়ায় অনিমার অবস্থা ইম্প্রুভ হতে শুরু করল। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল ও। আর যখন সবটা কিছুটা বোঝার মতো অবস্থায় পৌঁছালো তখন নিজের মেয়েকে কাছে পাওয়ার জন্যে ছটফট করতো ও। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগে মিষ্টিকে সবসময় অনিমার কাছে রাখা ঠিক হতোনা। তাই সীমিত সময়ের জন্যেই মেয়েকে কাছে পেতো ও। বাকি সময়টা খুব কাঁদতো। আদ্রিয়ান তখন ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতো। তবে কাঁদতে নিষেধ করতো না।
আজ দীর্ঘ দেড় বছর পর মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী অনিমা সম্পূর্ণ সুস্হ স্বাভাবিক। অনিমা এখনো মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রেখে কাঁদছে। এই মানুষটার মতো ওকে হয়তো কেউ কখনও ভালোবাসতে পারবেনা। জগতের সবচেয়ে ভাগ্যবতী মনে হয় নিজেকে যে ও আদ্রিয়ানের স্ত্রী। সকলেরই চোখে হালকা অশ্রু থাকলেও মুখে হাসি। হাসান কোতয়াল তৃপ্ত চোখে দেখছে নিজের মেয়ের সৌভাগ্যকে। সব বাবাই চায় তার মেয়ের স্বামী যেনো তার মতই তার মেয়েকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসে, সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখে। পরিস্থিতি যাই হোক কখনও যাতে তার মেয়েকে একা ছেড়ে না দেয়। আদ্রিয়ান পেরেছে সেটা। আর উনি পেরেছেন একজন যোগ্য ছেলের হাতে নিজের মেয়েকে তুলে দিতে। যে সারা পৃথিবীর সাথে লড়াই করেছে কিন্তু তার মেয়ের হাত ছাড়েনি।
#চলবে…