বাইজি কন্যা পর্ব ২১+২২

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_২১
একমাস পর – পাঁচফোড়ন গৃহে এখন চরম বিপর্যস্ত অবস্থা। রোজ নিয়ম করে কোলাহল শুনতে পাওয়া যায়, কখনো কখনো জমিদারের ছোট গিন্নির ক্রন্দনধ্বনিও শুনতে পাওয়া যায় সুস্পষ্টভাবে। তার আহাজারিতে ব্যথিত হয় সকল মা’য়ের মন। কখনো অঙ্গনের ভাঙচুর, চিৎকার, চেঁচামেচি,কখনো বা হাহাকার ভেসে বেড়ায় গৃহের আনাচে-কানাচে। আবার কখনো পলাশ চৌধুরী’র অশ্রাব্য গালিগালাজও শোনা যায়। ছোট ভাইয়ের করুণ দশায় তার মাঝে বিন্দু পরিমাণ আফসোস তো খুঁজে পাওয়াই যায় না৷ আবার ভাই’টা যখন মস্তিষ্কের তীব্র যন্ত্রণায়,মনের তীব্র ক্লেশে আবিষ্ট হয়ে ছটফট করে, আর্তনাদ করে, সকলের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে গায়ে হাতও তুলে, তখন ক্রোধান্বিত হয়ে পলাশ মারধর করে অঙ্গন’কে। বড়ো ভাই পল্লব আর অলিওর যেদিন বাড়ি থাকে সেদিন রক্ষা পায় অঙ্গন৷ কিন্তু যেদিন তারা বাড়ি থাকে না সেদিন একদম রক্তাক্ত করে আধমরা করে কক্ষে আঁটকে রাখে। এসব সহ্য করতে না পেরে, পলাশ’কে কোনক্রমেই বাঁধা দিতে না পেরে যখন প্রেরণা ছেলে শোকে জ্ঞান হারায় তখনি খবর যায় প্রণয়ের কাছে। একমাত্র প্রণয়ই প্রতিবাদ করে পলাশের সঙ্গে। গতো দিনগুলোতে প্রণয় কম চেষ্টা করেনি। শহরের বড়ো বড়ো মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়েছে। চিকিৎসা চলছে অঙ্গনের তবুও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। দিনের পর দিন অঙ্গনের পাগলামো যেনো বেড়েই চলেছে। অঙ্গনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে করতে প্রেরণাও কেমন অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় অরুণা প্রেরণা’কে বললো,
-‘ ছোট বউ প্রণয়ের থেকে তো সবটাই শুনছিস। অঙ্গন সেই কিশোর বয়স থেকে রোমানা’কে ভালোবাসতো। কিন্তু রোমানা প্রণয়’কে ভালোবাসতো বলে সে নিজের মনের কথা গোপন রাখছে। রোমানার সুখ চাইছে, কিন্তু মেয়েটার মৃত্যু’তে সব উলোটপালোট হয়ে গেলো৷ এই ছেলের চিন্তায় আমার ঘুম আসেনারে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে দেখলাম অঙ্গন’কে বিয়ে করানো উচিৎ। ‘
মনমরা হয়ে পালঙ্কে বসে ছিলো প্রেরণা৷ হঠাৎ অরুণা এসে পাশে বসে এমন কথা বলায় কিঞ্চিৎ বিচলিত হলো প্রেরণা। অরুণার দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ডুঁকরে ওঠে বললো,
-‘ আমার ছেলেটা’কে কেউ মেয়ে দিবনা আপা। আমার অমন সুন্দর, সভ্য ছেলেটার জীবনে কার কুনজর পড়লো। আমার হিরার টুকরা ছেলে,আমার অঙ্গনটার কি হয়ে গেলো। ‘
বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো প্রেরণা৷ অরুণা তাকে স্বান্তনা দিয়ে বললো,
-‘ কাঁদিস না কাঁদিস না। আমাদের এতো দুর্দিন আসেনাই যে এ বাড়ির ছেলের জন্য পাত্রীর অভাব পড়বে। ‘
-‘ কিন্তু আমার অঙ্গন কি স্বাভাবিক হবে? আমার কলিজাটা কি আগের মতো সুন্দর হাসি দিয়ে আবারো আমার বুকে শান্তি দিবে? আম্মা,আম্মা ডাকতে ডাকতে ঘরে এসে আমার কোলে মাথা রাখবে? ‘
-‘ সব হবে আগে তুই মত দে। ‘
-‘ বিয়ে করালে সত্যি আমার অঙ্গন ঠিক হবে আপা?’
-‘ সব ঠিক হবে তার জন্য লাগবে একজন রূপবতী মেয়ের সান্নিধ্য। মনে রাখিস নারী’র সান্নিধ্য পেলে পুরুষ মহাপুরুষ হয়ে যায়৷ আমাদের অঙ্গনের জন্য একটা রূপের সমুদ্র নিয়ে আসবো আমি দেখিস। যার সান্নিধ্য পেলে রোমানা’কে ভুলে যাবে অঙ্গন। ‘
প্রেরণার চোখ, মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো৷ চকচকে দৃষ্টিজোড়ায় ভেসে ওঠলো অরুণার প্রতি অগাধ ভরসা৷ সেই ভরসাতেই প্রেরণা অনুমতি দিলো,
-‘ তবে তাই হোক আপা তাই হোক। ‘
[২৮]
বাইজি গৃহঃ
হাতাহীন কৃষ্ণবর্ণীয় ব্লাউজের সঙ্গে পাতলা একটি শাড়ি পরে পলাশের সামনে এসে দাঁড়ালো মান্নাত বাইজি৷ বাইজি গৃহের সেই ঘরে রয়েছে তারা যে ঘরে গত কয়েক বছর ধরে নিয়মে,অনিয়মে বাসরশয্যা হয় তাদের। পুরোনো বহু স্মৃতি এসে হানা দেয় মান্নাতের মনে। বক্ষঃস্থল হয়ে ওঠে ভারী। এই সেই ঘর যে ঘরটার প্রতিটি ইষ্টকও তার আর্তনাদের শাক্ষি। চেয়েছিলো আস্ত এক ভালোবাসাময় মানব,একটি ছোট্ট ঘর, ছোট্ট সংসার অথচ পেলো, আস্ত অভিশাপ। ভালোবাসা মানে অভিশাপ। হয়তো সবার বেলায় নয়, তবে জমিদারের পুত্রদের ভালোবাসা মানেই আস্ত এক অভিশাপ। যে অভিশাপের ভার বহন করতে করতে লাশ হয়ে ক্ষ্যান্ত হতে হয়। তবে জীবিত লাশের সংখ্যাই বেশী, আর জীবিত লাশগুলোর যন্ত্রণাও বেশ প্রখর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কক্ষের দরজা লাগালো মান্নাত৷ পলাশ চৌধুরী তখন বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে উদাম শরীরে শুয়ে আছে বিছানায়। নাভীর কিঞ্চিৎ নিচ থেকে প্যান্ট পরায় নগ্ন বুক থেকে উদর অবদি পুরোটাই সুস্পষ্ট চোখে ধরা দিলো। তার শ্যামবর্ণীয় সুঠাম দেহে, লোমশ ভর্তি বুকে এক নজর তাকাতেই দৃষ্টি নত করে ফেললো মান্নাত। এক ঢোক গিলে ধীরপায়ে এগিয়ে যেতেই বিশ্রী হেসে হেচকা টান দিয়ে মান্নাত’কে নিজের বুকে আঁছড়ে ফেললো পলাশ। মূহুর্তেই মান্নাতের শরীর থেকে শাড়িটি খুলে বুকে মুখ ডুবিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিতে শুরু করলো। আচমকা মান্নাত’কে শূন্যিতে তিলে ঘুরিয়ে বিছানায় ফেলে নিজের বিশাল দেহটি দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো৷ প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত স্বরে বলে ওঠলো,
-‘ তোকে আমি বলেছিলাম, বলেছিলাম ছল করে চতুরতা করে নুর’কে আমার কাছে নিয়ে আসতে। তুই আমার কথা রাখিসনি,রাখিসনি তুই আমার কথা। ‘
শুধু কন্ঠে ক্ষিপ্ততা নয় বরং নিজের শক্তিশালী দেহটি দ্বারাও অসহীনয় ক্ষিপ্ততা প্রকাশ করলো পলাশ। কখনো অসহ্য হয়ে ছটফট করলো মান্নাত,কখনো চোখে অশ্রুপাত ঘটালো, কখনো যন্ত্রণাময় স্পর্শগুলোয় তাল মেলালো। তবুও মুখফুটে একটি শব্দও উচ্চারণ করলো না। কারণ নৃশংস মানুষ’টা তার থেকে ভালো,মন্দ যাই শুনবে তাতেই তার ক্ষিপ্ততা বেড়ে যাবে। মনে মনে এখন সে খুব চায় পলাশ চৌধুরী তাকে খুন করে ফেলুক। তার জান কবজ করে তাকে মুক্তি দিক। জান দিয়ে দেবে তবুও তার হাতে কোন পরিস্থিতি’তে নুর’কে তুলে দেবেনা। বেইমানি, জমিদার’দের রক্তে থাকতে পারে কিন্তু সামান্য বাইজিদের রক্তে বেইমানি নেই।

রাত তখন দশটা ছুঁয়েছে। শাহিনুর’কে বক্ষে চেপে শুয়ে আছে শারমিন। এই একমাসে অনেক কিছু ঘটেছে। শারমিন জানতে পেরেছে নুরের জীবনে রঙ্গনের প্রবেশের কথা। সব শুনে পায়ের নিচ থেকে যেনো মাটি সরে গেছে শারমিনের। এতো পরিশ্রম করে, এতোটা যুদ্ধ করে কী লাভ হলো তার সেই শকুনিদের নজরেই পড়লো শাহিনুর! যেদিন তীব্র ভয়ে জর্জরিত হয়ে শাহিনুর সবটা বলে ক্ষমা চাইলো, বাকরুদ্ধ হয়ে কতোটা সময় বসে ছিলো শারমিন জানা নেই। কিন্তু যখন সে সংবিৎ ফিরে পেলো তখন শাহিনুর’কে প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলো। বহুবছর পর অনেকটা সময় কেঁদেছিলো শারমিন। শাহিনুরের ছোট্ট মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়েছিলো তার জীবনের বিশাল বিশ্বাসঘাতকতার কথা। মা’য়ের থেকে সবটা শুনে শাহিনুরও বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলো। প্রশ্ন করেছিলো,
-‘ আম্মা জমিদার তোমাকে ভালোবাসলে এমন খারাপ জায়গায় কেন রাখলো? মা’কে ভালোবাসে বলে মা’য়ের অন্যায়কেও ভালোবাসতে হবে কেন? অন্যায় তো অন্যায়ই সে যেই করুক না কেন। ‘
শাহিনুরের কথা শুনে গর্বে বুক ভরে ওঠে শারমিনের। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলে,
-‘ এইতো আমার মেয়েটা কতো বুঝে। তোমায় আরো বুঝতে হবে, আরো জানতে হবে। দুনিয়া টা বড়ো কঠিন। দুনিয়ার মানুষগুলো বড়ো স্বার্থপর। কঠিন এই দুনিয়াতে নিজেকে কঠিনভাবে গড়ে তুলতে হবে। স্বার্থপর মানুষগুলোর সাথে স্বার্থপর হয়েই লড়াই করতে হবে। ‘
সেদিনের পর থেকেই শুরু হয় শারমিনের সংগ্রাম। নিজের মেয়ে’কে কঠিনভাবে গড়ে তোলার সংগ্রাম। যে সংগ্রামের শুরু হয়েছে বাইজি গৃহের ভেতরে আর শেষ হবে বাইরের জগতে, বিশাল পৃথিবী’তে।
এখন আর নুর’কে একা রাখে না শারমিন। সবসময় নিজের কাছে,নিজের বুকে আগলে রাখে। কতোদিন হয়ে গেলো অলিওরের সঙ্গেও দেখা করেনা। অলিওর ঠিকই আসে কিন্তু মেয়ে’কে ছেড়ে সে এক মূহুর্তের জন্যও সরতে নারাজ। মায়ের মন বুকের ভিতর কেমন কেমন করে, সামনের দিনগুলো নিয়ে ভয় করে খুব। শহর থেকে বান্ধবীর চিঠি পেয়েছে দু’দিন আগে। সে বেশ কঠিনভাবে এবার জানিয়েছে,সামনে মাসেই নুর’কে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে। নয়তো পরে আফসোস করতে হবে। বান্ধবীর চিঠির উত্তর দিয়ে শারমিনও বলেছে,
-‘ প্রিয় সেতেরা,
তুই রাগ করিস না। তুই তো জানিস জমিদারের চতুর্থ পুত্র বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে৷ এই নিয়ে জমিদারের অবস্থাও তোকে জানিয়েছি। তাই কিছুদিন নুরের বিষয়ে তার সাথে কথা বলিনি। কিন্তু আজ,কালের মধ্যে তাকে জানাবো আমার মেয়ে’কে এবার আমার বান্ধবীর হাতে তুলে দিতে চাই। মেয়ের মা আমি, আমাকে তো মেয়ে’কে পরের ঘরে দান করতেই হবে বল। তুই রাগ করিস না। যদি রাগ করিস বেয়ান হিসেবে না হয় মনে মনে গালটা টিপে দেবো। সাক্ষাৎে তা তো আর সম্ভব হবে না! শোন বেয়ান, তোর ছেলেটা’কে বলে দিস তার শাশুড়ি মা তার জন্য আস্ত এক ডায়েরি পাঠাবে। সেখানে একটি অক্ষর না পেলেও নিজের মতোন করে অক্ষর দিয়ে শব্দ বুনে নেবে, ভালোবাসা মাখিয়ে বাক্য তৈরি করতে পারবে। যা কখনো নিঃশ্বেষ হবে না। মানুষ নশ্বর কিন্তু তাদের সৃষ্টি অবিনশ্বর। আমি আস্ত এক ডায়েরি দিলাম তাকে আস্ত ভালোবাসা বুনে নিতে বলিস। আর হ্যাঁ মেয়েটাকে এখনো এ ব্যাপারে জানাইনি তুই আমাকে দুটো দিন সময় দে আমি সবটা সাজিয়ে,গুছিয়ে নিয়ে আমার অমূল্য রতন,কলিজার টুকরাটাকে শিঘ্রই পাঠিয়ে দেবো। ভালো থাকিস চিঠির অপেক্ষায় থাকবো।

-শারমিন শায়লা
[২৯]
জরুরী তলবে প্রণয়ের কোয়ার্টারে এসে হাজির হলো রঙ্গন৷ প্রণয় অত্যন্ত গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে বসে আছে সোফায়৷ রঙ্গন গিয়ে তার পাশে বসলো৷ প্রণয় হাতে কিছু পেপার্স নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে৷ রঙ্গন অনুমান করলো, তার কোন পেশেন্টের কাগজপত্র ওগুলো৷ হয়তো অঙ্গনেরই হবে। তাই সেদিকে মাথা ঘামালো না। অপেক্ষা করলো প্রণয়ের কথা শোনার জন্য গুটিকয়েক মিনিট পর কাগজপত্র গুছিয়ে পাশে রাখলো প্রণয়৷ পিঠ এলিয়ে এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতেও বসলো। দৃষ্টি উপরের দিকে স্থির রেখে তর্জনী আঙুল দ্বারা ভ্রু চুলকাতে চুলকাতে প্রশ্ন করলো,
-‘ বাইজি’র মেয়েটার কি খবর? রাত দুপুরে এখনো দেখা হয়? ‘
রঙ্গন কিঞ্চিৎ অবাক হলো পরোক্ষণেই মৃদু হেসে বললো,
-‘ না ভাইয়া ওর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিলো তোমার জন্মদিনের দিন তারপর আর হয়নি। ‘
-‘ কেন? ‘
-‘ ও চায়নি। ‘
ওষ্ঠকোণে দুর্বৃত্ত হাসির দেখা মিললো প্রণয়ের। সহসা রঙ্গনের দিকে ঝুঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন করলো,
-‘ ওর সাথে ব্যাপারটা কতোদূর এগিয়েছিলো রঙ্গন? হাত অবদিই নাকি আরো গভীরে গিয়েছিলি? ‘
#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_২২
কৌশলে প্রণয় তার এবং নুরের মধ্যেকার সম্পর্ক জানতে চাচ্ছে, এর পেছনে সঠিক কারণ বোধগম্য হলো না রঙ্গনের৷ তবুও বড়ো ভাই এমন একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে উত্তর না দিয়েও উপায় নেই। ওষ্ঠকোণে কিঞ্চিৎ লজ্জা মিশ্রিত হাসির আভাস নিয়ে রঙ্গন বললো,
-‘ আরে নাহ, কি যে বলো অমন ইনোসেন্ট মুখ দেখলেই তো প্রাণ জুড়িয়ে যায়, আর কিছু লাগে নাকি? ‘
প্রণয় ভ্রুদ্বয় কুঁচকে আবারো গা এলিয়ে বসলো। বাঁকা চোখে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-‘ পুরো পৃথিবী’কে রঙ্গ দেখিয়ে ঘোল খাওয়াতে পারিস, কিন্তু আমাকে পারবিনা জমিদারের ছোট পুত্তুর! ‘
প্রণয়ের মুখে পুত্তুর শুনে রঙ্গনের ছোটবেলাকার কথা মনে পড়ে গেলো। তার দাদিও ঠিক এভাবেই পুত্তুর সম্বোধন করতো৷ দাদির কথা মনে পড়ায় অতি উচ্চ স্বরে হেসে ওঠলো রঙ্গন৷ বললো,
-‘ আমরা সব ভাই’রা তো পাঁচ মিশাল তাইনা ভাইয়া? তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুবুদ্ধি সম্পন্ন, সুজ্ঞান সম্পন্ন তো একমাত্র তুমিই। আমরা কেউ তা অস্বীকার করতে পারিনা বা আমরা কোন ভাই এই সত্যিটা অবিশ্বাসও করিনা। কিন্তু ভাই, আমি যতো রঙ্গই দেখাই,যতো রঙ্গই করি আমার ভিতরেও একটা সফট মন আছে। ‘
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রণয় বললো,
-‘ তা আমি জানি আর তোর সফট কর্ণার কোথায়,কে সেটাও জানি৷ তাই তো বলছি বাইজির মেয়েটা’কে যখন ভালোইবাসিস না এতো রঙ্গ করছিস কেন? ‘
-‘ আরেহ ভাই এতো সুন্দরী একটা মেয়ে আমার প্রেমে দিওয়ানা, হতে পারে সে বাইজি’র মেয়ে। কিন্তু ভাবোতো মেয়েটা’কে বউ হিসেবে পাওয়া কতোটা সৌভাগ্যের? এমন ইনোসেন্ট, এমন বিউটিফুল গার্ল’কে কে না বউরূপে পেতে চায়। ‘
তাচ্ছিল্য সহকারে হেসে প্রণয় বললো,
-‘ যদি ভালো নাই বাসিস বিয়ে করে মেয়েটা’কে ঠকাতে দেবো না রঙ্গন। তাছাড়া পলাশ চৌধুরী বেঁচে থাকতে তুই নুরের সঙ্গে বিয়ে,সংসার কোনটাই করতে পারবিনা৷ আর আমি বেঁচে থাকতে ওকে ঠকতে দেবো না। ‘
শেষ কথাটায় কেমন যেনো চমকে ওঠলো রঙ্গন। বিস্মিত হয়ে স্পষ্ট দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো প্রণয়ের দিকে। দেখতে পেলো প্রচণ্ড গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে প্রণয়। তার দৃষ্টির দৃঢ়তা,মুখের গম্ভীর্যতায় বক্ষঃস্থল কেমন আনচান করে ওঠলো। অস্থির চিত্তে প্রণয়’কে প্রশ্ন করলো,
-‘ কি বলছো ভাইয়া! ‘
এ পর্যায়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না প্রণয়৷ চট করে ওঠে দাঁড়ালো। পিছ মুখী হয়ে ক্রমশ শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ বাড়িয়ে তুলে চোয়াল শক্ত করে বললো,
-‘ ইয়েসস আই ওয়ান্ট টু সেভ হার। এর জন্য তাকে আমার হতে হবে। ‘
রঙ্গন কিছুটা বিচলিত ভঙ্গিতে ওঠে দাঁড়ালো। তার পুরো শরীর তরতর করে ঘামতে শুরু করলো। বিস্ময়ান্বিত কন্ঠে বললো,
-‘ ভাই আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। ‘
-‘ ওর আমাকে খুব প্রয়োজন রঙ্গন, ওর আমাকে ভীষণ প্রয়োজন। ‘
-‘ না এটা মিথ্যা, তুমি আমার সাথে ছলনা করছো ভাইয়া! তুমিও বাকি সবার মতো নুরের রূপে উন্মাদ হয়ে গেছো। কিন্তু ভাইয়া নুর আমাকে ভালোবাসে ঐ মেয়েটা’কে আমি ঠকাতে পারবো না। ‘
ক্রোধান্বিত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে রঙ্গনের গালে ঠাশশ করে থাপ্পড় মারলো প্রণয়। ধমকের সুরে বললো,
-‘ এতোগুলো দিন হবু ভাবি’র সঙ্গে তামাশা করেছিস কিছু বাঁধায় তা দাঁত চেপে মেনে নিয়েছি। নেক্সট কোন তামাশা চাই না। ‘
রঙ্গনের চোখ,মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। গালে হাত দিয়ে ব্যথাহত কন্ঠে বললো,
-‘ সামান্য একটা মেয়ের জন্য তুমি আমার গায়ে হাত তুললে ভাইয়া৷’
প্রণয় স্মিত হেসে বললো,
-‘ এক থাপ্পড়ে যে মেয়েটা তোর কাছে সামান্য হয়ে গেলো সেই মেয়েটা কতোটা অসামান্য তুই জানিস না রঙ্গন। আমার পূর্বে মেয়েটা তোকে ভালোবাসি বলেছে তবুও আমি ওকে সামান্য ভাবতে পারিনি। ঐ মেয়েটা’কে তুই যেদিন থেকে চিনিস তার বহু আগে থেকে ওকে আমি চিনি৷ যাকে চিনিস না,জানিস না,যাকে ভালোবাসিস না,যে মেয়েটা তোর চোখে সামান্য তার সঙ্গে ঘর বাঁধা কাপুরুষতা রঙ্গন৷ আমার ছোট ভাই’টা কাপুরষ হোক তা আমি চাইনা৷ অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়,শান্ত কন্ঠে বলছি নুর’কে জীবনে আনার কথা ভুলে যা। ‘
-‘ কিন্তু নুর আমাকে ভালোবাসে ভাইয়া। ‘
-‘ যে মেয়েটা নিজেকে ভালোবাসতে শিখেনি সেই মেয়েটা তোকে ভালোবাসে এটা খুবই হাস্যকর রঙ্গন৷’
-‘ মানে? ‘
-‘ খুবই সহজ। জীবন কী, মানুষের পূর্নরূপ কী তা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞাত নুর। তোর সঙ্গে রাত,বিরাতে ঘুরাঘুরি’তে মেয়েটা ভয় পায়নি কারণ পুরুষ মানুষ সম্পর্কে ওর ধারণাই নেই। পুরুষ দ্বারা ওর কীভাবে ক্ষতি হতে পারে সে বিষয়ে এখনো অজ্ঞান নুর, এমনি কীসে নিজের ভালো হবে,কীসে মন্দ হবে সেটাও সঠিকভাবে এখন অবদি বুঝতে পারেনি। সাধারণ নলেজ যার এতো কম সে তোকে ভালোবাসলো কী করে? ভালোবাসা’র মানেটা ঐ মেয়ে বুঝে? আমি তোকে বলছি যেদিন ঐ মেয়েটা সত্যিকারের অর্থে ভালোবাসার মানে বুঝবে সেদিন আর তোকে ভালোবাসি বলবে না। মিলিয়ে নিস। ‘
কিছুটা আহত সুরে রঙ্গন বললো,
-‘ নুরের রূপের কাছে তোমার ব্যক্তিত্বও নড়বড়ে হয়ে গেলো ভাইয়া! ‘
রঙ্গনের মুখে এমন কথা শুনে রাগ না করে হাসলো প্রণয়। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে রঙ্গনের কাঁধে হাত রাখলো। শান্ত গলায় বললো,
-‘ আগেতো দর্শনধারী পরে গুণবিচারি মেরা ভাই। ‘
রঙ্গন চাপা নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। প্রণয় অতি সন্তর্পণে নিজের পকেট থেকে টিস্যু বের করে রঙ্গনের কপালে ফুটে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দিতে দিতে বললো,
-‘ দেখ ভাই আমি মেজো ভাই’য়ের মতো অতোটা পাষাণ নই যে তোর ভালোবাসা কেড়ে নেবো। কিন্তু আমি তার থেকেও ভয়ংকর পাষাণ তাই নিজের ভালোবাসা’কে কেড়ে নিচ্ছি। নুর’তো তোর ভালোবাসা নয়। ‘
রঙ্গন ঠাশ করে প্রণয়ের হাত নামিয়ে দিলো৷ কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বললো,
-‘ নুর তোমাকে পছন্দ করে না। তুমি এটা করোনা ভাইয়া, তুমি তো এমন নও। ‘
-‘ তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো না? তুমি নুরের ভালো চাও না বলো? ‘
প্রচণ্ড রেগে গিয়ে রঙ্গন’কে তুমি করে বলে প্রণয়৷ রঙ্গন বুঝলো প্রণয় বেশ চটে গেছে তাই শান্ত হয়ে বললো,
-‘ আমার মাথা কাজ করছে না। ‘
প্রণয় বললো,
-‘ তোর কি কষ্ট হচ্ছে? ‘
-‘ নাহ। ‘
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে প্রণয় এবার রঙ্গনের মাথায় হাত বুলালো। বললো,
-‘ তাহলে তুই শিওর থাক নুরের প্রতি তোর ভালোবাসা নেই। যা আছে তা দায়। ‘
-‘ আমি পলাশ চৌধুরী থেকে প্রতিশোধ নিতে চাই। ‘
-‘ তোদের প্রতিশোধের জন্য একটা নিষ্পাপ জীবন নষ্ট হোক তা আমি চাইনা৷ কিন্তু আমার ভালোবাসার জন্য কারো জীবন সুন্দরতম ভাবে গড়ে ওঠুক খুব চাই৷ সবচেয়ে বড়ো কথা আমি আমার মনোহারিণী’কে চাই। ‘
বিস্মিত কন্ঠে রঙ্গন বললো,
-‘ তুমি সত্যি নুর’কে…’
বাকিটুকু বলতে দিলো না প্রণয়। রঙ্গনের ওষ্ঠদ্বয়ে নিজের তর্জনী আঙুল চেপে ধরে বললো,
-‘ ভাবি বল ভাবি। ‘
বুক কেঁপে ওঠলো রঙ্গনের একবার ভাবলো সে কি আবারো হেরে যাচ্ছে? পরোক্ষণেই ভাবলো সে তো সত্যি নুর’কে ভালোবাসে না। প্রণয় তো ভুল কিছু বলেনি প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নুরের জীবন যে নষ্ট হবে না তারই বা নিশ্চয়তা কী? অগণিত দ্বিধায় দিশেহারা হয়ে গেলো রঙ্গন। তখনি কানের কাছে ফিসফিস কন্ঠস্বর শুনতে পেলো প্রণয়ের,
-‘ এতো দ্বিধা না করে নুর’কে ভাবি হিসেবে মেনে নেওয়ার চেষ্টা কর রঙ্গন। এতে সবারই মঙ্গল। ‘
রঙ্গনের সঙ্গে অনেকটা সময় কথা বলার এক পর্যায়ে প্রণয় সিদ্ধান্ত নিলো খুব শিঘ্রই বাইজি শারমিন শায়লার সঙ্গে দেখা করবে সে। এবং খুব শিঘ্রই শারমিন শায়লার নিকট বিবাহের পয়গাম পাঠাবে স্বয়ং নিজে গিয়েই।
[৩০]
মাঝরাতে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলো শারমিন বাইজির। শোয়া থেকে সটান হয়ে বসে বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে শুরু করলো সে। পুরো শরীরে কেমন হিম ছুঁয়ে যাচ্ছে। গণ্ডস্থল থেকে বক্ষঃস্থল অবদি শুকিয়ে কাঠকাঠ অবস্থা। না পেরে বিছানা ছেড়ে পাশের টেবিলে থাকা জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরে ঢকঢক করে গিলতে লাগলো। দু’গ্লাস পানি এক নিমিষেই শেষ করে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো শারমিন৷ তার কান্নায় অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গেলো শাহিনুরের। নড়েচড়ে, ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসলো সে। ভয়ে জর্জরিত হয়ে শারমিনের দিকে চেয়ে বললো,
-‘ আম্মা তুমি কাঁদছো কেন? ‘
শাহিনুরের কথা শুনে চমকে ওঠে ত্বরিতগতিতে অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া মুছে নিলো। চোখেমুখে মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে শাহিনুরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-‘ কি বলছিস মা কাঁদবো কেন? পানি খেলাম’রে হেঁচকি ওঠে গেছিলো। ‘
কপট রাগ দেখিয়ে শাহিনুর বললো,
-‘ না আম্মা আমি স্পষ্ট তোমার কান্না শুনতে পেয়েছি কান্না শুনেই ঘুম ভেঙে গেছে আমার। ‘
শারমিন জানে শাহিনুর কিছুতেই হার মানবে না৷ সে চায়ও না তার মেয়ে জীবনে চলার পথে কোথাও হার মানুক, তার নিজের কাছেও নয়৷ তাই ওষ্ঠকোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে শাহিনুর’কে বুকে টেনে নিলো। মাথায় স্নেহময় চুম্বন এঁকে দিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-‘ মা’রে কখনো নিজের দূর্বলতাগুলোকে কারো কাছে প্রকাশ করতে নেই। আর কারো সামনে নিজের দুঃখ যন্ত্রণাগুলো যতোটুকু পাড়া যায় গোপন করতে হয়৷ আমি কাঁদছিলাম কিনা সেটা আর জিজ্ঞেস করিস না মা। ‘
শাহিনুর নিশ্চুপ রইলো। শারমিনের বুকের ধুকপুকানি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে৷ শারমিনও বুঝলো শাহিনুর এখন কিছুটা বিচলিত হয়ে আছে। তাই বললো,
-‘ নুর, এ পৃথিবীতে কিছু মানুষ রয়েছে যারা ঠিক নারিকেলের মতো। বাইরে থেকে কঠিন আর ভিতরে একেবারে নরম। কিন্তু তুমি বাইরে ভিতরে একই রকম। আমি তোমাকে বাইরে এবং ভিতরে দু’জায়গায়ই শক্ত দেখতে চাই৷ মানুষের মন সত্যকার অর্থে কঠিন হতে পারেনা, হয় তাদের মন নরম নয়তো তাদের মন নৃশংস। তুমি ভিতরে শক্ত হতে পারো বা না পারো কেউ যেনো কখনো তোমার ভিতরের সত্তা টের না পায়৷ নিজেকে কঠিন করে গড়ে তুলতে হবে৷ তোমাকে অনেক শক্ত হতে হবে। এখন যেমনটা আছো এমনটা থাকলে চলবে না৷ যদি এমনটা থাকো পুরো দুনিয়া তোমাকে নৃশংসভাবে ঠকিয়ে দেবে৷ আর একটি কথা মনে রাখবে যার মুখে যতো রস তার সত্তায় ততো বেশী ভেলকি থাকবে৷ প্রকৃত অর্থে মানুষ’কে চিনতে হলে জানতে হলে তাদের দৃষ্টি বুঝতে হবে,বোঝার চেষ্টা করতে হবে৷ সবশেষে বলবো মানুষ’কে চেনার থেকেও মানুষ’কে পড়ার চেষ্টা বেশী করবে৷ তোমাকে একটি গল্পের নাম বললাম তুমি নাম জানলে, সে বইটা তোমার হাতে দিলাম তুমি বই’টা চিনলে। কিন্তু ভিতরের বর্ণনা গুলো না পড়লে তুমি সে বই বিষয়ে অজ্ঞই থেকে যাবে৷ বই পড়ার মতো করেই মানুষ’কে পড়তে হবে৷ মনে রেখো পৃথিবী সম্পর্কে জানার যেমন শেষ নেই তেমনি পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া বিচিত্র মানুষগুলো’কে পড়েও শেষ করা যাবে না৷ তবে সামনে, পিছে, ডানে,বা’মে, মস্তিষ্কে, মনে থাকা প্রতিটি ব্যক্তিকেই নিখুঁত ভাবে পড়ার চেষ্টা করবে। পুরো দুনিয়া নয় এ’কজনকেই সুক্ষ্ম ভাবে পড়ার চেষ্টা করো সব সময়৷ ‘

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here