বাল্যবিবাহ পর্ব -০৬

#বাল্যবিবাহ
[পর্ব – ৬ ]
লেখক – আবির চৌধুরী।

কিছুক্ষণের মধ্যে নীলার আব্বা আম্মা চলে আসে হাসপাতালে। এসে দেখে নিলয় আর নিলয়ের মা বসে আছে।

নীলার আম্মা নিলয়ের কাছে এসে বলতে থাকে — বাবা, আমার মেয়েটা কেমন আছে?

— ডাক্তার দেখছে।

— বাবা নীলার তো মাত্র ৯ মাস হলো তাহলে এতো তাড়াতাড়ি ব্যাথা কি ভাবে শুরু হয়ে গেছে? ওকি আঘাত পেয়েছে কোনো ভাবে?

তারপর নিলয় নীলার আম্মাকে সব বলল। নীলার আম্মা এসব শুনে কান্না করে দিল। জামসেদ আলী তাত স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে এসে বলল — কান্না করোনা নীলার কিছুই হবে না।

— আপনি চুপ থাকেন। আপনার জন্য এতো কিছুই হচ্ছে৷ আজ আমার মেয়েটা মরতে বসছে৷ আমার মেয়ের যদি কিছু হয়ে যায় আপনাকে আমি ছাড়বনা।

জামসেদ আলীর মুখ দিয়ে কিছুই বের হচ্ছে-না। তিমি তো নীলার ভালোর জন্য বিয়ে দিয়েছেন।

একটু পরে ডাক্তার আসল আবার। সবাই ডাক্তারের কাছে এগিয়ে গেল।

জামসেদ আলী — ডাক্তার আমার মেয়ের কি অবস্থা এখন?

— অবস্থা অনেক খারাপ। একে তো বয়েস অনেক কম আবার সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে বাচ্চা আঘাত পেয়েছে। এখন আমাদের হাতে একটা রাস্তা আছে হয়তো বাচ্চাকে বাচানো যাবে না হয় বাচ্চার মাকে। এখন আপনারা বলুন।

নিলয় — ডাক্তার আপনি আমাত স্ত্রীকে বাঁচিয়ে দেন প্লিজ। আমার বাচ্চার দরকার নেই। আমি আপনার কাছে হাত জোর করছি। আমি ওর সাথে অনেক অন্যায় করছি। ওকে আমি অনেক অবহেলা করছি৷ প্লিজ ডাক্তার ওকে আপনি বাচিঁয়ে দিন৷

ডাক্তার — ঠিক আছে আমরা চেষ্টা করব। আমরা দুজন কেই বাচানোর চেষ্টা করব বাকিটা আল্লাহর হাতে৷ আমরা আমাদের শতভাগ দিয়ে চেষ্টা করব।

এই কথা বলে ডাক্তার নীলার কেবিনে চলে গেলো।
নীলা ডাক্তার কে বলল — ডাক্তার আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিল।

— কি কথা বলুন?

— আমি সব শুনেছি আপনাদের কথা। আপনার কাছে একটা রিকুয়েষ্ট আপনি আমার বাচ্চাকে বাচিঁয়ে দিন আমার যা হবার হবে। আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।

— কিন্তু আপনার হাসবেন্ড তো বলল উনি আপনাকে চায় বাচ্চাকে নয়।

— ডাক্তার আমি আপনার পায়ে পড়ি আমার কথাটা রাখুন প্লিজ। আমার হাসবেন্ড বাচ্চা খুব পছন্দ করে আমি চাইনা আমার জন্য তার সন্তানের কিছু হয়ে যাক। আর আপনি আমাকে একটা কাগজ আর কলম দিবেন প্লিজ?

— কাগজ কলম দিয়ে কি করবেন আপনি?

— দরকার আছে৷

— ঠিক আছে দিচ্ছি আমি।

— ডাক্তার আরেকটা কথা!

— বলুন কি কথা?

— আপনি কাওকে কিছু বলবেন না আমি যে বলছি বাচ্চাকে বাচিঁয়ে দেওয়ার কথা। প্লিজ ডাক্তার কাওকে বলবেন না আপনি।

— ঠিক আছে৷

— অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

তারপর ডাক্তার নীলাকে একটা কাগজ আর কলম ধরিয়ে দিয়ে বের হয়ে চলে গেলো। তারপর নীলা লেখা শুরু করে দিল।

কিছুক্ষণ পরে একটা নার্স বের হয়ে সবাইকে বলতে থাকে রোগী আপনাদের সাথে দেখা করতে চায়। একজন একজন করে ভিতরে যান আপনারা।

জামসেদ আলী আগে ভিতরে গেলো। ভিতরে গিয়ে নীলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল — মা তুই চিন্তা করিস না তুই ঠিক হয়ে যাবি। দেখবি তোর কিছুই হবে না মা।

— আব্বা আমি তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করছি আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিয় প্লিজ। আর বাবা একটি কথা আমি যদি মরে যায় আমার মাথায় একবার হাত ভুলিয়ে দিয়। আর হ্যা আমার ছোট বোন মিতুকে আমার মতো এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয় না। ওকে পড়াশোনা করতে দিয় আব্বা। না হলে আমার মতো তুমি আরেকটা মেয়ে কেও হারাবে অল্প বয়েসে।

— মা তুই এসব কি বলছিস? চুপ কর, তোর কিছু হবেনা মা তুই ঠিক হয়ে যাবি।

— আমি সব জানি আব্বা। আমার একটাই কষ্ট একটা বার নিজের বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারলাম না।

— মা তুই সুস্থ হয়ে নে তোকে আর আমি ওই বাড়িতে ফিরে যেতে দেবনা কখন।

নীলা জামসেদ আলীর কথা শুনে একটা মুচকি হাসি দিল। তারপর নীলা তার এক হাত দিয়ে জামসেদ আলীর চোখের পানি মুছে দিল। তারপর জামসেদ আলী নীলার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে বের হয়ে চলে গেলো।

একটু পরে নীলা মা নীলার কেবিনে ঢুকে নীলাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। নীলা তার মাকে বলল — আম্মা কান্না করছ কেন? আমি কি মরে গেছি নাকি? তোমরা সবাই তো এটাই চাইছিলে তাই না? সেই জন্যই তো আমাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলে এখন কান্না করছ কেন?

— মারে তুই এই ভাবে কথা বলিস না। আমার যে খুব কষ্ট হয় মা।

— তোমরা তো খুশি হওয়ার কথা! তাহলে কষ্ট কেন পাচ্ছ মা?

— চুপ কর তুই তোর কোনো কিছুই হবেনা। তুই ঠিক হয়ে যাবি।

তারপর আরো কিছুক্ষণ নীলাকে সান্ত্বনা দিয়ে নীলার কপালে একটা চুমু দিয়ে বের হতে যাবে এমন সময় নীলা পিছন থেকে ডাক দিল।

— আম্মা শোনো!

— হুম মা বল!

— মিতু আর জিসান আসে নাই? ওদের দেখতে ইচ্ছে করছে খুব৷ একটু ভিতরে নিয়ে আসবে?

— আচ্ছা নিয়ে আসছি।

তারপর নীলা মা জিসান আর মিতুকে নিয়ে আসল। নীলা তার দুই ভাইবোনের গালে চুমু খেয়ে বলল — তোরা সব সময় আম্মা আব্বার কথা শুনিস, কখনো তাদের কথার অবাধ্য হবিনা। আর তাদের দেখে রাখিস তোরা।

একটু পরে নীলার শ্বাশুড়ি আসল। তার চোখে পানি টলমল করছে। তবে আজ চোখের পানি টা দেখানো না। তিনি নীলার পাশে বসে।

— বউমা কেমন আছো তুমি?

— ভালো আছি মা।

— বউমা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয় প্লিজ আমি তোমার সাথে সব সময় খারাপ আচরণ করছি। তোমার সাথে কখনও ভালো ভাবে কথা বলি নাই। আজ তোমাকে এতো কষ্ট পেতে হচ্ছে শুধুই আমার জন্য। আমি যদি তোমাকে দিয়ে এসব কাজ না করাতাম তাহলে আজ তোমার সাথে এমন কিছুই হতোনা। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমিও সন্তানের মা। আমি ভুলে গিয়ে ছিলাম একটা মেয়ে সন্তান পেটে রেখে কাজ করতে কতটা কষ্ট হয়। আমি তোমাকে দিয়ে অনেক কাজ করাইছি। তোমার যত্ন নেওয়ার বদলে তোমাকে একটা কাজের নেয়ের মতো খাটিয়েছি। আমাকে তুমি মাফ করে দিয় মা।

— মা আপনি আমার কাছে ক্ষমা ছেয়ে আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? আপনি আমার গুরু জন আমার জন্য দোয়া করবেন। আর মা একটা কথা আমি যদি মরে যাই আপনার ছেলেকে আরেকটা বিয়ে করাবেন। আর সেই বউয়ের সাথে এমন আচরণ করবেন না। সবাই আমার মতো হবে না।

— বউমা তুমি কিসব বলছ? ডাক্তার বলছে তোমার কিছুই হবেনা। তুমি আবার আমাদের মাঝে আগের মতো হয়ে ফিরে আসবে। আমি আর তোমাকে দিয়ে কোনো কাজ করাব না সব সময় নিজের মেয়ের মতো করে রাখব৷

— অনেক দেরি হয়ে গেছে মা। আমার সময় খুব কম।

— আমি নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে তোমাকে চাইব। আল্লাহ তোমাকে আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিবে ।

তারপর নীলার শ্বাশুড়িও বের হয়ে চলে গেলো। নিলয় দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিলয়ের মা নিলয় কে বলল — বাবা যা বউমা তোকে ঢাকছে।

নিলয় নিজের চোখের পানি মুছে নীলার কেবিনের ভিতরে ঢুকে নীলার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের চোখ সরিয়ে নিল।

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here