বাল্যবিবাহ পর্ব -০৭ ও শেষ

#বাল্যবিবাহ
[৭ম ও শেষ পর্ব]
লেখক — আবির চৌধুরী

নিলয় কিছুতেই নীলার চোখে চোখ রেখে কথা তাকাতে লারছেনা। নিজের কাছে নিজেকেই আজ খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। এবার নিলয় নীলার দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। নীলার পাশে চুপ করে বসে রইল নিলয়৷

নীলা এবার নিলয় কে বলল — কিছু বলবেন না আপনি? আজকে শেষ বারের মতো আমাকে বোকা দিন আর হয়তো কখনো আমাকে বোকতে পারবেন না।

— নীলা কি বলছ এসব তুমি? তোমার কিছু হতে দেবনা আমি৷ আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিয় নীলা। আমি যদি তোমার পাশে থাকতাম আজ তাহলে তোমাকে এতো কষ্ট পেতে হতোনা। আমি তো তোমাকে সব সময় অবহেলা করে গেছি৷ কখনও ভালোবাসতে পারি নাই। শুধু তোমাকে ব্যবহার করে গেছি। আজ নিজের কাছে নিজেকেই বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।

— কেন আপনি নিজেকে অপরাধী মনে করছেন? আমার ভাগ্য খারাপ ছিল আপনার এতে কিসের দোষ ছিল?

— নীলা আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিয় প্লিজ।

— আপনি কেন আমার কাছে ক্ষমা ছেয়ে আমাকে অপরাধী করছেন? আপনার উপরে আনার কোনো রাগ অভিমান নেই। আমার শুধুই একা কষ্ট কখনও আপনার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারলাম না। আমি যদি মরে যাই আমাকে একবার আপনার বুকে জড়িয়ে নিয়েন প্লিজ৷

— নীলা এসব কি কথা বলছ তুমি? বলছিনা কিছু হবে না তোমার। আমি তো আছি আমি তোমাকে আমার বুকে আগলে রাখব সারাজীবন।

— আমাকে একটু আপনার বুকে জড়িয়ে নিবেন প্লিজ?

এবার নিলয় নীলাকে একটা টান দিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ এই ভাবে থাকার পরে নিলয় নীলাকে আসতে করে শুইয়ে দিল। নীলার অপারেশনের টাইম ঠিক করা হয়ে গেছে। রাত ৯ টায় নীলার অপারেশন শুরু হবে।

ডাক্তার একটা কাগজ নিয়ে সবার সামনে আসে সবার থেকে সিগনেচার নিচ্ছে।

নিলয় ডাক্তার কে বলল — ডাক্তার দেখবেন কারোর যেনো কোনো ক্ষতি না হয় প্লিজ।

— আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করব। মা ও বাচ্চা দুজনেই ঝুঁকিতে আছে। আমরা যে কোনো একজনকে বাচাতে পারব।

তারপর ডাক্তার চলে গেলো। কিছুক্ষণ পরে ঘড়িতে ৯ টা বাজতেই ডাক্তার অপারেশন রুমে গিয়ে অপারেশন শুরু করে দিল। বাকি সবাই অপারেশন রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিলয় দেওয়ালে হেলান দিয়ে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক্ষন হয়ে গেলো কিন্তু এখনও কোনো খবর আসল না। সবার চিন্তা বেড়েই যাচ্ছেই। তারপর অনেক্ষন পরে ডাক্তার বের হয়ে আসল।

নিলয় ডাক্তার কে বের হতে দেখে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে ছুটে চলে আসল — ডাক্তার নীলা ঠিক আছে তো?

ডাক্তার কিছু না বলে চুপচাপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

— ডাক্তার কিছু তো একটা বলুন চুপ করে থাকবেন না প্লিজ৷

–Sorry she’s dead. I’m sorry I couldn’t save your wife despite many attempts.

ডাক্তারের কথা শুনে নিলয় ধপাস করে ফ্লোরের উপরে বসে গেছে মাথায় হাত দিয়ে।

ডাক্তার আবার বলল — আমরা অনেক চেষ্টা করছি মা ও সন্তানকে বাচিঁয়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু পারলাম না। বাচ্চা সুস্থ আছে। কিন্তু বাচ্চার মা। i am sorry.

এই কথা বলে ডাক্তার চলে গেলো। সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। নীলা আম্মা জামসেদ আলীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে৷ নিলয় নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। নিলয়ের মা নিলয়ের মাথায় হাত রাখতেই একটা ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিল।

নিলয়ের মা এবার বলল — বাবা তুই শক্ত হো তুই এমন করিস না৷

— নিলয় এবার রাগী চোখে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল — সব কিছুই তোমার জন্য হয়েছে। তোমাকে মা বলে ডাকতেও আজ আমার ঘৃণা হচ্ছে। আজ নীলা আমাদের মাঝে থাকতো শুধুই তোমার জন্য আজ আমি নীলাকে হারিয়ে ফেলছি।

নিলয়ের মা নিলয়ের মুখে এসব শুনে কান্না করে দিচ্ছে। আর বলছে — হুম বাবা তুই ঠিকি বলছিস আমার জন্যই আজ মেয়েটা সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস বাবা।

কিছুক্ষণ পরে নীলার লাশ আর বাচ্চা নিয়ে সবার সামনে আসল। নীলার লাশের পাশে রাখা হয়েছে নীলা বাচ্চা। বাচ্চাটা খুব কান্না করছে। বাচ্চাটার ভাগ্য এতোই খারাপ যে জন্মের পর মায়ের দুধ ও তার কপালে জুটেনি। বাচ্চাটা কান্না করেই যাচ্ছে। নীলার মা দৌড়ে এসে নীলার লাশের সামনে দাড়ালো। নীলার লাশ সাদা কাপড় দিয়ে ডেকে রাখা হয়েছে। এবার নীলার মা নীলার মুখের ওপর থেকে সাদা কাপড় টা সরিয়ে নীলাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। সবার চোখ থেকে পানি বের হচ্ছে।

একটু পরে ডাক্তার এসে বলল — আপনাদের জন্য একটা চিঠি দিয়ে গেছে উনি।

তারপর ডাক্তার চিঠিটা নিলয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। নিলয় চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করে দিল।

চিঠি
__________

আসসালামু আলাইকুম।
আমি জানি তোমরা যখন এই চিঠিটা পাবে তখন হয়তো আমি আর থাকব না। তোমাদের ছেড়ে চলে যাবো না ফেরার দেশে। তবে তোমরা কষ্ট পেয়েও না আমি ভালোই থাকব। আমার জন্য কারোর কান্না করতে হবেনা।

আব্বা, মনে আছে তোমার আমি তোমাকে আমার বিয়ের সময় কি বলছিলাম? হয়তো মনে আছে। বলছিলাম আমাকে এই বিয়ে দিয়না আমি মরে যামু। দেখো ঠিক তাই হয়েছে। আব্বা তুমি এখন কান্না করছ কেন? একদম কান্না করবেনা। আমার মাথায় একটু হাত ভুলিয়ে দিয়। আর একটা কথা। আমার ছোট ভাইবোন দের দেখে রাইখ। আম্মার খেয়াল রাইখেন।

আম্মা, মনে আছে যখন আমি খুব ছোট ছিলাম, খিদে লাগলেই কান্না করতাম। আর তুমি আমার কান্না থামাতে অনেক কিছুই করতে। আমার বিয়ের দিন আমি তোমার দিকে তাকিয়ে অনেক কান্না করছি কিন্তু তুমি তখন আমার কান্না থামাতে আসলেনা। জানো আম্মা তখন আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। ভালো থেকো তুমি আম্মা।

মা, আপনাকে আমি নিজের মায়ের মতো সম্মান করতাম। নিজের মা মনে করতাম। কখনও শ্বাশুড়ি মনে করি নাই। আমার সব কিছুই আমু মুখ বুঝে সহ্য করতাম। জানেন মা আজ না আমার খুব ভালো লাগছে আজ থেকে আমাকে আর কষ্ট পেতে হবেনা। চলে যাচ্ছি সবার থেকে অনেক দূরে। মা আপনার জন্য আমার সন্তানকে রেখে যাচ্ছি। আমার মতো করে আমার সন্তানকে অবহেলা করবেন না ওকে দেখে রাখবেন। ভালো থাকবেন মা।

এবার নীলা তার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে লিখল– আপনাকে আমি খুব ভালোবেসে ফেলছি লাম। আপনার দেওয়া কষ্ট গুলো আমার কাছে কখনও কষ্ট মনে হয়নি। আমার একটাই আফসোস আপনার বুকে মাথা রেখে আমি কখনও ঘুমাতে পারিনি। আপনাকে কখনও বলা হয়নি ভালোবাসি আপনাকে খুব ভালোবাসি। বাচ্চা আপনার খুব পছন্দ তাইনা? বাচ্চাকে রেখে গেলাম। আমার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। ওকে কখনও কষ্ট পেতে দিয়েনা প্লিজ৷ ওকে কখনও অবহেলার শিকার বানাবেন না। অবহেলাটা সত্যি অনেক কষ্টের যে কষ্ট আমি প্রতিনিয়ত পেয়েছি। আপনি কি কান্না করছেন? জানি তো কান্না করবেন না কারণ আমি তো কেউ না। একটি বার কি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিবেন? প্লিজ একটি বার আপনার বুকে জড়িয়ে নিন আমাকে। কি হলো নিবেন না? ওকে নিতে হবে না। ভালো থাকবেন আপনিও।

ইতি
সবার আপদ নীলা।

নীলয় চিঠিটা পড়ে শেষ করে নীলাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না করতে থাকে। আর বলতে থাকে।

–নীলা এই ভাবে আমাকে একা করে দিয়ে চলে যেতে পারলে। তোমাকে ভালোবাসার জন্য আমাকে একটু সুযোগ দিলেনা। এতো অভিমান তোমার। একটি বার চোখ খুলো নীলা। একটি বার তোমাকে ভালোবাসার সুযোগ দাও। আর কখনও তোমাকে কষ্ট পেতে দেবনা নীলা। নিজের বুকে আগলে রাখব সব সময়। প্লিজ নীলা একটি বার কথা বলোনা প্লিজ প্লিজ।

যে চলে যায় না ফেরার দেশে, তাকে শতবার ডাকলে কি সে ফিরে আসে?নীলাতো চলে গেছে সবাইকে মুক্তি দিয়ে। সে আর কি করে চোখ খুলবে? সে তো চিরতরে নিজের চোখ বন্ধু করে নিয়েছে।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here