#বাসন্তীগন্ধা
|২৪|
লাবিবা ওয়াহিদ
“কবুল” শব্দটি কোনোরকম আওড়ে মূর্তির মতো বসে রইলো মেহের। মাথায় রোকসানার বিয়ের সেই পুরানো দোপাট্টা। এখন ঘড়ির কাটা সকাল সাতটার ঘরে। বাড়ির বেশিরভাগ মানুষ ঘুমে বিভোর। এমতাবস্থায় মেহের এবং সারিমের বিয়ে হলো। ইতিহাসে এই বিয়ের কাহিনী থাকা উচিত। কেউ বিয়ে করে মাঝরাতে আবার কেউ বিয়ে করে ভোর সাতটায়। অদ্ভুত হলেও সত্য, মেহের এখন সারিমের বিবাহিতা স্ত্রী। এই ভোরেই তাদের বিয়ে হয়েছে। জোরপূর্বক। জোর করেছে স্বয়ং আইঁয়ুব সাহেব। যা এতদিন রোকসানা নিজে চেয়েছিলেন। মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে তার। এজন্যই বলে গুরুজনকে মান্য করতে হয়। কেন যে এতদিন নাটক করলো কে জানে? ভাগ্যের লিখন কী কেউ বদলাতে পারে?
সারিম হতভম্ভ হয়ে বসে আছে। নেশা ভাব তখনই কেটে গেছে যখন বাবার মুখে শুনেছিলো
“এখন এই মুহূর্তে-ই সারিম এবং মেহেরের বিয়ে হবে।”
সারিম বুঝলো না, ব্যাপারটা আসলে কী? হুট করে তার বাবা এরকম একটা সিদ্ধান্ত কেন নিলো? নেশার ঘোরে কী এখনোও আছে? না থাকলে এই বিষয়গুলো মাথায় নাড়া দিচ্ছে না কেন? অদ্ভুত তো!
মেহের এবং সারিমকে একই ঘরে দেখার পরপর আইঁয়ুব সাহেব একপ্রকার ধরে-বেঁধে মেহেরের বাবাকে বললো কাজি ডাকতে। এখন মানে এখনই। মেহেরের বাবা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সেরকম কোনো কাজ হয়নি। উলটো ধমক খেতে হয়েছে। পরে আর কী, গেলো কাজিকে ডাকতে। ছেলে-মেয়ের সিদ্ধান্ত জানারও চেষ্টা করেনি। জানতে চাইবে কেন? যা চোখে দেখেছে তাই-ই তো যথেষ্ট। এখন সম্মান বাঁচাতে এই পথ-ই অবলম্বন করতে হবে। ছোটো ছেলে তো আর মুখ-ই রাখলো না।
মেহের অসহায় নজরে তার মায়ের দিকে তাকালো। জ্যুতি ফোলা চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেহেরের বাবা একপ্রকার জোর করে তাকে ঘুম থেকে তুলেছে। মেয়ের বিয়ে শুনে জ্যুতিও কিছুটা অপ্রস্তুত।
রোকসানা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে মেহেরের পাশে গিয়ে বসলো। খুব সুন্দর কারুকাজ করা এক জোড়া বালা মেহেরের হাতে পরিয়ে দিয়ে বললো,
–“এগুলো সারিমের মায়ের। আজ তোর হাতে পরিয়ে দিয়ে সারিমের মায়ের দায়িত্ব পালন করলাম পাখি। সদা ভালো থাক, এই দোয়াই করছি!”
মেহের ছলছল নয়নে রোকসানার দিকে তাকালো। কম্পিত গলায় বললো,
–“এসব কেন হলো দাদী?”
রোকসানা হেসে বললো,
–“সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয় রে বোকা। এখন একটু হাস তো দেখি। আজ মোটেও কাঁদবি না।”
বিয়ে হতেই সকল ছেলেরা হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। সারিম কিছুক্ষণ বসে থেকে সেও বেরিয়ে যায়। অদ্ভুত লাগছে সব। বড়োই অদ্ভুত। সারিম চলে যাওয়ার পরপরই মেহেরের পাশে এসে বসেছে রোকসানা। মেহের বললো,
–“তাও দাদী, এভাবে…”
–“চুপ কর। সবটা আমি বুঝে নিবো। তুই শুধু আমার নাতীকে আগলে রাখিস। যদিও পুচকে হয়ে বুড়োটাকে সামলাতে একটু কষ্ট হবে। তবে দেখবি, ভালোবাসা থাকলে হঠাৎ-ই কেমন বড়ো হয়ে যাবি। সব দায়িত্ব নিজে বুঝে ফেলবি। বিয়ের পবিত্র বন্ধন তো এরকমই। অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলে।”
–“সারিম ভাইয়া যদি আমাকে খারাপ ভাবে?”
–“দিবো এক চড়! ভাই কিসের? থাপড়ে গাল লাল করে দিবো। এখন সারিম তোর বর। শরীয়ত মোতাবেক স্বামীকে “ভাইয়া” বলা কী-রকম গুনাহের কাজ জানিস?”
রোকসানার কথা শুনে মেহের নিজেকে সামলে নিলো। অতঃপর শুকনো ঢোঁক গিলে বললো,
–“ঠিকাছে বলবো না।”
–“লক্ষী মেয়ে। এখন যা দেখি, হাত-মুখ ধুঁয়ে নে। আমি বেদ্দপ গুলাকে উঠাই। বাড়ীতে কত বড়ো ঝড় গেলো অথচ এগুলার একটারও কোনো খবর নাই!”
মেহেরের হাসি পেলেও হাসলো না। এখনো গভীর শকে আছে কী না। সে আলতো করে হাতের বালা গুলো খুলে রোকসানার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
–“এগুলা বড়ো মার হয়ে থাকুক দাদী। নিজের কাছে রাখতে চাই না। যদি হারিয়ে যায়?”
রোকসানা বুঝলো মেহেরের অবস্থা। তাই হাতে নিয়ে বললো,
–“আচ্ছা, ঠিকাছে। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আমার কাছেই আমানত হিসেবে থাকুক। বড়ো বউয়ের টা বড়ো বউকে বুঝিয়ে দিয়েছি।”
মেহের হঠাৎ রোকসানাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী স্বরে বললো,
–“খুব ভালোবাসি তোমাকে দাদী। তুমি ছাড়া আমায় কেউ বুঝে না। তুমি আমার সাহস জুগাও এবং ভীতি দূর করে দাও। তুমি আমার খুব খুব প্রিয়।”
রোকসানা হাসলো। মেহেরের মাথায় সুন্দর করে হাত বুলিয়ে বললো,
–“আমার এই বিয়ের দোপাট্টা দ্বিতীয়বার স্বার্থক হলো রে মেরু।”
—————–
রোকসানা আড়ালে ডাকলো সেই তিন আত্নীয়কে। যারা বিয়ের সাক্ষী হিসেবে ছিলো এবং সারিম মেহেরকে যারা একসাথে একরুমে দেখেছে। রোকসানা ছেলে সম আত্নীয়দের দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে এক গাল হাসলো। সেই চাচা তিনজনও হাসলো। হেসে একজন বললো,
–“অবশেষে আপনার মনের আশা পূরণ হলো জেঠী।”
–“সে আর বলতে? ভাগ্যিস ফজরের পরপর তসবিহ পাঠ করতে করতে ওদের ঘরের সামনে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সারিম বিছানায় ঘুমোচ্ছে আর মেহের চেয়ারে বসে ঘুমোচ্ছে। তখনই বুদ্ধি আঁটলো মাথায়। তারপর তোমাদের তিন জনকে নিয়ে এসে দেখালাম। নয়তো তোমরা আমার নাতী-নাতনিকে বাজে ভাবতে পারো!”
দ্বিতীয় জন হেসে বললো,
–“আরে নাহ জেঠী। বাজে কেন ভাবতে যাবো? তবে আপনার বুদ্ধি চমৎকার ছিলো। কিন্তু কথা হচ্ছে আপনি ওদের দরজা লক কী করে করলেন?”
রোকসানা আড়াল থেকে একটা চাবি বের করলো। এই চাবিটা ডুপ্লিকেট। প্রায় সব ঘরের চাবি-ই রোকসানার কাছে ডুপ্লিকেট আছে। সেটা দেখে তিন ভাই-ই হেসে দিলো।
বাড়িতে পীনপতন নীরবতা পালন হচ্ছে। প্রগাঢ় নীরবতা। সবাই নীরবে নাস্তা করতে ব্যস্ত। বাড়িতে এতগুলা মানুষ। সবাই হঠাৎ বিয়ের কারণে স্তব্ধ, বিমূঢ়। কেউ যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। তার চেয়েও বড়ো সমস্যা হলো, একটা বিয়ে হলো, আর সবাই কী না ঘুমিয়ে ছিলো? কেউ টেরও পেলো না? এই ব্যাপারটা কারোই হজম হচ্ছে না।
বড়োরা খেয়ে উঠেছে আগেই। সকলেই জিজ্ঞেস করলো কী এমন জরুরি পরলো যে হুট করে বিয়েটা দিয়ে দিলো? বাড়িতে এতগুলা মানুষ থাকা সত্ত্বেও কেউ কেন খবর পেলো না? এত তাড়াহুড়োর কী ছিলো? রোকসানা তখন সবার উদ্দেশ্যে বলেছিলো,
–“আমার জেদে বিয়ে হয়েছে। তোমরা ঘুমে কাতর ছিলে। তোমরা ওঠোনি তাই তোমরা ব্যর্থ। বিয়ে দেখতে পারোনি!”
মাহিম বেচারার মুখটা দেখার মতো। সে অসহায় ভান ধরে বললো,
–“আমার থেকে দেড় মিনিটের ছোটো মেয়েটাও আমার আগে বিয়ে করে ফেললো। এখন আমার এই মুখ লুকাবো কই? মানুষ আমাকে বিয়ের দিক দিয়ে আর বড়োই ভাববে না!”
মাহিমের এরূপ কথায় সকলে হেসে দিলো। শুধু হাসি নেই সারিম এবং মেহেরের মুখে। দুর্ভাগ্যবশত মেহের মাহিমের মুখোমুখি বসেছে। মাহিম এ-কথা বলতেই সজোরে পায়ে লাথ খেলো। যার ফলে মাহিম চাপা আর্তনাদ করে উঠলো। “উ” করে উঠে সারিমের উদ্দেশ্যে বললো,
–“তোমার এই নয়া বউটারে সামলাও সারিম ভাইয়া। মেয়েটা এখনো শোধরায়নি, কত বড়ো বেয়াদব দেড় মিনিটের বড়ো ভাইকে লাথ দেয়। বিচার চাই সারিম ভাই!”
সারিম কড়া নজরে চাইলো মাহিমের দিকে। এই সময়ে এই ধরণের কথা-বার্তা কানে বিষের মতো লাগছে যেন। মেহেরেরও তাই অবস্থা। মাহিমের দিকে গরম চোখে চেয়ে মিনমিন করে বকতে লাগলো। আশিফের সাথের জন টিপ্পনী কেটে বললো,
–“মাহিম। বরের কাছে বিচার দিয়ে লাভ নেই। নিজের বিচার নিজে কর। নয়তো সবাই বলবে তোর মধ্যে সৎ সাহস নেই। এজন্য বিলাইয়ের মতো আরেকজনের কাছে গিয়ে মিউমিউ করছিস!”
এ-কথা শুনে মাহিমের নিজেকে বড্ড অসহায় অনুভব হলো। এটা কী ঠিক হলো?
মেহের করিডোর দিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছিলো ওমনি পেছন থেকে সারিমের গলা শুনতে পেলো। সারিম মেহেরকে ডাকছে।
–“মেরু!”
পুরুষালি শীতল কন্ঠস্বর শুনে মেহেরের সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে গেলো। পা জোড়া না চাইতেও থেমে গেলো। মেহের পিছে ফেরারও সাহস পেলো না। সব কেমন যেন লাগছে। মিশ্র অনুভূতি। ভালো লাগা, লজ্জায় নিমজ্জিত হওয়া, কিছুটা জড়তা ইত্যাদি। ভয়টা তো আছেই। এখনো স্বপ্ন লাগছে যে সারিম মেহেরের বর!
সারিম এগিয়ে আসলো মেহেরের দিকে। সারিমের পায়ের শব্দ যত নিকটে পাচ্ছে তত মেহেরের বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ বাড়ছে। মেহের হাত দুটো মুঠিবদ্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালালো।
সারিম মেহেরের সামনে দাঁড়িয়ে মেহেরের মুখশ্রীতে চোখ বুলালো। অতঃপর কপালে কয়েক ভাঁজ ফেলে খুবই নরম গলায় বললো,
–“গতকাল রাতে কী আমার দ্বারা কোনো ভুল হয়েছে মেরু?”
মেহের হতভম্ভ, বিমূঢ় সারিমের এরূপ কথা শুনে। কী বলছে সারিম? মেহের আমতা আমতা করে বললো,
–“মা..মানে?”
সারিম আগের মতোই অনুশোচনা নিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
–“তোর রুমে এসে শুয়েছি। এরপর আর সেন্স ছিলো না। কী হয়েছে তাও মনে করতে পারছি না। এজন্য জিজ্ঞেস করছি, আমায় দ্বারা কোনো ভুল হয়েছিলো? না মানে, সকাল সকাল বিয়ে..!”
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
বিঃদ্রঃ গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকবো। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।