বাসন্তীগন্ধা পর্ব -২৩

#বাসন্তীগন্ধা
|২৩|
লাবিবা ওয়াহিদ

মেহের নিজের রুমে এসে চমকে গেলো। তার-ই বিছানায় সারিম হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। কখনো নাক না টানা সারিম আজ নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। মেঝেতে জুতো, মোজা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গায়ের কোটটাও মেঝের এক কোণে এলোমেলো করে পরে আছে। বলা বাহুল্য, খুব খারাপ অবস্থা। অন্য সময় হলে সারিমের প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হতো। কারণ, মেহের তার যাবতীয় ব্যবহৃত জিনিসপত্র অন্য কারো ব্যবহার করা একদমই পছন্দ করে না। সেখানে এই বদস্বভাব স্বয়ং সারিমের। তবে আজ মেহেরের মধ্যে কোনো বিরক্তি কাজ করছে না। বরং সারিমকে তার বিছানায় দেখে কোনো রকম অভিযোগ করলো না, চোখ-মুখও কুচকালো না। তবে দুশ্চিন্তায় কপালে কতশত ভাঁজ পরেছে।

বিয়ে বাড়ি, মেহমানভর্তি মানুষ৷ যতোই কাজিন হোক না কেন এক রুমে থাকাটা বড্ড দৃষ্টিকটু। তাই মেহের চিন্তিত হয়ে আর রুমে প্রবেশ করলো না। প্রথমে সারিমের রুমে চলে গেলো। দরজা খুলতে গিয়ে দেখলো দরজা লক। ভ্রু কুচকে গেলো মেহেরের। সারিমের রুমে কে বা কারা দখল করলো? ভেতর থেকে শব্দ হলে হয়তো ধারণা করতে পারতো। সারিমের রুম ছেড়ে মাহিমের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। মাহিমের রুমে এসে দেখলো মাহিম বাদে বয়স্ক দুজন দূর সম্পর্কের ফুপা-ফুপি ঘুমিয়ে। এমন অবস্থা থেকে মেহের চটপট দরজা লাগিয়ে দিলো৷ মাহিমের রুমের এ অবস্থা হলে মাহিম কোথায় শুলো?

মেহের উপর থেকে নিচে তাকালে দেখলো বেশকিছু কাজিনের সাথে ঢালা বিছানা করে মাহিম বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সাইয়ান তার রুমে। রোজার সাথে। মেহের সবকিছু দেখে বড্ড অসহায় বোধ করলো। পরে হঠাৎ মনে পরলো সামিরার কথা। মেহের যেন আশার আলো খুঁজে পেলো। দ্রুত ছুটলো সামিরার রুমে গেলো। কিন্তু হায় কপাল। কথায় আছে, অভাগী যেদিকেই যায় সেদিকেই পানি ফুরায়।”

মেহেরের সাথেও তাই হলো। মুখটা দেখার মতো হলো। এখন কী করবে? ওদিকে মেহেরের অগোচরে আশিফ এবং সামিরা মিলে প্রেম করতে ব্যস্ত। সারিমের রুমটা আশিফ-ই নিয়েছে। আশিফের দুজন বন্ধু বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। আর আশিফ সারিমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হবু বউয়ের সাথে প্রেমালাপে ব্যস্ত। সামিরা এবং সারিমের বারান্দা পাশাপাশি হওয়ায় আশিফ এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে। সারাদিন কাজের ব্যস্ততায় সামিরার সাথে মন ভরে কথা হয়নি। কথা তো দূর, সারাদিনে দুই, একবার চোখের দেখা দেখেছে।

সামিরার বেলাতেও তাই। থাই গ্লাস টেনে দেওয়ায় ভেতরের কোনো শব্দ বাইরে আসছে না। এদিকে মেহের নিরাশ হয়ে রুমে চলে এলো। রুমে এসে দেখলো সারিমের নাক ডাকা থেমেছে। আগের জায়গায় কোনো নড়াচড়া ছাড়া ঘুমোচ্ছে। মেহের সারিমের কাছে এগিয়ে গেলো। যদি কোনো ভাবে নিচে পাঠিয়ে দেওয়া যায় তাহলেই হবে। তাই সারিমের কাছাকাছি গিয়ে আলতো হাতে সারিমকে ডাকলো। কিন্তু সারিমের কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। মেহের আবার ডাকলো। পরপর কয়েকবার। সারিম নড়াচড়া করে অন্যদিকে ফিরে ঘুমিয়ে যায়। মেহের হতাশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে চলে গেলো। সিঙ্গেল সোফায় কিছুক্ষণ বসে রইলো। সবাই ঘুমোচ্ছে আর মেহের ঢুলুঢুলু অবস্থায় সকলের ঘুমের দিকে তাকাচ্ছে। তার দৃষ্টি করুণ। এখানে সব ছেলেরা৷ নয়তো মেহের কোনো এক জায়গায় নিজের জায়গা ঠিকই করে নিতো৷ মেহের আবার উপরে চলে গেলো।

রুমে কতক্ষণ পায়চারি করলো। আবার ডাকলো সারিমকে। সারিম ঘুমের মাঝেই চোখ-মুখ কুচকে বিরক্ত হয়ে আওড়ালো,
–“জ্বালাস না তো মেহের। ঘুমোতে দে। আ’ম টায়ার্ড!”

মেহের নরম হয়ে সারিমের দিকে চাইলো। সারাদিন দৌড়া-দৌড়ি করেছে। তার উপর কিসব ছাই-পাশ গিলেছে। মেহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সারিমকে কঠিন ভাবে নিষেধ করবে যেন এসব না গিলে। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর।

এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে মেহের চেয়ারে গিয়ে বসলো। সারিমের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে পুরো মুখশ্রী। তখনই মেহেরের মাথায় এলো ইলিরার কথা। ইলিরার বিয়ে হলো গত এক সপ্তাহ আগে। ইলিরা সারিমকে দাওয়াত দিয়েছিলো। কিন্তু মেহেরের মনে অসম্ভব কু ডাকছিলো। ইলিরার বিয়ের দিন মেহের সারিমের বাহুর শার্টের অংশ খামচে বড়োই ব্যাকুল কন্ঠে বলেছিলো,

–“প্লিজ ইলিরা আপুর বিয়েতে যাবেন না!”

মেহেরের কাকুতি যেন সারিম কোনো কারণ ছাড়াই মেনে নিলো। সত্যি সত্যি-ই ইলিরার বিয়েতে যায়নি। ইলিরাকে কল করে মিথ্যা বলে যে সারিমের হঠাৎ-ই কিছু কাজে চট্টগ্রাম যেতে হয়েছে। মেহের সেদিন অত্যন্ত খুশি হয়েছিলো। যার ফলে মেহের খুশি-মনে সারিমের জন্যে কিছু রান্না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্যে সেদিন প্রথমবারের মতো রান্নাঘরে প্রবেশ করে মেহের। প্রথমদিনেই কাজের নামে নিজের হাত পুরিয়ে বসলো। পাশের চুলোতেই জ্যুতি মাছ ভাঁজতে দিয়েছিলো। জ্যুতি বারবার করে বলেছিলো চুলোর থেকে দূরে সরে আসতে, গরম তেল ছিটে আসতে পারে। কিন্তু মেহের সেই কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ভীষণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিলো,
–“কিচ্ছু হবে না।”

কিন্তু পরমুহূর্তেই ঘটলো অঘটন। তেল ছিটে আসলো মেহেরের হাতে। যার ফলে কালচে দুটো ছোটো ছোটো দাগ হয়ে গেছে। সঙ্গে অসম্ভব জ্বালা। মেহের সেটা মাকে বুঝতে না দিয়ে চোখ-মুখ শক্ত করে কুচকালো। বড়োদের কথা না শুনলে যা হয় আর কী। অতঃপর মেহের পুরো সময়টা নিজেকে সামলে মায়ের সাহায্যে পায়েশ রাঁধলো। নিজে আগে টেস্ট করলে বুঝলো লবণ বেশি দিয়ে ফেলেছে। প্রথম বারের এমন রান্নায় মেহেরের উত্তেজিত মন মুহূর্তে-ই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সারিমকে খুশি করতে গিয়ে এখন পায়েশ-ই খাওয়ার অযোগ্য। অখাদ্য তো আর সারিমের মুখের সামনে তুলে ধরতে পারে না? এজন্য না চাওয়া সত্ত্বেও সব পায়েশ ফেলে দিতে হয়েছে। ফুরফুরে মেজাজ বিষণ্ণ হয়ে গেলো।

দুপুরবেলায় খেতে গিয়ে সারিম কোনো ভাবে হাতের দাগ দেখে নেয়। অতঃপর মেহেরের এক গাদা বকা শুনতে হয়েছে সারিমের থেকে৷ সারিমের বকা খেয়ে মেহেরের সেদিন অর্ধেক পেট ভরে গিয়েছিলো।

————-
হঠাৎ কিছু শব্দে মেহেরের ঘুম ভেঙে গেলো। আরেকটুর জন্যে টেবিলে থোঁতা গিয়ে লাগেনি। এতক্ষণ গালে হাত ভর দিয়ে ছিলো। যার ফলে বাম হাতটা এখন ঝিমঝিম করছে। নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। মেহের আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলো ভোর হয়ে গিয়েছে। মেহের নিজেও মনে করতে পারলো না সে কখন ঘুমিয়ে পরেছে। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো সারিম ঘুমিয়ে আছে। কোমড়ে অসহনীয় ব্যথা। সারা রাত এক ভাবে থাকার ফল। আবারও দরজায় কড়াঘাত করলো কেউ। বিকট শব্দে সারিমের ঘুমটাও ভেঙে যায়। যার কারণে সে উঠে বসলো। উঠে বসলেও চোখ তখনো বন্ধ। যেন ঘুম তখনো কাটেনি। চুলগুলোও ঠিক নেই, ভীষণ উষ্কখুষ্ক।

মেহের সময় নষ্ট না করে দরজার কাছে গেলেই চমকালো। ব্যাপার কী, দরজা তো লক। মেহেরের স্পষ্ট মনে আছে মেহের দরজা ভিঁজিয়েই চেয়ারে গিয়ে বসেছিলো। চোখ লেগে যাওয়ায় দরজা লাগাতে ভুলে গিয়েছিলো। মেহের আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই মেহেরের চোখ কপালে। তার সামনে রোকসানা, মেহেরের বাবা এবং আইঁয়ুব সাহেব। সঙ্গে আরও তিন জন আত্নীয়। মেহের বড়োদের দেখে তার কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। ভেতরে সারিম আছে। এখন কী করবে মেহের? বারংবার শুকনো ঢোঁক গিলছে। মনে মনে দরুদ পড়লো। উপরওয়ালার কাছে প্রাণপণে বললো যাতে এবারের মতো বাঁচিয়ে দেয়। মেহের তাদের ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে বললো,
–“কিছু লাগবে?”

রোকসানা মেহেরের কোনো কথা কানে না তুলে মেহেরকে সরিয়ে দিয়ে একপ্রকার জোর করেই ভেতরে প্রবেশ করলো। রোকসানার পিছু পিছু বাকিরাও প্রবেশ করলো। এই পরিস্থিতিতে মেহেরের হাঁটু-জোড়া থরথর করে কাঁপছে। বিপি লো হয়ে আসছে তার। সারিমকে মেহেরের ঘরে দেখে সকলের চোখ কপালে উঠে যায়। রোকসানা আইঁয়ুব সাহেবের দিকে তাকালো। আইঁয়ুব সাহেবের চেহারা দেখার মতো। সারিমকে এই অবস্থায় মেহেরের রুমে একদমই প্রত্যাশা করেনি। আইঁয়ুব সাহেবের ভাব-ভঙ্গি দেখে রোকসানা কৌশলে পৈশাচিক হাসি দিলো। এবার না মেনে যাবে কোথায় বড়ো বাপ?

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। ছোটো পর্বের জন্যে অত্যন্ত দুঃখিত। তবে ঝটকা কেমন হলো বা পরবর্তীতে কী হতে চলেছে তা নিয়ে সুন্দর মন্তব্য চাইছি❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here