#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#অষ্টম_পর্ব
কেবিনের চেয়ারে মুখোমুখি হয়ে বসে আছে ফাইয়াজ আর পত্রিকার সম্পাদক সহ বাকি দুই তিন জন রিপোর্টার। ফাইয়াজের গম্ভীর মুখ দেখে রিপোর্টার সহ সম্পাদক কবির সাহেব ও বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে।
– ” কালকের ম্যাগাজিনের আর্টিকেল কোন রিপোর্টার করেছে!!
আই সে হু দা হেল ডিড দিস?”
ফাইয়াজের হুংকারে রীতিমতো ভয়ে চুপসে গেল সামনে থাকা লোকজন।
– ” কি হলো চুপ করে আছেন কেন মিস্টার কবির সাহেব? আমার পারমিশন ব্যাতীত আপনাদের সাহস হলো কি করে এত বড় একটা নিউজ ছাপানোর!
ঘটনার সত্য মিথ্যা যাচাই না করে একটা উটকো ধারণার ভিত্তিতে আপনারা এই নিউজটা ছাপিয়ে দিলেন! হাউ ইরেসপন্সেবল!
আপনি নিশ্চয়ই ভালো করেই জানেন যে এই মিথ্যা নিউজ ছাপানোর জন্য আপনাকে আর আপনার এই রিপোর্টারদের আমি জেলের হাওয়া খাওয়াতে পারি।”
ফাইয়াজের গম্ভীর কন্ঠে এমন ভয়ঙ্কর কথা কর্ণপাত হতেই কবির সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
– ” প্লিজ স্যার এমনটা করবেন না! আমাদের নিউজ চ্যানেলের আর পত্রিকার এত বড় ক্ষতি করবেন না মুগ্ধ স্যার। আমার রিপোর্টারদের হয়ে আমি আপনার কাছে পার্সোনালি মাফ চাইছি! এমন ভুল আর সেকেন্ড বার কোনোদিনও হবে না। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করবেন না দয়া করে।”
কবির সাহেবের সাথে তাল মিলিয়ে বাকি রিপোর্টাররাও অনুনয়ের কন্ঠে ফাইয়াজকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো।
ফাইয়াজ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে কবির সাহেবকে যা বলল তাতে জাকির সাহেব সহ বাকি সব রিপোর্টাররাও বিস্মিত।
আহমেদ বাড়ির সবাই গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। সকালে নিউজপেপারে ফাইয়াজের ব্যাপারে লিখা আর্টিকেল দেখে জাফর সাহেব বেশ চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন।
– ” আহা পাপা তুমি এমন শুরু করেছো কেন বলোতো? সাংবাদিকরা তো কত ফেক নিউজ ও পত্রিকায় ছাপিয়ে দেয়। আর যদি এমন কিছু হতো তাহলে ভাইয়া অন্তত আমাকে তো জানাত, তাইনা?
তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো। নিশ্চয়ই কোনো একটা গরমিল আছে নিউজে।”
ফারিহার কথা শুনে মাথা তুলে তাকালেন জাফর সাহেব।
– ” মুগ্ধ কে ফোন করো। ওকে ইমিডিয়েটলি ঢাকা ব্যাক করতে বলো! আমার জরুরী কথা আছে ওর সাথে।”
কথাটুকু বলেই সোফা ছেড়ে উঠে উপরের দিকে গটগট করে হাঁটা শুরু করলেন জাফর সাহেব। আর সেদিকে তাকিয়ে ছোট একটা শ্বাস ফেলে ফোন হাতে তুললো ফারিহা।
সকাল থেকেই নিউজ পেপারে ছাপানো নিউজ কানে যেতেই থম মেরে বসে আছে সিরাত। রিয়ানের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ক্রমশ তাকে গ্রাস করছে। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে চুপ করে রুমের এককোণে ফ্লোরে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। চন্দ্রিকা গানের ক্লাস জয়েন আর নিশাত কলেজ ক্লাস জয়েন করায় আশ্রমের রুমে চুপচাপ বসে আছে সে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ কানে পৌঁছাতেই নড়েচড়ে উঠলো সিরাত।
খাটের হাতল ধরে হাতড়ে হাতড়ে দরজার কাছে গিয়ে নিচু কন্ঠে বলে উঠল,
– ” কে? কে ওপাশে?”
– ” আরে পূরবী দরজা খোল! আমি চন্দ্রিকা।”
চন্দ্রিকার কন্ঠস্বর শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দরজার কড়া খুলে দিল সিরাত।
বদ্ধ রুমে কোনো আলোর ছিটেফোঁটা না পেয়ে খটকা লাগে চন্দ্রিকার। সিরাতের মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে উঠে,
– ” কি ব্যাপার পূরবী? এভাবে রুম অন্ধকার করে বসে ছিলি কেন? আর এমন চুপচাপ হয়ে আছিস কি কারণে? কিছু হয়েছে?”
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়ই কাঁপা কাঁপা কন্ঠে চন্দ্রিকাকে উদ্দেশ্য করে সকালের ঘটে যাওয়া ঘটনা খুলে বলে সে। সবটা শুনে চন্দ্রিকাও হতভম্ব।
– ” আচ্ছা নিউজপেপার টা কোথায়?”
– ” নিশাত বোধহয় নিচে স্টোররুমে রেখে এসেছে।”
সিরাতের প্রশ্নোত্তর অবলম্বন করে নিচ তলার স্টোর রুম থেকে পেপার নিয়ে আসে চন্দ্রিকা। রুমে এসে আর্টিকেল সম্পূর্ণ পড়তেই কপালে চিন্তার সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে তার।
– ” কিন্তু এখানে তো তোর চেহারা স্পষ্ট না পূরবী। রিপোর্টারদের মতানুযায়ী তোর কোনো নাম কিংবা পরিচয় ই এখানে উল্লেখ করা হয় নি। তবুও এটা যাতে রিয়ানের কানে না পৌঁছে সেটাই প্রার্থনা।
এখন এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল পূরবী। তোর জন্য একটা ভালো খবর আছে।”
চন্দ্রিকার কথা সিরাতের ঠিক বোধগম্য হলো না। তাই কৌতুহলবশত পুনরায় আবারো জিজ্ঞেস করলো,
– ” কিসের খবর আপু?”
– ” তোর চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার কথা পূরবী!”
নিজের চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে আনার কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই মস্তিষ্কের অভ্যন্তর জুড়ে এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূতি হলো। উৎসুক হয়ে চন্দ্রিকার হাত মুঠোয় নিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– ” সত্যি? সত্যি বলছো তুমি পূরবী আপু? কি বলেছে? আমার দৃষ্টিশক্তি কি সত্যিই ফিরিয়ে আনা যাবে? আমি কি আবারও আগের মতো সবকিছু দেখতে পারবো?”
– ” হ্যাঁ আমি সত্যিই বলছি পূরবী। তোর চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। যদিও তোর চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার চান্সবিলিটি ২৫% থাকলেও একটু চেষ্টা করলেই তোর দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মনে আছে কিছুদিন আগে তোর মেডিক্যাল রিপোর্ট নিয়েছিলাম। আমার ফ্রেন্ড ডক্টর রূপ আবরারের সাথে আমি কথা বলেছি। ডক্টর রূপ তোর রিপোর্ট দেখেছে। তার সিনিয়র কিছু ডক্টরের সাথে কথা বলে জেনেছে তোর চোখের অপারেশন একটু ক্রিটিক্যাল হলেও খানিকটা চেষ্টা করলে তুই আবারো সবকিছু দেখতে পারবি!”
চন্দ্রিকার কথা শুনে খুশিতে চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে গালে এসে জমা হলো সিরাতের। চন্দ্রিকা কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সিরাত চুপচাপ নিজের বাহুদ্বয় দিয়ে চন্দ্রিকাকে জড়িয়ে ধরলো।
বিকেলের দিকে কলেজ থেকে ফিরে আসে নিশাত। ক্লান্ত শরীর নিয়ে গুটি গুটি পায়ে দোতলায় উঠে রুমের দরজা খুলতেই পেছন ফিরে তাকায় সিরাত।
– ” কে এসেছে? ”
– ” আমি আপু! তুই এখনো রুমে বসে আছিস?”
– ” হ্যাঁ এমনি মাথাটা একটু ধরেছিল তাই সকাল থেকে রুমেই ছিলাম।
তুই ফ্রেশ হয়ে নে।”
সিরাতের কথানুযায়ী কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে তোয়ালে নিয়ে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় নিশাত।
গোধূলির রক্তিম আভায় আকাশের প্রস্থচ্ছেদের বেশ খানিকটা অংশ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। সন্ধ্যে হতে আর অল্প সময় বাকি। পাখিদের নীড়ে ফেরার সাথে সাথে মানুষের কোলাহল ও অনেকটাই কমে এসেছে। ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফাইয়াজ। হাতে থাকা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সেটা রেলিংয়ের ওপর রেখে দিল সে।
– ” মেয়েটার সাথে দ্বিতীয় বার দেখা হওয়ার পর থেকেই মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে।
চাইলেও মেয়েটার প্রতি চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে সরাতে পারছি না। কিন্তু কেন? সিরাতের সাথে আমার কিসের সম্পর্ক? মেয়েটা তো আমাকে ঠিক মতো জানেও না। আমি ও তো ঠিক করে চিনি না সিরাতকে। তবুও এই অনুভূতি?
এই অনুভুতির অভিধান কোত্থেকে পাবো আমি?”
– ” ফাইয়াজ?”
পেছন থেকে ধ্রুবের কন্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকায় ফাইয়াজ। ধ্রুব এগিয়ে এসে ফাইয়াজের বাম পাশে এসে দাঁড়ায়।
– ” কি হয়েছে?”
– ” ফারিহার কল এসেছিল। আঙ্কেল জানিয়েছে রিয়াকে পিক আপ করে যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় ব্যাক করতে।”
ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা শুনে খানিকটা কপাল কুচকায় ফাইয়াজ।
– ” কিন্তু কেন? হঠাৎ এত দ্রুত ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কোনো কারণ? আর ফারিহা তো আমাকে জানিয়েছে রিয়ার ফ্লাইট ডিলে হয়ে আরো তিন দিন পিছিয়েছে। আর আমারো কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে।
আচ্ছা আমি বাবার সাথে কথা বলছি।”
বলেই পকেট থেকে ফোন বের করলো ফাইয়াজ।
রাতের বেলা খাটে হেলান দিয়ে বসে ফোনে স্ক্রলিং করছিল নিশাত। হঠাৎ একটা আর্টিকেলে চোখ আটকে যায় তার। পুরোটা আর্টিকেল পড়ে সামনের দিকে তাকিয়ে একপ্রকার চিল্লিয়ে উঠে সে।
ব্যালকনিতে গ্রিল ঘেঁষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল সিরাত। কিন্তু নিশাতের হঠাৎ এমন চিৎকার শুনে চমকে উঠলো সিরাত। তড়িঘড়ি করে রুমের ভেতর এসে বলল,
– ” কি ব্যাপার নিশাত? এভাবে চিল্লাচিল্লি করছিস কেন? কি হয়েছে?”
– ” আরে কি হয়নি তাই বলো। আর তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এখানে এসো। মুগ্ধ ভাইয়ার একটা আর্টিকেল লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে আর সেটাও তোমার আর মুগ্ধ ভাইয়াকে নিয়েই।”
পুনরায় নিজের সাথে ফাইয়াজকে জড়ানোর মতো কোনো বিষয় কর্ণপাত হতেই আরেক দফা বিস্মিত হলো সিরাত।…………
#চলবে 🍂