বাসর পর্ব ৭

#বাসর
#৭ম_পর্ব


সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না।সে বয়ে চলে তার আপন গতিতে। নীলার বিয়ের আজ দু মাস ষোল দিন পার হলো।আর তার বিধবা হওয়ার আজ দু মাস পনেরোতম দিন। এই সময়ের প্রত‍্যেকটা সেকেন্ড জানে‌ নীলার দীর্ঘশ্বাস কতটা ভারী!সে এখন শব্দ করে কাঁদতেও পারে না।সে কাঁদে নীরবে। চুপিচুপি। অন্ধকারে।যেন কেউ না দেখতে পায় তার এই আহাজারি।তার এই দুঃখ। কিন্তু একজন ঠিক দেখেন তার এই কষ্ট। তিনি জানেন তার দীর্ঘশ্বাসের ওজন।

বিকেল।দগদগে সূর্য তেজ হারিয়েছে অনেকখানি। নীলা রোজ দিনের মতো নাঈমের কবরের কাছে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাড়ি ফিরছিলো। এই সময় সে মধ‍্য বয়স্ক দুজন মেয়ে মানুষের গলায় থমকে দাঁড়ায়।ওরা কথা বলছে ঘরের বারান্দায় বসে। একজন নীলা দের ঘরের কাজের মেয়ে কুলসুম।আর অন‍্যজন‌ ও বাড়ির খালেদা দাই।
খালেদা দাই বলছে,’মাইনষে কইনা মার চায় মাসির দরদ বেশি । নাইলে কী আর নিজের বাপ মা থুইয়া মরা পতির মায়ের সেবার লাইগা পইরা থাহে কোন মানুষ।’
কুলসুম তখন খিলখিল করে হেসে উঠে বললো,’না গো বু। তুমি ঘটনা ধরতা পারো নাই।মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি না। স্বামীর চেয়ে দেওরের দরদ বেশি।’
বলে আবার হেসে উঠলো কুলসুম। খালেদা দাই কথাটা শুনে চোখ কপালে তুললো। তারপর অদ্ভুত কন্ঠে বললো,’হাছাইনি?’
‘কুলসু জীবনে মিছা কয় না বু।সে তার পষ্ট নয়নে দেইখা কথা কই।’
‘কুলসু কী দেখছত?সিলান কিছু দেখছত?’
‘বু তুমি অখন যাও তো।আইসা শুনবো পরে।’
‘অখনই যাইয়াম গা।খালি ক,সিলান কিছু দেখছত?’
‘তয় দেখছি না তো কী।রাইত নিশি হইলেও বুড়া শাউড়িরে ঘুম পাতাইয়া থুইয়া দেওরের শইল‍্যে তা দেয় আইসা মাগী।’
বলে অশ্লীল হাসিতে ভেঙে পড়ে কুলসুম। খালেদা দাই দ্রুত পায়ে কেটে পড়ে। নীলার তখন মনে হয় তার পায়ের নিচে কোন মাটি নেই বুঝি।সে কেমন অসহায়ের মতো আকাশের দিকে তাকায়। তারপর দেখে তার চোখ দুটি জলে জ্বলে উঠছে।সে এবার দ্রুত হেঁটে ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। ঘরের ভেতর ঢুকে দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দেয়। তারপর বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে গিয়ে ঢাউস বালিশের পেটে মুখ ডুবিয়ে কাঁদতে শুরু করে।আহা সেকি কান্না!তার নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে! খুব খুব অসহায়।
নীলা ভাবছে তার নিজের কথা। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধের কথা। এখানে থাকা কী তার ঠিক হচ্ছে না তবে! তাকে নিয়ে সমাজের সবাই সমালোনচনায় মেতে উঠেছে। এই জন্যই তো সেলিম ওইদিন বললো তাকে বাড়ি চলে যেতে!সে বাড়ি চলে যাবে। এখানে আর এক মুহূর্তও না।

নীলা চিঠি লিখলো।তার বাবার কাছে চিঠি লিখলো। সেই চিঠি লিখতে গিয়ে চোখের জলে ভিজে উঠলো অক্ষর।সে আবার সেই চিঠি ছিঁড়ে ফেলল। তারপর আবার লিখলো। আবার ছিঁড়লো। কেন এমন করছে সে? নীলা কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।সে এখন ভাবছে এতোদিন তো সে সহ‍্য করেছেই। এখন আর কটা দিন? এই তো চারমাস হয়ে এলো।সে কষ্ট করে থাকবে।থাকতেই হবে যে তাকে!

সালমা বেগম ঘরে ছিলেন না। তিনি ও বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ওখান থেকে এসে দেখেন নীলার চোখ মুখ লাল।ফুলে ফেঁপে আছে। তিনি দেখেই বুঝলেন নীলা কেঁদেছে। সালমা বেগম তার কাছে গেলেন। তারপর নীলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,’মন খারাপ মা?’
নীলা কথা বলতে পারলো না।তার কান্না এসে গেল।সে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,’আমার কষ্ট হয় আম্মা। আমার কষ্ট হয়!’
সালমা বেগম তাকে সান্ত্বনা দিলেন। বললেন,’আল্লাহ পাক সব সমাধান করবেন মা। আল্লাহ পাক সব সমাধান করবেন।’
কিন্তু নীলা জানে তার জীবনে কোন সমাধান নাই। কীভাবে সমাধান হবে?এক মাত্র মৃত‍্যুই তার সহজ সমাধান। মৃত্যুর আগে তো আর তার নাঈমের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়!

সে রাতে নীলা এক অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্ন দেখলো।সে দেখলো ওই দিনের স্বপ্নের ভিটেখানিই এখন একটা ফুলের বাগান। সেখানে কত জাতের যে ফুল ফুটে আছে।আর কত রঙের প্রজাপতি।পাখি।আর ভাঙা ঘরটা এখন নতুন।কী যে সুন্দর লাগছে দেখতে!
সে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের সামনে।তার পরনে লাল টুকটুকে একটা শাড়ি।সে অপেক্ষা করছে একজনের জন্য। এই একজনটা কে?
নীলা দেখল সামনের রাস্তা ধরে নীল পাঞ্জাবি পরে কেউ একজন এগিয়ে আসছে। নীলা ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো মানুষটা কে! কিন্তু সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। স্বপ্নেই তার কান্না পেয়ে গেল।ঘুম ভাঙলো তার কান্না নিয়ে। কিন্তু আজকের কান্না সে তার শাশুড়িকে দেখালো না।সে নাঈমের কাছে গিয়ে সবকিছু বলবে বলে বিছানা থেকে ধীরে স্হীরে উঠে টিপ টিপ পায়ে দরজা খুলে সে চলে গেল নাঈমের কবরের কাছে। কিন্তু ওখান থেকেও সে এলো প্রচন্ড কান্না নিয়ে। কারণ নাঈম তার সাথে আজ কোন কথা বলেনি।সে তার সাথে কী নিয়ে রাগ সে বুঝতে পারছে না!

ঘরে ফিরতেই নীলা দেখল সালমা বেগম জেগে উঠেছেন। তিনি তাকে দেখেই বললেন,’নাঈমের কাছে গেছিলা মা?’
নীলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,’জ্বি মা।’
তারপর সে গাঢ় কান্নায় ভেঙে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে সে বললো,’তিনি আমার সাথে কথা বলেন না আম্মা। আমার সাথে কথা বলেন না!’
সালমা বেগম নীলার দিকে তাকিয়ে তার কান্না দেখছেন। আর মনে মনে জপছেন,’পৃথিবীতে এমন পবিত্র মেয়ে আমি আর দেখিনি। পৃথিবীতে এমন পবিত্র মেয়ে আমি আর দেখিনি।’



#চলবে__
#অনন্য_শফিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here