বাসর পর্ব ৬

#বাসর
#৬ষ্ঠ_পর্ব

শেষ রাতে মায়ের ওমের মতো শাশুড়ির গায়ের ওমের ভেতর শুয়ে থেকে চোখ মুদে এলো নীলার।আর তখনই কান্ডটা ঘটলো।সে ঘুমে থেকেই দেখলো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারদিকে ঘনিয়ে আসছে ঘন অন্ধকার।
আর তখন ঘরে কেউ নেই। সালমা বেগম কোথায় যেন গিয়েছেন। শুধু ঘরে আছে সেলিম।তার চেহারা কেমন অগ্নিমূর্তির মতো ধারণ করেছে।তার ঠোঁটে কেমন শয়তানি হাসি ঝুঁলে আছে।আর তার কাঁধে একটা মস্ত কালো রঙা ব‍্যাগ।সে এগিয়ে আসছে কেমন অদ্ভুত ভাবে হেঁটে। তারপর নীলার কাছে এসেই তার একটা হাত টেনে ধরলো। নীলাকে সে এবার টেনে হেঁচড়ে ঘর থেকে বের করে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নীলা ভয়ে আঁতকে উঠলো।সে তার সমগ্র শক্তি এক করে গলায় এনে মিশিয়ে চিৎকার করে ডাকলো তার শাশুড়ি মাকে। কিন্তু শাশুড়ি মা তার ডাক শুনতে পেলেন না।
কী ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছে নীলা। এই বিপদ থেকে তার বাঁচার উপায় কী?কে এসে বাঁচাবে এখন তাকে?
নীলা চেষ্টা করছে ওর হাত থেকে ছুটে যেতে। একবার কুটুস করে একটা কামড়ও বসিয়েছে সেলিমের হাতে।এতে সেলিমের কিছুই হলো না।সে শুধু হাসলো। সেই হাসির কী বিকট এবং ভয়ংকর আওয়াজ।হাসির শব্দে নীলার মনে হলো এই বুঝি তার কান ফেটে যাচ্ছে।
সে ভয়ে ভয়ে বললো,’আমায় আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন এভাবে?’
সেলিম কোন জবাবই দিলো না। বরং সে তখন এমন ভাব করলো যেন নীলার কথাটা সে শুনতেই পায়নি। নীলার এখন খুব বাবার মুখটা মনে পড়ছে। ছোট বেলায় একবার বড় বিপদে পড়েছিল সে। তাদের বাড়ির সামনে যে পুকুর আছে সেই পুকুরের ঘাটে সন্ধ্যা বেলায় পা ধুতে গিয়ে ঘাটের শ‍্যাওলায় পা পিছলে ধুম করে সে পড়ে গেল পুকুরের জলে। তখন আবার সে সাঁতার জানে না। গভীর জলের দিকে গিয়ে সে শুধু তলিয়েই যেতে লাগলো। নিরুপায় নীলা তখন ভাবলো আর বুঝি সে বাঁচবে না। কিন্তু সে সেবার বেঁচে গেল। কীভাবে যেন তার বাবা টের পেয়ে এই সন্ধ্যা বেলাতেই লাপ দিয়ে পুকুরে নেমে গেলেন। তারপর খুঁজে বের করে টেনে তুললেন তাকে।
কিন্তু এবার! এবার কে বাঁচাবে তাকে?
এখন তো বাবা অনেক দূরে?

নীলাকে সেলিম নিয়ে এসেছে জঙ্গলের উঁচু মত একটা পরিত‍্যাক্ত ভিটেতে। সেই ভিটেতে নানান গাছ গাছড়া। কিছু কিছু গাছ এতো বড়ো আর লম্বা যেন মেঘ বেধ করে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে! তারপর নীলা দেখলো পাশেই একটা ভাঙাচোরা কাঠের ঘর। সেই ঘর মানুষ শূন্য।আর ঘরটা দেখতেও কেমন জানি বুক ধকধক করে উঠে। ভয়ে গা জমে যেতে চায়। নীলা মনে মনে আল্লাহর নাম নিলো।সে দোয়া ইউনুস জানে। এই দোয়া জপে মাছের পেট থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন নবী ইউনুস (আঃ)। এখন সে কী বাঁচতে পারবে না এই দোয়া জপে ?
কিন্তু না সেলিম আরো ভয়ংকর কিছু করতে যাচ্ছে।সে এবার নীলার শাড়িটা একটানে খুলে ফেললো। তারপর সেই শাড়ি দিয়েই নীলাকে মস্ত খুটিটার সাথে বেঁধে ফেললো। নীলা বললো,’আল্লাহর দোহাই আপনি আমারে জীবন ভিক্ষা দেন!’
কিন্তু সেলিম তার অনুনয় শুনলো না।সে তার ব‍্যাগ থেকে কেরোসিনের বোতলটা বের করে নীলার সারা শরীরে কেরোসিন ছিটিয়ে দিলো। তারপর পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে বললো,’খুনের বদল খুন।খুনের বদল খুন। মৃত্যুর জন্য তুই প্রস্তুত হয়ে যা ডাইনি।’
সেলিম জ্বলন্ত দিয়াশলাইয়ের কাঠিটা নিয়ে এগিয়ে আসছে নীলার দিকে। নীলা চোখ বন্ধ করে প্রকাণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠলো।
‘বাঁচাও, বাঁচাও!’
সালমা বেগম হঠাৎ আঁতকে উঠলেন নীলার চিৎকার শুনে। তিনি আধঘুমো চোখে তাকিয়ে দেখেন নীলা থরথর করে কাঁপছে আর তার সারা শরীর কোল কোল করে ঘামছে। সালমা বেগম তার পিঠে হাত রেখে বললেন,’কী হইছে মা কী হইছে? খারাপ স্বপন দেখছো গো মা?’
নীলার মুখ দিয়ে কোন রা বের হচ্ছে না। অনেক্ষণ চেষ্টা করার পর বড় কষ্ট করে সে বললো,’পানি। পানি খাবো।’
সত‍্যিই পানির তেষ্টায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সালমা বেগম তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে রান্নাঘরে গেলেন। ওখান থেকে গ্লাস ভর্তি পানি এনে দিলেন নীলার হাতে। নীলা সেই পানি ঢকঢক করে গিলে ফেলল মুহূর্তে।
তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,’সেলিম। সেলিম ভাই আমায় মেরে ফেলতে চায়!’
সালমা বেগম কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি নীলার ভয় মাখা নীল মুখটার দিকে ফ‍্যাল ফ‍্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।
নীলা তারপর সবকিছু খুলে বললো। সালমা বেগম হেসে বললেন,’সকাল বেলার স্বপন হইলো মিছা স্বপন।এই স্বপন দেইখা ডরানোর কিছু নাই মা।সকল মন্দ আল্লাহ পাক তড়াইয়া নিবো।আসল কথা কী মা, নাঈমের মরণের দিন সেলিমের আচরণে তোমার ভিতরে ডর ঢুইকা গেছে। এই জন্যই এমন স্বপন দেখছো।’
নীলা কথা বললো না।চুপ করে রইলো।
সালমা বেগম বললেন,’সেলিম এইরকম না মা।তার ভিতর রাগ গোস্বা বলতে কিছুই নাই। ঠান্ডা মানুষ। কিন্তুক ওইদিন তার ভাইয়ের মৃত্যু তারে অনেক কষ্ট দিছে। সেই কষ্ট সহ্য করতে না পাইরা সে তোমার লগে এমন করছে।’
নীলা বললো,’মা আমার এখানে ভয় করে। অনেক ভয় করে।’
সালমা বেগম হেসে বললেন,’কোন সমস্যা নাই। তোমার আব্বার কাছে খবর পাঠাইতাছি। তিনি আইসা তোমারে নিয়া যাইবেন। তারপর যখন ভয় কাটবো তখন আসবা।’
নীলা বললো ,’আচ্ছা।’

ফয়জুর রহমান এসেছেন নীলাদের বাড়িতে। মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন তিনি। কিন্তু সমস্যা হলো নীলা এখন বলছে সে যাবে না।সে রান্না ঘরে গিয়ে তার শাশুড়ির কাছে কেমন মনমরা হয়ে বসে রইল।
সালমা বেগম লক্ষ্য করে বললেন,’মনমরা কেন গো মা?’
নীলা প্রায় কেঁদে ফেললো।সে কেঁদে কেঁদেই বললো,’আমি যাবো না আম্মা। এখানেই থাকবো।’
সালমা বেগম হাসলেন। তারপর নীলার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,’কাইন্দোনা কইলাম। আমি জানতাম,মারে ছাইড়া মেয়ে কোনোদিন যাইতে পারবো না। কোনোদিন না।’

ফয়জুর রহমান তার মেয়েকে পাগলের মতো ভালোবাসেন। নীলা যখন বাবার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,’আব্বা,আমি চার মাস পরে যাবো এখান থেকে। এখন যাবো না।’
ফয়জুর রহমান খিলখিল করে হেসে উঠে বললেন,’ঠিক আছে মা।’
নীলা তখন খালিদের কথা জিজ্ঞেস করলো।সে বললো,’বাবা,খালিদ কেমন আছে?’
‘ভালো আছে।’
‘আমার কথা জিজ্ঞেস করে না?’
‘করে তো। প্রথম প্রথম কাঁদতো তোর লাইগা। এখন অবশ্য কাঁদে না। মাঝেমধ্যে মনে হইলে জিজ্ঞাস করে,’বুবু আসবো কখন।’
নীলার কেন জানি হঠাৎ কান্না পাচ্ছে।সে এবার জিজ্ঞেস করলো,’খালিদ কী একা একা ঘুমোতে পারে?’
‘তার মার সাথে ঘুমায়।’
নীলার এবার যা কান্না পেলো!সে সত‍্যিই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে ভাবলো মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণী। তাদের জীবন কারোর জন্য থেমে থাকে না। যেমন খালিদের থাকছে না তার জন্য কিংবা তার থাকছে না খালিদের জন্য।
ফয়জুর সাহেবের খারাপ লাগছে। খুব খারাপ লাগছে।তার কান্না আসছে বুক ভেঙে। কান্না আসছে তার মেয়েটির কষ্টের কথা মনে করে। আহারে! এমন লক্ষ্মী একটা মেয়ের জীবন কী করে এমন হয়ে গেল?অন‍্য কারোর মেয়ের তো এমন হলো না তার মেয়ের কেন এমন হলো? তিনি কী অত বড় পাপ করেছেন যে এর এতো বড় শাস্তিটা তার মেয়েকেই শুধু পেতে হলো?
———————————————————————

#চলবে_
#অনন্য_শফিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here