#বিকেলে_ভোরের_ফুল
#পর্ব_২০
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ফুলের মাথা পুরোই ঘুরে গেছে।এটা পারো??ওটা পারো??ইত্যাদী ইত্যাদী,এতো পুরোই ওর দাদীর ডুপ্লিকেড।মাথাটা বনবন করে ঘুরতেছে। মনে হচ্ছে এরা বউ নয় কাজের মেয়ে নিবে। ফুল কিছু বলতেও পারছে না। ভদ্রতার খাতিরে সব জবাব দিচ্ছে। অবশেষে ওনাদের সব প্রশ্ন শেষে ফুল নিজের রুমে আসার অনুমতি পেল।রুমে এসেই দম ফেলল ফুল। উফফ আজকাল মানুষ এত প্রশ্ন করে নাকি??
ফুল শাড়িটা খুলে ওয়্যারড্রপ থেকে ড্রেস বের করতে গেল। তখনই চোখ গেল নেভি ব্লু রঙের কুর্তির উপর।যেটা স্পর্শ ওর জন্য কিনে এনেছিল।এটা পরেই তো বাড়িতে এসেছিল ফুল। ড্রেসটা বের করে তাতে হাত বুলায়।চোখ থেকে পানি গাড়িয়ে ড্রেসটার উপর পড়লো। ফুল কুর্তিটা পরে নিল। আজকে অনেক বেশি স্পর্শের কথা মনে পড়ছে ফুলের। ফুল ড্রেসটা পরে নিল।ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার এর মধ্যে ব্লু রঙের চুড়ি ছিল সেগুলো পরে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে ফুল।জীবনটা ওর এরকম না হলেও পারত।শাড়িটা ভাজ করে রেখে দিলো।
রাত হয়ে গেছে ফুল বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়তেছে। এমন সময় রিনা বেগম খাবারের প্লেট নিয়ে ফুলের রুমে এলো। ফুল তার দিকে একজন তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু মনে মনে ফুল ভিশন অবাক হয়েছে। কারণ রিনা বেগম কখনোই ফুলের রুমে আসে না।শত প্রয়োজন থাকলেও না। কিন্তু কেন আসে না সেটা ফুলের অজানা। ইচ্ছে করে আসেনা নাকি দাদি আর বাবা আসতে দেয়না?? ফুল নিচের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতেছে।রিনা বেগমের পিছুপিছু জাইফ সাইফ এসে হাজির।রিনা বেগম ফুলের পাশে বসল। খাবারের প্লেটটা পাশের টেবিলে রেখে বলল,
–“জাইফ তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকো কেউ আসলে আমাকে ডেকে দেবে।”
জাইফ বলল,
–“কেউ আসবে না মা।দাদি বাবার ঘরে কথা বলতেছে। ওনাদের কথা শেষ হতে অনেক দেরি আছে।”
রিনা বেগম চোখ রাঙিয়ে বলল,
–“তোমাকে যেতে বলেছি।”
জাইফ মুখ গোমড়া করে দরজার বাইরে দাঁড়ায়। ফুল অবাক হয়ে রিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ওনার হলো কি??রিনা বেগম ফুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
–“আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো না।এটাই তো স্বাভাবিক তাই না?? আমি তোমার মায়ের জায়গায় দখল করেছি এতে তো তোমার রাগ হওয়ার কথা। আমি এখন পিছনের কথা বলতে চাই না।আমি বর্তমানের কথা বলতে এসেছি। তুমি আজ পর্যন্ত অনেক কষ্ট পেয়েছ। কিন্তু আমি চাই তুমি এরপর যেন সুখে থাকো।তাই বলছি তুমি আজকেই এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাও।”
ফুলের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।কি বলবে তা ভেবে পাচ্ছে না।রিনা বেগম বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–“ওনারা তোমার বিয়ে যে ছেলের সাথে ঠিক করেছে সে ছেলেটা একদম ভালো না। এর আগে তিনটা বিয়ে করেছে। তুমি বলো মা হয়ে কি করে মেয়েকে এতবড় নরকে ঠেলে দেই??
কালকেই তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।তাই আমি তোমাকে আজকেই পালিয়ে যেতে বলছি।”
ফুল বাকরুদ্ধ হয়ে রিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে।রিনা বেগম আঁচলের তলায় লুকানো হাতটা বের করে আনলো।হাতে তার টাকা। টাকাগুলো ফুলের হাতে দিয়ে বলল,
–“এখানে দশহাজার টাকা আছে।এটা নিয়ে তুমি ট্রেন স্টেশনে গিয়ে ঢাকা চলে যাবে তোমার স্পর্শের কাছে। আর ভয় পেয় না তোমাকে পালাতে আমি সাহায্য করব।”
সাইফ এগিয়ে এসে বলল,
–“আপু আমি আর জাইফ ও হেল্প করব।”
রিনা বেগম বলল,
–“এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে সবকিছু গুছিয়ে নাও।”
বলেই তিনি উঠে চলে যেতে নিলে ফুল বলল,
–“মা,,,,”
রিনা বেগম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছনে ঘোরার শক্তি নেই ওনার। ফুল দৌড়ে এসে রিনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।দুজনেই কাঁদছে। ফুল কান্না থামিয়ে বলল,
–“আমাকে ক্ষমা করে দিন মা। আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম।সব সৎ মা যে এক হয় না সেটা আমার জানা ছিল না। কিন্তু আপনি তা প্রমাণ করে দিলেন। আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
রিনা বেগম ফুলের কপালে চুমু খেয়ে চলে গেলেন। ফুল রিনা বেগমের কথামতো খেয়ে সবকিছু গুছিয়ে নিল।জাইফ আর সাইফ ওকে হেল্প করল। ফুল জাইফ সাইফকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল ওরাও কাঁদল।ওরা তিনজন অপেক্ষা করছে।রাত খুব বেশি না।নয়টা বাজে। তখনই বাইরে হট্টগোলের আওয়াজ ভেসে আসলো।সবাই আগুন আগুন বলে চিৎকার করতেছে। ফুল দৌড়ে সেদিকে যেতে নিলেই জাইফ ওর হাত ধরে বলল,
–“কোথায় যাচ্ছো??”
–“বাইরে আগুন লেগেছে জাইফ।”
–“তুমি এখন পালাও।”
–“কি বলছিস?? বাড়িতে আগুন লেগেছে আর আমি পালাবো??”
–“এটা প্ল্যান আপু।চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”
ফুল জাইফ সাইফের হাত ধরে গেটের সামনে আসে। গেইটে এখন কোন দারোয়ান নেই।সবাই এখন আগুন নেভাতে ব্যস্ত। ফুল বাইরে এসে ভাইদের বিদায় জানিয়ে চলে গেল।
প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে ফুল দাঁড়ালে চলবে না। অনেকক্ষণ দৌড়ে ভাবল এভাবে দৌড়ালে তো চলবে না। আর ট্রেন স্টেশন তো ও চেনে না।তাই একটা সিএনজি ডেকে তাতে করে রওনা দিলো।আধঘন্টার মধ্যে ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে গেল ফুল। কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে নিজের প্লাটফর্মে গিয়ে বসল।এক বোতল পানি কিনে এনেছে খুব পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু অনেক সময় পার হয়ে গেছে এখনও ট্রেন ছাড়ার নাম নেই। ফুল ভয়ে রিতিমত ঘামছে যদি ধরা পরে যায়। তাহলে তো আর রক্ষা নেই। ওড়না দিয়ে ভালো করে মুখটা ঢেকে বসে আছে। তখনই ওর ফোন বেজে উঠল।ফোন রিসিভ করে বলল,
–“হ্যালো।”
অপর পাশে থেকে জাইফ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–“আপু আমি জাইফ।”
–“জাইফ কি হয়েছে কাদছিস কেন??”
–“বাবা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সব জানতে পেরে গেছে যে মা আগুন লাগিয়েছে আর আমরা তোমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছি। মাকে বাবা খুব মেরেছে। আর তুমি পালাও ওখান থেকে। কারণ বাবা ফোন করে ট্রেন আটকে দিয়েছে।বাবা ওখানে যাওয়ার জন্য রওনা হয়ে গেছে।তাই আমি তোমাকে লুকিয়ে ফোন করেছি। তুমি পালাও আপু।”
এটুকু বলেই জাইফ ফোন কেটে দিল। ফুল আর এক মুহূর্তও ট্রেনে বসল না।এক দৌড়ে বেরিয়ে আসল।ভাগ্যিস জাইফকে ওর নাম্বারটা দিয়ে এসেছিল। কিন্তু ফুল এখন কোথায় যাবে?? কিছু ভেবে পাচ্ছে না। আর এখানে ও তো থাকা যাবে না যেকোন সময় ওর বাবা চলে আসতে পারে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুল ভয়ে কাপতেছে।একটা অটোওয়ালা ওর সামনে এসে দাড়িয়ে বলল,
–“আপা ট্রেন তো এখন ছাড়বে না। আপনি কি ঢাকায় যাবেন??”
–“হ্যা যাবো।”
–“তাইলে আসেন আপনারে বাস স্ট্যান্ডে দিয়ে আসি ওখান থেকে আপনি ঢাকায় যাইয়েন।”
ফুল যেন প্রান ফিরে পেল। তাড়াতাড়ি অটোতে করে বাস স্ট্যান্ডে যায়।অটোওয়ালার কাছ থেকে ঢাকার বাস কোনটা তা জেনে নেয়। তারপর টিকিট কেটে বাসে ওঠে।ভাগ্যিস ঠিক সময় এসেছে।দশ মিনিটের মধ্যে বাস ছেড়ে দিল। ফুল বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। অবশেষে এই নরক থেকে মুক্তি পেতে চলেছে। কিন্তু এরপর ও কি করবে?? কোথায় যাবে??স্পর্শর কাছে তো যাবে না। কারণ স্পর্শর বাবা স্পষ্ট না করে দিয়েছে।তাই ফুল ভাবল ও স্পর্শকে খুঁজবে না। কিন্তু তাহলে কোথায় যাবে ও?? সিলেটের তো কোন জায়গায় চেনে না আর সেখানে ঢাকা। ফুল গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে। এভাবে চিন্তা করতে করতে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
🍁🍁🍁
সকাল নয়টা বাজে। ফোনের শব্দে স্পর্শর ঘুম ভাঙল।ফোনটা কালকে কিনে এনেছে।স্কিনের দিকে তাকিয়ে দেখল আকাশের ফোন।উফফ এই ছেলেটা না?? কালকে সবে ফোন করে কথা বলেছে আর আজকে থেকেই সকালের ঘুম নষ্ট করা শুরু করে দিয়েছে। আকাশের অভ্যাসটা বরাবর এরকমই।স্পর্শ ফোন রিসিভ করল,
–“হ্যালো।”
–“কি রে এখনও পরে পরে ঘুমাচ্ছিস??”
–“কেন কি হয়েছে??”
–“কি হয়েছে মানে?? তোকে কাল বললাম না যে আমার এংগেজমেন্টের জন্য রিং কিনতে যাব ভুলে গেলি??”
–“না ভুলিনি।”
–“তাহলে দেরি করছিস কেন তাড়াতাড়ি চলে আয়।”
–“এখন সবেমাত্র নয়টা বাজে।”
–“আরে যেতে যেতে দশটা বাজিয়ে ফেলবি তুই। তাড়াতাড়ি আয়।”
আকাশ ফোন কেটে দিল।স্পর্শ উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ব্রেকফাস্ট করে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আকাশের বাড়ির সামনে এসে ওকে কল করল। কিছুক্ষণ বাদেই আকাশ এসে হাজির।স্পর্শ আকাশে পিঠে চাপড় মেরে বলল,
–“কি রে আমাকে আসতে বলে নিজেই লেট করলি কেন??এত সাজুগুজু করিস মেয়েদের মতো??”
–“চল তো দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আকাশ বাইকে বসে স্পর্শ বাইক স্টার্ট দেয়। দুজনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। হঠাৎ স্পর্শ বাইক থামিয়ে দিল।
–“কি হয়েছে থামলি কেন??”
–“সামনে এতো ভীড় কেনে?? আর এত ধোঁয়া কিসের??”
–“ঠিকই তো??”
আকাশ একটা লোককে জিজ্ঞেস করল,
–“ভাই এখানে কি হয়েছে??”
–“এই মাত্র দুটো বাস মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে।প্লিজ আপনারা সাহায্য করুন। এখনও অ্যাম্বুলেস এসে পৌঁছায়নি।”
স্পর্শ আর আকাশ তাড়াতাড়ি নেমে সেদিকে এগিয়ে যায়।বাস দুটোর খারাপ অবস্থা না জানি ভেতরের মানুষগুলোর কি অবস্থা হয়েছে?? মানুষ সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখতেছে। কিছু কিছু মানুষ বাসের মধ্যে থেকে যাত্রিদের বের করে আনতেছে।স্পর্শ আর আকাশ বাসের ভেতর ঢুকে মানুষ বের করতেছে।এর মধ্যে পুলিশ অ্যাম্বুলেন্স চলে এসেছে। অনেকেই মারা গিয়েছে।স্পর্শ একটা ছোট মেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে দিতেই আকাশ ওকে ডাকল,
–“স্পর্শ এদিকে আয়।এই সিটের নিচে একটা মেয়ে চাপা পরেছে। আমি সিটটা একা সরাতে পারছি না হেল্প কর।”
স্পর্শ সেদিকে দৌড়ে গেল। আকাশ আর স্পর্শ মিলে সিটটা টেনে সরালো।দেখলো একটা মেয়ে উল্টো হয়ে পরে আছে। রক্তে গা ভেসে গেছে।স্পর্শ মেয়েটাকে ঘোরাতেই শক খেল।মুখ দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়ে এলো,
–“ফুল।”
আকাশ হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
–“কি বলছিস??এটা ফুল??”
স্পর্শ আকাশের কথায় কান না দিয়ে ফুলকে টেনে নিজের কোলে বসালো। ফুল তখন চোখটা পিটপিট করছে। সামনে বসে থাকা মানুষটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফুলের কোন হিতাহিত জ্ঞান নেই। শুধু চোখটা খোলা রেখেছে।স্পর্শ ফুলের গালে হাত রেখে বলল,
–“ফুল তোর কিছু হবে না।দেখ আমি এসে গেছি।আমি স্পর্শ দেখ। ফুল তাকা।”
ফুল স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আছে।চোখটা বন্ধ হয়ে আসতেছে। ফুল সর্বশক্তি দিয়ে চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করতেছে।হাতটা একটু একটু করে নড়াচ্ছে। হাতটা স্পর্শের দিকে একটু এগিয়ে নিয়ে যেতেই স্পর্শ ফুলের রক্তমাখা হাতটা টেনে ওর গালে রাখল।
–“ফুল দেখ আমি এসে গেছি। ফুল তোর কিছু হবে না।”
আকাশ বলল,
–“এরকম করলে হবে না স্পর্শ। ফুল কে হসপিটালে নিতে হবে।”
স্পর্শ বলল,
–“হ্যা চল।”
স্পর্শ ফুলকে কোলে তুলে নিয়ে বাইরে এলো। তারপর অ্যাম্বুলেন্সে শুইয়ে দিল।অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলছে।স্পর্শ ফুলের একহাত ধরে বসে আছে। ফুলের তখন জ্ঞান নেই। আকাশ স্পর্শর কাঁধে হাত রাখল।স্পর্শ বলল,
–“আকাশ ফুল বাঁচবে তো?? ফুলের ভালো থাকার জন্যই তো ওর থেকে দূরে চলে এসেছি। কিন্তু ফুল তো ভালো নেই। ফুল বাঁচবে তো আকাশ বলনা??”
–“রিল্যাক্স স্পর্শ ফুলের কিছু হবে না।সব ঠিক হয়ে যাবে।”
স্পর্শ আকাশের কোন কথা শুনছে না। পাগলামি করতেছে।চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরছে স্পর্শর। ওর মনে হচ্ছে ফুল কে বোধ হয় বাঁচাতে পারবে না।কোন ঝড় মনে হয় ওর দিকে এগিয়ে আসতেছে।
চলবে,,,,,,,,,,,,