বিকেলে ভোরের ফুল পর্ব ২১

#বিকেলে_ভোরের_ফুল

#পর্ব_২১

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে স্পর্শ।ফুলকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।স্পর্শর পাশেই আকাশ দাঁড়িয়ে আছে।স্পর্শ বারবার শার্টের হাতায় ঘাম মুছতেছে। আকাশ বলল,

–“বেশি টেনশন করিস না।দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।চল এখানে বস।”

আকাশ টেনে স্পর্শকে বসিয়ে দিল। স্পর্শ বসে বসে ছটফট করতেছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে এখনও ডক্টর বের হচ্ছে না তাই স্পর্শ আরও ভয় পাচ্ছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর ডক্টর বেরিয়ে আসতেই স্পর্শ ছুটে গেল ডক্টরের কাছে ওর পিছুপিছু আকাশও গেল। স্পর্শ ডক্টরকে বলল,

–“হোয়াট হ্যাপেন্ড ডক্টর?? ফুল ঠিক আছে তো??ও সুস্থ হয়ে যাবে তো??”

–“প্লিজ কাম ডাউন। আমাকে বলতে দিন।”

আকাশ স্পর্শকে বলল,

–“স্পর্শ চুপ থাক।ডক্টরকে বলতে দে।”

স্পর্শ চুপ করে গেল।ডক্টর বলতে শুরু করল,

–“দেখুন বাস এক্সিডেন্টে অনেকেই মারা গেছে। আবার অনেকের অবস্থা খুব খারাপ।বাচতেও পারে আবার নাও পারে।তাদের মধ্যেই একজন হলো আপনাদের পেশেন্ট। খুব খারাপ অবস্থা ওনার। বাঁচার আশা ফোরটি পার্সেন্ট। আমরা চেষ্টা করছি আর করবোও। বাকি সবটা আল্লাহর হাতে। আর আপনারা পেশেন্টের সাথে একেবারেই দেখা করতে পারবেন না। সপ্তাহ খানেক আই.সি.ইউ তে থাকবে। প্লিজ আপনারা কেউ দেখা করতে পারবেন না।”

বলেই ডক্টর চলে গেল। আকাশ গিয়ে স্পর্শকে শক্ত করে ধরল। স্পর্শ আকাশ কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। ফুলের কাছে গিয়েও সেদিন আলাদা হয়ে গিয়েছিল। তবে এটাই কি লাস্ট দেখা ফুলের সাথে??

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁচের ভেতর দিয়ে ফুলকে দেখছে স্পর্শ। মুখে অক্সিজেন মাস্ক হাতে ক্যানেলা নিয়ে শুয়ে আছে ফুল।জ্ঞান নেই।স্পর্শ এক ধ্যানে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে আর চোখের পানি ফেলতেছে। তখনই একজন নার্স এসে স্পর্শকে একটা ব্যাগ দিয়ে বলল,

–“এক্সকিউজ মি,এটা পেশেন্টের কাছে ছিল।”

স্পর্শ ব্যাগটা হাতে নিলো এবং খুলল।ব্যাগে তেমন কিছুই নেই। এমনকি কোন জামাকাপড় ও আনেনি ফুল।রিনা বেগম বলেছিলেন জামাকাপড় নিতে কিন্তু ফুল আনেনি। স্পর্শ ব্যাগের ভেতর একটা ফটো ফ্রেম পেল।তাতে ফুলের ছোটবেলার ছবি। ফুল আর পাপড়ি হাসি মুখে ওর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আছে।ওর মাও হাসি মুখে তাকিয়ে আছে।স্পর্শ ছবিটাতে হাত বুলিয়ে আবার ব্যাগে হাত দিলো।ব্যাগের ভেতর ওর ওয়ালেট আর ফোন পেয়ে অবাক হয়ে যায়। তারমানে এগুলো ফুলের কাছে ছিল??স্পর্শের আরও কষ্ট হচ্ছে। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা ওর। আকাশ স্পর্শের বাড়িতে খবর দিলো। কিছুক্ষণ পরেই স্পর্শর বাবা আর ভাই হসপিটালে চলে আসলো।

স্পর্শের বাবা স্পর্শকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইল কিন্তু স্পর্শ কিছুতেই গেল না। শেষমেষ তিনি বাড়িতে চলে গেলেন।স্পন্দন রয়ে গেল।

__________________

কেটে গেল এক সপ্তাহ।

এই এক সপ্তাহ স্পর্শ দিনরাত এক করে ফেলেছে। হসপিটাল থেকে এক পাও নড়েনি। ওকে জোর করেও কোন লাভ হয়নি।
ডক্টর এসে খবর দিল ফুলের জ্ঞান ফিরেছে। ফুল এখন বিপদ মুক্ত।আই.সি.ইউ থেকে ফুলকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। এখন সবাই ফুলের সাথে দেখা করতে পারবে। একথা শুনে সবচাইতে বেশি খুশি হয়েছে স্পর্শ।তাই সবার আগে স্পর্শকে পাঠানো হলো ফুলের সাথে দেখা করতে।

স্পর্শ হালকা আওয়াজ করে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো। তারপর ফুলের কাছে গিয়ে বসল। ফুল তখন চোখ বন্ধ করে ছিল।চেয়ার টানার শব্দে চোখ খুলে তাকালো।স্পর্শকে দেখেই উঠে বসার চেষ্টা করল কিন্তু ব্যর্থ হয়।স্পর্শ ফুলকে ধরে উঠিয়ে পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে বসালো।স্পর্শ ফুলকে বলল,

–“আর ইউ ওকে নাউ??”

ফুল মাথা দুলিয়ে বলল,

–“হুম।”

–“কোন কষ্ট হচ্ছে না তো??”

–“না।”

–“কোন প্রব্লেম হলে আমাকে জানাবি??”

–“হুম।”

–“কি তখন থেকে হুম না করে যাচ্ছিস। আর কোন কথা নেই??”

–“তো আমি কি বলব??”

–“সব কথা বলবি তবুও হুম না বলবি না ওকে।”

–“হুম।”

বলেই ফুল স্পর্শের দিকে তাকিয়ে বলল,

–“না মানে ঠিক আছে।”

স্পর্শ ফুলের হাত ধরে বলল,

–“তুই জানিস না ফুল আমি কতটা টেনশনে ছিলাম।এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল যে আমি আবার তোকে হারিয়ে ফেললাম। নিজের সেন্স হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। তুই প্রমিস কর তুই আর কোথাও যাবি না।প্রমিস কর।”

ফুল অপলক দৃষ্টিতে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আছে।স্পর্শের ভালোবাসা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছে ফুল। ফুলের জবাব না পেয়ে স্পর্শ আবার বলল,

–“কি হলো প্রমিস কর।”

–“আর যদি মরে যাই।”

ফুলের কথা শুনে স্পর্শ রেগে যায়। বলে,

–“এক থাপ্পড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দেব যদি আরেকবার মরার কথা বলিস। আমার হাতের মার কি ভুলে গেছিস??”

ফুল স্মিত হেসে বলল,

–“ওসব কি ভোলা যায়??”

–“গুড। তুই আর এসব কথা মুখেই আনবি না।আর এখন থেকে তুই আমার কাছে থাকবি।দ্যাটস ইট।”

–“আর যদি ফুলের বাবা এসে ওকে নিয়ে যায়??”

স্পর্শ আর ফুল দু’জনেই দরজার দিকে তাকালো।স্পর্শের বাবা আর স্পন্দন দাঁড়িয়ে আছে।স্পর্শের বাবা ভেতরে আসতে আসতে বলল,

–“যদি ফুলের বাবা এসে ওকে নিয়ে যায় তাহলে তুই কিভাবে আটকাবি??”

স্পর্শের বাবাকে দেখে ফুল থতমত খেয়ে যায়।স্পর্শের থেকে ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেয়।স্পর্শের বাবা ফুলকে তো স্পর্শের থেকে দূরে থাকতে বলেছিল। ফুল তা মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু নিয়তি ওকে আবার স্পর্শের সামনে নিয়ে এসেছে। ফুল বলল,

–“না আঙ্কেল আমি বাবার সাথে যাব না। আপনাদের সাথেও না। এখান থেকে রিলিজ হলেই আমি চলে যাব। আসলে আমি এখানে ইচ্ছে করে আসিনি। আমার বাসটা হঠাৎ অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তাই,,,,,”

স্পর্শের চোখে চোখ পড়তেই ফুল থেমে গেল।স্পর্শ রাগি চোখে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে। ফুল মাথাটা নীচু করে ফেলে।স্পর্শ রাগি গলায় বলল,

–“কোথায় যাবি তুই??”

ফুল মাথা নিচু করেই বলল,

–“জানি না। তবে অনেক দূরে চলে যাব যেখানে বাবা আমাকে খুঁজে পাবে না।”

–“তুই আমার সাথে যাবি ব্যাস।”

স্পর্শের বাবা বলল,

–“সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আজমল যদি আবার আসে??আর আমাদের ক্ষতি করতে চায়। তাহলে কি হবে??”

স্পন্দন ওর বাবাকে বলল,

–“বাবা এটা সিলেট নয়।এটা ঢাকা, এখানে ওই আজমল চৌধুরী নিজের ক্ষমতা দেখাতে পারবে না। বাবা এবার তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো। ফুল সত্যি ওখানে ভালো নেই না হলে এভাবে পালিয়ে আসতো না।

–“কিন্তু যদি আজমল এসে ফুলকে নিয়ে যেতে চায় তাহলে তো আমাদের কিছু করার থাকবে না।”

স্পর্শ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

–“সে ব্যবস্থা আমি করবো।”

স্পন্দন বলল,

–“কি করবি তুই??”

স্পর্শ কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল।স্পন্দন বলল,

–“এই হলো স্পর্শ। সবসময় এরকমই করে। কোন কথা যদি সোজা সাপ্টা বলে।”

স্পর্শের বাবা ফুলের সামনে বসে বলল,

–“আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। আসলে আজমল আমাকে ভয় দেখিয়েছিল।যদি ও আমার সন্তানদের কোন ক্ষতি করে দেয়।”

–“না আঙ্কেল আপনি যা করেছেন সব তো ভালোর জন্যই করেছেন।”

🍁🍁🍁

তিনদিন পর ফুলকে রিলিজ করা হয়। ফুল স্পর্শের সাথে ওর বাড়িতে আসে।গাড়ি থেকে নামতেই ফুলকে কোলে তুলে নেয় স্পর্শ। ফুল বলল,

–“একি কি করছেন?? আমি হাঁটতে পারব।”

–“আমি হাঁটতে দেব না।”

–“আমি হাঁটতে পারব। আপনি আমাকে হাঁটতে না দেওয়ার কে??”

–“সেটা না হয় পরেই বোঝাব।”

ফুল স্পর্শের গলায় একটা চিমটি কাটলো।স্পর্শ ‘আহহ’ শব্দ করে বলল,

–“এটা কি করলি??”

–“কেন মনে নেই।”

–“আছে তো আমার হাতের কামড়ের দাগ এখনো যায়নি।”

–“আমাকে নামান না হলে ঘাড়ে কামড় দিয়ে সব রক্ত খেয়ে নেব।”

–“আগে তো জানতাম তুই একটা শাকচুন্নী এখন তো দেখছি তুই একটা পিচাশিনি।”

–“কি??”

স্পর্শ হেসে ফেললো। ততক্ষণে স্পর্শ বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে।ফুলকে সোফায় বসাতেই বাড়ির সবাই দৌড়ে আসে।স্পর্শের মা এসে ফুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

–“কত বড় হয়ে গেছে সেই ছোট্ট ফুল।”

স্পর্শ বলল,

–“হুম কলি থেকে এখন ফুলে পরিণত হয়েছে।”

স্পর্শের এহেম কথায় ফুল খানিকটা লজ্জা পেয়ে যায়।স্পর্শের মা বলল,

–“তুই কি শোধরাবি না??সেই আগের মতোই মেয়েটার পিছনে পড়ে থাকবি??”

–“না না মা এখন আমি আর ওর পিছনে পড়ে নেই।ওই আমার পেছনে পড়ে আছে। দেখছো না সেই সিলেট থেকে আমার পিছু পিছু এখানে চলে এসেছে।”

ফুল রাগি চোখে স্পর্শের দিকে তাকালো।দিয়া স্পর্শের পিঠে চাপড় মেরে বলল,

–“এসব কি হচ্ছে স্পর্শ??এই সিরিয়াস মুহূর্তে তোমার এসব না বললেই নয়।”

বলেই দিয়া ফুলের পাশে বসল।সবার সাথে ভাব বিনিময় করে তারপর ফুলকে স্পর্শের মায়ের রুমে নিয়ে গেল।

কেটে যায় আরো দুটো দিন।এই দুদিনে ফুলের যত্নের কোন কমতি রাখেনি স্পর্শ।সবটা নিজের হাতে করেছে ও। কাউকে কিছু করতে দেয়নি। ফুল শুধু স্পর্শের কান্ড দেখেছে আর হেসেছে।

স্পর্শ নিজের রুমে বসে কিছু একটা করছিল। তখনই স্পন্দন ওর রুমে ঢুকলো।চোখ মুখে ভয়ের ছাপ।স্পর্শ জিজ্ঞেস করল,

–“কি হয়েছে ভাইয়া??”

–“ফুলের বাবা এসেছে সাথে পুলিশ নিয়ে।”

স্পর্শ মৃদু হাসলো।স্পন্দন বলল,

–“তুই হাসছিস??সবাই কত চিন্তায় পড়ে গেছে?? এখন কি হবে??”

–“চলো দেখি কি হয়??”

স্পর্শ ভাইয়ের সাথে ড্রয়িং রুমে আসলো। সেখানে মামা মামী বাবা মা এমনকি বাড়ির সকলে উপস্থিত। ফুল সোফায় বসে আছে। আজমল চৌধুরী সামনেই পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।স্পর্শ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে এসে দাঁড়ালো।

চলবে,,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here