#বিচ্ছেদ – ৪
আশিক মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
মা এমন একটা কথা বলতে পারে সে আন্দাজ করতে পারছিল। গত কয়েকদিন ধরে মায়ের কথা-বার্তায় তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল।
আশিক মনে মনে রেডি হচ্ছিল।
তুমি রিয়া-রায়নাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো, মা নরম গলায় কথা বলছেন।
আমি জীবনে যা কখনো ভাবিনি, আমার ফ্যামিলিতে তাই হয়েছে। তোমার বাবা বেঁচে থাকলে কখনোই এমন হতে দিতেন না। তখন যদি রিয়া আর তুমি এত জেদ না করতে তাহলে আজ এমন হতনা। যাহোক এখন আর ওসব ভেবে লাভ নেই। বরং আমার দীদা ভাই এর কথায় ভাবো আগে,এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে মা থামলেন।
আশিক মাথা নিচু করে শুনছিল এতক্ষণ।
মায়ের কথা শেষ হলে মুখ তুলে তাকালো।
জেদ তো করেছেই আশিক। জেদটা আরো বাড়তো যখন রিয়াদের দু’একজন কাছের আত্মীয়ের মাধ্যমে জানতে পেরেছিল যে, রিয়া নাকি ফিরতে চায়না কিছুতেই। রিয়ার অনেক রাগ তার উপর।
এসব শুনেই আরো রাগ বাড়তো আশিকের।
রিয়ার প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণার জন্ম নেয়।
আশিক মনে করে তার জীবনের আজকের অবস্হার জন্য রিয়া দায়ী।
রিয়াকে ক্ষমা করতে পারেনা।
ডিভোর্সের পর চেষ্টা করে আমেরিকার স্কলারশিপটা ম্যানেজ করে দেশ ছেড়েছিল আশিক।
রিয়ার থেকে দূরে যেতে চেয়েছিল সে।
আমেরিকায় গিয়ে প্রথম প্রথম পড়াশোনায় ডুবে থাকতো। সে সময় গুলো খুব কষ্টের ছিল।
দুই বছরে তার অনেক কিছুই ঘটেছে আশিকের জীবনে। হতাশার দিনগুলোকে ভুলতে পেরেছে অনেকটা।
আমার পক্ষে সম্ভব নয় মা। আমি আবার সেই অতীতে ফিরতে চাইনা, বললো আশিক।
চমকে উঠলেন মা।
অবাক হয়ে বললেন, কেন ? কেন সম্ভব না ?
তুমি তোমার মেয়েকে কাছে পেতে চাওনা ?
তার প্রতি তোমার দায়িত্ব পালন করতে চাওনা ?
এতগুলো কথা একবারে বলে মা থামলেন।
আশিক বুঝতে পারছে পরিস্হিতি তার অনুকূল
থাকবেনা। এখনো সে বাড়ীর কারো সাথেই কথা বলতে পারেনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়ে।
তার বেশ নার্ভাস লাগছে।
মাকে কিছুতেই দুঃখ দিতে চায়না সে।
মা তার সবকিছু।
বাবা মারা যওয়ার পর মা ওদেরকে আঁকড়ে বেঁচে আছেন। আশিক বড় সন্তান। সব সময় মাকে সর্বোচ্চ ভাল রাখার চেষ্টা করে ওরা সব ভাই বোন।
রাশিক এবং ইভাও রিয়া-রায়নাকে ফিরিয়ে আনার জন্য বস্ত হয়ে পড়েছে। ওরাও চাইছে সব কিছু আগের মত হয়ে যাক।
আশিক কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
তার পক্ষে এখন আর কোন কিছুই আগের মত করা সম্ভব নয়। অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে কেটেছে তার প্রবাসের গত দু’টা বছর।
আমি পারবো না মা। কারণ আমি আরেকজন কে কথা দিয়েছি। আমার জীবনে নতুন কেউ এসেছে। আমি তোমাদের এতদিন জানাইনি। ভেবেছিলাম দেশে ফিরেই বলবো।
মা অবাক চোখে তাকালেন আশিকের দিকে।
কি বলছে ছেলেটা !
ঠিক মত কোন মেয়ের সাথে বন্ধুত্বই করতে পারলো
না পুরো ছাত্র জীবনে।
আর সে কিনা এত বড় একটা ঘটনার পরে নিজ থেকেই কাউকে পছন্দ করলো ?
মা হতাশ গলায় বললেন,কাকে পছন্দ করলে ?
কেমন কি কিছুই জানলাম না। আমার মতামতও নেয়ার প্রয়োজন মনে করলে না ?
আশিক মাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো,আমি তোমার মতামত ছাড়া কিছুই করবো না।
মা বোঝাবার চেষ্টা করলেন, তোমার মেয়ের কথা ভেবে হলেও তুমি নতুন সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসো।
আশিক বার বার মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো।
মা বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
তার শরীর খারাপ লাগছে।
আশিক মাকে ঠিক করে শুইয়ে ঘরের আলোটা
নিভিয়ে দিল। দরজাটা আস্তে করে টেনে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
রিয়া স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তার রুমের সাথে লাগোয়া ছোট্ট বারান্দায়। রায়না ঘুমাচ্ছে।
রাত অনেক হয়েছে।
রিয়া ঘুমাতে পারছেনা।
বুকের ভেতরটা কেউ খামচে ধরে আছে মনে হয়।
খুব জ্বলছে রিয়ার…
আজ বিকেলে আশিকদের বাড়ীতে গিয়েছিল।
ইভা হট্যৎ ফোন করে অস্হির গলায় বলেছিল,ভাবী প্লিজ চলে এসো। মা খুব অসুস্হ। রায়নাকে দেখতে চাইছে।তোমার সাথেও নাকি জরুরী কথা বলবে। প্লিজ এসো।
রিয়া অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বের হয়েছিল আজ। বাসায় এসেই রায়নাকে নিয়ে ওবাড়ীতে চলে গিয়েছিল।
মায়ের প্রেশার বেড়েছে।
ডায়াবেটিসও একটু বেশী।
আর তাছাড়া মা তো ক্যানসারের পেশেন্ট।
একটু এদিক-ওদিক হলেই শরীরটা খারাপ হয়ে পড়ে। ঔষুধ, খাওয়া, ঘুম সবই খুব নিয়মের মধ্য করেন তিনি।
তারপরও মাঝে-মধ্য শরীর বেশ খারাপ হয়ে পড়ে।
রিয়া মায়ের ঘরে গিয়ে হাত ধরে কেমন আছেন জানতে চেয়েছিল। রায়না দৌড়ে গিয়ে তার দাদীর কোল ঘেষে শুয়ে পড়েছিল।
তার দাদী রায়নাকে বুকে চেপে ধরে রেখেছিলেন দীর্ঘক্ষণ। কোন কথা বলেন নি সেসময় তবে তার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল।
রিয়া তখন খানিকটা অবাক হয়েছিল।
কাঁদছেন কেন উনি ?
এখন তো বরং উনার আনন্দে থাকার কথা।
সব কিছু আগের মত হয়ে যাবে।
রায়নাকে নিয়ে তার বাবা বেড়াতে বের হয়েছিল।
মায়ের সাথে ব্যালকুনিতে বসে চা খাওয়ার পর
মা রিয়ার হাত ধরে বলেছিলেন, তোমাকে এত কষ্ট দেয়ার জন্য আমাকে মাফ করে দিও।
কিন্ত আমার কষ্ট দূর করি কিভাবে বলো তো ?
আমি কোনদিনই তোমাদের ডিভোর্স চাইনি।
আবার এখনও আমার চাওয়ার কোন মূল্য নেই।
আল্লাহ-তায়ালা আমার কপালে নাতি-পুতির সুখ দেয়নি মনে হয়।
রিয়া কিছুই বুঝতে পারছিলনা মায়ের কথা।
মা তখন খুব কাঁদছিলেন।
সেসময় ইভা এবং রাশিকও এসে বসেছিল ব্যালকুনিতে ওদের সাথে।
ওদের মুখেই সব কিছু শুনেছিল রিয়া।
আশিক আমেরিকায় যাওয়ার পর নীলার সাথে পরিচয় হয়েছিল। একসাথেই পড়াশোনা করতো।
নীলা ডিভোর্সি। একটা ৭/৮ বছরের বাচ্চা আছে।
আশিকের সাথে ধীরে ধীরে মেয়েটির সম্পর্ক গভীর হয়। দু’জন দু’জনকে মানসিক সাপোর্ট দিতে গিয়েই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
একে অপরকে কথা দেয়,নতুন করে জীবন শুরু করবে। তাই আশিক মায়ের প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
এদিকে মা আশিকের এই বাচ্চাসহ কাউকে বিয়ে করাটা কোন ভাবেই মেয়ে নেননি।
মা নাকি কঠিন গলায় আশিককে বলেছেন,
আমার বংশধর কে রেখে তুমি আরেকজনের বাচ্চার বাবা হতে চাও ? আমি বেঁচে থাকতে এধরনের কথাও আমার সামনে বলবে না। কারণ আমি মেনে নিবো না। তোমার যা ইচ্ছা করতে পারো।
আমার সাথে কোন সম্পর্ক থাকবেনা।
এর পরেই নাকি মা খুব অসুস্হ হয়ে পড়ে।
পরিবার থেকে কোন সমর্থন পায়নি আশিক তার নতুন সম্পর্কের জন্য।
রাশিক এবং ইভাও চাইছে সব আগের মত হোক।
রায়না তার নিজের বাড়ীতে নিজের মানুষদের মাঝে বড় হোক।
রিয়া মায়ের হাত ধরে নিস্তব্ধ হয়ে বসে ছিল বেশ খানিক্ষণ।তারপর,
এক বুক শূন্যতা নিয়ে রায়নার হাত ধরে বেরিয়ে
এসেছিল আশিকদের বাড়ী থেকে।
রাতে ঘুমোবার আগে রায়না রিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, মা আমরা বাবার কাছে চলে যাব ?
কি মজা !
রিয়া কিছুই বলতে পারেনি রায়নাকে।
মেয়েকে বুকের ভেতর চেপে ধরে ছিল।
তারপর পরম মমতায় ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
মা-বাবাকে এখনো কিছু জানায়নি রিয়া।
এমন একটা খবর কিভাবে দেবে ভেবে পাচ্ছেনা।
মেয়ের ভাঙাচোরা জীবনটা সুন্দর মত জোড়া লাগার সপ্নে বিভোর হয়ে আছে মানুষ দু’টো।
কিভাবে তাদের সপ্ন ভেঙ্গে দেবে রিয়া ?
আশিকের সাথে বিচ্ছেদের পর খুব ভেঙ্গে পড়েছিল রিয়া। মনে হত বাঁচবে কিভাবে আশিককে ছাড়া ?
কিন্তুু বেঁচে তো ছিল !
খুব কষ্টে বেঁচে ছিল।
আশিককে ছাড়া প্রতিটা মূহুর্ত্য কষ্ট হত।
তবে রাগ অভিমানও ছিল খুব।
কিন্তু আজ যখন জানতে পারলো আশিক অন্য
কাউকে ভালবাসে.. তাকে কথা দিয়েছে।
রিয়া বুকের ভেতর নদীর পাড় ভাঙার শব্দ
শুনতে পেয়েছিল।
কষ্ট.. কষ্ট.. কষ্ট..
খুব কষ্ট হচ্ছে…
বুক ভেঙে যাচ্ছে রিয়ার।
অন্ধকার বারান্দায় বসে রিয়া অঝোরে কাঁদতে লাগলো…
( চলবে )