#বিচ্ছেদ – ৫
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে সাধারণত; মেইল চেক করে রিয়া। জরুরী হলে সাথে সাথেই রিপলাই করে।
আজও মেইল চেক করছিল।
হট্যৎ থমকে যায় একটা নাম দেখে !
রিয়া ভাল ভাবে চেক করলো, না কোন ভুল হয়নি।
আশিক রায়হান।
রিয়া স্হির হয়ে তাকিয়ে আছে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে। আশিক রায়হান মেইল করেছে রিয়াকে।
গত সাত বছরে একবারের জন্যও সরাসরি যোগাযোগ হয়নি ওদের মাঝে।
রিয়া আশাও করেনি।
সাত বছর আগে যখন আশিক ওদের ফিরিয়ে দিয়েছিল, তখন দ্বিতীয় বারের মত ঝড় উঠেছিল রিয়ার জীবনে।
মনে পড়লো সাত বছর আগের সব কথা….
পরদিন সকালে কাউকে কিছু বলেনি রিয়া।
অফিসে গিয়েছিল।
সারাদিন অফিসে বসে ভেবেছিল,কি করা উচিৎ ওর ? কি করবে ? কিভাবে বাবা মাকে বলবে কথাটা ?
বাবা-মা জানার পর বাড়ীতে খুব অশান্তি হয়েছিল।
বড় ভাইয়া,বড় আপু একটুও ভাল ভাবে নেয়নি বিষয়টা। আশিকের উপর সবাই খুব রাগ হয়েছিল।
বড় ভাইয়া তো বলেইছিল,তোকেও আমি ভাল ছেলে দেখে আবার বিয়ে দিবো।
মা খুব কেঁদেছিল।
বাবা একদম চুপ হয়ে গিয়েছিল।
কোন কিছুই বলেন নি।
রিয়া বাবার কষ্ট দেখতে পারছিল না।
একদিন ইভা ফোন করেছিল।
রায়নার দাদীর শরীর আরো খারাপ হয়ে পড়েছিল।
রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল এই ভেবে যে, আশিকের পরিবারের মানুষগুলো এত ভাল কেন ?
রায়না এই ভাল মানুষগুলোকে পেলনা !
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব,অফিস কলিগ সকলের চোখেই অনেক প্রশ্ন!
সবাই জানতো রায়নার বাবা ফিরেছে। তার বাবার কাছে চলে যাওয়ার একটা সম্ভবনাও আছে।
এখন রিয়া কি করে সবার সামনে মুখ দেখাবে ?
বিশেষ করে অফিসের কাছের অনেকেই জানতো আশিকের সাথে তার আবার একটা রি-ইউনিয়ন হতে যাচ্ছে।
রিয়া মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, এই পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে রায়নাকে নিয়ে অন্য কোথাও বা দূরে কোথাও চলে যেতে হবে।
তা না হলে রায়নাকে মানুষ করতে পারবে না।
চেনা-জানা মানুষের কথার আঘাতেই রায়না ক্ষত-বিক্ষত হতে হতে বড় হবে।
রিয়া কিছুতেই সেটা চায়নি।
একটা নতুন চাকুরীর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল
রিয়া। সেসময় ওর এক স্কুল জীবনের বান্ধবীর হাসবেন্ডের (আর্মি অফিসার) মাধ্যমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষক পদে চাকুীর খবর পেয়েছিল। রিয়া সাথে সাথেই দরখাস্ত করে এবং লিখিত পরীক্ষা আর ভাইবাতে ভালভাবে উর্তীণ হয়ে গিয়েছিল। চাকুরীটা পেয়ে রিয়া সেই দমবন্ধ করা সময়টা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। পরে শিক্ষক নিবন্ধন এবং বিএড করেছে রিয়া।
রায়নাকে নিয়ে স্কুলের খুব কাছেই অল্প ভাড়ায় দুই রুমের বাসা ভাড়া করে ছিল প্রথম চার বছর। এদিকে স্কুলে শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দকৃত বাসার জন্য আবেদনও করে রেখেছিল।
সেনাবাহিনীর কলেজের ভিতরেই টিচারদের বসবাসের জন্য বেশ কিছু বিল্ডিং আছে। আরো কিছু তৈরী হচ্ছিল।
গত তিন বছর হলো রিয়া কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরেই জুনিয়র টিচারদের জন্য বরাদ্দকৃত একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে আছে রায়নাকে নিয়ে।
রায়নাকে এই স্কুলেই ভর্তি করেছিল সেসময় প্লে-গ্রুপে। সাতটা বছর কম সময় নয়।
কত কষ্ট করতে হয়েছে রিয়াকে।
বাবা-মা চায়নি রিয়া চলে আসুক এভাবে।
কিন্তু ২য় বার মানুষের কথার অত্যাচারে জর্জরিত হতে চায়নি রিয়া। মানুষের উপেক্ষা, করুনার পাত্র হতে চায়নি। মেয়েকে এসব কিছু থেকে দূরে রাখতে রিয়ার এই যুদ্ধে নামা।
প্রথম প্রথম রায়নাকে নিয়ে কি যে কষ্ট হত।
ওর সকাল সাড়ে দশটায় ক্লাস শেষ হয়ে যেত।
এদিকে রিয়া দেড়টার আগে কলেজ ছাড়তে পারতো না। এটা সেনাবাহিনীর কলেজ। তাই এখানে নিয়ম-কানুন গুলোও অনেক কড়া।
যেমন টিচাররা সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে কলেজে না ঢুকলে রীতিমত লিখিত কৈফিয়ত দিতে হয়।উপযুক্ত কারণ না দেখাতে পারলে কর্তৃপক্ষ নির্দেশিত কিছু ব্যবস্হা মেনে নিতে হয়।
কাজেই রিয়া সবসময় চেষ্টা করেছে সে যেন কলেজের নিয়ম মত চলতে পারে।
রায়নাকেও এটা শিখিয়েছে।
সাড়ে দশটা থেকে দেড়টা, এই তিন ঘন্টা ছোট্ট রায়নাকে কোথায় রাখবে ভেবে পেত না রিয়া।
ওর অসহায় অবস্হা দেখে ভিপি ম্যাডাম একদিন ওকে বলেছিলেন, তুমি এই সময়টা রায়নাকে টিচার্স রুমের এক কোনে কপি, রং আর পেন্সিল দিয়ে বসিয়ে দিও।আর ওখানে ডিউটি সিস্টারকে একটু খেয়াল রাখতে বলো। আর আমাদের টিচাররা কেউ না কেউ তো থাকেই। আমি সবাইকে বলে দেবো রায়নার দিকে খেয়াল রাখবে।
রিয়া চিন্তামুক্ত হয়েছিল সেদিন।
ভিপি ম্যাডামকে সব ঘটনা বলেছিল রিয়া।
কারণ ওর বাসাটা কেন এত দরকার এটা বোঝাতে গিয়েই বলতে হয়েছিল।
তবে ভিপি ম্যাডাম সব শুনে দুঃখ করেছিলেন।
আর বলেছিলেন,তুমি যে মেয়েকে নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাইছো, এটায় আমার সবচেয়ে ভাল লাগছে। ভেবো না, আমি তোমার পাশে আছি।
রিয়ার চোখ ভিজে উঠেছিল সেদিন।
সেনানিবাসের বাইরে যখন ভাড়া বাসায় থাকতো,তখন কিযে কষ্টে কেটেছে রিয়ার। বাসা ভাড়া,বিদ্যুৎ বিল,গ্যাস,পানির বিল দেয়ার পরে তেমন কিছুই থাকতো না আর রিয়ার হাতে।
খুব কষ্টে হিসেব করে চলতে হত রিয়াকে।
রায়নার কোন সখ-আল্লাদই তেমন ভাবে মেটাতে পারতো না রিয়া।
রিয়ার বড় ভাই বিদেশ থেকে যখনই দেশে আসতেন, তিনি রায়নার জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসতেন।
তিনি যে ক’দিন দেশে থাকেন, রায়নার সখ মেটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
গত তিন বছর হলো সেনানিবাসের ভেতরে আছে।
এখন রিয়া আগের চেয়ে ভাল আছে।
নিরাপদে আছে।
দায়িত্ব এবং দক্ষতার জন্য রিয়ার সুনাম আছে কলেজে।
প্রথম প্রথম বাবা-মা বলতো, এভাবে একা একা কিভাবে চলবি ? ফিরে আয়।
কিন্তু রিয়া ফিরে যায়নি।
বাবা দেশের বাড়ী থেকে একজন বিশ্বত কাজের মহিলাকে এনে দিয়েছিলেন।
গত পাঁচ বছর ধরে সে রিয়ার সাথেই আছে।
রায়নাকে খুব ভালবাসে রহিমা খালা।
রহিমা খালা না থাকলে স্কুলের এত এত দায়িত্ব পালন করে বাকীটা সামলাতে রিয়াকে হিমশিম খেতে হত।
রায়না এখন স্ট্যান্ডার্ড ফোরে পড়ে।
যখন স্ট্যান্ডার্ড ওয়ানে পড়তো, তখন একবার রিয়ার
বাবা রিয়াকে জানিয়েছিল,আশিক রায়নার পুরো নাম জানতে চায়, যেটা বার্থ-সার্টিফিকেটে আছে।
কারণ আশিক তখন আমেরিকায়। চাকুরী ছেড়ে দিয়ে আমেরিকায় একবারে চলে গেছে।
স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় পড়ার সময়ই নাকি কিছু কিছু জায়গায় চাকুরীর চেষ্টা করেছিল।
পরে নাকি মায়ের সাথে মতের অমিল হওয়ায় ভালমত চেষ্টা করে ইউ এস চলে গেছে একবারে।
সিটিজেনশিপের কাগজ-পত্রে রায়নার নাম দিতে চায়। এখন না দিলে পরে আর দিতে পারবে না।
তাই সঠিক নামটা দেয়ার জন্য বলেছে।
রিয়া না করে দিয়েছিল।
আশিক কি রায়নার কাগজে-কলমের বাবা
হতে চায় ?
অসম্ভব এক কষ্ট রিয়াকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।
মনে হয়েছিল,থাক আশিক নিজে ভাল থাক। রায়নার দায়িত্ব তার নেয়ার দরকার নেই।
সে একাই রায়নার জন্য যথেষ্ট।
রায়নার জীবনে আশিকের প্রয়োজন আছে বলেই তো রিয়া ফিরতে চেয়েছিল, কিন্তুু আশিক সেটা মনে করেনি। তাই রিয়া বাবার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিল,রায়নার আমেরিকার সিটিজেনশীপ লাগবেনা।
তবে রিয়া কোনদিন আশিক সম্পর্কে একটাও খারাপ কথা বলেনি মেয়েকে।
সবসময় মেয়ের কাছে তার বাবাকে ভাল মানুষ হিসেবে তুলে ধরেছে।
মেয়েটা সাত বছর আগে যখন থেকে বুঝতে
পারলো, বাবার কাছে তারা আর ফিরে যাচ্ছে না।
তার বাবা শুধু তাকে চায়, মাকে চায়না। তখন থেকে আর বাবাকে নিয়ে কোন কথা বলতো না।
সব সময় বন্ধুদের বাবাদের দেখতো আর মলিন হয়ে যেত রায়নার মুখ।
তবে ইদানিং প্রায়ই বলে, মা,বাবা কি সত্যিই আমাকে ভালবাসে ? আমাকে কোনদিন দেখতে আসবে ?
রায়না এক আকাশ কষ্ট বুকে চেপে বলে,অবশ্যই ভালবাসে। নিশ্চয় আসবে তোমাকে দেখতে।
যদিও রিয়া জানেনা আশিক মেয়েকে দেখতে আসবে কিনা। মেয়েকে খুঁজবে কিনা।
তবুও, রায়নাকে কষ্ট দিতে, নিরাশ করতে মন চায়নি।
রিয়া জানে আশিক বিয়ে করেছে।
নতুন বউ নিয়ে আমেরিকায় থাকে।
বিয়েটা অবশ্য খুব বেশীদিন হলো করেনি।
রায়নার দাদী মারা গেছেন আজ পাঁচ বছর হলো।
বিয়েটা করেছে মা মারা যাওয়ার বেশ পরে।
শুনেছে ইভার বিয়ে হয়ে গেছে।
ইভা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল।
রিয়া একটা সময় দূরে সরে এসেছে।
নিজের উপর, ভাগ্যের উপর অভিমান করে
সবার থেকে দূরে সরে এসেছে রিয়া।
রিয়া দূরেই থাকতে চেয়েছে সবার থেকে।
কিন্তু আজ হট্যৎ এত গুলো বছর পরে..
আশিক কেন যোগাযোগ করলো ?
কি চায় আশিক… ???
( চলবে )