#বিনিময়
পর্ব- ১০
“একটা কথা সত্যি করে বল তো…তুমি আমাকে বিয়ে কেন করেছিলা? টাকার জন্য? না অন্য কোনো ব্যাপার আছে?”
সত্যি কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলো রুহান।
.
শুরুতে সে নিশ্চিত ছিল যে লিসা টাকার জন্যে তাকে বিয়ে করেছে। কিন্তু এখন সে আর অত নিশ্চিত না। লিসার আচার আচরণ দেখে রুহানের মনে হয় এ বাসায় বেশিদিন থাকার ইচ্ছা নাই তার।
.
রুহানের প্রশ্ন শুনে লিসার মনেও এ চিন্তা আসলো. হঠাৎ করে কেন সে রুহানকে বিয়ে করতে গেল? তার লাইফ মুহুর্তের মধ্যেই কমপ্লিকেটেড হয়ে গিয়েছে রুহানকে বিয়ে করার পর।
.
“যদি টাকার জন্যে বিয়ে করে থাকো তাহলে বল আমার লাইফ থেকে বিদায় নিতে কত টাকা নিবে তুমি?”, রুহান বলতে থাকে।
টাকা দিয়ে হলেও লিসাকে আপাতত ঘাড় থেকে নামাতে চায় সে। পরে শোধ নিবে সে লিসার থেকে।
.
লিসার চোখ রাগে চকচক করে উঠলো… সে বলল, “কলেজে থাকার সময় এক মেয়ের প্রতি তুমি কি অন্যায় করেছিলে মনে আছে?”
রুহান কনফিউজড হয়ে তাকালো তার দিকে। কোন মেয়ের কথা বলছে লিসা?
লিসা বলল, “মনে নাই না? মনে তো থাকবেই না। তোমার জন্যে একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে আর তোমার তার কথা মনেই নাই!”
.
আত্মহত্যা করেছে?! কলেজের কোন মেয়ে আত্মহত্যা করলো? রুহান এবার পুরোপুরি কনফিউজড হয়ে গেছে।
লিসা বলল, “আমাকে নিজের জীবন থেকে সরাতে চাও? ওই মেয়ের পরিবারের কাছে মাফ চেয়ে আসো। এক পয়সাও না নিয়ে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো.”
।
লিসার কথা শুনে রুহানের মাথা ভার হয়ে যায়। কোন মেয়ের কথা বলছে লিসা! তার মনেই নাই যার কথা তাকে খুজে বের করবে কেমন করে? কলেজে থাকার সময় তার অনেক রিলেশন ছিল। সবার কথা মনে নাই রুহানের এখন।
.
নাহ! খুব দ্রুত তাকে এ ব্যাপারে জানতে হবে। জামিলকে খুব মিস করছে সে। জামিল থাকলে এ ব্যাপারে তাকে চিন্তা করতে হতনা। এখন রিলায়েবল কাউকে খুজে বের করা লাগবে তার পার্সোনাল লাইফ হ্যান্ডেল করার জন্য।
.
রুহানকে ভাবনায় ফেলে চলে আসলো লিসা রুম থেকে। রুহানকে বোকা বানিয়ে খুব মজা লাগছে তার। কেমন করে আহাম্মকের মত তাকিয়ে ছিল লিসার দিকে!!! এমন মেয়ের কথা ইচ্ছা করেই বানিয়ে বানিয়ে বলেছে লিসা। রুহানের বহু গার্লফ্রেন্ড আর “জাস্ট”ফ্রেন্ড ছিল কলেজে। কাজেই লিসার কথা সে অবিশ্বাস করবেনা।
.
এভাবে বানিয়ে বলার আরেক উদ্দেশ্যও আছে তার। লিসা যে কাকতালীয়ভাবে রুহান এর জীবনে আসেনি তা সে সন্দেহ করা শুরু করেছে। ইনভেস্টিগেশন শুরু করলে তার আর সিয়ামের কানেকশন এর ব্যাপারে রুহান জেনে যেতে পারে। তাকে মিসগাইড করাই ভাল। এতদিন লিসা রুহানকে চোখে চোখে রেখেছিল যাতে সে.
।
বাইরে কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারে। কিন্তু কাল থেকে লিসা অফিসে যাবে। রুহানের উপর সেরকম নজর দেওয়া যাবেনা। কাজেই তাকে একদিকে ব্যস্ত রাখাই ভাল।
.
.
লিসা অফিসে যাওয়া নিয়ে নার্ভাস বোধ করছেনা তেমন। এক্সিডেন্ট এর পরে রুহানের থেকে ল্যাপটপ আর মোবাইল নিয়ে নিয়েছিল লিসা। সিয়াম এর পরিচিত একজন কে দিয়ে ল্যাপটপ আর মোবাইল এর সব ইনফরমেশন রিকভার করেছে লিসা। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় রুহানকে যারা সাহায্য করতো তারা এখন লিসাকেও সাহায্য করবে. কয়েকদিন ধরে সে এই প্রিপারেশনই নিয়েছে।
.
অবশ্য এসবের বিনিময়ে সিয়ামও কয়েকটা ইম্পর্টেন্ট কনফিডেন্সিয়াল ইনফরমেশন নিয়েছে। তাতে লিসার যায় আসেনা। জগতে কেউ কাউকে এমনি এমনি হেল্প করেনা।
.
.
পরেরদিন অফিসে তাড়াতাড়িই গেল লিসা। আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে।
এমনিতে নতুন ইমপ্লয়িদের এসব মিটিং এ থাকতে দেওয়া হয়না। তবে লিসার কথা আলাদা। সে মিটিং এ থাকলে কেউ তাকে বাধা দিবেনা।
।
রুহান সৌদিআরবে নতুন এক ব্যবসা চালু করতে চেয়েছিল। কাজ অনেকদূর গিয়েছিল। কিন্তু এ নতুন ব্যবসা হ্যান্ডেল করার মত এক্সপেরিয়েন্স নাই এ অফিসে কারো। তাই তারা অন্য কোম্পানির সাথে চুক্তি করবে। তারা বিদেশে ব্যবসার দেখাশোনা করবে আর লাভের নির্দিষ্ট অংশ শেয়ার অনুযায়ী ভাগ হবে।
.
অনেক কোম্পানিই এতে ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে। লিসা রুহানের ল্যাপটপ থেকে এসব ইনফরমেশন পেয়ে তার বাবার কোম্পানির নামও দিয়ে দিয়েছে লিস্টে।
.
কোন কোম্পানির সবচেয়ে যোগ্য এ ব্যাপারে আজকে সিদ্ধান্ত হবে। যে লোকের কাছে দায়িত্ব পড়েছে এসব ইনফরমেশন বের করা লিসা তার সম্পর্কে সমস্ত খবর বের করেছে। নাম তার জামশেদ। এর আগে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে রুহান মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিতো বিভিন্ন কোম্পানির কাছে।
যে কোম্পানি সবচেয়ে বেশি টাকা দিতো তাদের সম্পর্কে রুহান এই লোককে দিয়ে ভাল ভাল ইনফরমেশন দেওয়াতো। স্বাভাবিকভাবেই সেই কোম্পানিই সিলেক্ট করা হত।
কত সুন্দরভাবে ডেমোক্রেসিকে ম্যানিপুলেট করা যায়!!!
.
রুহান অবশ্যই ঘুষের কিছু অংশ ওই লোককেও দিতো। কবে কত টাকা ঘুষ দিয়েছে সেসব রেকর্ড ছিল রুহানের কম্পিউটার এ। কি পরিমাণ গর্দভ হলে মানুষ নিজের পাপকর্মের এমন রেকর্ড রাখে।
.
দুইদিন আগেই লিসা ওই জামশেদকে সেই রেকর্ডের স্ক্রীনশট পাঠিয়েছে যদি আজকে তার বাবার কোম্পানি সিলেক্টেড না হয় তাহলে ওই লোকের খবর আছে।
.
লোকটা লিসাদের কোম্পানির একের পর এক প্রশংসা করে যাচ্ছে আর লিসা অবাক হচ্ছে। কত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারে ওই লোক!! অবশ্যই শেষমেশ তাদের কোম্পানিই সিলেক্ট হবে।
.
ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর রুহানের বাবা যখন কোম্পানির মালিকের নাম দেখলেন তখন তিনি ভ্রু কুঁচকে লিসার দিকে তাকালেন। লিসা ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে উনার দিকে।
“সরি স্যার, আমার বাবা বিয়ের আগে এটার জন্য এপ্লাই করেছিল। আপনি সংকোচ বোধ করলে বাদ দেন”.
.
রুহানের বাবা কিছু বললেননা। তাদের কোম্পানি ছাড়া অন্য কোম্পানির রেকর্ড একদম ভালনা। এ কোম্পানি ছাড়া আর কাউকে সিলেক্ট করা সম্ভব না।
.
লিসা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এ ডিল ফাইনাল হলে তাদের ফাইনানশিয়াল অবস্থার উন্নতি হবে। সবচেয়ে বড় কথা তার পরিবার বিদেশে থাকলে রুহানের নাগালের বাইরে থাকবে। রুহানের যে ক্যারেক্টার সে অনুযায়ী অবশ্যই সে লিসার ফ্যামিলির প্রতি দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে চাইবে। লিসা এটা হতে দিতে পারেনা। তাদের ক্রসফায়ারের মধ্যে লিসা তার পরিবারকে পড়তে দিবেনা
।
জামশেদ এরই মধ্যে লিসাকে মেসেজ পাঠালো। লিসার সাথে দেখা করতে চায় সে। লিসা মাথা নাড়লো তাকে দেখে।
যদিও ভালোভাবেই জানে লিসা যে সে কি চায়। লিসাকে সে সমস্তা ডাটা ডিলেট করতে বলবে।
মনে মনে হাসলো লিসা। সোনার ডিম দেওয়া মুরগিকে কেউ বলে এত সহজে ছেড়ে দেয়!!
.
বের হওয়ার সময় রুহানের বাবা। লিসার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন। লিসা কি জামশেদ এর দিকে তাকিয়ে কোনো ইশারা করলো এখনি? তা কি করে সম্ভব! এদের তো একে অন্যকে চেনার কথা না। দুইজনের দিকে তাকালেন তিনি। নাহ! মনের ভুলই হবে তার।
.
.
*
কয়েকদিন এর মধ্যেই লিসা নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে।
রুহানের বাবা লিসার পরিশ্রম দেখে ইমপ্রেসড হলেন। তার আসলে এত পরিশ্রম করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু কেন যে মেয়েটা কাজের মধ্যে থাকে সারাদিন!
মাঝে মাঝে তাঁর মনে হয় রুহানকে এড়িয়ে চলার জন্যেই সে যতক্ষণ পারে অফিসে থাকে। লিসা সবার সামনে রুহানের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করলেও তাদের মধ্যেকার অস্বাভাবিকতা রুহানের বাবার চোখ এড়ায়না।
.
.
তবে লিসা কেবলমাত্র রুহানকে এড়িয়ে চলার জন্যেই অফিসে ওভারটাইম করেনা। তার দুইনাম্বারি কাজগুলা সবার সামনে করা সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়ে তাকে দেরি করে বাসায় যাওয়া লাগে। মাঝে মাঝে সিয়ামকেও কয়েকটা কনফিডেনসিয়াল ইনফরমেশন দেওয়া লাগে। নাহলে সে কখন বিদ্রোহ করে বসবে ঠিক নাই।
.
অফিসে থেকে থেকে লিসা আর রুহানের প্রতি নজর রাখার সময় পায়না।
.
ইতিমধ্যেই রুহানের অবস্থার যে অনেক উন্নতি হয়েছে আর সে লুকিয়ে আরেকটা ফোন কিনে বাইরে যোগাযোগ করা শুরু করে দিয়েছে এদিকেও লিসা খেয়াল করেনি।
.
হাতপা বেশি ব্যবহার করলে এখনো রুহানের ব্যাথা হয়। তবে সে হাটতে পারে এখন।
লিসা বাসায় আসলে রুহান এমন ভান করে যেন তার হাত পা এখনো ঠিক হয়নি।
লিসা বাসায় আসলেই সে ফোন আর ল্যাপটপ ফেরত দেওয়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান করে।
কিন্তু সে এখন রীতিমত বাইরে একজনের সাথে যোগাযোগ করে। লোকটা আগে জামিলের হয়ে কাজ করতো। এখন সে রুহানের হয়ে কাজ করে।
লিসার থেকেই শিখেছে রুহান যে সবসময় নিজের ক্ষমতা প্রকাশ করতে হয়না।
.
প্রায় একমাস পর্যন্ত খোঁজখবর নিয়ে রুহান জানতে শেষমেশ নিশ্চিত হয় সে লিসা কলেজের মেয়ের কথা বানিয়ে বলেছে। তারমানে রুহানের সাথে বিয়ের আসল কারণ প্রতিশোধ না। তাহলে উদ্দেশ্য কি তার?
.
লিসার মধ্যে থেকে আসল কথা বের করার জন্য রুহান সচরাচর যা করে তাই করতে গেল। ব্ল্যাকমেল। লিসার ভাইকে ধরে একবেলা বেধে রাখলেই লিসা বাপ বাপ করে আসল কথা বের করবে।
.
কিন্তু ওই লোক এসে রুহানকে দুঃসংবাদ দেয় যে লিসার পরিবার আগেই বিদেশে চলে গিয়েছে। এত বড় ঘটনা অথচ রুহান জানতেও পারলোনা! ওরাই বা কেমন জামাই এর সআতসাথে দেখা না করেই চলে গেল! রাগে গা জ্বলে উঠলো রুহানের।
.
বলাই বাহুল্য যে যাওয়ার আগে লিসার পরিবার বারবার সবার সাথে দেখা করে যেতে চেয়েছিল…লিসাই মানা করে দিয়েছে।
“বাবা রুহান আর তার মা এখনো আমাকে পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি,”
কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে লিসা, “প্লিজ তুমি এখানে এসোনা। তোমার অপমান হলে আমার তা সহ্য হবেনা। ”
লিসার কথা অবশ্য পুরোপুরি মিথ্যা না।
কাজেই উনারা অফিসে কেবল রুহানের বাবার সাথে দেখা করেই চলে যায়।
.
শর্টকাট উপায় কাজ না করায় বাধ্য হয়ে রুহানকে অপেক্ষা করতে হয়। লোকটিকে বলে লিসাকে চোখে চোখে রাখতে।
কিন্তু লিসাকে কোনো সন্দেহজনক কাজ করতে দেখা যায়না। শুধু বাসা আর অফিসের মধ্যেই থাকে লিসা।
.
রুহান খুবই হতাশ হয়। লোকটিকে বলে, “লিসার কল রেকর্ড বের কর। আমাদের সম্পর্কে এতকিছু জানা তার একার পক্ষে অসম্ভব। অবশ্যই সে সাহায্য পেয়েছে অন্য কারো থেকে।”
বিরক্ত হয়ে রুহান বিছানায় শুয়ে থাকলো।
লিসা আর তার সাহায্যকারীকে পেলে রুহান এমন অবস্থা করবে তাদের যেন তারা মৃত্যুকামনা করবে।
.
রুহানের কর্মকান্ড সম্পর্কে অনবগত লিসা এই সময় অফিসে কাজের মধ্যে ডুবে ছিল। হঠাৎ ফোন আসাতে বিরক্ত হয় সে।
ফোন ধরতেই সিয়ামের ব্যঙ্গাত্মক আওয়াজ ভেসে আসে, “নিজের হাসবেন্ড সে সামলাও। সে শীতনিদ্রা থেকে জেগে উঠেছে “।
সতর্ক হয়ে উঠে লিসা, “মানে কি?”
সিয়াম বলল, “ফোন কোম্পানিতে আজকে একজন গিয়েছিল তোমার কল রেকর্ড বের করতে।” বিরক্তিকর ভঙ্গিতে হাসলো সে।
.
কিছু না বলে ফোন রেখে দিলো লিসা। হঠাৎ করে আগের ভয়টা ফিরে এসেছে। নিজের উপর রাগ হচ্ছে খুব। রুহানের প্রতি মনোযোগ না দেওয়াটা উচিত হয়নি তার। সে যে চুপচাপ বসে থাকবেনা তা জানা কথা।
.
লিসা কিছু না বলে বাসায় ফিরে গেল তাড়াতাড়ি।
রুহান ঘুমিয়ে গেছে।
তার দিকে তাকিয়ে লিসার মুখে হঠাৎ শীতল হাসি ফুটে উঠলো।
“ইউ ওয়ান্ট টু প্লে? লেটস প্লে।”
।
চলবে…
.
#ফারিহা_আহমেদ
.