#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ২৫
#লেখিকাঃদিশা মনি
জোনাকি ও আলো একসাথে বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এই বাড়িতে আর থাকবেনা। এই সিদ্ধান্তের আর কোন নড়চড় হবে না। যেই ভাবা সেই কাজ।
দুজনে যাওয়ার আগে সুমনার কাছে আসে। হাজার হোক তার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। সুমনা জোনাকি আর আলোকে নিজের রুমে দেখে বলে,
‘তোমরা? একি তোমাদের হাতে ব্যাগ কেন? তোমরা কি কোথাও যাচ্ছ?’
জোনাকির চোখ ছলমল করছিল। সুমনা তাদের অনেক ভালোবাসা দিয়েছে। আজকালকার যুগে এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। উপকারীর অপকার করতে চায়না জন্যই তো এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
‘হ্যা আমরা চলে যাচ্ছি। আমরা আবার বাড়িতে ফিরে যাবো। আপনি এতদিন আমাদের এখানে আশ্রয় দিয়েছিলেন এজন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আল্লাহ আপনার সহায় হোক।’
সুমনার চোখে জল চলে আসে জোনাকির কথাটা শুনে।
‘এভাবে হঠাৎ চলে যাচ্ছ কেন? আর কিছুদিন থেকে যেতে পারতে।’
‘না আন্টি আমাদের যেতে হবে। আব্বু আমাদের ফিরে যেতে বলেছেন। আজকেই ফিরে যেতে চাই।’
সুমনা চোখের জল নিয়ে তাকায় আলোর দিকে। মেয়েটাকে দেখলে তার নিজের চাচাতো বোন জ্যোতির কথা মনে পড়তো। আজ মেয়েটা চলে যাবে ভেবে খারাপ লাগছে।
‘ঠিক আছে, যখন একবার ঠিক করে নিয়েছ চলে যাবে তখন আর আমি তোমাদের আটকাবো না।’
সুমনা আলমারী থেকে কিছু টাকা বের করে জোনাকির হাতে দিয়ে বলে,
‘এগুলো নিয়ে যাও কাজে লাগতে পারে।’
‘না আন্টি লাগবে না।’
‘আমি কোন কথা শুনব না। নিতে বলেছি চুপচাপ নিয়ে নাও। এমনি আমার মন মেজাজ ভালো নেই।’
‘ঠিক আছে নিলাম।’
এবার আলো আসে সুমনার সামনে।
‘ভালো থাকবেন আন্টি। নিজের খেয়াল রাখবেন।’
সুমনা আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
‘তুমিও ভালো থেকো আলো। জানো তোমার সাথে একজনের খুব মিল খুজে পাই আমি। যাইহোক আমি ড্রাইভারকে বলছি তোমাদের পৌছে দেবে।’
জোনাকি আপত্তি জানায়।
‘আমরা একাই চলে যেতে পারবো।’
‘একা কিভাবে যাবে? তোমাদের বাড়ি তো অনেকদূর সেই জামালপুরে।’
‘এখান থেকে সিএনজি নিয়ে যাব তারপর ট্রেন।’
‘সিএনজি নেওয়ার দরকার নেই। অন্তত রেলস্টেশন পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে যাও।’
‘ঠিক আছে।’
আলো আর জোনাকি সুমনার সাথে সালাম বিনিময় করে। দুজনে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। সুমনাও আসে তাদের পিছু পিছু।
জরিনা বাইরে দাড়িয়ে ছিল। আলো ও জোনাকিকে আসতে দেখে বলে,
‘তোমরা একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। যাও দূরে চলে যাও এটাই তোমাদের জন্য ভালো হবে।’
আলো,জোনাকি গাড়িতে ওঠে। গাড়ির কাচ দিয়ে শেষবারের মতো সুমনাকে দেখে। সুমনা তাদের ইশারা করে টা টা বলে। গাড়ি স্টার্ট হয়। অবশেষে আলো, জোনাকির এই বাড়িতে থাকার মেয়াদ শেষ হয়।
৪৯.
আলো, জোনাকি চলে যাওয়ার পর জরিনা যায় গেস্টরুম পরিস্কার করতে। বিছানা পরিস্কার করার সময় বালিশের নিচে একটি ছবি দেখতে পায়। ছবিটা ভালোভাবে খেয়াল করার পর জরিনার বুক কেপে ওঠে। ক্ষীণস্বরে বলে,
‘জ্যোতি,,,’
বর্ষ অবশেষে সব অভিমান ভুলে বাড়িতে ফিরে আসে। বাড়িতে এসেই দেখতে পায় বর্ণ সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। বর্ণকে এভাবে আয়েসি ভঙ্গিতে শুয়ে থাকতে দেখে বর্ষর রাগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বর্ণকে টেনে তুলে বলে,
‘আমাকে বিপদে ফেলে এখন এখানে শান্তিতে ঘুমানো হচ্ছে? তোর না বিদেশে থাকার কথা ছিল। এখানে কিভাবে এলি?’
বর্ণ হালকাভাবে ধা’ক্কা দিয়ে বর্ষকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। শার্ট ঝাড়া দিয়ে বলে,
‘আমি বিদেশে গেছি কখন বললাম? আমি তো শুধু এয়ারপোর্টে ছিলাম। এতই টেনশনে ছিলাম যে ফ্লাইটের টিকিটই কা’টার কথা মনে ছিলনা। ফ্লাইট উড়ান দিলে ভাবলাম আজকের রাতটা আর বাড়িতে ফেরার দরকার নেই। তাই একটা হোটেলে থাকলাম। এনগেজমেন্টটা তো ভেস্তে দেওয়া গেছে। তুই এতো রেগে আছিস কেন?’
‘রেগে থাকবোনা? তুই যে কাণ্ড করেছিস। তোর জন্য কাল মম আমায় এলিনার সাথে এনগেজমেন্ট করাতে চেয়েছিল।’
‘কিইইই!’
বর্ষ বর্ণকে গতকাল রাতের সব ঘটনা বলে। সব শুনে বর্ণ খিলখিল করে হাসতে থাকে। বর্ষ এতে ভীষণই রেগে যায়।
‘তোর লজ্জা করছে না এভাবে হাসতে?’
বর্ণ হাসি থামায়। কিছুক্ষণ গম্ভীর ভাব করে থেকে আবার হাসতে থাকে আর বলে,
‘তুই এই কাজটা একদম ঠিক করিস নি। এভাবে এতগুলো লোকের সামনে এলিকে থা’প্পর মে’রে দিলি।’
‘তোর যখন এতোই দরদ তোর এলির উপর তখন ওকে বিয়ে করে নিলেই তোর পারিস। এলিনাকে আমার একদম সহ্য হয়না।’
‘এভাবে বলছিস কেন? তুই জানিসনা আমার মনজুড়ে কার বাস। তুই তো জানিস বল আমার এই জীবনে আগে কখনো প্রেমে পড়িনি। কখনো পড়ব ভাবিও নি। জোনাকি আসার পর না জানি কিভাবে ও আমার মনে প্রেমের ফুল ফুটিয়ে দিল। বাগানের ফুলগুলো আমার খুব পছন্দ। ফুল ফুটতে দেখতে আমার দারুণ লাগে ঠিক সেরকমই দারুণ লেগেছিল জোনাকির জন্য নিজের মনে ফুল ফুটতে দেখতে।’
‘এতকিছু না করে মমকে সবকিছু বলে দিলেই হতো।’
‘আমি কিভাবে আম্মুকে সবকিছু বলতাম? আচ্ছা বাদ দে। আমার বুকটা ক’দিন থেকে খুব ব্যাথা করে। এই ব্যাথা কোন শারীরিক ব্যাথা না, ভালোবাসা না পাওয়ার ব্যাথা। যখন হার্টের সমস্যার জন্য ব্যাথা হতো তখন সেই ব্যাথা অনায়াসে সহ্য করে নিতাম। কিন্তু এখন যে ব্যাথা হচ্ছে সেটা কোনভাবেই সহ্য হচ্ছে না।’
৫০.
সুমনার মন খুব খারাপ ছিল। একে তো কাল এনগেজমেন্টের ওখানে যা হলো তার উপর জোনাকি, আলোর এভাবে চলে যাওয়ায় তার খুব খারাপ লাগছে।
আচমকা জরিনা তার রুমে চলে আসে। জরিনা কাদছিল। সুমনার কাছে এসে বলে,
‘ম্যাম এই দেখুন এটা কি।’
‘এটা,,,এটা তো জ্যোতির ছবি। আর এই ছবি তুমি কোথায় পেলে? চাচা তো জ্যোতি চলে যাওয়ার পর তার সব ছবি, জিনিসপত্র সব পু’ড়িয়ে দিয়েছিল।’
‘ভালো করে দেখুন ম্যাম এই ছবিতে জ্যোতি একটা ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আছে।’
‘এই ছবি তুমি কোথায় পেলে?’
‘গেস্টরুমে।’
সুমনার আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না।
‘তারমানে,,,,আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। আলোর সাথে জ্যোতির মুখের এত মিল দেখেও আমি কেন বুঝলাম না? আগে যদি জানতাম তাহলে এভাবে ওদের যেতে দিতাম না। জ্যোতির সাথে দেখা করার একটা উপায় ছিল ওরা।’
জরিনা কেদে ফেলে। কাদতে কাদতে বলে,
‘সব দো’ষ আমার। শুধুমাত্র আমার জন্য মেয়েদুটো এভাবে চলে গেল।’
‘কি বলছ তুমি? তোমার দো’ষ কিভাবে?’
জরিনা সুমনাকে সবকিছু বলে। সব শুনে সুমনা হতভম্ব হয়ে যায়। তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না।
‘আম যাচ্ছি ওদের ফিরিয়ে আনতে। জ্যোতির সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে।’
সুমনা দ্রুত পায়ে হেটে নিচতলায় চলে আসে। এসেই বর্ণ আর বর্ষর সাথে দেখা। বর্ণকে দেখে রে’গে বলে,
‘কোথায় গিয়েছিলি তুই? তোর জন্য কাল কত কি হয়ে গেল।’
বর্ণ মাথা নিচু করে ফেলে। বর্ষ জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি এভাবে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছ?’
‘আলো-জোনাকিতে আটকাতে। তোরা জানিস ওরা আমার চাচাতো বোন জ্যোতির মেয়ে।’
‘কি বলছ তুমি মম? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘বেশি কিছু বলার টাইম নেই। ওরা কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে গেছে। যেকোনসময় ট্রেন চলে আসতে পারে। ওদেরকে আটকাতে হবে।’
বর্ণ আর বর্ষ সমস্বরে বলে ওঠে,
‘না,,,’
বর্ণ বলে,
‘তোমাকে যেতে হবে না আম্মু। আমরা যাচ্ছি ওদের ফিরিয়ে আনতে।’
বর্ণ আর বর্ষ একসাথে গাড়ি নিয়ে রওনা দেয়।
‘আরো জোরে চালা বর্ষ। আজ যদি জোনাকিকে হারিয়ে ফেলি তাহলে আমি আর বাচবোনা।’
বর্ষ যথাসম্ভব জোরে ড্রাইভ করছিল কিন্তু জ্যামে গাড়ি আটকে যায়। জ্যাম সেরে গেলে আবার গাড়ি চালায়।
কিছু দূর এগিয়ে আসার পর দেখে তাদের গাড়ি যেটাতে করে আলোরা এসেছিল সেটা দাড়িয়ে আসে। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশে অনেক মানুষের ভিড়।
সামনে গিয়ে কয়েকজন মানুষকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলে,
‘আজকাল যে কি দিনকাল পড়ল! দিনেদুপুরে ড্রাইভারকে মে’রে দুটো মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨