#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৩
দুইদিন যাবত জ্বরে কাতর রুহানী। চোখ দুটো তার ভীষণ লাল। মুখটাও ফ্যাকাশে হয়ে আছে। তাও আজ যখন আরহানের থেকে খবর পেল সাফাকে আজ রাতেই সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হবে। তখন সে আর শুয়ে থাকতে পারলো না। একপ্রকার জেদ করে আরহানকে বাধ্য করল, তাকে যেন সাফাকে দেখতে নিয়ে যায়। আরহান গাড়ি ড্রাইভ করছে আর রুহানী তার পাশের সিটে মাথা এলিয়ে বসে আছে। আরহান এক পলক রুহানীর দিকে তাকিয়ে আবার সামনের দিকে লক্ষ্য রেখে বলল,
“এই জ্বরের মধ্যে তোমার জেদ না করলে হচ্ছিল না তাই না?”
রুহানি রুগ্ন নয়নে মাথা কাত করে আরহানের দিকে দৃষ্টি ফেলল। আরহান আবার বলল,
“এত জিদ্দি কেন তুমি? নিজে এক রোগী হয়ে আরেক রোগীকে দেখতে যাচ্ছ। গাড়িতে উঠার পর তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, এখন তোমাকে কোলে তুলে সাফার সাথে দেখা করিয়ে আনতে হবে।”
আরহান যাই বলছে রুহানী নিরুত্তর। সে নিরুত্তাপ, নিরুদ্বেগ হয়ে আছে। আরহান বুঝল ওর খারাপ লাগছে তাই আর কথা বলল না। কিছুক্ষণ পর সাফাদের বাসার নিচে গাড়ি থামে। আরহান রুহানীকে বলে,
“তুমি বসো। আমি ওপাশ দিয়ে তোমাকে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”
রুহানী চুপচাপ বসে রইল। আরহান গাড়ি থেকে নেমে রুহানীর পাশের দরজা খুলে রুহানীকে কোলে তুলতে নিলে রুহানী বাধা দেয়। কারো বাসায় এসেছে, এখন এক অবিবাহিতা মেয়েকে এক অবিবাহিত ছেলের কোলে নিশ্চয়ই শোভাবর্ধন করে না! রুহানীর বিষয়টা বুঝে আরহানও আর ওকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইল না। অতঃপর হাতে ধরে নামায়। হাত ধরে ধীরে ধীরে লিফটের কাছে যায়।
কলিংবেল বাজা মাত্রই কাজের মেয়ে রিতা দরজা খুলে দিল। আরহান রুহানীকে নিয়ে ধীরে ধীরে বাসার ভিতরে প্রবেশ করলে দেখতে পায় মিসেস শাহানা সাফার ঘরের দিকে যাচ্ছে। রুহানী ও আরহানকে দেখে মিসেস শাহানা থেমে যান। তিনি এগিয়ে এসে বলেন,
“তোমরা এখানে?”
আরহান জবাব দেয়,
“সাফার সাথে দেখা করতে এলাম আন্টি। রুহানীও খুব চাইছিল দেখা করতে তাইতো তীব্র জ্বর নিয়ে দেখা করতে এসেছে।”
“ও আচ্ছা আসো তবে। আমরা আর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই বের হবো।”
রুহানী লক্ষ্য করল মিসেস শাহানা রুহানীর দিকে একবারের বেশি তাকাননি। ওই একবার তাকানোর মধ্যেও কেমন যেন একটা তাচ্ছিল্যতা ছিল। বিষয়টা রুহানীর খারাপ লাগল কিন্তু তা প্রকাশ করল না। মিসেস শাহানা আরহান ও রুহানীকে সাফার ঘরে বসিয়ে বলেন,
“তোমরা বসো। আমি একটু আসছি।”
মিসেস শাহানা চলে যেতেই রুহানী সাফার হাত ধরে। রুহানী জানে সাফা এসব হয়তো অনুভব করতে পারছে না। কারণ কোমায় থাকা অবস্থায় মানুষ আমাদের শুনতে পায়, হয়তো তা ব্যবহারিকভাবে সত্য। কিন্তু আমরা কী বলছি, তা বোঝার ক্ষমতা তাদের একদমই থাকে না।
রুহানীর নেত্রযুগল একাধারে সাফার দিকে নিবদ্ধ। আরহান ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,
“চিন্তা করো না, সাফা সিঙ্গাপুর থেকে সুস্থ হয়েই ফিরবে।”
বিনিময়ে রুহানী মলিন হাসে। কিছু সময় পর মিসেস শাহানা হালকা চা-নাস্তা নিয়ে আসেন। তারপর রুহানীর দিকে আদা-লেবুচা তুলে দিয়ে বলেন,
“এটা খাও। আরাম লাগবে।”
রুহানী হালকা হেসে মিসেস শাহানার হাত থেকে চায়ের কাপটা নেয়। আরহান জিজ্ঞেসা করে,
“আন্টি আপনিও কি যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ। মেয়ের থেকে দূরে থেকে চিন্তা করার থেকে কাছে থাকা ভালো।”
“এখানকার ডাক্তার তো দেখিয়েছেন, তাই না? ডাক্তার কী বলল?”
“ডাক্তার বলেছে অবস্থা ভালো না। এখন বাকিটা দেখা যাক কি হয়।”
আরহান বিপরীতে কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। একজন মাকে কী বলে সান্ত্বনা দিতে হয় তা তার জানা নেই। সে চুপ করে রইল। রুহানী নিজের ব্যাগ থেকে বেলি ফুলের মালা বের করে সাফার হাতে পরিয়ে দিল। এই মালাটা তার নিজের তিনটা গাছের ফুল দিয়ে গেঁথেছে। ফুলগুলো সার্ভেন্ট সংগ্রহ করে এনে দিলেও মালাটা সে নিজ হাতেই বানিয়েছে। রুহানী ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
“তুমি খুব জলদি সুস্থ হয়ে ফিরে এসো সাফা। আমরা তোমার অপেক্ষা করব।”
রুহানী কী বলেছে তা আরহান মিসেস শাহানাকে বুঝিয়ে বলে। মিসেস শাহানক পলকহীন দৃষ্টিতে আরহান ও রুহানীকে দেখতে থাকে। একজন আরেকজনের আওয়াজ হয়ে ওঠার মতো ভালোবাসা। তিনি রুহানীর মাথায় হাত রেখে মলিন হেসে বলেন,
“ভালো থেকো।”
বিনিময়ে আরহান ও রুহানী মৃদু হেসে বিদায় নিয়ে চলে আসে।
_________
সময় বড্ড বহমান। সে কখনোই কারো জন্য অপেক্ষা করে না। নদীর স্রোত কখোনো আবহাওয়ার কারণে উলটো দিকে প্রবাহিত হলেও সময় হয় না। তাই সময়কে মহামূল্যবান মানা হয়। দেখতে দেখতে একটি মাস পেরিয়ে গেছেম চৈত্রের দ্বিতীয় সপ্তাহ। প্রকৃতিতে সূর্যের রৌদ্র রূপ। এক সপ্তাহের মধ্যে আরহান ও রুহানীর বিয়ের তারিখ পড়েছে। তাই নিয়ে বেশ তোরজোরও চলছে দুই পরিবারের মধ্যে। আরহানের ফুফি আলো শেখও এতোদিনে রুহানীকে মেনে নিয়েছেন। তার জন্য আরহানের ক্রেডিটটাই মূখ্য। রুহানীর সাথে আলো শেখের দেখা-সাক্ষাত ও বার্তালাপ বাড়িয়ে মিষ্টি সম্পর্ক তৈরি করেছে। রুহানীর ফুফি রিক্তা শেখ ও ফুফাতো ভাইয়ের বউ সপ্তাহ খানেক আগেই চলে এসেছেন। কিন্তু রুহানীর ফুফা নজরুল আহমেদ এবারও আসলেন না। তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আসবেন না।
আরহান আজ তার বন্ধু, কাজিন ও রুহানীকে নিয়ে জাফলং ঘুরতে যাচ্ছে। বিয়ের আগে এই ঘোরাঘুরির প্ল্যানটা আহানের। তার এখনও জাফলংটাই ঘোরা বাকি। খুব সকাল সকাল বেরিয়ে পরেছে তারা। মাইক্রো ভাড়া করে বেশ আনন্দ ফুর্তি করেই যাচ্ছে। রুহানী ও আরহান পেছনের সিটে বসেছে। আরহানের একপাশে রুহানী আরেক পাশে আহান। মাঝের দুই সাড়িতে আরহানের তিন বন্ধু, দুই বান্ধবী, রুহানীর বান্ধবী কাজল ও আরহানের কলিগ সাদমান। সেরিনা এসব থেকে দূরে থাকতে ফ্রন্ট সিটে বসেছে। রুহানী জার্নি করতে করতে ঝাঁকিতে নাজেহাল। আরহান ওকে শক্ত করে ধরে বলে,
“তোমার শরীর খারাপ লাগছে? তাহলে কবিরদের বলি পেছনের সিটে আসতে।”
রুহানী না বোধক বুঝায় তারপর সে আরহানের কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয়।
দুই ঘণ্টা জার্নির পর ওরা জাফলং পৌঁছায়। প্রকৃতির কন্যা হিসাবে পরিচিত সিলেটের জাফলং। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ এক লীলাভূমি। এখানে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের সৌন্দর্য আরও মোহিত করে। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ সাজানো এই জাফলং।
সেরিনা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় তারপর বাকিরা আস্তে আস্তে নামে। কবির এসে সেরিনার পাশে বেশ ভাব নিয়ে দাঁড়ায় কিন্তু তাতে সেরিনার কোনো হেলদোল নেই। সবাই আসার পর ওরা আগে পাহাড়ে উঠতে যায়। রোদের তেজে নীলাম্বরে তাকানো যেন দায় হয়ে পরেছে। কাজল অভীকের পাশে পাশে হাঁটছে। দুইজনের নেত্রে লাজুকতা দৃশ্যমান। সাদমান রাইদাকে ধরে ধরে উঠাচ্ছে। তন্নি ও আহান পাশাপাশি উঠছে তবে তন্নির আহানের প্রতি আগ্রহ নেই। আহানই বরং চাইছে তন্নির সাথে কথা বলতে। চলতে চলতে রুহানীর পায়ে একটা পাহাড়ি গাছের মূলের সাথে লাগে। যার দরুণ সে পরে যেতে ধরলে আরহান ক্ষীপ্র হাতে রুহানীকে টান দিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়। আরহান নিচের দিকে চেয়ে দেখে রুহানী এখান থেকে পিছলে গেলে একেবারে নিচে পরত। যদিও উচ্চতা ততোটাও না। আরহান স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে রুহানীকে সোজা করে দাঁড়া করিয়ে রুষ্ট স্বরে বলে,
“এই সাইডে কেন আসছ? দেখছ আমরা উপরের দিকে উঠছি।”
রুহানী ঢোক গিলে ইশারায় সরি বলে। তারপর আরহান ওকে অপরপাশে নিয়ে শক্ত করে হাত ধরে চলতে থাকে। পাহাড়ের উপরে চড়ে ডাবের পানি খেয়ে ওরা কিছুক্ষণ ছবি তুলে আবার নেমে এসে নৌকা ভাড়া করে কমলাবন যাওয়ার জন্য। নৌকা দিয়ে সেখানে যেতে সুবিধা ও আশেপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এরপর ওরা পান্থুমাই জলপ্রপাত দেখতে যাবে। বেশ আনন্দ আমেজেই সময়টা পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তন্নি বাদে ওদের কারোই মস্তিষ্কে এখন রাফাতের চিন্তা নেই!
চলবে ইনশাআল্লাহ,
রাফাতের খোঁজ আগামী পর্বে পাবেন অপেক্ষমান পাঠক। রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।